স্বাধীনতার রামায়ণ : রাম কে লিয়ে – তন্ময় ধর
“আমি স্বাধীন নই। আমি যা করেছি, তা ধর্মার্থ পরিকল্পিত” – রাম (কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড, ১৮/৩৫)
‘অপরজন’ যখন চক্ষের সামনে স্বাধীনতার রামায়ণের লুটিসখান ঝুলাই দিল, তখন আমি সবে ঘুম থিক্যা উঠছি। কি কইরব, কি কইরব- ভাবতে ভাবতে সাইকিলট লয়া বারোইলাম । সেকালে সাইক্লে সাইক্লে নাক্ষত্রিক সিএনও সাইক্ল, মিলাঙ্কোভিচ সাইক্ল, মেটোনিক সাইক্ল, উইলসন সাইক্ল, কেলভিন-বেনসন সাইক্ল, কার্নো সাইক্ল ঘুরায়ে-মুরায়ে যিখানে যাইতাম, সেখানে হাজির হলাম। বিঠুর- ব্রহ্মাবর্তে গিয়ে সেই দরোজাটা ঠকঠকায়ে দিলাম। বুড়া বাইরে আইসা বিরক্তভাবে উবাচ- ‘আমারে কি চিরজীবি ব্যাস পাইছিস যে যখন-তখন আইসে দরোজা ঠকঠকায়ে দিবি? এই তো কাল কারা আইসা বলল ‘ধোর বাল্মীকি’ নাম দিয়া একটা রিয়ালিটি শো করবে, আমাকে শুধু বইসা বইসা তালি বাজাইতে হবে, আমি ওদের দস্যু রত্নাকরের খড়্গ দেখায়ে ভাগায়ে দিছি। উয়াদের অপমান বইলা কিছু নাই। একটু পরে আইসা বলে, রিয়ালিটি শোয়ের কথা ছাড়েন, আমাদের টেলিসিরিয়াল ‘জানকীর মেজজায়ের ম্যাজম্যাজে মেজাজ’-এর জন্য দুইটা গান লিখ্যা দ্যান। আমার হাতে খুন হয়া যেত, খড়্গটা ঠিক চালাইতে পারি নাই, মাথাট কেমন ঘুরাইং গেল…’
‘দাদু, এসব আজগুবি গল্প থাক। কাজের কথায় আসি। আমি রামায়ণ রিকনস্ট্রাকশন করতে এসেছি’
‘বেশ করেছিস। তা বেশ করেছিস। রামকে ডাক। সীতা, হনুমান, রাবণ, বালী, শম্বুক- এদেরকে প্যানেলে রাখ’ বাল্মীকি দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন ‘সেকালে পিতা চ্যবন যখন আমাকে মাতা সুকন্যার হাতে ফেলে চলে গেলেন, কত দুঃখের জীবন ছিল! দস্যু হলাম, পোষাল না। কবি হতে চাইলাম, স্বর্গ-মর্ত্য হাহাকার করা প্রথম শ্লোক লিখলাম –“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্”। হায়, নিষাদকে প্রতিষ্ঠা থেকে আটকাব কি, নিজের আপূর্যমাণ অপ্রতিষ্ঠ আত্মার ধাক্কায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ওরে, রামায়ণ না লিখে চ্যবনের ঘরে জন্মে চ্যবনপ্রাশ বিক্রি করাই উচিত ছিল…’
‘স্যর, প্যানেলিস্টরা মূল বক্তব্যে ফোকাস করতে বলছেন…’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো’ খেই ধরলেন বাল্মীকি ‘রাম, তুমি শুরু করো। টপিক-‘স্বাধীনতার রামায়ণ’। তুমি বলতে থাকো। আমি ধরতাই দেব…’
‘স্বাধীনতা!! মাই ফুট! কঃ সন্নদ্ধে বিরহবিধুরাং ত্বয্যুপেক্ষেন জায়াং ন স্বাদন্যোহপ্যহমিব জনো যঃ পরাধীনবৃত্তি। রামেরই যেখানে আধিপত্য ছাড়া অন্য গুণ নেই, স্বাধীনতা নেই, সেখানে রামায়ণের স্বাধীনতা!! আমার জন্মই দিয়েছেন কিসব পায়েস-টায়েস খাইয়ে। একটু বড় হতেই মুনিদের আশ্রমে রাক্ষস মারতে ভাড়াটে গুন্ডাদের মত ব্যবহৃত হয়েছি। লেখাপড়া যা শিখেছি, কোন কাজেই লাগে নি। আমার উল্টোদিকে যে ভিলেন সে পর্যন্ত নিজে ‘রাবণ সংহিতা’ নামে এক তন্ত্র গ্রন্থ লিখেছে, বুকে পাথর চাপা পড়া অবস্থায় ‘শিবতান্ডব স্তোস্ত্র’ লিখেছে, রুদ্রবীণায় সুর সৃষ্টি করেছে, ‘বাহুলীন’ বা ভায়োলিন নামের বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছে। যুদ্ধের আগে দুর্গাপূজা করতে পর্যন্ত রাবণকে ডাকতে হয়েছে। লোকেরা হেসে বলেছে- রাম অশিক্ষিত। এসব নিয়ে কী কদর্যভাবে ট্রোলড হয়েছি সারাজীবন, আপনারা বুঝবেন না। আমার মা-বাবাকে টেনে এনে ট্রোলিং করা হয়েছে ‘কৌশল্যাকে বলো, হরলিক্স-কমপ্ল্যান দিতে…’
‘না…ইয়ে…মানে…তোমার চরিত্রে উত্তরণ ঘটানোর জন্যই এসবের অবতারণা…’
‘উত্তরণ !! মাই ****। শুধু অন্যায় আধিপত্যবাদ ছড়ানোর জন্য আমাকে হাতের পুতুল তৈরি করেছেন। এই যে এখন রামের নামে অন্যায়-অবিচার চালানো এত সহজ হচ্ছে কেন? একে একে কারণগুলো বলছি। প্রথমে বালীবধ দিয়ে শুরু করি।
বালী যখন আমার তীরের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ধরাশায়ী হলো, তখন সে অভিযোগ করেছিল ‘হে রঘুকূল তিলক, আমি এখানে তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি ইতিমধ্যেই অন্য একজনের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলাম, আর তখনই তুমি আমাকে আক্রমণ করেছ। আমি জানি না এই কর্মের দ্বারা তুমি কী সাফল্য বা সুনাম অর্জন করলে। হে রাজপুত্র, যদি তুমি আমার সামনে এসে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে, তবে আমি নিশ্চিতরূপে তোমাকে যমরাজের আলয়ে পাঠাতাম। সাপ যেভাবে ঘুমন্ত মানুষকে তার অজান্তে এসে কামড় দিয়ে তার মৃত্যু ঘটায়, ঠিক তেমনিভাবে তুমিও নিজেকে লুকিয়ে রেখে আমার মতো একজন যুদ্ধরত সৈনিককে আঘাত করেছে। আর ফলে তুমি ভয়ানক পাপের ভাগী হয়েছে। সুতারাং আজ যদি আমি মরেও যাই, আমি কিছু মনে করব না। কিন্তু তুমি শুধু আমাকে বলো, আমাকে এভাবে হত্যা করার এহেন কর্মকে তুমি কীভাবে ন্যায্যতা প্রদান করবে?’
উত্তরে আমার মুখে জ্ঞানের কথা বসানো হল- ‘হে বানর রাজ, তুমি জীবনের চারটি লক্ষ্য সম্পর্কে কিছুই জানো না- ‘ধর্মমর্থঞ্চ কামঞ্চ সময়ং চাপি লৌকিকম্/ ন মে তত্র মনস্তাপো ন মন্যুর্হরিপুঙ্গব’- ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ (ধর্ম, অর্থনৈতিক উন্নতি, ইন্দ্রিয় তৃপ্তি এবং মুক্তি)। তাহলে তুমি কেন শিশুসুলভ ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে আমাকে এ ধরনের কথা বলছ? কর্মের জটিলতা সম্পর্কে উপলব্ধি না করেই, একটি চপলমতি বানরকে যেভাবে উপদেশ দাও, তুমি আমাকেও তাই দিতে চাইছো?’ তারপর আস্তে আস্তে পলিটিক্যাল হেজিমনি ‘পাহাড়-পর্বত, বন-উদ্যান সমন্বিত এই গ্রহ বর্তমানে ইক্ষাকু রাজবংশের রাজাদের অধীনে রয়েছে। সুতরাং যেকোনো ব্যক্তি-হোক সে পশু, পাখি অথবা মানুষ-তাদের শাস্তি প্রদান অথবা ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার তাঁদের রয়েছে। রাজা ভরতের নির্দেশ অনুসারে- ধর্মের আইন লঙ্ঘনকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে আমরা তাদের এভাবেই তারণ করে থাকি। তোমার সারা জীবনে তুমি শুধু কাম আর ইন্দ্রিয়তৃপ্তিকেই প্রশ্রয় দিয়েছ। রাজার জন্য উপযুক্ত কোনো পথেই তুমি কখনো অবিচলিত ছিলে না। তুমি সর্বদাই ধর্মের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছ এবং তোমার অধার্মিক কাজের জন্য তুমি সর্বদা সাধুদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছ। তুমি অসৎ এবং সবসময় তোমার সমমনা অসৎ চরিত্রের অন্যান্য বানরদের সঙ্গ করেছ। একজন জন্মান্ধ ব্যক্তি যেমন অন্য আরেকটি অন্ধ ব্যক্তির কাছে নির্দেশনা দেয়ার জন্য বলে, তুমিও তেমনি এসমস্ত অজ্ঞ বানরদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। সুতরাং প্রকৃত ধর্ম কী তা নির্ধারণ করতে তুমি কিভাবে সমর্থ হবে? এর সারমর্ম কী তা তুমি কীভাবে উপলব্ধি করবে’?
তারপর খাপ পঞ্চায়েতের বাপ বসানো হয়েছে আমার মুখে- ‘তুমি তোমার ছোট ভাইয়ের পত্নীর সঙ্গে সহাবস্থান করার কারণে সনাতন ধর্ম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, কারণ সে ছিল তোমার ভগ্নীর মতো। যে ব্যক্তি তার ভগ্নী, মাতা অথবা ভ্রাতার পত্নীর প্রতি কামপূর্ণ আচরণ করে, তাকে হত্যা করার নির্দেশ শাস্ত্রে দেয়া হয়েছে। কারণ এটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। আমি একটি উন্নত ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেছি, তাই আমি তোমার পাপকে ক্ষমা করতে পারি না। যেহেতু তুমি ধর্ম থেকে পথ ভ্রষ্ট হয়েছ, তবে আমি কী করে তোমাকে উপেক্ষা করতে পারি? আমি সুগ্রীবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছি। তাই লক্ষণের জন্য আমার যেরূপ স্নেহ রয়েছে, সুগ্রীবের জন্যও আমার একই অনুভূতি রয়েছে। সে আমাকে সাহায্য করতে রাজী হয়েছে। তাই আমি তাকে কথা দিয়েছি, তার রাজ্য এবং পত্নীকে ফিরে পেতে আমি তাঁকে সাহায্য করব। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে আমি তার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধও হয়েছি। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমার মতো একজন ব্যক্তি কী করে তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে? যে ব্যক্তি ধর্মকে অনুসরণ করে, বিপদের সময় তার বন্ধুকে সাহায্য করা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই তোমাকে শাস্তি দেয়া ধর্মের বিপরীত কিছু নয়। তুমি নিজে একজন রাজা হয়ে যদি ধর্মকে অনুসরণ করতে, তবে আজ আমি যা করেছি, তুমিও তাই করতে। যদি কোনো ব্যক্তি পাপ করে এবং রাজা কর্তৃক তাঁকে দেয়া দন্ডকে সে স্বেচ্ছায় ভোগ করে, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পরিশোধিত হয় এবং কোনো সাধু ব্যক্তির মতো সেও স্বর্গে গমন করে। যখন রাজা কোনো পাপীকে শাস্তি দেয়, তখন সেই পাপ থেকে সে মুক্ত হয়। উপরন্তু রাজা যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, তবে স্বয়ং রাজাকেই সেসমস্ত পাপপূর্ণ কর্মের প্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হয়। পূর্বে কোনো এক শূদ্রও ঠিক একই ধরনের পাপ করেছিল এবং তাকেও আমার পূর্বপুরুষ মান্ধতা কর্তৃক শাস্ত্র অনুযায়ী কঠিন দন্ড ভোগ করতে হয়েছিল’।
এবং শেষে বর্ণবৈষম্য ও খুনের জাস্টিফিকেশনও করানো হল আমাকে দিয়ে –‘এক রাজা বিশাল জাল পেতে, ফাঁদ পেতে কিংবা চোরা গর্ত খনন করে ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে পশু শিকার করতে পারে, এটা বিবেচনা না করেই যে, তারা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাকি কোথাও নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে বিশ্রাম গ্রহণ করছে। ক্ষত্রিয় পুরুষ সচেতন অথবা অসচেতন প্রাণী কিংবা অন্য দিকে মুখ করা যেকোনো প্রাণীকে বধ করতে পারে। এধরনের শিকার তাদের জন্য পাপের কারণ নয়। অতএব, এটা কোনো ব্যাপার নয় যে, আমি তোমার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তোমাকে বধ করেছি কি না! এতে কোনো পাপ নেই, কারণ তুমি একটি বানর প্রকৃতির শরীর ধারণ করে আছো- যান্তি রাজর্ষয়: চ অত্র মৃগয়াম ধর্ম কোবিদা: / তস্মাদ্ ত্বং নিহতো যুদ্ধে ময়া বাণেন বানর/ অযুধ্যন্ প্রতিযুধ্যন্ বা যস্মাদ্ শাখামৃগো হি অসি’। (কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, ১৭-১৮)
আরেকটা ব্যাপার তো বললামই না। বালী তীরবিদ্ধ হয়ে যে অভিযোগগুলো করছিল, তার ছত্রে ছত্রে অরণ্যচারী মানুষের ওপর নগরবাসী মানুষের আধিপত্যের অপচেষ্টার কথা আছে। ওসবের বিশদ ব্যাখ্যা হলে পরিবেশবাদীরা আমায় খেয়ে ফেলবে’।
ঢোঁক গিললেন বাল্মীকি ‘অনারেবল প্যানেলিস্টরা, এক মিনিটের বিরতির অনুমতি যদি দেন, ঘরে গিয়ে প্রেসারের ওষুধটা খেয়ে আসতে পারি…’
বাল্মীকি ফিরতেই রাম আবার শুরু করলেন ‘এবার যুদ্ধকাণ্ড, সর্গ ১১৫। যুদ্ধশেষে বিভীষণ সীতাকে নিয়ে এসেছেন আমার সামনে। চারপাশে বানরে-রাক্ষসে গিজগিজ করছে। সবাই উৎসুক, সীতাকে আমি কি বলব, সেটা শোনার জন্য। তখন আমার দিয়ে বলানো হল-
প্রাপ্তচারিত্রসন্দেহ মম প্রতিমুখে স্থিতা
দীপো নেত্রাতুরস্যেব প্রতিকূলাসি মে দৃঢ়ম্ ।।
তদ্গচ্ছ ত্বানুজানেহদ্য যথেষ্টং জনকাত্মজে
এতা দশ দিশো ভদ্রে কার্যমস্তি ন মে ত্বয়া ।।
কঃ পুমাংস্তু কূলে জাতঃ স্ত্রিয়ং পরগৃহোষিতাম্
তেজস্বী পুনরাদ্দয়াৎ সুহৃল্লেখ্যেন চেতসা ।।
রাবণাঙ্কপরিক্লিষ্টা দৃষ্টাং দুষ্টেন চক্ষুষা ।
কথং ত্বাং পুনরাদ্দয়াং কুলং ব্যপদিশন্ মহৎ ।।
তদর্থং নির্জিতা মে ত্বং যশঃ প্রত্যাহৃত্নং ময়া ।
নাস্থ মে ত্বয্যভিষ্বঙ্গো যথেষ্টং গম্যতামিতঃ ।।
অর্থাৎ, হে সীতা, তোমার চরিত্রে আমার সন্দেহ হয়েছে, নেত্ররোগীর সম্মুখে যেমন দীপশিখা, আমার পক্ষে তুমি তেমনই কষ্টকর। তুমি রাবণের অঙ্কে নিপীড়িত হয়েছো, সে তোমাকে দুষ্টচোখে দেখেছে, এখন যদি তোমাকে আমি পুনর্গ্রহণ করি, তবে কি করে নিজের মহৎ বংশের পরিচয় দেব?…এখন আর তোমার প্রতি আমার আসক্তি নেই, তুমি যেখানে ইচ্ছা যাও। আমি মতি স্থির করে বলছি- লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা রাক্ষস বিভীষণ, যাকে ইচ্ছা কর তার কাছে যাও অথবা তোমার যেদিকে ইচ্ছা হয়, চলে যাও।
কালান্তক যমের মত চেহারা হয়েছিল তখন আমার। কোন বন্ধুবান্ধব আমার দিকে তাকাতে পারছিলেন না (ন হি রামং তদা কসশ্চিৎ কালান্তকযমোপমম্ / অনুনেতুমথো বক্তুং দ্রষ্টুং বাপ্যশকৎ সুহৃৎ)।
অপমানিতা সীতা তখন শান্তকন্ঠে আমাকে যে কথা বলল, তার প্রশান্তি, শুচিতা, সৌন্দর্য্য, মাধুর্য অতুলনীয়, স্বর্গের পবিত্রতাকেও যেন ম্লান করে দেয়। যে শুচিতা এবং সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার কী পবিত্র উত্তর! চিরমঙ্গল দীপশিখার মত তা ভারতবর্ষের হৃদয়মন্দিরে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সীতার উত্তর-
কিং মামসদৃশং বাক্যমীদৃশং শ্রোত্রদারুণম্
রুক্ষং শ্রাবয়সে বীর প্রাকৃতঃ প্রাকৃতাম্ ইব।।
ন তথাস্মি মহাবাহো যথা ত্বমবগচ্ছসি
প্রত্যয়ং গচ্ছ মে স্বেন চারিত্রেণৈব তে শপে।।
পৃথকস্ত্রীণাং প্রচারেণ জাতিং ত্বং পরিশঙ্কসে।
পরিত্যজেমাং শঙ্কাং তু যদি তেহহং পরীক্ষিতা ।।
যদ্যহং গাত্রসংস্পর্শং গতাস্মি বিবশা প্রভো।
কামকারো ন মে তত্র দৈবং তত্রাপরাধ্যতি।।
মদধীনং তু যত্তন্মে হৃদয়ং ত্বয়ি বর্ততে।
পরাধীনেষু গাত্রেষু কিং করিষ্যাম্যনীশ্বরা।।
সহসংবৃদ্ধভাবাচ্চ সংসর্গেণ চ মানদ।
যদ্যহং তে ন বিজ্ঞাতা হতা তেনাস্মি শাশ্বতম্ ।।
অর্থাৎ – নীচ ব্যক্তি নীচ স্ত্রীলোককে যেমন বলে তুমি আমাকে সেরূপ বলছো কেন ?…আমার অধীন যে হৃদয় তা তোমারই ছিল, কিন্তু যখন আমি নিজের কর্ত্রী নই তখন আমার পরায়ত্ত দেহ সম্বন্ধে কি করতে পারি? আমার চরিত্রের শপথ করে বলছি, আমাকে বিশ্বাস করো। শারীরিক শক্তিতে অসমর্থ আমি, তাই রাবণ আমার গাত্রস্পর্শ করেছিল, সে তো আমার ইচ্ছাকৃত নয়, তার জন্য দৈবই দায়ী। সেজন্য আমি কি করতে পারি? আমার অধীনে যে হৃদয় সে তো তোমারই। তাকে তো কেউ স্পর্শ করতে পারে নি। এতকাল আমরা একসাথে আছি, ভালোবেসেছি, তবু তুমি আমাকে বুঝতে পারলে না, এই তো আমার চিরমৃত্যু। …তুমি চরিত্রজ্ঞ, কিন্তু আমার মহৎ চরিত্রের সম্মান করলে না (যুদ্ধকাণ্ড , সর্গ ১১৬)
একটু যদি আপনি বুদ্ধি করে ওই সময় আমায় শান্ত রাখতে পারতেন, আমার মুখে শান্ত সীতার ডায়লগ আমার মত করে বসাতে পারতেন, দেশে এই অবুঝ একদেশদর্শী পিতৃতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত হত না।
এবার আসি শম্বুক বধে। উত্তরকাণ্ডের ৭৩-৭৬ সর্গ। নারদ এসে আমায় বললেন- কোন শূদ্রের তপস্যার পাপে নাকি জনৈক ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। রাজা হিসেবে আমাকে তার প্রতিবিধান করতে হবে। অনেক অনুসন্ধানের পর আমি দেখলাম, শৈবল পর্বতের কাছে সরোবরের তীরে এক তপস্বী অধোমুখে লম্বমান হয়ে কঠোর তপস্যা করছেন- তস্মিন্ সরসি তপ্যন্তং তাপসং সুমহত্তপঃ/ দদর্শ রাঘবঃ শ্রীমাল্লম্বমানমধোমুখম্ । আমি অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- হে সুব্রত, আপনার এই উগ্র তপস্যার অভীষ্ট কি? তখন সেই তপস্বী উত্তর দিলেন –
দেবত্বং প্রার্থয়ে রাম সশরীরো মহাযশঃ।
ন মিথ্যাহং বদে রাম দেবলোক জিগীষয়া।
শূদ্রং মাং বিদ্ধি কাকুৎস্থ শম্বুকং নাম নামতঃ।।
(আমার এই উগ্র তপস্যার উদ্দেশ্য, আমি সশরীরে দেবত্ব লাভ করতে চাই। আমি দেবলোক জয় করে দেবতা হতে চাই। আপনাকে মিথ্যা বলব না। আমি জাতিতে শূদ্র, আমার নাম শম্বুক)
শম্বুকের কথা শেষ না হতেই আমি অস্ত্রাঘাতে তার শিরচ্ছেদ করলাম। ছিটকে এসে রক্ত লাগল আমার মুখে। আর লাগল এক ভয়ঙ্কর পাপের দাগ, যা কোনদিন মোছা যাবে না। আজ আমার নামে দাঙ্গা কেন হয়?’
‘কেলো করেচে! এই উত্তরকাণ্ড আমি লিখি নি। এর দায় আমার নয়’ ঢোঁক গিললেন বাল্মীকি।
‘ঠিক এই যুক্তিটাকে খন্ডন করার আগে কয়েকটা কথা বলি। উত্তরকাণ্ডকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা অতীতেও ছিল, আজও আছে, কয়েক হাজার বছর পরেও থাকবে। আন্তর্জাল মাধ্যমে আই আই টি কানপুর, স্যাক্রেড টেক্সট, ডিজিটাল আর্কাইভ- সবাই ছয় কাণ্ডেই রামায়ণ শেষ করে দিয়েছে। ছাপার অক্ষরে হোক বা আন্তর্জালে উত্তরকাণ্ড জোগাড় করতে আপনার কালঘাম বেরিয়ে যাবে- পাঠ এবং ব্যাখ্যা তো দূর অস্ত। কিন্তু শূদ্রহত্যার কাহিনি, সীতা পরিত্যাগের কাহিনি এগুলোর ছিন্নমূল চর্চা কিন্তু হচ্ছে বা হবে। কেন? আধিপত্যবাদের প্রয়োজনে, দাঙ্গার প্রয়োজনে, বৈষম্যের প্রয়োজনে, ঘৃণার প্রয়োজনে। এনিওয়ে, আমি রামায়ণের মাত্র দু’টো জায়গা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, যাতে বোঝা যাবে এটি আপনার বাল্মীকি রামায়ণেরই অংশ। উত্তরকাণ্ডের ৯৬ সর্গের উনবিংশ শ্লোক- প্রচেতাসোহহং দশমঃ পুত্র রাঘবনন্দন/ বহুবর্ষসহস্রাণি তপশ্চর্যা ময়া কৃতা। পরিষ্কার বলা হল, প্রচেতার দশম পুত্র বাল্মীকি এই কাণ্ড লিখছেন। আর আদিকাণ্ডে তৃতীয় সর্গে ৩৮-৩৯ শ্লোকে বলা হয়েছে- রামাভিষেকাভ্যুদয়ং সর্বসৈন্য বিসর্জনম্ / স্বরাষ্ট্ররঞ্জনঞ্চৈব বৈদেহ্যাশ্চ বিসর্জনম্ / অনাগতঞ্চ যৎকিঞ্চিদ্ রামস্য বসুধাতলে/ তচ্চকারোত্তরে কাব্যে বাল্মীকির্ভগবান্ ঋষিঃ – অর্থাৎ নারদের যে কাব্যবীজ, তার অনুসারী হয়েই বাল্মীকি ‘উত্তরে কাব্যে’ রামের ভবিষ্যৎ অনাগত জীবন নিয়ে উত্তরকাণ্ড রচনা করবেন। বাঙালী কবি বুদ্ধদেব বসু লিখবেন –‘উত্তরকাণ্ড না থাকলে রামায়ণ এত বড় কাব্যই তো হত না। লঙ্কায় অগ্নিপরীক্ষার পর সীতা লক্ষ্মীমেয়ের মতো রামের কোলে বসে পুষ্পকে চড়ে অযোধ্যায় এলেন, আর তারপর ঘরকন্না করে বাকি জীবন সুখে কাটালেন- এই যদি রামায়ণের শেষ হত, তাহলে কি সমগ্র ভারতীয় জীবনে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রামায়ণের প্রভাব এমন ব্যাপক, এমন গভীর হতে পারত? বাল্মীকি যদি উত্তরকাণ্ড না লিখে থাকেন, তবে সেইটুকু বাল্মীকিত্বে তিনি ন্যূন। উত্তরকাণ্ড যে কবির রচনা তিনি বাল্মীকি না হন, বাল্মীকি-প্রতিম নিশ্চয়ই। বস্তুত রামায়ণকে অমর কাব্যে পরিণত করলেন তিনিই। যে সীতার জন্য এত দুঃখ, এত যুদ্ধ, এমন সুদীর্ঘ ও সুতীব্র উদ্যম, সেই সীতাকে পেয়েও হারাতে হল, ছাড়তে হল স্বেচ্ছায়, এই কথাটাই তো রামায়ণের অন্তঃসার”। (‘প্রবন্ধ সংকলন’- বুদ্ধদেব বসু, ১৯৬৬, পৃঃ ১৫৩-৫৪)
কড়া ডিটারজেন্ট দিয়ে কাচা জীর্ণবস্ত্রের মত মুখ করে বাল্মীকি বললেন “ঠিক আছে। মানলুম, উত্তরকাণ্ড আমিই লিখেছি। তাতে তোমার কি সুবিধে?”
“তাতে খুনী, পরাধীন, আধিপত্যলোভী, রক্ষণশীল, ধর্মভীরু হয়ে আমাকে থেমে যেতে হয় না। গোব্রাহ্মণ্যবলয় যেটা কয়েক হাজার বছর ধরে যেখানে আমায় থামিয়ে রাখতে চাইছে। এক গ্লানিহীন হন্তারক, যে ধর্মের নামে শুধু হত্যা করে চলবে। অরণ্যকাণ্ডে নির্বিচারে রাক্ষস মারবে। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে ভ্রাতৃবিবাদ ঘটাবে, সুবিধাবাদী রাজনীতি করবে, পিছন থেকে বালীবধ করবে, সীতাকে চরম অপমান করবে। এবং কোন অনুশোচনা থাকবে না, কোন গ্লানি থাকবে না, পাপ থাকবে না। এক নির্মম নিষ্ঠুর একদেশদর্শী ঘাতক দেবতায় পরিণত হবে। লঙ্কাকাণ্ডে একের পর এক রাক্ষসের রক্তে হাত রঞ্জিত করে হাসবে। শিষ্য হনুমানকে দিয়ে শিশুহত্যা করাবে পৈশাচিক উল্লাসে-
“এতেক বলিয়া মহীরাবণের নারী।
ধনুক লইয়া উঠে মার মার করি।।
সঙ্গেতে সাজিল সেনা অসংখ্য গণন।
হনুর উপরে করে বাণ-বরিষণ।।
বড় বড় বৃক্ষ যত মারে হনুমান।
বাণেতে কাটিয়া রাণী করে খান খান।।
মনেতে ভাবিয়া কিছু না পায় মারুতি।
কোপ করি রাণীর উদরে মারে লাথি।।
দশমাস গর্ভ ছিল রাণীর উদরে।
প্রসবে সন্তান এক মহা ভয়ঙ্করে।।
অষ্টগোটা বাহু তার চারি গোটা মুণ্ড।
বিকট মূরতি তার দেখিতে প্রচণ্ড।।
ভূমিষ্ঠ হইল পুত্র অদ্ভুত বিক্রম।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ যুগান্তের যম।।
মহাযুদ্ধ আরম্ভিল হনুমান সনে।
সাপটিয়া কীল লাথি মারে হনুমানে।।
গর্ভের রুধির পূঁজে ব্যাপিত শরীরে।
আচম্বিতে সংগ্রামেতে সিংহনাদ করে।।
উলঙ্গ উন্মত্ত যেন পাগল সমান।
তাহার বিক্রম দেখে হাসে হনুমান।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ হাসে দেখিয়া রাক্ষস।
হনুমান বলে বেটার বড়ই সাহস।।
এখনি জন্মিয়া পুত্র করে ঘোর রণ।
মহীরাবণের বেটা সে অহীরাবণ।।
আথালি পাথালি হানে মারুতির বুকে।
কিছু নাহি বলে হনু সম্বরিয়া থাকে।।
হনুমান বলে বেটার আম্বা দেখি অতি।
এখনি পাঠাব তোরে যমের বসতি।।
মারিবারে হনুমান ধায় উভরড়ে।
ধরিতে না পারে শিশু পিছলিয়া পড়ে।।
হেনকালে হনুমান চিন্তিল উপায়।
পবন স্মরণে রণে ঝড় বয়ে যায়।।
বিষম বাতাসে ধূলা লাগে তার গায়।
পাছরিয়া ধরে হনু আর কোথা যায়।।
দুই পদে ধরে তারে লয়ে ফেলে দূর।
পাথরে আছাড় মারি হাড় কৈল চূর”।। (কৃত্তিবাসী রামায়ণ, লঙ্কাকাণ্ড, ৮০)
‘এই, এই কৃত্তিবাসী রামায়ণের দায় আমার নয়। অহীরাবণ-মহীরাবণ এইসব চরিত্র কৃত্তিবাস আমদানি করেছেন…’ কঁকিয়ে উঠলেন বাল্মীকি।
‘আপনার আশকারাতেই তো করেছেন। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তিনশো রকম রামায়ণের দায় আপনারই। আপনার ছায়াতেই সব সৃষ্টি হয়েছে। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’- মনে পড়ে?’
‘ওরে, কবির মত পরাধীন আর কেউ নেই রে। আমার… আমার এই বুকটায় বড় ব্যথা রে…’ সুখেন দাসের স্টাইলে এই কথা বলে বাল্মীকি ব্রহ্মাবর্তের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে শুরু করলেন ‘…রামের অর্থ কেউ বুঝল না। আমাদের দেহতন্ত্রের ভিতরে যে আধ্যাত্মিক রাম আছে, আমাদের কসমিক কনশাসনেস বা মহাজাগতিক চেতনার ভিতরে যে রাম আছে, আমাদের কৃষিচেতনার ভিতরে যে রাম আছে, তাকে না বোঝাই তো পরাধীনতা…’
সীতা একবার ডাকলেন তাঁকে ‘মহাকবি, আমাদের স্বাধীনতার কথাটা একবার শুনে যান। আপনার রামায়ণের চাইতে ঢের শক্তিশালী রামায়ণ লিখে এনেছে আমাদের চন্দ্রাবতী। একবার শুনে যান’…
বাল্মীকির একবার ইচ্ছা হল ‘ফিরে যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই স্বাধীনতার কথাও শুনে আসি’ কিন্তু ততক্ষণে দাড়িতে তমসার বাতাস লেগেছে, তমসার বাতাসের তামাশা সামলানো মুশকিল।
Posted in: August 2020 - Cover Story, PROSE