দোতারা : সুবর্ণা কর্মকার

বাড়িঘর, মাঠ, গাছপালাগুলো সব সাঁ সাঁ করে দূরে চলে যাচ্ছে। জানলার বাইরে দৃশ্যগুলো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল। ছয়টা মাস কেটে গেল তাও যেন মনটাকে সামলাতে পারছে না সে।
সেদিন চাচীর উপর খুব অভিমান হয়েছিল তার। একে ক্ষ‍্যাপা-পাগলা মানুষ, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াই, মনের আনন্দে গান গাই, চাষ করি, মাঝেমাঝে পলায়ে যাই যেদিকে দুচোখ যায়; এইসব বন্ধন আমার মনপাখিকে খাঁচায় ভরে ফেলার ব‍্যবস্থা। চাচীও তাই ভেবেছিল, ঘরে বউ আসলে যদি সংসারে মন বসে বাছাটার, ফকিরজীবন আর কতদিন চলবে! প্রায় জোর করেই বিয়েটা দিয়েছিলেন চাচী।অভিমানে নাজিমার দিকে ফিরেও তাকায়নি সে। মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতো বা ঘরে থাকলে, তক্তার এক কোণে চোখ-বুজে শুয়ে থাকতো। দিনকয়েক পরে নাজিমা নিজেই কাছে এসে বললো, “এই নিন”। পুকুর ধারে বসে সে জলে নারকেল গাছটার ছায়া দেখছিলো। ফিরে দেখে তার আব্বার দোতারাটা হাতে নিয়ে মেয়েটা। এই দোতারা যে তার প্রাণভোমরা। ছোটবেলায় দেখতো, আব্বাকে দোতারা বাজিয়ে গান করতে। আব্বা-আম্মি চলে যাওয়ার পরে এই দোতারাটাই ওর শেষ সম্বল। দোতারা বাজালে মনে হয়, সঙ্গেই আছে ওঁরা। দোতারা হাতে মেয়েটার দিকে এই প্রথম তাকালো সে, নাজিমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল সে, অদ্ভূত মায়া মাখানো দুটো চোখ, বিশ্বের সবকিছুকে যেন আপন করে নিতে চায় এই চোখযুগল। সেই যে সে মোহগ্ৰস্ত হলো, সে মোহ যে এখনো কাটলো না।

“তেহট্ট – তেহট্ট – তেহট্ট” বাস কন্ডাক্টরটা চেঁচিয়ে উঠলো। এখানে বাসটা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। লোকজন নামছে-উঠছে, চায়ের দোকানে চা খেয়ে ধোঁয়া টানতে টানতে সীমাহীন আড্ডা চলছে। কারুর কোনো যায় আসে না; না মানুষের না প্রকৃতির। সবাই বড় নিষ্ঠুর। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-ওগো আমার নাজিমা নেই- আর কোনোদিনও তার চোখে ডুবে যেতে পারবো না- তার কথা শুনতে পারবো না- অভিমান করতে পারবো না। তার সব কথাই মৌনতায় মিশে যায়।

একটি বাচ্চাকে নিয়ে এক মহিলা তার পাশে এসে বসে। বাস আবার চলতে শুরু করে। নাজিমাও একদিন এমনভাবে পাশে বসেছিল; সেদিন প্রথমবার বাসে চড়েছিল সে; চোখেমুখে তার আনন্দ আর ভয়ের অসাধারণ মিশ্রণ। কৃষ্ণনগর যেতে হয়েছিল এক লোকগানের উৎসবে যোগ দিতে। গোরভাঙার বাউল উৎসবে গিয়েই কৃষ্ণনগরের জন্য ডাক পেয়েছিল। নাজিমাও ছিল তার সঙ্গী এই গানের পথে। যে বন্ধনকে সে পায়ের শিকল ভেবেছিল একদিন সেই বন্ধনই তার দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। সমুদ্রের মতো অসীম এই অনুভূতি; শেষ হয় না কোনোদিনও। জানলার বাইরে টা আবার ঝাপসা হয়ে আসে, এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে নিজের অজান্তেই। হাতে একটা গরম স্পর্শ অনুভব করে চমকে ওঠে সে। “তুমি কাঁদছো?” বাচ্চাটা বলে ওঠে। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না সে। মা বাচ্চাটাকে বকে সরিয়ে নেয়। এমন একটা শিশুর বড় সাধ ছিল নাজিমার। কিন্তু সেই সাধও পূরণ হল না। বিশাল পৃথিবীতে এইদুটো মানুষই ছিলো একে অপরের সঙ্গী। আল্লা তাকেও কেড়ে নিলো। এখন সে একা, বড় একা। কী লাভ এই জীবনের! লাভ – লোকসানের হিসাব তো সে কোনোদিনও করেনি তবে আজ কেন করছে!

“নাজিরপুর নাজিরপুর” চিৎকারে খেয়াল হয় – বাড়ি যে চলে এলো- বাড়ি! কোনটা তার বাড়ি কোনটাই বা ঘর! ঝোলাটাকে কাঁধে নিয়ে বৃদ্ধ শরীরটাকে টানতে টানতে নামায় বাসথেকে সে। ভাবে কোথায় যাবে। ঘর বলে কি কিছু তার আছে! ক্লান্তদেহে বসে পড়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চে। গরম এক স্পর্শ, সেই বাচ্চাটা; সেও নেমেছে তার মায়ের সাথে এখানে। তার বাড়িও নাজিরপুরে?

“ওটা কী গো তোমার ঝোলায়?” বলে ওঠে বাচ্চাটা। দোতারাটা‌ ধীরে ধীরে বের করে দেখায়; আর বলে “এটাকে বলে দোতারা”। বাচ্চাটা নরম তুলতুলে আঙুল দিয়ে গুনতে থাকে- এক- দুই- তিন- চার। “কিন্তু এটাতে তো চারটা তার আছে, তাহলে দোতারা কেন বলে?” হেসে ফেলে সে; আজ অনেকদিন পর এমন হাসি পেলো; বুঝিয়ে বলে সে “তার চারটা ঠিকই কিন্তু এদের যুগল বলে, তার দুটো কিন্তু আত্মা এক- প্রাণ এক- মন এক। কোনোকিছুই তাদের আলাদা করতে পারে না, তাই যুগল। দুটো যুগল তাই দোতারা।” বাচ্চাটা বলে “দেখতে আলাদা আলাদা কিন্তু আসলে একটা। কোনোকিছুই আলাদা করতে পারে না?” সে উত্তর দেয়- “ওরা যে যুগল, কোনোকিছুই আলাদা করতে পারে না ওদের।” এতদিনে সে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই পেলো- মনে মনে আবার বললো- ওরা আলাদা থাকতে পারে কিন্তু ওরা এক আত্মা- এক প্রাণ। দোতারাটা বাজিয়ে ওঠে সে- আজ মন খুলে গায়-
“মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষেরই সনে”

Facebook Comments

Posted in: August 2020, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply