কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ
“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।
২
কোয়ার্টার থেকে যে পথ বাইরের পথে, তারকাটার বাউন্ডারি অতিক্রম করে, কোয়ার্টারের সীমানার বাইরে চলে গেছে, সেই পথের ওপরে কয়েকদিন আগে লাল সুরকি ফেলে দিয়ে গেছেন সৈনিক বিভাগের লোকজন। তারা কোয়ার্টারগুলির বাগান, বাড়িঘর মেরামতি ও জলের কলের লাইন তারকাটার বাউন্ডারি এই সব কিছু দেখভালের কাজ করে থাকেন। বাবা বলতেন, এরা মেইনটেনান্স বিভাগের কর্মী। এদের দক্ষতা এতটাই যে কোনো ছোটো নদীর ওপরে, মাত্র কয়েক ঘণ্টায় জলের ড্রাম ভাসিয়ে তার ওপরে কাঠের পাটাতন ফেলে একটি সেতু নির্মাণ করে দিতে পারে।
সেই সেতুর ওপর দিয়ে ভারি ভারি মালবাহী ট্রাক অনায়াসে চলে যায়। এরা যুদ্ধক্ষেত্রে রাস্তা বা যোগাযোগের কাজ করে থাকে। এদের শরীর পাথরের মতো, বিশেষ করে এরা পাহাড়ি হয়। এরা যখন কাজ করতে আসতেন মা এদের চা বিস্কুট দিতেন। খুব খুশি হয়ে কোয়ার্টারের মেরামতির বাড়তি কাজ করে দিতেন। অদ্ভুত সুন্দর পাথরের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে যাওয়া শব্দের মতো ভাষা বলত। হিন্দি কথ্য ভাষার সাথে নিজেদের দেহাতের ভাষা মিশিয়ে দিয়ে কানে শ্রাবণের ধ্বনি আনত।
নতুন করে ফেলে দেওয়া সুরকির বিছানার ওপরে হেঁটে মা আর আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা তখন অফিস থেকে ফিরে এলেন। মাকে বললেন — তোমরা কি ক্ষেত্রপালের মন্দিরে যাচ্ছ ?
মা বললেন — হ্যাঁ। পণ্ডিতানিজি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। দেরি হয়ে গেছে অনেক।
আচ্ছা এস। ফিরে এস সব বলব, কাল সৈনিকরা আসবে, ওরা সব মালপত্তর গুছিয়ে দেবে। বেঁধে প্যাকেট করে দেবে।
তা হলে তো কাল সারাদিন এই নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। মন্দির থেকে ফিরে এস। রাতের দিকে সব কথা শুনে নেওয়া যাবে।
আমরা ক্ষেত্রপালের মন্দিরের দিকে হাঁটতে থাকলাম। মন্দিরটি আমাদের কোয়ার্টারের কিছুটা পিছনের দিকে। এখান থেকেই কাশবনের সীমানা শুরু হয়েছে। সীমানা শুরু হওয়ার আগে সারি সারি মাটির মূর্তি ও পুতুল বসানো আছে। কয়েকটি পাথরের মূর্তিও আছে। যেমন ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি, শীতলামাতার মূর্তি গাধাগুলি বৃষ্টির জলে গলে গেছে বাকিটা বিমূর্ত অন্য কোনো পশুর মতো। মাটির ঘোড়া, কালো অন্ধকারের মতো কালী মূর্তি। আর নানান আকারের সাপের ফণা। বিভিন্ন রঙ বৈচিত্রের। একটি মূর্তি অন্যরকম, বাউল ভগভগি শূন্যে তুলে মহাকাল ধরে গান গাইছে যেন। একটি ভাঙ্গা পাথরের ম্যাডোনা।
মন্দিরটি একটি ঢিবির ওপরে। বেশ উঁচুতে। বেস এরিয়ার সৈনিকরা পরের পর পাথর ফেলে ওঠা নামার জন্য সিঁড়ি গড়ে দিয়েছে। সিঁড়ি থেকে নামলেই পুকুর, পুকুরের জলজ উদ্ভিদ ও ফুলের সঙ্গে সহবাস করে শত শত সাপ। পুকুরের জল তাই মানুষের ছোঁয়া পায় খুব সাবধানে। প্রতিদিন বিধু নামে এক আধপাগল সকালে সিভিলিয়ান এরিয়া থেকে এসে, পুকুর থেকে জল তুলে পাথরের চাতাল ও সিঁড়ি ধুইয়ে দেয়।
একাখানকার মিলিটারি পুলিশ যারা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার সুরক্ষার দায়িত্বে তারা বিধু পাগলকে বহুদিন ধরে দেখে আসছে। বহুবছর ধরে বিধু পাগল একইরকম আছে। তার না কি বয়স বাড়ে না। বিধু পাগল আসে যায়, যাওয়ার সময় বলে যায় — ক্ষেত্রপাল বাবার পাথরের চাতাল ধুয়ে দিতে ভালো লাগে।
পণ্ডিতানিজি একটি তামার থালায় ফল ফুল বাতাসা ধূপকাঠি মোম নিয়ে ক্ষেত্রপাল মন্দিরের চাতালে বসে ছিলেন। মা চাতালে উঠে পাথরের ওপরে মাথা ছোঁয়ালেন। আর কেমন যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি সেই দীর্ঘশ্বাসের অর্থ বুঝতে পারলাম। হ্যাঁ, এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে আর আসা হবে কি না তাই ভেবে। গাছের গোড়ায় পাথরের পর পাথর রেখে ইটের গাঁথনি তুলে দিয়ে, মন্দিরের আকারে ক্ষেত্রবাবার কুটির। বটগাছের ফুঁড়ে ওঠা শিকড়ে লাল সুতোর হাজার হাজার মানত, মনোবাসনা ও কামনার গিটঠু বাঁধা আছে। পণ্ডিতানিজি মন্দিরের চাতালে বসে পুজোর সব গুছিয়ে নিলেন। নিজেই তারপরে পুজো শুরু করলেন। এই মন্দিরে কোনো স্থায়ী পূজারি নেই। যারা বা যিনি আসেন তিনিই নিজের পদ্ধতি অনুসারে পুজো করেন।
গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়া পিতলের ঘণ্টা বাতাসে দুলে যাচ্ছিল, মিহি শব্দে কেমন এক শূন্যতার শরীর সৃষ্টি করছিল। আমি বেশ কিছুটা দূরে, একটি পাথরের ওপরে বসে ভাবছিলাম, এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে আমার কাছে আর কিছুই এমন থাকবে না। সব কিছুই হয় তো বদলে যাবে। কাশবন ভাঙ্গা রেলের ওয়াগন এই মন্দিরের চাতাল আর মাধবীলতার মাচার নিচে আমারই হাতে গড়ে তোলা শহর। একটি শহর রচনা করেছি, সেই শহরের মধ্যে নেই কোনো ব্রীজ আর কাঠের সেতু। সেতুহীন শহর বা ব্রীজ নেই যে শহরে, সেই শহর খুব নিঃসঙ্গ হয়। বড়ো একা হয়।
হতে পারে আমার করুণ নিয়তি আমাকে একটি জনবহুল শহরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে এত ফাঁকা ফাঁকা, নির্জনতা আর জনহীন বিলাসিতার মাঝে আমি যেন দিন প্রতিদিন একটি বুনো খরগোশের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম।
বিকেল গড়িয়ে আসার আগে যেমন বেস এরিয়া জুড়ে কাঠকুটো শুকনো গাছের ডাল, ঘাস পোড়ানোর গন্ধ উঠে আসে, এমনটাই বিকেল সাফাইয়ের রীতি এখানে। সারাদিনের জঞ্জাল কাছারিখানার অপাংক্তেয় কাগজ আর বিভাগীয় স্টোর্সের বাতিল সামগ্রী পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর সেই সঙ্গে মিলিটারি পুলিশের মোটরসাইকেলের ভুট ভুট শব্দ, আর ডাহুকের চেল্লানি। মায়ের যেন ক্ষেত্রপাল বাবার চাতাল থেকে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না। মা এখানে এসে একপ্রকার নিজের হারিয়ে যাওয়া বা অপ্রাপ্তির বিষয়গুলির সাথে সখ্য অর্জন করতেন।
ফেরার সময় গ্যারিসন রোডের ধারে জটলা দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। এক সৈনিক পরিবারের একটি ছেলে পাথর ছুঁড়তে যাবে, একজন সৈনিক তাকে ডেটে বকা দিল, অনেকেই অনেক কিছু বলছিল, গোখরো শঙ্খচূড় কেউটে অনেক কিছু। আমি জানি না, মা বললেন শঙ্খলাগা, দুইটি সাপ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যেন চুলের বিনুনি বেঁধেছে। আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে অপূর্ব নিসর্গ দেখতে থাকলাম।
তুলো বাতাসে ওড়ার মতো সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ল। এই মুহূর্তের দৃশ্য দেখা না কি, গৃহস্তের মঙ্গল। সচরাচর দেখা যায় না। হঠাৎ দেখলাম ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রাজি এলেন। তিনি সাহস করে এগিয়ে গিয়ে একটি ধবধবে সাদা তোয়ালে পেতে দিলেন। যদি শঙ্খলাগার স্পর্শ লাগে। কিন্তু সাপ দুইটি স্থির ভঙ্গিতে একই ভাবে অবিচল। মায়ের পাশেই এসে দাঁড়ালেন, মায়ের চুল থেকে অপূর্ব সুগন্ধি তেলের গন্ধ কাশের বনকে আপ্লুত করছিল।
মা তাকে মিটিমিটি হেসে বললেন — তোয়ালে দিলেন যে বড়।
পণ্ডিতজি বললেন, মঙ্গল হয়। ম্যাডাম তাই দিলেন, বলল, পেতে দিতে।
এসব কি করে বিশ্বাস করলেন আপনার ম্যাডাম। শঙ্খলাগা মঙ্গল, এ আমাদের দেশীয় আচার বিশ্বাস করে। আপনি ও আপনার ম্যাডাম যতদূর জানি, উত্তরপ্রদেশের।
হ্যাঁ। আমরা দুইজনেই উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ। এই দৃশ্যের সৌন্দর্য মানুষের ভালো না করে পারে না। আপনাদের এই দেশীয় বিশ্বাসের মধ্যে সত্যিই কোনো মিথ্যে নেই। বড়ই সুন্দর ও সত্য।
আমি ও পণ্ডিতানিজি সামান্য একটু এগিয়ে গিয়ে কাশবনের হলুদের স্পর্শ নিতে চাইছিলাম। বিকেলের পিচের রাস্তা বড়ই অমায়িক হয়।
মা বললেন আজকে এ্যাকোরডিয়ান বাজালেন না ?
বাজাচ্ছিলাম তো। আপনাকে বারান্দায় দেখলাম না তো ? সংবাদ শুনে ছুটে এলাম এখানে। আপনি বারান্দায় এসে না দাঁড়ালে এ্যাকোরডিয়ান বাজাতে ভালো লাগে না। কেমন যেন মনে হয় মরা পৃথিবীতে একা একা বাজিয়ে চলেছি।
আজ দেখলাম, মাধবীলতার ঝাঁক আরও দিব্য হয়েছে।
আগামীকাল সন্ধ্যায় যাব।
আমরা তো চলে যাব। তখন আপনার এ্যাকোরডিয়ান?
ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রাজি কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। বিকেল কেমন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গড়িয়ে আসছিল। সন্ধে এসে আমাদের শরীরকে ছুঁয়ে ফেলল। পাশেই হাঁসপুকুরের জলাশয়, কাশবনের মধ্যে একজোড়া সাপের স্থির ভাস্কর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি।
একজন সৈনিক বললেন — আজকে সারারাত এমন একই ভাবে থাকবে।
আজ এই প্রবীণ সময়ে এসে মনে হয়, আমাদের স্মৃতি থেকে উঠে আসা নানান আচরণ, নানান ভঙ্গি, মনের ও চিন্তনের বিভিন্ন স্তর ছায়া আঁধারের অতীতের এক ভাস্কর্যের সংগ্রহশালা।
[ক্রমশ…]
Posted in: August 2020 - Serial, PROSE