সুদেষ্ণা ঘোষ-র কবিতা
ছোটবেলা
সব সময় মনে হত একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে গাছে গাছে ছয়লাপ বারান্দায়
আর চোখ তুলে তাকালেই কোথাও কিছু না।
শুধু রঙ্গন গাছের পাতা তিরতির করে কাঁপত।
আর লোহার রেলিংয়ে অনেকদিন ধরে একটা ছোট্ট সাদা মাকড়সা জাল বুনছিল।
অ্যালবাম উলটে দেখতাম একটা পুরনো দিনের সাদা-কালো ছবিতে কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না।
আর খেলার মাঠের তিরের মতো ছিটকে ওঠা উল্লাসকেই আমরা শর্ত মেনে নিচ্ছিলাম।
টিঁকে থাকার ব্যয়বহুল শর্ত।
একদিন ব্যাগের ভিতর চোরা সুরঙ্গে মোবাইল নম্বর লেখা কাগজ হারিয়ে গেছিল।
তাই প্রায়শই কলেজ স্ট্রিটের তিন ভাগে ভেঙে যাওয়া গলির মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
দিনের চড়া আলোয় পুরনো অসুখের মতো ল্যাম্পপোস্ট জ্বলত।
তুমি বলেছিলে ভালবাসলে উপায়ের অভাব হয় না।
কিন্তু উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে নীচে তাকালেই কেন চোখ জলে ভরে যেত?
কেন মনে হত মুহূর্তরা এবার ঠিক জমে যাবে দেখো এবার গানের ভিতর…
একটা ফেটে যাওয়া আয়নার ভিতর জমা হচ্ছিল সমান্তরাল সব দুপুরের ক্ষোভ।
দ্যাখো পুরনো জামাকাপড়ের ভিতর কত কী জমা করা আছে
কত কান্না, কত চাপা গলার অভিশাপ, কত নিপুণ হত্যাকাণ্ড লুকিয়ে ফেলা সেকথা তো তুমি জানতে,
তাও প্রতি রাতে মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে
প্রতি রাতে আমার ঘুমের ভিতর হ্যাঁচকা টানে কাঠের পাটাতন সরিয়ে নিতে
সব্বাই চলে যাওয়া অবধি আমায় অপেক্ষা করতে হবে এ তো স্কুল ছুটির সময় থেকেই জানি।
শুধু বইয়ের পাতার ভিতর একটা বড় কালো সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠছিল।
তার বরফের কুঁচি, তার নোনা হাওয়ার প্রাণপণ ঝাপটের কথা ভেবেই আমি রোজ বাড়ি ফিরতাম।
না হলে তো সবটাই অন্যরকম হত।
সবটাই হয়তো সাদা বা আর্তনাদহীন।
ভয়দের ইচ্ছে
আমি স্বপ্নে বহুবার এক কবরখানা দেখেছি
আর দেখেছি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সব আলো নিভে গেল।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারপরও যখন বাস এল না
বৃষ্টির আঁশটে গন্ধ এল হুড়মুড়িয়ে।
আমি দৌড়ে খুব খুব সরু একটা গলির ভিতর ঢুকে পড়লাম
যার দুদিকে বিশাল বিশাল চড়া রংদার ছবি আঁকা
কিন্তু গলিটা এত ছোট ছবিগুলো দেখব বলে যতই পিছোচ্ছি
আর দেওয়াল সরে যাচ্ছে
আর কে বলছে ওকে একদম বয়কট করো।
বলছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে
বলছে আর বলছে ‘এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়?’
আমি যতই বলতে চাই, একটা কথাও আমি ভুলিনি। সব মনে আছে।
কিন্তু বলে ফেলি কবর, বলে ফেলি কুয়াশা,
কখনও খুব চেষ্টা করে বলতে চাই
এভাবে মেরো না।
আর পায়রারা কেমন শব্দ করে বুকের ভিতর থেকে,
আর হাওয়াদের বেপরোয়া মর্জির কথা তোমায় আর নতুন করে কী বলব?
আর অমনি দেওয়াল একগুঁয়ে বাচ্চা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর সরে না।
একটুও না।
এদিকে স্যালাইনের ড্রিপ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে বিছানাটা একতিলও শুকনো থাকে না।
খুব খুব ঠান্ডা সাদা বিছানায় ভিতর আর কতদিন থাকব আমি?
কতদিন ধরে আমি হেডলাইটজ্বলা গাড়ির পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাব?
সকালবেলা খুব ঘষে ঘষে দেওয়াল পরিষ্কার করার পরও একটা দুটো শব্দ যেমন নিষ্ঠুর, কান্না তোমায় দেখেই খসে পড়ে।
ইচ্ছে করলেই পরিষ্কার শোনা যায় ওদের চাপা হাসির শব্দ!
ইচ্ছে করে তোমার? এখনও?
Posted in: August 2020, POETRY