রামরাজ্যে রামায়ণ : শ্রীপর্ণা দত্ত

বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ করতে আমাদের সব সময় অতীতের কাছে হাত পাততে হয়েছে। তাই রামরাজ্যের একটা মোটামুটি ধারণা করতেও আমাকে অতীতের কাছেই হাত পাততে হল। সতীনাথ ভাদুড়ীর “ঢোঁড়াই চরিত মানস” উপন্যাসটি স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে রামরাজ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সময়ের সাথে সাথে রামায়ণও বদলায়। আর “ঢোঁড়াই চরিত মানস”‌ সেই পরিবর্তনেরই দলিল। এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে বিহার অঞ্চলের তাৎমাটুলি, ধাঙরটুলি ও বিসকান্ধার মানুষদের কেন্দ্র করে। যাদের জীবনের মূল ভিত্তিই হল রামায়ণ, তুলসীদাসী রামায়ণ “রামচরিতমানস”।আর এই “রামচরিতমানস” এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ঢোঁড়াই এর জীবন কাহিনীই “ঢোঁড়াই চরিত মানস”।
সতীনাথ ভাদুড়ী-র উপন্যাস বিহারের বিশেষ অঞ্চলের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনধারার এক প্রতিচ্ছবি যা তার লিখনি শৈলীর নৈপুণ্যে সমগ্র ভারতবর্ষের অবহেলিত গ্রামজীবনকে তুলে ধরে। এই অঞ্চলের মানুষেরা ধর্মের দিক থেকে রামচন্দ্রকে এবং কর্মের দিক থেকে গান্ধীজীকে নিজের হৃদয়ের আসনে স্থাপন করেছে। জীবন এক প্রবহমান স্রোত যার মধ্যে ঢোঁড়াই হয়ে ওঠে ‘পাক্কীর’ (সড়কের) প্রতিরূপ।এর দুদিক বন্যার জলে ভেসে গেলেও পাক্কী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে জীবনের প্রতীক হয়ে। পালিত পিতা বাওয়া যখন ঢোঁড়াই কে তার পেটের তিনটি দাগের জন্য রাম বলে চিহ্নিত করে তখনই বোঝা যায় এ এক নব রামায়ণের গল্প। যদিও উপন্যাসটির শুরু থেকেই লেখকের বক্তব্য পরিষ্কার: “অযোধ্যাজী নয়, এখনকার জিরানিয়া। রামচরিতমানসে এর নাম লেখা আছে ‘জীর্ণারন্য’। পড়তে না পারো তো মিসিরজীকে দিয়ে পড়িয়ে নিও।” এখানে বদল শুধু নামে না গল্পেও।আসল কথাটা হলো বর্তমান ভারতের রাম কোন রাজার সন্তান নয় বরং ঢোঁড়াইয়ের মত এক সাধারণ মানুষ। আর তাই উপন্যাসে ‘অশ্বমেধ’-এর জায়গায় ‘কুক্কুরমেধ’ যজ্ঞ হয়।
ঢোঁড়াই এর জীবনে রামিয়া ও সাগিয়ার প্রবেশ ঢোঁড়াইয়ের জীবনকে পরিণত করে। তাৎমাটুলিতে ঢোঁড়াই এর বিয়ে হয় রামিয়া হরফে রামপিয়ারীর সঙ্গে। নামটা লক্ষ্য করুন। রামিয়া আবার আর পাঁচজন ‘ঝোটাহার'(তাৎমারা মেয়েদের এই নামেই ডাকে) মত নয়। তার লাজ লজ্জা কম, গায়ে প্রচুর শক্তি, ব্যাটা ছেলেদের মত কাজ করতে পারে, কথার ঝটপট উত্তর দেয় আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সে প্রতিদিন মাথায় তেল দিয়ে স্নান করে। তার এমনই সাহস যে যেদিন ঢোঁড়াই ওর গায়ে প্রথম হাত তুলল সেইদিনই ও ঢোঁড়াইয়ের ঘর ছাড়ে। শুধু তাই না দৃঢ় কণ্ঠে বলে পাঠায় যে সে ঢোঁড়াইয়ের ঘর আর করবে না। তবে শেষে রামিয়া নয়, ঢোঁড়াই তাৎমাটুলি ছাড়ে। বিসকান্ধায় ঢোঁড়াই এর ঠাঁই হয় সাগিয়ার বাড়ি। সেবার ভূমিকম্পে ধরতিমাই যখন সাগিয়াকে পাতালের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ঢোঁড়াইই তাকে তুলেছিল। তবে সেও সীতাজীর মত অত ভালো মেয়েমানুষ নয়। কোন রাবণ তাকে ধরে নিয়ে যায়নি বরং সে নিজেই বিদেশিয়ার দলের সঙ্গে দেশ ছাড়ে। “কে কে যেন যেতে দেখেছে সাগিয়াকে বিদেশিয়ার দলের গরুর গাড়িতে। বাজে কথা নয়, তারা স্বচক্ষে দেখেছে, মাথায় কাপড় পর্যন্ত তুলে দেয়নি বেহায়া মেয়েটা”। যদিও সাগিয়া আর রামিয়া এক নদীর দুই কুল তবুও ঢোঁড়াই তাদের দুজনকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
বিসকান্ধায়ই ঢোঁড়াই তার জীবনের নতুন লক্ষ্য খুঁজে পায়। এখান থেকেই শুরু হয় রামরাজ্য আনয়নার্থে মহাযজ্ঞ। “ধন্য হো মহাত্মাজী, ধন্য হোক কংগ্রিসের বলন্টিয়র, যাদের দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে কাঠবিড়ালির কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” ভূমিকম্পের পর ঢোঁড়াই নিজে কানে মহাত্মা‌জীকে বলতে শুনেছে: “…. পৃথিবীতে পাপের বোঝা বেড়েছে। তাই জন্যই দেশে এই ভূমিকম্প হয়েছে।” ঢোঁড়াইয়েরও কথাটা ঠিক বলেই মনে হয়। রাজপুতদের পাপ, তাৎমাটুলির মোড়লের পাপ। কিন্তু গান্ধীজী বলেন : “… আমরা হরিজনদের ওপর অন্যায় করি। তাদের মানুষ বলে ভাবি না। ধরতিমাই সে পাপের বোঝা সইতে পারেনি…।” কিন্তু এই কথাটা ঢোঁড়াইয়ের বুঝতে অসুবিধা হয়। “রাজপুত্রের পাপের কথা তাহলে কি ভুল? তাৎমাটুলির মোড়লদের পাপের কি তাহলে কোন ওজন নেই?”। কিন্তু এসব প্রশ্ন চাপা দিয়ে গান্ধীজী বলেন: “…’এই বিপদে কত লোক জেরবার হয়ে গিয়েছে। রামজীর উপর বিশ্বাস রাখবে। সমাজে যে সবচাইতে নিচে আছে, তার সঙ্গেও ভাইয়ের মতো ব্যবহার করবে। তবে না পৃথিবীতে রামরাজ্য ফিরে আসবে। রামরাজ্যে-
নহিঁ দরিদ্র কোউ দুখী ন দীনা
নহিঁ কোউ অবুধ ন লচ্ছনহীনা।
রাম রাজ্যে দরিদ্র, দীনদুঃখী, নির্বোধ বা অলুক্ষণে কেউ থাকবে না।’… ” এইজন্যই সেই সময় ঢোঁড়াইরা চেষ্টা করেছিল রামরাজ্য আনার। যা একটা স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়। লাডলীবাবুরা মাঝখানে এসে কিভাবে যে পুরো খেলাটা ঘুরিয়ে দেয় তা ঢোঁড়াইরা বুঝেই উঠতে পারেনা। মহাত্মাজীর সঙ্গে ‘রংরেজের’ (ইংরেজের) যুদ্ধে ঢোঁড়াইরা লড়বে মহাত্মাজীর হয়ে। যেমন রাম রাবণের যুদ্ধ রামজীর অনুচরেরা লড়েছিল রাবণের নাতি-পুতির সঙ্গে ঠিক সেরকম। যুদ্ধে ঢোঁড়াইরা লড়বে, আর শুধুই লড়বে। আর ‘আচ্ছে দিন’ আসবে লাডলীবাবুদের। বলেন্টিয়ররা বলে অংরেজ ‘জুলুমকার’। কিন্তু আবার ঢোঁড়াইয়ের মনে প্রশ্ন জাগে কে বেশি জুলুমকার, রংরেজ না বাবুসাহেব? কার থেকে আগে স্বাধীনতা চাই। আজকের ঢোঁড়াইরাও ঠিক একই ভাবে বুঝতে পারছে না (সঠিকভাবে বললে বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না) তাদের আসলে কি চাই, হিংস্র সাম্প্রদায়িকতা না সুন্দর, সুস্থ ভবিষ্যৎ। ঢোঁড়াইয়ের আক্ষেপ হয় লেখাপড়া জানলে সে মহাত্মাজীকে চিঠি লিখতে পারতো। তবে লেখাপড়া জানলে ঢোঁড়াই হয়তো এই প্রশ্নটাও করতো: দেশ কার?
অবশেষে ঢোঁড়াই হয় ক্রান্তিদলের রামায়ণজী। যেখানে ক্রান্তিকারীর সংজ্ঞা ঠিক এরকম: “যে যত নিষ্ঠুর সে ততো ক্রান্তিকারী, যে যত বেপরোয়া সে ততো ক্রান্তিকারী, যে যত মুখখিস্তি করতে পারে সে ততো ক্রান্তিকারী, খাওয়ার সময় যে যত উদ্দণ্ডতা দেখাতে পারে সে ততো ক্রান্তিকারী…”। এ যেন ঠিক বর্তমানের রাম রাজ্যের ঠিকাদারেরা। যারা “জয় হিন্দ” আর “ভারত মাতা কি জয়”-এই শব্দগুচ্ছ গুলির মধ্যে দেশপ্রেম খুঁজে পায়। যে যত মুসলিম বিদ্বেষী সে ততো দেশপ্রেমী। আর ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ এই ডিসকোর্সের চাপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রামায়ণ। এক দেশ, এক আইন এবং এক নেতা এই মতবাদের সাথে যুক্ত হয় ‘এক রামায়ণ’ শব্দ দুটিও। ভারতের মতো দেশে যেখানে ৩০০টিরও বেশি ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রামায়ণ রচনা হয়েছে সেখানে প্রাধান্য পায় একটি রামায়ণ। যখন ভারতের মাটিতে সব রামায়ণ তাদের বিভিন্নতা গুলি নিয়ে সমমর্যাদায় পাশাপাশি বিরাজ করবে তখনই রামায়ণ হবে “স্বাধীনতার রামায়ণ”।
“ঢোঁড়াই চরিত মানস” নব রামায়ণ। এখানে অধ্যায়ের পর অধ্যায় আসে নিয়ম মেনেই শুধু সময়ের গুনে গল্পটা বদলে যায়। “বদলায় অথচ বদলায় না। পুরানো রামায়ণ আর নতুন রামায়ণে জট পাকিয়ে যায়”। কিন্তু অস্বীকার করা যায় না কোনোটাকেই।

Facebook Comments

1 thought on “রামরাজ্যে রামায়ণ : শ্রীপর্ণা দত্ত Leave a comment

  1. লেখিকা কে ধন্যবাদ ঢোঁড়াই মানসের নির্যাস বর্তমান প্রেক্ষিতে তুলনা করার স্পর্ধা দেখাতে … বিপ্রতীপ ভাবনা চেতনাকে উন্নত করছে …

Leave a Reply