মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
৩
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত :
এই পৃথিবীর মাটিতে বসে আমরা টের পাই এর বিশালকে। প্রত্যক্ষ করি এর পাহাড় নদী তৃণভূমি শস্যখেত। এর বিশাল ব্যাপ্ত কত মহাদেশ আর মহাসাগর। কত অন্তহীন মরুভূমি, ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি, প্রবাল প্রাচীর, গভীর সমুদ্রগহ্বর, সমুদ্রসুনামী। বিশাল কত হিমশৈল, দুর্গম বৃষ্টিবন, কত বজ্রগর্ভ উল্লম্ব মেঘ, মরুঝড়, বিধ্বংসী ভূমিকম্প, প্রবল টর্নাডো। এই পৃথিবীকে আমরা নানা রঙে নানা সাজে কত ঋতুতে সেজে উঠতে দেখেছি। এর রঙই আমাদের শরীরে ও মনে রঙের সঞ্চার করে। আমরা দেখেছি তার অবিরল ছন্দিত নৃত্যরত কতই ভঙ্গিমা। পুজো করেছি এর মাটিকে ; আকাশের মেঘ, পবিত্র নদীজল আর আগুনকে। হে প্রণম্য অগ্নি, বলেছি আমরা। বিশ্বাস করেছি, এই মাটি জল বাতাস আগুন ও আকাশের উদার থেকে আমরা উৎপন্ন হয়েছি, এবং জীবনশেষে একদিন আবার রূপান্তরিত হয়ে এইসবের মধ্যেই মিশে যাবো।
আমরা তো নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশকেই আমাদের স্বর্গীয় পরলোক মনে করেছি, আর আরাধনা করেছি সূর্যের। জেনেছি, এই সৌরমন্ডলের তিনিই গৃহকর্তা, তাঁর অবর্তমানে পৃথিবী মৃতবৎ। এইভাবে কেটে গেছে কত সহস্র বছর। ক্রমশঃ বিজ্ঞান গবেষণা আর উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা যখন সৌরমন্ডলের বাইরে গভীর মহাকাশের সুদূরে চোখ রাখলাম, অনুভব করলাম এই প্রকান্ড ব্রহ্মান্ডের রহস্যময় বিশালতাকে, আমরা তখন বিস্মিত, বিপর্যস্ত, নির্বাক। এই বিশ্বজগতকে কোনওদিন জানা শেষ হবে না। কিন্তু আমাদের অসীম প্রচেষ্টা তাকে জানার, আর এই নিয়েই কত সহস্র লক্ষ আয়োজন। আমরা কোথা থেকে এসেছি, কী আছে শেষে, পথের শেষ কোথায় ? যে কবি প্রশ্ন করছেন, তিনিই আবার বলছেন—শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে ?
মহাকাশ-কক্ষপথে টেলিস্কোপ :
পৃথিবীর তাবৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞানীদের দীর্ঘকালের প্রিয় বিষয় হল পৃথিবীর বাইরে উন্নত প্রাণজীবনের সন্ধান। এই মহাবিশ্বে আমরা কি একাই, নাকি আমাদের পরিচিত সৌরমন্ডলের বাইরে আরও অনেক গ্রহ বা ‘এক্সোপ্ল্যানেট’ রয়েছে, যেখানে আছে পৃথিবীর মতোই হাওয়া-জল-অক্সিজেন, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত। তারই সন্ধানে গভীর মহাকাশের দূরতম প্রান্ত অবধি খুঁজে চলেছেন আজকের বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্ব নামক বিপুল গোলকটি সতত সম্প্রসারণশীল, ক্রমশঃ স্ফীতকায় হয়ে উঠছে আয়তনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির সাথে সাথে, বড় বড় রেডিও টেলিস্কোপ এবং মহাকাশে প্রদক্ষিণরত হাব্ল টেলিস্কোপের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এখন অতিগভীর মহাকাশের প্রায় ততদূর অব্দি দেখতে পেরেছেন, যেখান থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে লাগে প্রায় ১৩২০ কোটি বছর। এর বাইরেও, আরও বহুদূর বিস্তৃত এই ব্রহ্মান্ড।
মনে রাখা যাক, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে লাগে আট মিনিটের একটু বেশি। চাঁদ থেকে আলো আসতে সময় লাগে ১.২৫৫ সেকেন্ড। আর সুদূর মহাকাশের সুবিশাল অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছয় ২৫ লক্ষ বছরে (ওপরে ছবি)।
সেই তুলনায় ব্রহ্মান্ডের দূরতম প্রান্ত থেকে প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটে আসতে আলোর লাগে ১৩২০ কোটি বছর! এতদূর দৃষ্টিশক্তি মানুষ পেয়েছে ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’-এর সাহায্যে, যে রয়েছে মহাকাশে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মেঘ-বাস্প-ধূলিকণার অনেক ওপর থেকে সে ছবি তুলছে দূরের নক্ষত্রজগতের (নীচে ছবি)।
আজ এই লেখাটি একটু থামিয়ে, এই মুহূর্তে সে কোথায় রয়েছে জানতে ইচ্ছে করছে আমার। তাকে কম্পিউটারে ট্র্যাক করে দেখতে চাই, এখনই। দেখা যাক। … হ্যাঁ, পাওয়া গেল তাকে, মহাকাশে প্রায় ৫৩০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে পৃথিবীকে এখন প্রদক্ষিণ করছে সে। গতিবেগ ঘন্টায় ২১,০০০ কিলোমিটার। একটু আগে ভারত মহাসাগর পার হয়ে, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের উত্তর দিক দিয়ে এসে, এখন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে দেখতে পাচ্ছি। এখন বিকেল ৫.০৫, শুক্রবার, ২১ অগস্ট, ২০২০। প্রশান্ত মহাসাগরের বিখ্যাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অঞ্চলে, যেখানে আছে সমুদ্রের গভীরতম তল ‘চ্যালেঞ্জার ডীপ’, ঠিক তার ওপর দিয়ে এখুনি গিয়েছে সে ; সমুদ্রতলের গভীরতা সেখানে প্রায় ১১-কিলোমিটার। এভারেস্ট শৃঙ্গ যতটা উঁচু, তার চেয়েও অনেক বেশি গভীর। আর মিনিট দশেক পরেই সে পৌঁছে যাবে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের ওপরে। (নীচে ছবি)।
এভাবেই, মহাকাশে মানুষের পাঠানো প্রায় ২৭০০টা উপগ্রহ রয়েছে এখন ; নানা গবেষণার কাজে বিশ্বের নানা দেশ থেকে এসেছে তারা। এই হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে মানুষ আজ দেখতে পাচ্ছে প্রায় ১৩২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের (Hubble Ultra Deep Field) নক্ষত্রজগতের জন্মমৃত্যুর কাহিনী। এর চেয়েও আরও ঢের দূরত্ব আছে ব্রহ্মান্ডে, যা দৃশ্যসম্ভব ; পৃথিবী থেকে যেকোনও দিকে যা প্রায় ৪৬৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূর অবধি বিস্তৃত। এখনও সেই গভীরে মানুষের টেলিস্কোপের দৃষ্টি পৌঁছতে পারেনি। এবার পারবে, কারণ হাবলের চেয়েও অনেক বেশি, প্রায় ১০০-গুণ শক্তিশালী টেলিস্কোপকে এবার পাঠানো হবে মহাকাশে, যার নাম ‘জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ’। আগামী বছর, ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর, তাকে আরিয়ান রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপ করবে নাসা।
হাবল টেলিস্কোপের ৮-ফুট ব্যাসের তুলনায় এর ব্যাস প্রায় ২১-ফুট, সোনার মিহি আস্তরণ দিয়ে পালিশ করা। হাবলের কক্ষপথ পৃথিবীর প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার ওপরে। সে তুলনায় জেমস ওয়েবকে মহাকাশে যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে স্থাপন করা হবে, পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব হবে ৩,৭৪,০০০ থেকে ১৫,০০,০০০ কিলোমিটার ওপরে। এখন তার নির্মাণ পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে (নীচে ছবিতে)।
এই হাবল এবং জেমস ওয়েব, দুটোই অপ্টিকাল টেলিস্কোপ অর্থাৎ, দৃশ্য আলোয় রচিত যে ছবিকে আমরা দেখতে পাই তাকেই এরা বহুগুণ বিবর্ধিত করে দেখায়। এছাড়াও নক্ষত্রজগত থেকে কত বেতার তরঙ্গ ভেসে আসে, তাদের চোখে দেখা যায় না। তার সংকেত ধরা পড়ে রেডিও টেলিস্কোপে। এমনই আছে এক্সরে, ইনফ্রারেড, গামা-রে টেলিস্কোপ, ইত্যাদি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ‘চন্দ্র এক্সরে টেলিস্কোপ’-কে নাসা মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছিল ১৯৯৯ সালে। দূর নক্ষত্রজগতের সুপারনোভা, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি থেকে অনর্গল নির্গত হওয়া তীব্র এক্সরে রশ্মিকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে আসা অতি ক্ষীণ অবস্থাতেও সনাক্ত ক’রে তার ছবি গঠন করে দেখায় এই অত্যুন্নত দূরবীক্ষণ। এক্সরে রশ্মিকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল অনেকটাই শুষে নেয় বলে, চন্দ্র এক্সরে টেলিস্কোপকে পৃথিবী থেকে অনেক ওপরে মহাকাশে উপবৃত্তাকার (১৪,৩০৮ থেকে ১,৩৪,৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব) কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোবেলজয়ী জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুব্রামণিয়ান চন্দ্রশেখরের নামে এই টেলিস্কোপ বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় টেলিস্কোপগুলোর মধ্যে এখন প্রধান। কৃষঙ্গহ্বর নিয়ে আলোচনার সময় এর প্রসঙ্গে আবার আসবো।
প্রথম আলোর চরণধ্বনি !
সম্প্রতি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র (ISRO) অ্যাস্ট্রোস্যাট নামক স্যাটেলাইটের একটি পর্যবেক্ষণ আন্তর্জাতিক সংবাদে এসেছে। এর সাহায্যে প্রায় ৯৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি নক্ষত্রপুঞ্জ (AUDFs01) থেকে ধেয়ে আসা অতিবেগুণী রশ্মিকে সনাক্ত করতে পেরেছেন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এরকমটা নাকি এই প্রথম। আমি তাকে এখনই ট্র্যাক করে দেখলাম, এই অ্যাস্ট্রোস্যাট উপগ্রহটি রয়েছে মহাকাশে, হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক উঁচুতে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৪০ কিলোমিটার উচ্চতায়। এই মুহূর্তে সে মাঝসমুদ্রে, প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি, বিষুব রেখার ৫.৩ ডিগ্রী ওপর দিয়ে পূর্বদিকে ছুটে চলেছে। এরই মধ্যে আছে ৫-টি টেলিস্কোপ, যা এক্সরে এবং আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিকে সনাক্ত করতে পারে। নাসার হাবল টেলিস্কোপ শুধু দৃশ্য আলোকে দেখতে পায় বলে, মহাকাশের এই সুদূর নক্ষত্রপুঞ্জ তার নজরে থাকলেও এর তীব্র অতিবেগুণী রশ্মিকে সে দেখতেই পায়নি। ভারতীয় বিজ্ঞানী ডঃ কনক সাহার নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক দল একে অ্যাস্ট্রোস্যাটের তথ্যের সাহায্যে প্রথম সনাক্ত করেছেন, যা বিখ্যাত ‘নেচার’-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এটা একটা দারুণ ব্যাপার, কারণ এখানেই হয়তো পাওয়া গেল ব্রহ্মান্ডসৃষ্টির পর প্রথম আলোর জন্মের সন্ধান, কবি বর্ণিত ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’। নীচে সেই ৯৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সির ছবি।
গ্রহাণুদের গল্প :
গভীর মহাকাশ থেকে ছুটতে ছুটতে কেউ কি আমাদের সূর্যের পাড়াতেও এসে পড়ছে কখনো? কোনও নতুন অতিথি? হতে পারে সে কোনও গ্রহ, গ্রহাণু, বা ধূমকেতু, যারা আদতে এই সৌর মন্ডলের অধিবাসী নয়। এমনিতে তো কত ধূমকেতুকেই আমরা রাতের আকাশে দেখেছি। কেউ আসে বারবার। কেউ আসে অনেক বছর পার করে। কিন্তু তারা সকলেই তো আমাদের সৌরমন্ডলের মধ্যেই রয়েছে। আর যারা খুব কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে, রাতের আকাশের সেইসব উল্কাদেরও তো হামেশাই দেখেছি আমরা। কিন্তু তার চেয়েও আমাদের বেশি আগ্রহ ওই অতিথিদের নিয়ে, যারা বহুদূরের অন্য কোনও নক্ষত্র জগত থেকে পাড়ি দিয়ে সহসা এসে পড়েছে আমাদের সুর্যের পাড়ায়, এবং দেখা দিয়ে আবার দ্রুতবেগে ফিরে চলে গেছে মহাকাশের গভীরে, অন্য কোনও নক্ষত্রলোকে। অতি সম্প্রতি আমরা চিহ্নিত করতে শুরু করেছি তাদের।
প্রথম অতিথির নাম হয়তো অনেকেরই মনে আছে। তার নাম ছিল ‘ওমুয়ামুয়া’। ২০১৭-র অক্টোবরে যখন আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাকে ছুটে আসতে দেখে চমকে উঠেছিলেন, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমাদের সৌরমণ্ডলে সে যখন কিছুটা প্রবেশ করে আবার ফিরে যাচ্ছিল গভীর মহাকাশে, তার মাত্র কয়েকদিন দিন আগে তাকে আবিষ্কার করেছিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটি অ্যামেচার টেলিস্কোপ। এই হাওয়াই দ্বীপের বেশ খ্যাতি আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে। এখানকার টেলিস্কোপ থেকেই প্রথম জানা গিয়েছিল সৌরমন্ডলের প্রান্তে ‘কাইপার বেল্ট’ নামক গ্রহাণু-বলয়ের কথা। ‘ওমুয়ামুয়া’কেও এখান থেকেই প্রথম চিহ্নিত করা যায়। হাওয়াই দ্বীপের আদিবাসীদের ভাষায় ওমুয়ামুয়া-শব্দের অর্থ দূর নক্ষত্রজগতের খবর নিয়ে আসা প্রথম অতিথি।
কোথা থেকে এসেছিল ‘ওমুয়ামুয়া’? তাকে নিয়ে সবার আগে সম্ভবত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিজ্ঞানী ছড়িয়ে ছিলেন গল্পটা : বলেছিলেন ভিনগ্রহের এলিয়েনদের পাঠানো কোনও মহাকাশযানের এসে পড়ার কথা। এঁদের অনেকেই আর্থার ক্লার্কের সায়েন্স ফিকশান গল্পগুলোর ভক্ত। কারণ ক্লার্কের বিস্ময়কর কাহিনীতে জড়িয়ে আছে আজকের বিজ্ঞান আর সেদিনের কল্পনা। তবে এখন যা জানা যাচ্ছে তাতে, ওমুয়ামুয়ার জন্ম হয়েছিল প্রায় দশ কোটি বছর আগে। তার গমনপথের (trajectory) চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সৌরমন্ডলের গ্রহদের কক্ষপথের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নপথে এসেছিল সে এদিকে। আমাদের সৌরমন্ডল থেকে ১৩ আলোকবর্ষ দূরের Ross-614 নামক এক নক্ষত্রের সংসার থেকে। মহাকাশে ক্যানিস মেজর এবং ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝখানে তাকে দেখা যায় শক্তিশালী টেলিস্কোপে। তবে এটা তো মিটিওর নয়, এটা কমেট, শুকিয়ে যাওয়া কোনও ধুমকেতু, অন্য নক্ষত্রজগত থেকে আসা, প্রথম চিহ্নিত বহিরাগত।
সে এসেছিল কিছুটা দুলতে দুলতে, টলতে টলতে। টাম্বলিং অ্যান্ড স্পিনিং। এত দ্রুতগতিতে সে সূর্য এবং পৃথিবীর কক্ষপথের অনেকটা কাছে এসে (নব্বই লক্ষ মাইল), আবার হঠাৎই পাড়ি দিয়েছিল নক্ষত্রজগতের গভীরে যে, তার ছবিও ঠিক করে তুলতে পারা যায়নি। বোঝা যায়নি তার কক্ষপথ। তবে অনেক মাপজোক করে সন্দেহ হয়, সে ছিল প্রায় ৪০০-মিটার লম্বাটে একটা ঝামাপাথরের মতো বস্তুপিণ্ড, যার ঝাঁজরা শরীরের অনেকগুলো ফুটো দিয়ে মাঝেমাঝে তীব্রবেগে রুদ্ধগ্যাস বেরিয়ে এসে তার চলনকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। সে এসেছিল ‘ভেগা’ (Vega) নামক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সংসার ছেড়ে, বিবাগী হয়ে। তার আসল ফটো না পেয়ে বিজ্ঞানীরা একটা কল্পিত ছবি এঁকে প্রকাশ করেছিলেন, যা দেখতে অনেকটা চুরুটের মতো (নীচে ছবি)।
তার টেকনিকাল নাম ছিল ‘1I/2017’; এখানে 1I মানে, প্রথম ইন্টারস্টেলার। সেটা ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস। আমি তখন কবিদের কবিতাপাঠ ও জলযাত্রা নিয়ে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনা করছিলাম। ‘এম বি রাজমহল’-নামের সেই ছবিটি পরে উৎসর্গ করেছিলাম ওই প্রথম আন্তর্নক্ষত্রজগতের অতিথি ‘ওমুয়ামুয়া’-কে।
তো, উনি ছিলেন প্রথম, তাই এই সম্মান। তারপরে এসেছেন দ্বিতীয়জন। তবে এটি একটি সক্ষম ধূমকেতু। এর নাম ‘2I / Borisov’; 2I মানে দ্বিতীয় ইন্টারস্টেলার। গত ৩০ অগস্ট ২০১৯ একে আবিস্কার করেন গেন্নাডি ভ্লাডিমিরোভিচ বরিসভ নামে এক রাশিয়ান জ্যোতির্বিদ। এবার বিজ্ঞানীরা ‘হাবল টেলিস্কোপ’ দিয়ে শুরু থেকেই নজরে রেখেছিলেন তাকে। এই একটা প্রথম ধূমকেতু, নাম ‘বরিসভ’, যে আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের এক নক্ষত্রজগত থেকে প্রবল বেগে এদিকে ছুটে এসেছে, ঘণ্টায় এক লক্ষ সত্তর হাজার কিলোমিটার গতিতে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পৃথিবীর মাত্র দশ কোটি মাইলের মধ্যে এসে দেখা দিয়ে, ফিরে চলে গেল সে। আকারে সে ওমুয়ামুয়ার চেয়ে অনেক বড়, দশ-বারো কিলোমিটারের মতো, আর তার উজ্জ্বল লেজের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় দেড় লক্ষ কিলোমিটার। তার চলনপথের মাপজোক নিয়ে যে কক্ষপথের নকশা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাতে বোঝা যাচ্ছে সে ছিল পৃথিবী থেকে ১৩-আলোকবর্ষ দূরে ক্রুগের-৬০ নামের একজোড়া নক্ষত্রের কাছেপিঠে। সেখান থেকে রওনা দিয়ে, প্রায় দশ লক্ষ বছর ধরে ছুটতে ছুটতে সে এসেপড়েছিল আমাদের সৌরমণ্ডলে। তবে এখানে থাকতে নয়, দূর থেকে একটু দেখা দিয়ে সে চলে গেছে অন্য কোনও নক্ষত্রলোকের দিকে, যেমন তার মর্জি। এই বিশাল মহাবিশ্বে কে যে তাকে কোন দিক থেকে টান দিচ্ছে, কিসের টানে কোথায় সে ছুটে চলেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, কে জানে।
এরকমই লক্ষ কোটি গ্রহাণু ও ধূমকেতু রয়েছে সৌরমন্ডলের ভেতরে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে গ্রহাণু-বলয়ে (Main Asteroid Belt) এবং সৌরমন্ডলের শেষ প্রান্তে ‘কাইপার বেল্ট’-এ। এছাড়াও সৌরমন্ডলের সীমানার ওপারে উর্ট ক্লাউডে, অথবা আরও দূরের অন্য নক্ষত্রলোকে, যাদের কেউ কেউ পৃথিবীর আকাশে এসে কখনও দেখা দিয়ে যায়। হয়তো আগেও এরা এসেছে, কিন্তু প্রযুক্তির অভাবে আমরা জানতে পারিনি। এদের প্রতি আজ বিজ্ঞানীদের অসীম আগ্রহ কারণ, এদের আকার, গঠন, কক্ষপথ ও মতিগতি বিশ্লেষণ করে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টিরহস্যের অনেক খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এখনও জানার বাকি আছে অনেক।
এইসব গ্রহাণুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দূরে দূরে। সূর্য থেকে পৃথিবীর চেয়েও অনেক দূরে তাদের কক্ষপথ, তাই তাদের এক বছরও পৃথিবীর তুলনায় অনেক দীর্ঘ। তবে এদের দিন রাত হয় খুবই কম সময়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টায়। মহাকাশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল বেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে এইসব ছোট বড় নানা ধরণের লক্ষ লক্ষ গ্রহাণু। এরকম প্রায় দুই লক্ষ গ্রহাণুকে চিহ্নিত করে তাদের নাম ও নম্বর দিয়ে ডাটাবেস তৈরী করা হয়েছে। তাদের আকার ভিন্ন ভিন্ন, এবং পরিমাপ তিন চারশো কিলোমিটার থেকে মাত্র কয়েক ফুট পর্যন্ত (নীচে ছবিতে)।
মহাকাশ থেকে প্রতিদিনই এইরকম অসংখ্য ছোট, বড়, ক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র গ্রহাণু পৃথিবীর আকাশে ঢুকে পড়ছে। সংখ্যায় তারা নাকি কয়েক কোটি, প্রতিদিন। এদের কেউ হয়তো কোনও ধুমকেতুর ভাঙাচোরা সহস্র টুকরো, কেউ বা নানা খনিজ পাথরের ছোটবড় পিন্ড, মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর আকর্ষণে বায়ুমন্ডলে ঢুকে, ভূপৃষ্ঠে এসে প্রতিদিন আছড়ে পড়ে। কেউ বা জ্বলতে জ্বলতে বাতাসেই পুড়ে শেষ হয়ে যায়। রাতের আকাশে তাদের আমরা উল্কা বলি, আর কেউ বলে তারা খসে পড়ছে। এদেরই মধ্য থেকে বড়সড় কেউ দলছুট হয়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে এসে আছড়ে পড়তেও পারে। যারা বেশি কাছাকাছি রয়েছে, সেইসব ‘নিয়ার আর্থ অবজেক্ট’ (NEO) নিয়ে সর্বদাই আমাদের দুশ্চিন্তা, এদের গতিবিধির দিকে তাই সজাগ দৃষ্টি থাকে বিজ্ঞানীদের। তবে আগে থেকে জানতে পারা যায় না ব’লে, সনাক্ত করার পরে খুব সামান্য সময়, মাত্র কয়েকদিন হয়তো, হাতে থাকতে পারে পৃথিবীকে বাঁচাবার। এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত। এইসব আগ্রাসীদের চিহ্নিত করে, খুব তাড়াতাড়ি মাপজোক আর অঙ্ক কষে তাদের গতিপথকে জেনে নিয়ে, সেইমতো মিসাইল ছুঁড়ে মহাকাশেই তাদের ধ্বংস করে দেওয়া অথবা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়তো সম্ভব হতে পারে।
মারণ গ্রহাণু -১ (চিক্সুলুব):
এমনই এক বিশাল গ্রহাণু একদিন উল্কা হয়ে উড়ে এসে বিস্ফোরিত হয়েছিল পৃথিবীর ওপর, বিপুল ধ্বংস ডেকে এনেছিল জলে স্থলে ও জীবজগতে। বিলুপ্ত হয়েছিল অনেক প্রজাতির প্রাণী, যাদের মধ্যে ছিল ডায়নোসরেরা। আদিম পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অব্দি সবচেয়ে বড় ও বিপজ্জনক সেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে, এখন যেখানে মেক্সিকো শহরের সমুদ্রতীরবর্তী চিক্সুলুব (Chicxulub) শহর রয়েছে [21°24′0″N, 89°31′0″W]। আনুমানিক ১০ থেকে ৮০ কিলোমিটার আকারের সেই বিশাল গ্রহাণু এসে, ৪৫-৬০ ডিগ্রী কোণে সরাসরি আছড়ে পড়ায় পৃথিবীব্যাপী মহাপ্রলয়ে, ভূমিকম্পে, অগ্ন্যুৎপাতে নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেছিল পৃথিবীর তিনভাগ বনাঞ্চলের উদ্ভিদ, গাছপালা, বন্যপ্রাণ এবং ডায়নোসরও।
সেই বিপুল অভিঘাতে উপকূল সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার গভীর এবং ১৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত একটা গহ্বর বা ক্রেটারের সৃষ্টি হয়েছিল। আর মহাসমুদ্রে যে সুনামি উঠেছিল, উপকূলে তার জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০০ ফুট, প্লাবিত হয়েছিল সমগ্র টেক্সাস থেকে ফ্লোরিডার ভূখন্ড, আর গভীর সমুদ্রে ঢেউ উঠেছিল ৩-৪ মাইল উঁচু হয়ে ! সারা পৃথিবী ঢেকে গিয়েছিল ঘন্টায় ১০০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলা প্রবল ধূলোঝড়ে। কয়েক দশক ধরে পৃথিবীতে সূর্যের আলো ঢাকা ছিল ঘন মেঘের অন্ধকারে। সমুদ্রের তলদেশে, প্রায় ৬০০ মিটার মাটির নীচে আজও অক্ষত রয়ে গেছে সেই প্রকান্ড গহ্বরের কেন্দ্রের বৃত্তাকার রিং, যাকে ভুতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের নীচে তেলের খনির সন্ধানে গিয়ে ১৯৭০ সাল নাগাদ আবিস্কার করেন (অঙ্কিত ছবি নীচে)।
মারণ গ্রহাণু -২ (চেলিয়াবিন্স্ক):
মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার মধ্যভাগে উরাল পর্বতমালার কাছে পাইন গাছে ঘেরা সুদৃশ্য চেলিয়াবিন্স্ক (Chelyabinsk) শহরে একদিন আছড়ে পড়েছিল বিশাল এক গ্রহাণু। তীব্রগতিতে খুব নীচু হয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে ধেয়ে আসা সেই বিরাট আগুনের গোলা বাতাসেই বিকট আওয়াজ করে বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ে। হতচকিত শহরবাসী তীব্র আওয়াজে আকাশে চোখ তুলে দেখে, আকাশ যেন আড়াআড়ি চিরে দুফাঁক হয়ে গেছে, নিমেষে, আর সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল এক বিশাল আগুনের গোলা। সেই বিস্ফোরণের তীব্রতায় আগুন জ্বলে ওঠে আর ঘন ধোঁয়ার মেঘে ঢাকা পড়ে যায় সবকিছু। বহুদূরে ইউরোপের আকাশেও সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছিল, শোনা গেছিল তার শব্দ। আর বিস্ফোরণের তীব্রতার পরে তার গুড়গুড় রাম্বলিং-শব্দ সারা পৃথিবীকে দুবার প্রদক্ষিণ করেছে, শোনা গেছে। সারা শহরের অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়েছিল। ছবি পাওয়া গিয়েছিল নাসার মহাকাশে যেসব উপগ্রহ রয়েছে, তাদের থেকেও। বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল হিরোশিমার অ্যাটম বোমার প্রায় চল্লিশ গুণ। ঘরবাড়ি, জানালার কাচ নিমেষে ভেঙে পড়েছিল, আর আহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ।
মারণ গ্রহাণু -৩ (তুঙ্গুস্কা):
তবে প্রতিবছর ৩০ জুন যে বিশ্ব গ্রহাণু দিবস পালিত হয়, তার পেছনে আছে ১১২ বছর আগেকার আর এক ভয়ংকর দিনের স্মৃতি। সেদিনটাও ছিল ৩০ জুন, ১৯০৮ সাল। এই দিনটাই এখন সারাবিশ্বে গ্রহাণুদিবস নামে পালিত হয়ে আসছে, রাশিয়ায় তুঙ্গুস্কার উল্কাপাতের স্মৃতিতে। সাইবেরিয়ার নির্জন পূর্বপ্রান্তে, তুঙ্গুস্কা নদীর পাশে, সেদিন সকালে মহাকাশ থেকে ধেয়ে এসেছিল এক বিশাল উল্কাপিন্ড। বায়ুমন্ডল ভেদ করে কোণাকুণি ছুটে আসছিল ব’লে, মাটি স্পর্শ করার আগে প্রচন্ড গর্জনে সে আকাশেই বিস্ফোরিত হয়। সেই আগুনে ২০০০ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চলে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায় প্রায় আশি মিলিয়ন, বা ৮-কোটি গাছ। সেই বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল হিরোশিমার অ্যাটম বোমার প্রায় ১০০০ গুণ। কিন্তু মাটিতে এসে আছড়ে পড়েনি বলে সৃষ্টি হয়নি কোনও ক্র্যাটার বা বিশাল গহ্বর (নীচে ছবি)।
আপাততঃ এটাই ছিল শেষ বড়সড় বিস্ফোরণ, যা এসেছিল বহির্জগত থেকে। এখনও প্রতিদিনই অজস্র ছোটবড় গ্রহাণুর ছুটে আসার খবর পাওয়া যায়, অবশ্য তারা চলে যায় চাঁদের থেকেও অনেক দূর দিয়ে। তবে যদি আবার কেউ এসে আঘাত করে, সেইদিকে বিজ্ঞানীরা সতর্ক নজর রেখে ভয়ে ভয়ে আছেন। তাঁরা সবসময় লক্ষ্য রাখছেন মহাকাশের বড়সড় কয়েক হাজার গ্রহাণুর দিকে, যাদের বলা হয় NEO (Near Earth Objects)। আগে থেকে বিপদ বুঝতে পারলে, তাদের গতি ও কক্ষপথকে চিহ্নিত করতে পারলে, যদি আকাশে শক্তিশালী মিসাইল ছুঁড়ে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। অন্যথায় এক লহমায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা, জীবজগত।
লোভনীয় গ্রহাণু ‘সিক্সটিন শাইকি (16 Psyche)’
‘সিক্সটিন সাইকি’ হচ্ছে মহাকাশের একটি অতিকায় গ্রহাণুর নাম, যাকে ঘিরে কিছু মানুষের মনে তৈরী হয়েছে বিপুল উত্তেজনা। কারণ এই বিরল গ্রহাণুটি সম্পূর্ণত: ধাতুর তৈরী, যার মধ্যে আছে আয়রন, নিকেল, সোনা এবং আরও কিছু বহুমূল্য পদার্থ। আলুর মতো আকারের এই গ্রহাণুর ব্যাস প্রায় ২২৫ কিলোমিটার (কলকাতা থেকে প্রায় ঘাটশিলার দূরত্ব)। যদি একে বিস্ফোরণে কয়েক টুকরো করে ভেঙ্গে, পৃথিবীতে নামিয়ে এনে ধাতুর বাজারে বিক্রি করা যায়, তবে আজকের মূল্য হিসেবে যা পাওয়া যাবে সেই টাকা ভাগ করে পৃথিবীর আপামর জনসাধারণের ব্যাংকে পাঠালে প্রত্যেকে পাবে 93 billion dollars, অর্থাৎ প্রায় ৬,৯০,০০০ কোটি টাকা! হ্যাঁ, ছ’লক্ষ নব্বই হাজার কোটি টাকা প্রত্যেকে পাবে, পৃথিবীর সব্বাই। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ প্রতিদিন ২১ কোটি টাকা করে খরচ করলেও, নব্বই বছর লেগে যাবে তার টাকা শেষ হতে।
এর ফলে কী হতে পারে তা বুঝিয়ে বলতে পারবেন অর্থনীতিবিদরা। প্রথম অসুবিধে হবে অত পরিমাণ ধাতুকে ডলারে বা টাকায় পরিবর্তন করাই যাবে না, কারণ কিনবে কে, কার আছে অত টাকা? পৃথিবীর সব দেশের মোট জিডিপির চেয়েও সে যে অনেকগুণ বেশি। আর যদি ওই ধাতুসম্পদের সমমূল্যের নোট ছাপিয়ে নেওয়া যায় এবং সেই ধন সবাইকে সমান ভাগে দান করেও দেওয়া যায়, তবে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি হবে। একটা পাউরুটির দাম হবে বারো লক্ষ টাকা। এক ডজন ডিম হয়তো বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। বিপুল অর্থ থেকে বিপুল অনর্থ ঘটে যাবে দুনিয়া জুড়ে। আরও অনেক কিছু ওলোটপালোট হবে, যা সমাজবিদদের গভীর গবেষণার বিষয় হতে পারে। তখন খালপাড়ের ঝুপড়ির দুখু মুর্মু আর অ্যান্টিলার মুকেশ আম্বানিদের নেট ওয়ার্থ হবে প্রায় সমান সমান, দশ বিশ হাজার কোটির তফাৎ মাত্র। বামপন্থী বা সাম্যবাদী হিসেবে এতে তো খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু পৃথিবীর মোট উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত থাকার জন্যে এই কুড়িয়ে পাওয়া ধনের সুফল কেউ পাবে না। তাই পৃথিবীর রাজাগজা গরীবগুর্বো সকলেই এক ধাক্কায় সমান ধনী অথবা সমান গরীব হয়ে যাবে। এর ফলে শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দেশশাসন, সবই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। নতুন করে লিখতে হবে সেই কিস্যা। পড়ে পাওয়া প্রাচুর্যজনিত এইরূপ বিপন্নতার নাম দেওয়া হবে ‘সিক্সটিন সাইকি’।
সমস্যা অবশ্য গোড়াতেই একটা হবে। এই বিপুল পরিমাণ ধাতুকে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে যদি স্টকপাইল করে রাখতে হয়, আর সেই পাইলের উচ্চতা হয় তিরিশতলা বাড়ির সমান, তবে সমগ্র উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার সবটুকু চাপা পড়ে যাবে তার তলায় !! অর্থাৎ সম্পূর্ণ গ্রহাণুটিকে একবারে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা চলবে না, আনতে হবে অল্প অল্প করে, কয়েক হাজার বছর ধরে।
[নীচে ছবি : শিল্পীর কল্পনায় ধাতব গ্রহাণু ‘সিক্সটিন সাইকি’কে যেমন দেখতে।]
এই গ্রহাণুটির আবিষ্কার হয়েছিল দেড়শো বছর আগে, ১৮৫২ সালে। গ্রহাণুদের মধ্যে এটাই তখন ছিল ১৬-তম আবিস্কার। ‘সাইকি’ নামটা পৌরাণিক। গ্রীক পুরাণে কিউপিডের স্ত্রীর নাম সাইকি। সৌরমন্ডলে মঙ্গল গ্রহ আর বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝখানে যে Main asteroid belt আছে, যার কথা আগের পর্বে লিখেছি, সেখানেই আছে এই 16 Psyche. এই গ্রহাণুতে দুঘন্টা দিন আর দুঘন্টা রাত, এতটাই দ্রুত সে নিজে ঘুরছে। তবে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে তার সময় লাগে পাঁচ বছর। আগামী ২০২২ সালে নাসা সেখানে একটা মহাকাশযান পাঠাতে চলেছে, যেটা সাইকিতে পৌঁছে যাবে ২০২৬ সালে। তারপর বোঝা যাবে কিসে কি হয়।
গ্রহাণু 2006 VP32 -300128 :
মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে যে গ্রহাণু বলয়, সেখানে রয়েছে একটি গ্রহাণু, যা আবিস্কৃত হয়েছিল ২০০৬ সালের ১১ নভেম্বর। আমেরিকার ‘ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে’ টেলিস্কোপটি তাকে প্রথম নজর করেছিল। গত বছর, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা (International Astronomical Union) ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের প্রসিদ্ধ শিল্পী পদ্মবিভূষণ পন্ডিত যশরাজের নামে এই গ্রহাণুটির নাম রাখেন ‘Minor Planet Panditjasraj 2006 VP32-300128’। এর মধ্যে ৩০০১২৮ সংখ্যাটি পন্ডিতজির জন্মতারিখকে সূচিত করে (২৮ জানুয়ারি, ১৯৩০)।
এই সম্মান, যা আগে আর কোনও ভারতীয় সঙ্গীত সাধককে দেওয়া হয়নি, পন্ডিত যশরাজকে খুবই প্রীত করেছিল। মানপত্রে লেখা আছে যে, এই ভারতীয় গায়কের কন্ঠস্বর প্রায় সাড়ে চার অক্টেভ জুড়ে সাবলীলভাবে সঞ্চালিত হয়, যা সঙ্গীতবিশ্বে এক বিরল প্রতিভা। মাত্র কয়েকদিন আগে, এই ২০২০ সালের ১৭ অগস্ট, নব্বই বছর বয়সে আমেরিকার নিউজার্সি শহরে পন্ডিতজি প্রয়াত হয়েছেন। (নীচে মানপত্রের ছবি)।
ছোট্ট গ্রহাণু ‘রিউগু’ (162173 Ryugu) :
পৃথিবী থেকে প্রায় ১৮ কোটি কিলোমিটার দূরে মহাকাশে রয়েছে এই গ্রহাণু, যার নাম ‘রিউগু’। এর আকৃতি, দুটো লাট্টুকে উলটো করে পিঠে পিঠে জুড়ে দিলে যেমন হয়, অনেকটা সেরকমই (নীচে ছবিতে)। এর ব্যাস ১-কিলোমিটারের থেকেও কম, মাত্র ৮৬৫ মিটার। মাধ্যাকর্ষণ বল অতি সামান্য, পৃথিবীর ৮০,০০০ ভাগের এক ভাগ। নিজের কক্ষপথে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে সে, ঘন্টায় ৯১,০০০ কিলোমিটার গতিতে !
এই ছোট্ট গ্রহাণুটিকে নিয়ে এক বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা, যা অন্য কোনও দেশ আজ অব্দি পারেনি, আমেরিকা বা রাশিয়াও নয়। ২০১৪ সালের ৩-ডিসেম্বর জাপানী মহাকাশ সংস্থা ‘জাক্সা’ ( Japan Aerospace Exploration Agency) পৃথিবী থেকে ‘হায়াবুশা’-নামের একটি ছোট্ট মহাকাশযান পাঠিয়েছিল রিউগু-র উদ্দেশে। তারপর সাড়ে তিন বছর ধরে প্রায় তিরিশ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে সে। এর জন্যে তাকেও ছুটতে হয়েছে তীব্র গতিতে, ঘন্টায় কখনও প্রায় ১-লক্ষ কিলোমিটার। এইভাবে একদিন সে পৌঁছে গেছিল (২৭ জুন ২০১৮) ওই ছোট্ট গ্রহাণুটির পাশে। পৌঁছনোর পরে, কখনও সে কুড়ি মাইল ওপর থেকে ছবি তুলেছে রিউগু-র, কখনও নেমে এসেছে তার খুব কাছে (নীচে ছবি)।
তারপর এক লহমায় নীচে নেমে এসে, মাটি স্পর্শ করে, রোবোটিক ড্রিল দিয়ে একটু গর্ত করে তুলে নিয়েছে এক চামচ ধুলোমাটি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে এই কাজটা করেছে সে। তারপর একটু ওপরে উঠে গিয়ে নামিয়ে দিয়েছে একটা চৌকো বাক্সের আকারের ল্যান্ডার, যার নাম ম্যাসকট, আর ছোট গোল টিফিন কৌটোর আকারের ‘রোভার’, যার নাম মিনারভা, যার মধ্যে রয়েছে বিশেষ সব যন্ত্রপাতি। পৃথিবীর মাটি ছেড়ে হায়াবুশার মহাকাশ যাত্রা থেকে শুরু করে, রিউগু-তে পৌঁছনোর সব কর্মকান্ডের দারুণ একটা ভিডিও রয়েছে ইউটিউবে, যেটা অবশ্যই দেখা উচিত। এখানে তার লিঙ্ক দিলাম।
রিউগুর-জমি খুঁড়ে এক চামচ ধুলোবালি উঠিয়ে একটা কৌটোয় ভরে নিয়ে, এবার হায়াবুশা-২ রওনা দিয়েছে (নভেম্বর ২০১৯) পৃথিবীর পথে। আগামী ডিসেম্বর ২০২০-তে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কাছাকাছি এসে, তার পেটের ভেতর থেকে সে নামিয়ে দেবে সেই কৌটো অথবা ধাতব ডিস্কের আকারের ক্যাপসুলকে, যার ভেতরে আছে গ্রহাণু রিউগু-র মাটি খুঁড়ে উঠিয়ে আনা স্যাম্পল। বায়ুমন্ডল ভেদ করে তীব্র গতিতে নেমে এসে সেই ডিস্কটা একটা উল্কার মতো বেগে এসে আছড়ে পড়বে তার নির্ধারিত অবতরণস্থল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে, যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নেবেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। ঠিক এমনটাই হয়েছিল আগেরবার ২০০৫ সালে ‘আইটোকায়া’ নামক একটা গ্রহাণুতে হায়াবুশা-১এর অভিযানে, কিন্তু সেবার পরিকল্পনামতো সব কিছু পরীক্ষা করে ওঠা সম্ভব ছিলো না। এবারে সম্ভব হয়েছে। এই চূড়ান্ত সূক্ষ্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন সফলতা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই রিউগু গ্রহাণুটির জন্ম সম্ভবত বিশ্ব সৃষ্টির গোড়ার দিকের কোনও এক সময়ে। সুতরাং তার মাটি-পাথরের বিশ্লেষণ করে জানা যেতে পারে সৃষ্টিরহস্যের অনেক গোপন কথা। পাওয়া যেতে পারে নতুন কোনও আবিস্কারের দিকনির্দেশ। এইসব কাজ তাই এত প্রয়োজনীয়। তবে এই যে ছোট্ট গ্রহাণুটির ওপরে চড়ে বসা হোল, তার গায়ে ধাক্কা লাগলো অল্পকিছু, তাতে কি তার কক্ষপথে কোনও চ্যুতি ঘটবে, ভবিষ্যতে কোনওদিন সে কি পৃথিবীর দিকে ছুটে এসে বিপদ ডেকে আনবে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে তেমন সম্ভাবনা নাকি রয়েছে অন্য কয়েকটা গ্রহাণুকে নিয়ে, যেমন অ্যাপোফিস, বেন্নু, সিসিফাস, এবং আরও। এইসব গ্রহাণুরা বিপজ্জনক ‘অ্যাপোলো’ গ্রুপের সদস্য, যাদের সংখ্যা দশ হাজারেরও কিছু বেশি। এদের প্রত্যেকের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথকে দুজায়গায় ছেদ করেছে। সেইসব ছেদবিন্দুতে পৃথিবীর সাথে কখনও মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য।
এছাড়াও আছে ‘ট্রজান’ গ্রুপের গ্রহাণুরা, তারা পৃথিবীর সাথে একই কক্ষপথে ঘোরে, পৃথিবী থেকে বেশ কিছুটা আগে আগে অথবা পেছনে পেছনে। এরা নিরীহ, একই কক্ষপথে রয়েছে ব’লে এদের থেকে বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই। বৃহস্পতি গ্রহেরও এমন অনেক অনুগামী ট্রজান আছে।
*
এই লেখার তৃতীয় পর্ব এখানেই শেষ করা যাক। স্থানাভাবে এবারে বলা হোল না পৃথিবীর সেই রহস্যময় নবম গ্রহ বা প্ল্যানেট নাইনের কথা, বিজ্ঞানীরা যার ‘হাইলি সাসপিশাস’ উপস্থিতি অনুভব করছেন, কিন্তু দৃশ্যতঃ তাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী পর্বে তাকে নিয়ে কথা হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ কিছু ঝানু গোয়েন্দা আছেন, যাঁরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন সেই অদৃশ্য জিনিসটাকে খুঁজে বের করতে। এঁরা ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কানাইচরণ, এমনকি কোলকাতা পুলিশ বা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেরও আরাধ্য হতে পারেন।
(ক্রমশঃ)
Posted in: August 2020 - Serial, PROSE