পিটার গিজ্জি ও আয়না পৃথিবী : রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 আবার পিটার গিজ্জি ও তাঁর আর্কিওফোনিক্স। কিন্তু এবারে এই প্রত্নধ্বনিতত্ত্ব থেকে আমরা পৌঁছতে চাইছি অন্য এক পৃথিবীতে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে পারি mirror world বা আয়না পৃথিবী। আমরা শুনেছি সমান্তরাল পৃথিবীর কথা, যার বসত আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু পিটার গিজ্জির এই আয়না পৃথিবী বিজ্ঞানের কোনো গহন সুড়ঙ্গে নয় কিংবা মহাকাশের অজানা শূন্যতায় নয়, আঁচল পেতেছে আমাদের চেনা বিশ্বের কোলে। এ এমন এক পৃথিবী যার উপাদান এই পৃথিবীরই কিন্তু রয়ে গেছে আমাদের জানা গণ্ডির বাইরে, চেনা অনুভবের সীমানা পেরিয়ে। পৃথিবী ও আমাদের মাঝখানে পাতা আয়নায় প্রতিফলিত বাস্তবে মুখ দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু গিজ্জির এই পৃথিবী আয়নার উল্টোপিঠে হাত রেখে কথা বলে, যেখানে লুকোনো আছে অমসৃণ পারদপিঠের বিষণ্ণ ইতিহাস, আমাদের সরীসৃপ যাপনের যন্ত্রণা। আয়নার যেদিকে স্পষ্ট প্রতিফলন সেদিকে কবি দেখেন নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি। তাই গিজ্জির এই বাস্তব মুখ দেখে আয়নার সেই রুক্ষ খসখসে দিকে, যে দিকে লাগানো থাকে অনুভবের পারা, যা প্রতিফলিত করে না কিন্তু সমস্ত প্রতিফলনের সেই-ই নিয়ন্তা, অনুমোদনের ছাড়পত্র থাকে তারই হাতে। তাই আপন বোধে ঝলকে উঠতে দেখি পারদের সামাজিক ইতিহাস। প্রকৃতির প্রাণের ভেতর স্পর্শকান্তমণি দিয়ে পরখ করে দেখেন সেখানে কোনো বিভ্রম নেই; গোধূলি আলোয় শুনতে পান জঙ্গলের নিবিড় ডাক, ফার্ণের ফরিয়াদি ঝিরঝির, ছলকানো তারাদের নিসর্গ নির্যাস। জীবন খুঁড়ে বাস্তবের ছেঁড়া ফাটা রূপের ভেতর কবি খোঁজ করেন সেই উপাদান, যা দুঃখের ভেতর জেগে উঠে বুনে তুলছি প্রতিদিন। প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত জমাট কুয়াশা নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানায় কবিকে আর বেপরোয়া কবি খেলতে নামেন বিদ্যুতলাইনে বাতাসের সঙ্গে, খোঁজ করেন এক নতুন ঈশ্বরের আর অনুভবের গীতলতার পাক খুলতে থাকেন এক অদ্ভুত উৎসারণে। চলমানতায় থাকা কবি বিশ্বাস নিয়ে হাজির হন পৃথিবীস্টেশনে, আত্মপ্রত্যয়ে উচ্চারণ করেন হ্যালো। রচিত হয় প্রাণের ভেতর প্রাণ খোঁজা এক বাস্তব গীতলতা; নিজস্ব আবিষ্কারের সংকেতলিপিতে গেয়ে ওঠেন বাস্তবতার লিরিক।

২০১৬ সালে প্রকাশিত পিটার গিজ্জির কাব্যগ্রন্থ Archeophonics (প্রত্নধ্বনিতত্ত্ব), কবির উদ্ভাবিত এক নতুন শব্দ, Archaeology (প্রত্নতত্ত্ব) এবং Phonics (ধ্বনিতত্ত্ব) শব্দের সন্ধিকরণ, যার ইতিহাস আপনারা পড়েছেন আমার আগের লেখায়। সেই আর্কিওফোনিক্স কাব্যগ্রন্থের অন্য এক অধ্যায়ে এবারের যাত্রা। সেখান থেকেই ৯টা কবিতার অনুবাদ।

পারদের সামাজিক ইতিহাস (A Social History of Mercury)

নিজের ভেতর নিজের ভূত
ওই দেয়াল যেথায় আমার বাস
মেঝেতে আলোর বৃত্ত
নিজেকে স্পষ্ট করতে
আয়না পৃথিবী
তার নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি
এ কোনও বিষণ্ণতা নয়
পুরোপুরি আদিম
শব্দের বসতি
শেকড় ছড়ায়
সেজে ওঠা সম্বোধনে

“শীতসূর্য বলে লড়াই করো” (“the winter sun says fight”)

শীতসূর্য বলে লড়াই করো।
উত্তরমেরু বিস্ফোরণ বলে লড়াই করো।

আমার মাথা বলে বৃত্তাকার
তবু এই মেরুপৃথিবী সমতল
এমন অনেক কিছুই
আমার কাছে
না এর মতো

ইদানীং আমি চলমানতায়
প্রতিটা তলাতলে।
কী আছে তোমার হে সকাল
সান্ত্বনা দেবে আমাকে?

একবার দেখেছিলাম
ঈশ্বরের শহরটাকে
প্রতিফলিত হতে
সূর্যপ্রণীত সৃষ্টিছাড়া ছায়ায়।
ভেবেছিলাম জীবন পূর্ণ,
টানটান সুখ।

এখন সূর্য বলে সিগারেট,
আমি মানি। মনে পড়ে
তার শব্দিত ঝলক
আমাকে ভাঙতে চেয়ে
ঝমঝমাতো আমার ঘরে।

মনে পড়ে দিন আর রাত
রাত আর দিন
দিন রাত দিন
জমাট কুয়াশা।

এখন কুয়াশা বলে কফি,
ফিরিয়ে আনবে তোমায়।
কোথায়? কোথায়
আসল আমি বসত করি
মাথার বাইরে
রসায়নধোয়া জিনগর্ভে।

আমি ভালোবাসার জন্য লড়ছি
কিন্তু আমার দরকার এক নতুন ঈশ্বর।
পড়ে আছে কিছু,
এখন বেখাপ।
আমার ভেতরে থাকা সরীসৃপে
ক্লান্ত আমি, দীর্ঘমেয়াদি
পল্লবিত যন্ত্রণায়।

আমি ছিলাম এইখানে।

রাতের কাজ (Night Work)

অন্ধকারে চোখের আরাম
রাত নামা ঘরে দেখছে সব।

বুড়িয়ে যাওয়া অন্ধকার জাগছে এখন
দূরদেশী ভিক্ষুর প্যাগোডায় অচিন ঘণ্টা।

বাজিয়ে তুলছে রাতঘর অচিন আমার
অতীত পায়ে ঝমঝমানো নির্যাস।

এভাবে থাকতে চেয়ে
পৃথিবী কী চায়।

খাবি খাওয়া মোটর ওই দূরে
সমস্ত সুরে বাজে তরঙ্গ দূরতম হলে।

তুমি সওয়ার হতে পারো যদি শুনতে পাও
ঘ্যানঘ্যানে রাত কেমন চলমান ফিতে।

ইনস্টাগ্রামার (Instagrammar)*

হারানো তারা
থেকে যাবে ওইখানে
কাল যখন জাগবো
আমাদের দুঃখ নিয়ে,
সে কি আমরাই
যারা হারিয়ে গেছে
মুহূর্তে,
আজই কি সেইদিন
আমরা যখন ফুলমুখী

যদি এমনই হোত
কারণ আমরা সময়কে দেখেছি
আর ভালোবেসেছি,
যদি এটাই হোত
কারণ আমরাই,
এই তো ঠিক
যেমন ছিল,
দেখি তাকে
আলোলিতালো
আমাদের আগামী
আর দুঃসাহস

আমরা বলি
কীভাবে এমন
যদি খুঁজে পাই
সহাস্য আমাদের
অন্য কোথাও
অন্য কোনো আগামীতে,
কী এমন বেমানান
বলতে চাইছি
তাতে কী বা যায় আসে
জাহাজটা গাছের ওপরে ছিল
নাকি মাটিটা ছিল জলের ভেতর

এক তারা
দো তারা হয় নদীতে
ভেসে যে উঠেছিল
অতীতে একবার
আগামী চলন আমাদের
যদি মন
বলে এইসব
ঘোলাটে বা অরাজক
যদি মন
বলে এইসব
অঙ্গীকারে বা নির্দেশে

আগামী আমাদের
রইল বাতাসে

[*ইনস্টাগ্রামার – যিনি তাঁর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন।]

পুরোনো ঢিমেতাল (Antico Adagio)

আলো কমিয়ে আনো। তারাগুলো প্রকাশ করো। রেকর্ডকে গাইতে দাও; ভাইব্রাফোন; বেহালা; কাঁসর। আমরা তাকে মনোহারিণী ডাকি, গোধূলিতে ফেস্টুনিত ছাদখোলা ঘর। এমন মুক্তাঙ্গনে ডাকি রাত ও তার জীবগুলোকে; প্রতিটা বীট চাকা, প্রতিটা চাকাই উজ্জ্বল। মৃদু টানটান সুরেলা আলো, কখন হঠাৎ প্লাবন। সেই তো সুখী শুনতে যে পায় জঙ্গলের ডাক, ফার্ণের ঝিরঝির, ছলকানো তারা। আমি চেয়েছিলাম এমনই আহ্লাদিত টানটান সুখী আলো গোধূলিবেলায়। চেয়েছিলাম এমনই উদ্ভাস। সানাইবাজানো দীপালোকে তৈরি হল যাত্রাপথের বংশাবলি, বাঁশিতে তারই বন্দনাগীত; শুনতে শুনতে উড়ে যাও। শুনতে শুনতে উড়ে যাও বন্ধুত্বের মতো যেমন আধুনিকতার আরম্ভ, যেমন স্বপ্নের পুরোনো লাটাই স্টিমারকে টানতে টানতে সমুদ্রে। এমন গানের সঙ্গে মিলন, উপল ছড়ানো গান।

মনোহারিণী প্রিয়তম (Pretty Sweety)

ছোট্ট প্রাণীগুলো এইখানে
প্রাণ খোঁজে আর বিষয়বস্তু

হয়তো তাকে এটাই বলে
হয়তো প্রেম প্রাণখোঁজা এক ছোট্ট প্রাণী

বিষয়বস্তু পুরোদস্তুর ওইখানে মুখ দিয়ে
পিঁপড়ে, প্রভাকর আর পশমের সাথে

এই এক বিস্ময়
রোদ্দু্র, পশমালোক আর একটা মুখ

নিসর্গে নিয়োজিত
একটা মুখ নিরত মুকুলে

একটা মুখ লাবণ্য উন্মীলনে

বকলমে পুষ্পিত (A Ghosting Floral)

নত চোখে
পাঠানো হবে

ভুলে যেতে
সবুজের অনন্যতা

তুমি যা ভাবছো তা তো নয়
যখন আমি তাকাই

বীথি আমাকে মানায়

দোআঁশ ছড়ায়
স্খলিত সংগীতে

ছায়াঢাকা চাকা
ডানায় সম্প্রসারণ
করণে, সন্ধানে

দিনটা আমাকে মানায়

তোমার ভিতর
আমার ভিতর বাতাস,

নড়ো না
বাতাস একটু পাক না গতি

বাতাসে এক বাগান (A Garden in the Air)

গ্রীষ্মের টেরাবাইটে তোমার বিস্ময়
এখানে দেখো মাটির ওপর
গড়ছে ভাঙছে ভাসছে
ছায়া দেবে বলে
তখন রুদ্ধ স্বর গজরায়,
দূর কোনো ইঞ্জিন, একটু আরাম
ধ্বনিমগ্ন ছায়ায়,
অথবা ঘণ্টাধ্বনি ধীরে
হারায় যখন দূরে,
আশেপাশের আকাশ জুড়ে
নীল চিত্রক আলোর মতো,
চাপা এক বোধ
কাহিনির মুখের ওপর,
কারো মুখের মানচিত্রে
হঠাৎ বদল
যতটা সময়ে
ঠিক ততটা সময়ে,
আর তুমি ভাবতে থাকো,
মাথার ওপর পূর্বপুরুষের
গুঞ্জন, এই গোধূলির
প্রাণীজ নীলাকরণ
অনুভবে দেখে নিপাট সংখ্যা,
সিলিঙে গোল নকশার মতো,
এখনও তুমি ভাবছো
কীভাবে এই গুঞ্জন
আর সঙ্গতে থাকা সন্ধ্যা,
বিভ্রম নেই কোনো, এক উপাদান
বুনছে, পাক খুলছে
অতিরিক্ত উৎসারণের,
উত্তরাধিকারে পাওয়া দাগগুলো,
যার কথা তুমি বলছো,
পাতা, ঘূর্ণি আর এই যাপন,
গ্রীষ্মের সবুজ তালিকা,
কীভাবে স্বর টিকিয়ে রাখবে
তার কম্পাঙ্ক, সুরবাঁধার মুহূর্ত,
তবু তুমি সব কথা বলতে থাকো,
সমস্ত কথা বলতেই থাকো,
আর এই ঘরের পৃথিবীকে যাও ভুলে,
তুমি যে দেয়ালের কথা বলছো,
এপ্রান্তে থাকা আগুন।

নাগরিক গোধূলি (Civil Twilight)

ইদানীং জীবন অনেক বড়
কঠিন তার পরিমাপ।
এ এক জটিল বাক্য
যে গ্রহে আমরা আছি।
যদি এমন হতো সমস্তটাই জল
পাথরে জলোচ্ছ্বাস।
নুয়ে পড়া পাইনের ক্যাঁচক্যাঁচ
কর্তনী জাহাজের দড়ির মতো
পুরোনো দিনের অবান্তর আবহাওয়ায়।
মহাকাশের এই বলটাই
চিক্কুর হানে শূন্যে।

যদি আমি তোমায় দেখে থাকি
আর সেই আমি বলে
আমার কবিতা বদলাচ্ছে,
তবে আমি বলবো আমার জীবন বদলাচ্ছে।
আমি তাকে স্পষ্ট দেখি যেন বিদ্যুৎলাইন
রেলইয়ার্ডের মাথার ওপর খেলছে বাতাস নিয়ে।
এই নোটগুলো যেখানে আমি আকার পাই
তারপর হাজির হই
বর্তমানের পৃথিবীস্টেশনে, হ্যালো।

এটা এমন কিছু ব্যাপার নয় যে ঘূর্ণিটা
যেভাবে ঘটার ছিল তেমন ঘটেনি।
দাগ লাগা দিগন্ত
অন্য কিছুই হওয়ার নয়।
সেটাই আমি বলছি এখন,
তাই গভীরে চলেছি আরো
আমাকে পোড়ায়
হুইস্কি,
আকাশ এখন রাজা রাতের গভীরে।

কিন্তু আলোটা ছিল ডাইনি আগে,
তাৎক্ষণিক আর চকচকে, ছ ডিগ্রি
দিগন্তের ওপর প্রতিদিন।
সূর্য চলে পৃথিবীর পথে
আমার পশ্চিম বারান্দা থেকে।
ঘাসের ভেতর গান ওঠে
ঘ্যানঘ্যানে জেটের উল্টোপিঠে।
সমস্তই উবে যায় ক্ষয়ে যায়,
নীরবতায় নয় জীবনে।

সমস্তই যদি সংগীত হতো?
দিনটা যদি প্রচলবিমুখ সুরে
আমাদের বলতো, হারিয়ে দিত আমলাতন্ত্র,
যদি আমার উলোটপুরাণ উল্টে প্রস্তাব দিত প্রচলের।
সওয়ার হও, এ তো সঙ্গ দেবে না পুরোটা পথ।
সূর্যটা রাস্তায় নাকি আমিই কেবল ভাগ্যবান।
দিনটা এমনই ছিল।
আর সূর্যের স্থাপিত সত্য।

কবি পরিচিতি:
মার্কিন কবি পিটার গিজ্জি (জন্ম ১৯৫৯) বর্তমানে আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ Archeophonics ২০১৬ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচিত হয়। এছাড়া তাঁর বহু আলোচিত বইগুলি: In Defense of Nothing: Selected Poems 1987-2011 (২০১৪), Threshold Songs(২০১১)। পিটার গিজ্জি ১৯৯৪ সালে অ্যাকাডেমি অফ অ্যামেরিকান পোয়েটস দ্বারা প্রদত্ত Lavan Younger Poets Award এর প্রাপক। তাঁর প্রাপ্ত কবিতার ফেলোশিপ: The Rex Foundation, The Howard Foundation, The Foundation for Contemporary Arts, The John Simon Guggenheim Memorial Foundation এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত The Judith E. Wilson Visiting Fellowship. তাঁর সম্পাদিত প্রজেক্ট: o-blek: a journal of language arts, The Exact Change Yearbook তাঁর সম্পাদিত বই The House That Jack Built: The Collected Lectures of Jack Spicer আর My Vocabulary Did This to Me: The Collected Poetry of Jack Spicer কেলভিন কিলিয়ানের সঙ্গে সহসম্পাদনায়।

Facebook Comments

Leave a Reply