কনক : রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

এমন কালো, যে কোন সফেদ সুন্দরীকে দুয়ো করে নিজে সুয়ো হয়ে উঠবে। আমি ভাবছি কী বিশেষণ ব্যবহার করি! মিশমিশে, কাজল, কৃষ্ণ – যে কোন একটা এই কালোর আগে বা পরে বসলে ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে।

কী দেখছো?

কড়াইশুঁটির থলিটা প্রৌঢ় তুলে নিচ্ছেন আর তার কাঁধের ওপর দিয়ে সে আমাকে শুধলো।

আমি দু পা এগোলাম। দাঁড়ালাম। বললাম, বেগুন। পোড়ানোর মতো। দুটো। পাল্লায় চাপিয়ে মুখ না তুলেই, কী দেখছিলে?

বাজারটা বসে নি এখনো। তারই সুযোগ নিলাম, কী নাম তোমার?

কনক। তোমার?

কত হয়েছে?

বত্রিশ। নিজের নামটা পর্যন্ত ভুললে?

ভুলি নি। ঠিক সময়ে বলবো। যখন থলিটা দিচ্ছে, আঙুলে আঙুলের ছিটে লাগলো। দেখলাম লাল। দেখলাম ভোরের আলতা দুটো পায়ে।

আহত হওয়ার কী বাকি রইলো আমার! চোখ ফিরিয়ে, মুখ ফিরিয়ে, যখন ছেড়ে যাচ্ছি দায়, গলাটা খুব নিচু করে বললো, ফেরত’ও নেবে না?

গোঁফের নীচে দাড়ি আছে, একটা মুশকো মতো মোটরসাইকেল নিয়ে মাঝে মাঝে দেখি, তা তোমার ছেলে, আমি কী করে জানি বলো তো মা!

এই নাও আঠারো টাকা। এখানে রাখলাম। কবে থেকে পাওনা হয়ে আছে।

আমি একটা সিগ্রেট মুখে ঝুলিয়ে খাট থেকে নামলাম। ভোর রাত পর্যন্ত পড়েছি। না পড়ে থামতে পারি নি। সকালে চোখ জ্বালা করছে। বেশ বেলার রোদ। তার সাথে কথার আওয়াজ, অসহ্য।

পাল্লা টেনে মুখ বাড়িয়ে দেখি, অবিশ্বাস্য, কনক কালো। আমাকে এক ঠারে দেখে নিয়ে মায়ের সাথে কথোপকথনরত রইলো। আমি চোখের পাতা থেকে সব জ্বালাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। বরং, তোমরা একটু আস্তে কথা বলতে পারো না, মাকে বলে ঘরের ভেতর ফিরে এলাম। খাটে বসলাম।

ঠকাস করে কী একটা পড়লো। দেশলাই।

দেখার ভেতর একটা দেখা আছে। শোনার ভেতর একটা শোনা।

এই শোনো, আমি তোমার বাড়ি প্রায়ই আসি। মাসীমা ফোন করে বলে দেয় টুকিটাকি কী লাগবে। আমি বাজার তোলার পরে আর ট্রেন ধরার মাঝখানে সময় পেলে আসি। আজ এসে শুনি সনাতন বুড়ো ভোররাতে মারা গেছে। বাজার বন্ধ বলে…

আমি এত কিছু শুনতেও চাই নি, জানতেও। তুমি কি চা খাও? আমি নিজের জন্যে বানাবো, তোমার জন্যও বানাতে পারি।

রান্নাঘরের দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো কনক। মায়ের ঘর দেখা যাচ্ছে। কড়াইশুঁটি ছাড়াতে মা ব্যস্ত।

আমি তোকে ওর কথা বলেছিলাম। কনক। আমি আর উচ্চবাচ্য করি না। মা এতো নাম বলে। বলতেই থাকে।

ভারী লক্ষ্মী। তুই বলেছিলি শীত যাওয়ার আগে শেষ একবার কচুরি খাবি। তাই কনককে বলেছিলাম।

মা কখন ময়দা আর আটা মিশিয়ে রেখেছে। কনক বেসিনে সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছে।

আমি না এই চায়ে চিনি নিই না। তুমি নিলে নিতে পারো।

চিনি ছাড়া চা খায় নাকি কেউ?

অবারিত হাত চিনির কৌটো খুঁজে নিলো। এক চামচ চিনি।

কাপের ঘামবাষ্পে নাক ডুবিয়ে চোখ দুটোকে উজ্জ্বল করে তুললো কনক।

আমি চায়ের সাথে সিগ্রেট নিই। কনক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতো বই, তুমি পড়েছো?

বিশ্বাস করতে হবে? সবার নাম জানো তুমি? বিশ্বাস অবিশ্বাস দুটোই তোমার। তোমার নাম কনক কে রেখেছিলো?

এই যে ঢাউস বইটা, ইস ধুলো পড়া, বাদামী কাগজ দিয়ে মোড়া, নাম বলোতো।

পারবো। কিন্তু তোমার জেনে কী হবে?

আমার নাম কনক কে রেখেছিলো জেনে তোমার হবেটা কী শুনি?

এই বইটার নাম ইউলিসিস। আমি পড়ি নি পুরোটা।

খুব বিশ্বস্ত হাতে বইটাকে ধরলো কনক। খুললো। প্রাজ্ঞ দিদিমণির মতো বললো, ইউ দিয়ে শুরু। এস দিয়ে শেষ। ইস কতদিন বাদে বই হাতে নিলাম।

কী বললে? কিছু না।

কচুরি কী দিয়ে খাবে?

তোমার মাথা দিয়ে

কী বললে, সে তো কবেই খেয়েছো

আমাকে উদ্ধত গোড়ালি দেখিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো কনক।

এই হলো মাথা খাওয়া-খায়ির গল্প।

দেখো বাপু, তোমাকে আমার ভালো লাগে। ঠিক তোমাকে নয়। তোমার এই বাসি বিছানা, ছাড়া কাপড়, ছড়ানো বই, সারা ঘরে সিগারেটের গন্ধ, আমার ভালো লাগে। তুমি আমার পায়ের দিকে তাকালে আমি বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁটি। আমার ভালো লাগে। আমার বুকের থেকে কাপড় সরে যায়, আমার ভালো লাগে। আমি ভিজে যাই, আমার ভালো লাগে।

লাগে তো লাগে বাপু।

কিন্তু তোমার অঙ্গে যাই, সঙ্গে যাই কেমন ভাবে?

বাপু দেখো, কণ্ঠির নিচে তোমার গলা বেয়ে নেমে আসা ঘাম আমার ভালো লাগে। জামা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে বুকের কৃষ্ণ কালো মুখ, আমার ভালো লাগে। হাতের চেটো দিয়ে কপালে অথবা, তালু দিয়ে ঘাড়ে লেপটে থাকা চুল তুমি ওপরের দিকে ঠেলে তুলে দিচ্ছো, আমার ভালো লাগে। তোমার একটাও ভাঁজ না পড়া নিটোল গোড়ালি আমার ভালো লাগে কনক।

কিন্তু তোমার অঙ্গে যাওয়া, সঙ্গে যাওয়া কেমন ভাবে?

এসব যখন ভাবা হচ্ছে, তখন দুমড়ে মুচড়ে দুটো শরীর থেকে আরো দুটো কনক আর গোঁফের নিচে দাড়ি লোকটা বেরিয়ে আসছে। একটা দুপুরে, ফুরনো আলোর শ্বাসরোধ করে রেখেছে যে লাল পর্দা, তারই থেকে চুঁইয়ে নামা একটা আলো কনকের কপালে। আরেকটা লোকটার পিঠে। যেখানে কনকের পানের মতো দুটো ছোটো হাতের পাতা, আঙুলে তামা পেতল।

আলো মরে গেছে। বিছানায় কেউই নেই আর।

লোকটা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ খুলে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে চুপ করে বসে আছে।

কনক ওর তুলসীতলায়। প্রদীপ দিচ্ছে।

যেমন ভাবে যায়, একে অপরের অঙ্গে আর সঙ্গে, ঠিক তেমন ভাবেই মিলমিশের কিছু পৃথিবী হেঁটে যাচ্ছে। কোন যুক্তি নেই। ব্যাখ্যা নেই। যেমন অনেকটা শীতকাল। কনক রস আর গুড় নিয়ে এসেছে।

গুড় মাকে।

রস আমাকে যা, আমি ওর মুখ থেকে ধীরে ধীরে নিজের মুখের মধ্যে পুরে নিচ্ছি।

দুটো অর্ধেক জীবন বেঁটে নিচ্ছি আরো অর্ধেক ভাগে।

যেভাবে নেয়। যারা পারে তারা সকলেই।

Facebook Comments

Leave a Reply