স্বাধীনতার রামায়ণী ব্যাপার স্যাপার : প্রবীর রায়

একই সাথে স্বাধীনতা ও রামায়ণের কথা ভাবতে বসলে, নিজের শৈশব থেকে দেখা নানা ছবি ভেসে ওঠে। রামযাত্রা দেখেছিলাম খুব ছেলেবেলায়। পল্লীর পাশ দিয়ে বয়ে যেতো আদি গঙ্গা। আর তারই পাশে চারটি খুঁটির ওপর টিনের চালা। ওটি ছিল চারদিক খোলা দুর্গা মণ্ডপ।
সেখানেই হয়েছিল রামযাত্রা। সম্পূর্ণ রামায়ণ ধারাবাহিক চলত দিনের পর দিন। ঘুমে বন্ধ হয়ে আসা চোখদুটিকে টানটান করে খুলে রেখে দেখতাম কল্পনার সেই সব চরিত্রগুলিকে। বাজনদাররা গোল হয়ে বসে শুরু করত বাজনা ও গান- জয় রাম জয়রাম জয়রাম, সীতাপতি সুন্দর রাম। যাত্রার শেষে প্রতিদিন নিলাম হত অভিনেতাদের গলার মালার। সবচেয়ে বেশী দর উঠত রামের মালার। গরীব মানুষগুলির মধ্যে দেখেছি এক আকুলতা সেই মালা পাওয়ার জন্য। সেই অভিনেতাদের নিমন্ত্রণ থাকতো বিভিন্ন ঘরে। এক উন্মাদনা থাকত পুরো পল্লীকে ঘিরে মাসাধিক কাল ধরে। এই হল আমার রামায়ণ ভাবনার শুরু। সাধারণ গরীব মানুষের আবেগ বিশ্বাস ভক্তি এমনই গভীর ছিল সে সময়ে।

সেই রামায়ণ ধীরে ধীরে তার প্রভাব অন্যরকম ভাবে ফেলতে থাকল মানুষের মধ্যে। বদলে যেতে যেতে আজ জানি ‘জয় শ্রী রাম‘ একটি রাজনৈতিক দলের শ্লোগান। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে জোর করে বাধ্য করা হচ্ছে এই ঘোষণা উচ্চারণ করতে। যে রামায়ণকে একটি কাল্পনিক কাহিনী কিংবা মহাকাব্য হিসেবে জানতাম, তাকে ঐতিহাসিক কাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখা গেলো। সেটা এমন পর্যায়ে চলে গেলো যেন হিন্দু ধর্মের ঠিকাদারীত্ব নিয়ে নেমে পড়েছে একটি রাজনৈতিক দল।

বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে শুরু করে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার পূজা উৎসবের জাঁকজমক এখন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যখন সারা পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে এদেশে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলি চূড়ান্ত বেকারি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে এনে ফেলেছে, সেই সময় এই ধর্মীয় উন্মাদনা যেন এক অশুভ ইঙ্গিত। আমরা হতাশ হই, যখন দেখি, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত সহ বেশ কয়েকজন রামভক্ত করোনা আক্রান্ত, তখন বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে গোমূত্র পান ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়ার কথা প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি এও বলা হচ্ছে যে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হলেই নাকি করোনা ভাইরাস দূরীভূত হবে।

এও যেন এক নতুন রামায়ণ। ইতিহাসকে অতিক্রম করে যাচ্ছে বিশ্বাস। রামের জন্মস্থানের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মানুষ এবং সংলগ্ন এলাকার প্রচলিত ধারণা আর বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ালো। লকডাউন আর থমকে যাওয়া অর্থনীতির কবলে পড়া অসহায় মানুষের প্রতিবাদের জায়গাগুলিও যেন অবরুদ্ধ হয়ে আছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মানুষ প্রায় ঘরবন্দী হয়ে আছে। সংসদীয় রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলিও প্রায় অচল। সিদ্ধান্ত এবং ঘোষণাগুলিও নিমেষের মধ্যে নেওয়া হচ্ছে। নিজেদের বাঁচানো আর আত্মরক্ষায় ব্যস্ত দেশবাসীর এহেন দিশাহীন পরিস্থিতিতে আজ মনে হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে, প্রাপ্তি আর তার পরিণামে আর এক নতুন রামায়ণ লিখিত হতে চলেছে। সেখানেও ইতিহাস লেখা হবে অন্ধবিশ্বাসকে ভিত্তি করে।

রামায়ণ যেমন রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল, আমাদের স্বাধীনতা ও অনেক আন্দোলন ও বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীকে নিয়ে ইতিহাস হয়ে আছে। হয়তো আজকের অস্থিরতার বীজ ইতিহাসের সেই পর্যায়েই রোপিত হয়েছিল। স্বাধীনতালাভের পর নতুন ভারত তৈরির মূলমন্ত্র স্থির হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, এই ভাবনায়। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান মনস্কতার জায়গা নিচ্ছে কাল্পনিক মহাকাব্য। সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের সঙ্গে জোরদার হয়ে উঠছে প্রচলিত বিশ্বাস ও কল্পকাহিনী, ইতিহাস নয়।

মৌলবাদীদের নিয়ে রাজনীতি করা রাজপুরুষের অনেকদিনের বিলাস। ইংরেজ শাসকদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মাউন্টব্যাটেন নেহেরু জিন্নার বিভিন্ন মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি সবপক্ষই দেশবিভাগ মেনে নিল। পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের দুই প্রান্তে প্রচণ্ড হানাহানি ও রক্তপাত শুরু হয়ে গেল। চার্চিল নাকি মাউন্ট ব্যাটেনকে বলেছিলেন, তোমার জন্য, কুড়ি লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছে। মাউন্টব্যাটেনের ধারণায় তা ছিল দুলক্ষের বেশী নয়। পাঞ্জাবের দাঙ্গা ৪৭’এই শেষ হয়েছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে স্রোতের মত দাঙ্গা হয়েছে। ১৯৪৯-৫০, ৫৪, ৫৫, ৬৪, ৬৫। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থকদের অত্যাচারে বহু মানুষ পালিয়ে আসে ভারতে। কেউ কেউ বলেন, পূর্ববঙ্গের থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বিলুপ্ত করার জন্য এই দাঙ্গা—যাতে পূর্ববঙ্গের পাটজাত রোজগারের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতির জন্য খরচ করা যায়।

হয়তো মাউন্টব্যাটন অত তাড়াহুড়ো না করলে ব্যাপারটা দেশভাগের পর্যায়ে পৌঁছত না। এই দেশভাগ অনিবার্য ছিল কিনা, এ নিয়েও বিতর্ক আছে। ১৫ই আগস্ট নিজের জন্মদিনের বার্তায়, শ্রী অরবিন্দ ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন যে এই বিভাগ কৃত্রিম, উপমহাদেশ আবার এক হবে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনেকেই ভেবেছিলেন, মৌলবাদের আজ কোনও জায়গা নেই রাজনীতির দরবারে। এখন আমরা আবার মৌলবাদের ঊর্ধ্বে উঠে নতুন করে সমগ্র উপমহাদেশে সমৃদ্ধি আনার স্বপ্ন দেখতে পারি। সার্ক হয়তো তারই ভিত্তি সোপান।

কিন্তু ইতিহাসের স্রোত বইল অন্যখাতে। চরম হিন্দুত্ববাদী দল বসল ক্ষমতার মসনদে। সংবিধানের মূলমন্ত্র যেন লাঞ্ছিত হতে থাকল, বারবার। উন্মত্ততায় ভেঙ্গে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত হচ্ছে রামমন্দির। তার শিলান্যাসও হোল ধূমধাম করে, যখন নতুন অর্থনীতির কবলে পড়ে এবং করোনার করাল গ্রাসে ডুবতে বসেছে দেশ। বেকারি আর দুর্মূল্য পণ্যের সাঁড়াশি চাপে পরিত্রাহি অবস্থা দেশবাসীর।

স্বাধীনতার রামায়ণে পরিণতি কী? সে কী হিন্দু রাষ্ট্র গঠন? সেই উৎসাহেই কি দেবতাদের নামে রাজনৈতিক শ্লোগান? পরবর্তী ধাপে কি প্রতিষ্ঠিত হবে ব্রাহ্মণ্যবাদ? নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি অত্যাচার কি আমাদের পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? রামমোহন বিদ্যাসাগর সহ বহু চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা কি ভুলে যাবে দেশবাসী? রামকৃষ্ণের ভাষায় এখন শুধু প্রার্থনা করতে পারি – তাহাদের চৈতন্য হউক।

Facebook Comments

Leave a Reply