প্রথম কাব্যকথা ও ভারতীয়তা : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
ইস তুমি অ্যান্টি–ক্লকওয়াইজ হাঁটছ কেন সিসিফাস
জানোনা—পৃথিবী নামের জগদ্দল পাথরখণ্ডটি আদতে ধীরগতিতে পুবমুখে গড়ায়
লাল সিগন্যাল ঠুসে দিলেই তো হতো—স্থাণু হয়েই থাকতো বারোমাস।
বাক-স্বাধীনতা কি সত্যিই একটি আধুনিক কনসেপ্ট? ধন্দ হয়। প্রথম কাব্যের গুটিকয় বিষয় নিতান্তই আকর্ষণীয়: ওই যেমন—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে, ভারতবর্ষে—সাধারণ জনতা ওরফে রজকও দিল খোলকে বলতে পারত! আইজ্ঞা—রজক! য়ুনিভার্সিটি গলে আসা আমরা যদিও এই পোস্টমডার্ন সময়ে সেই উচ্চতায় পৌঁছতেই পারি না। উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগেও পসন্দ আপনি-আপনি মন্ত্র অনুসারে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার স্ত্রী-স্বাধিকার স্বীকৃত ছিল। যদিও, দুর্জনে বলে যে সেই ছুতোয় পৌরুষ প্রদর্শনের বিপুল মান্যতা ছিল। কিংবা ওই যেমন—বিচারের রায় প্রকাশের মুহূর্তে বকুলের ছাড়া পাওয়া কিংবা করবীর সাড়া দেওয়া সত্ত্বেও মাধবীর, থুড়ি, ভাস বিরচিত প্রকৃষ্ট সর্বগুণসম্পন্ন উত্তমপুরুষের—সে কী অপরিসীম দ্বিধা, পেণ্ডুলামসুলভ দোলাচল বৃত্তি! বহু শতাব্দী, তা প্রায় আঠারো শতক পরে, ইংলিশ মহাকবি শতপ্রতিশত একইরকম “টু বি অর নট টু বি” জিজ্ঞাসাটি ঠুসে দিলেন হ্যামলেটকুমারের বুকে! বস্তুত, ওই কাব্যগাথাতেই সর্বপ্রথম ‘শ্রেণি-বিভাজনের‘ আঁচ পেয়েছি। হৃদয়কমলের সৌরভ নিবেদন করিলেন অন্তজা এবং ভয়ংকর ভাবে প্রত্যাখ্যাত, ভর্ৎসিত এবং কর্তিত-অঙ্গ হইলেন। অর্থাৎ—শ্রেণি-স্বার্থের গণ্ডিটিকে, সেসময়ে, অবশ্য মান্য গণ্য করা হত। লঙ্ঘন করিলে চূড়ান্ত শাস্তি বরাদ্দ হইত। তা সত্ত্বেও, গণ্ডিটি ভাঙ্গিয়া ফেলার প্রবণতাটিও বেশ ব্যাপক এবং (এ যুগের মতনই, সে-যুগেও) শিল্প-সাহিত্যের খুল্লমখুল্লা চর্চা-বস্তু হয়ে উঠেছিল। গণ্ডি ভেঙ্গে ফেলা মাত্র প্রাণাধিকা (বিদেশি রাজা কর্তৃক) অপহৃত হইলেন। অর্থ হয়, বিদেশিরা ভিনদেশীয় ব্যাপারে কড়া নজর রাখিতেন। সুযোগ খুঁজিতেন। চৌকাঠ ডিঙ্গানো মাত্র খপাৎ। নিন্দুকে বলছে অবশ্য যে (হাল আমলে) নীরব-মেহুল-মাল্লারা নিয়ম-টিয়মের গণ্ডি ভেঙেই মারের সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ গমন করেন। ইস! ভূমিকাতেই সবকিছু উগরে দেবে নাকি? অতএব,—নেক্সট প্যারা… –
অর্থাৎ, এক্সটেন্ডেড দৈব-কাণ্ড। একটা দেশকে (পড়ুন, ইরাক) আক্রমণ, হড়প বা চাবকে ঠাণ্ডা করতেও আজকাল আর ‘লড়কে লেঙ্গে…’ কিংবা ‘করেঙ্গে ইয়া…’ বলে একাই ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। পড়লেও কোনো লাভ নেই; যেহেতু, সবুরেও মেওয়া ফলে না। (UNO-র শিডিউল অনুযায়ী) রামায়ণীয় তরিকায় এখন, ষাট-ষাট্টি দেশের জোটবদ্ধতা, গণতান্ত্রিকতা জরুরি। শ্রীরামচন্দ্রও অমনই বালী-সুগ্রীব-হনুমানের সাহায্য-সঙ্গ-সাহচর্য পেয়েছিলেন। তবে—সমস্যা হতে পারে যদি কেউ মুখ ফসকে রজকগিরি করে যে—বায়োলজিক্যাল অস্ত্র কি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল? অক্ষম, সামর্থ্য নেই। রেভন্যু যদি কমে যায়, তাই—মিডিয়াও সালিশি-উকিলিতে গররাজি! এমনকি, ILO-ও “অগ্নিপরীক্ষা’এড়াতে চায়। সুতরাং—হে সাদ্দাম, পাতাল-প্রবেশ করো এবং নিজ গর্তে প্রবেশান্তে সাংসারিকতার ‘ওরা-আমরা’ ভুলিয়া যেও।
তিনশো রামায়ণের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক এ.কে.রামানুজম। শুধুমাত্র সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, তবে অবাক হতে হয় যে প্রায় দশ-বারো শতাব্দী ধরে, শুধু ভারতবর্ষ নয়, দখিন ও দখিন-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মনন-চিন্তন-সংস্কৃতিতে নিজস্ব চিহ্ন রেখেছে। এছাড়াও কয়েকটি য়ুরোপীয় ভাষাতেও রামায়ণ অনূদিত হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিকতায় রামায়ণিক আদর্শ তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি বা রাজনীতির মার্গ দর্শন হয়ে ওঠেনি। সভ্যতার ঊষাকালেও নাগরিকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আয়োজন প্রাচীন রাষ্ট্রপ্রধানের অবশ্যকর্তব্য ছিল। কিন্তু বিবর্তনের হাজার হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে আসার পরেও, জনকল্যাণের লক্ষ্যে, ২০২০-র আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে স্বাস্থ্য–শিক্ষা-সংস্কৃতি খাতে, নাম-কা-ওয়াস্তে, বাজেট বরাদ্দ করা হয়। তখন আই.এম.এফ নামের অর্থনৈতিক দাদাগিরি ছিল না। যে সংস্থা নিয়ে এতো কচকচি—সেই WHO ছিল না! রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব-স্বাতন্ত্র্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য প্রতিস্পর্ধী ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক /WTO/ILO/UNO ছিল না কিংবা তৃতীয়বিশ্বের প্রতিটি দেশের ঘুমিয়ে পড়া মুমূর্ষু অর্থনৈতিকতার বিকল্প সঞ্জীবনী সুধা গোছের বিশ্বায়নী শিকড়টির অস্তিত্ব ছিল না।
আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচিতি হল ‘গ্লোকাল’। অর্থাৎ, একালের গ্লোবাল বিশ্বে প্রতিটি নেশন-স্টেটের লোকাল অবস্থিতি। মাইল মাইল পথ অতিক্রম করে আসা বিবর্তিত আধুনিকতার এমন দ্বিপ্রাহরিক মধ্যাহ্নে প্রাচীনকাল = রাজতন্ত্র = রাজ – সার্বভৌমত্ব নয়তো রাজসিক সুশাসনের কল্পনা! হা, হা—আমরা সুস্থিত তো? একুশশতকীয় রাবণ কোনজন? দারিদ্র্য নয় কি? চীনা মাল ডাম্পিং, ব্রেক্সিট ও সর্বশক্তিমান মার্কিনী ক্যাপিটালিজমের লেজ গুটানো হাল–হালতে এবং সর্বব্যাপী বাজার-ওমনিপোটেন্সির এমন দিনদাহাড়ে এবং (খোদ রাষ্ট্রব্যবস্থারই মহা সংকটকালে) রাজতন্ত্রের কথা পাড়া কি বাতুলতার নামান্তর নয়?
হয়তো নয়, যদি ‘রামরাজ্যে’র অর্থ হয় “শাসনতান্ত্রিক” সুচেতনা; বহুজনের বদলে ‘সর্বজনহিতকর’ শাসনতান্ত্রিকতা ও ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-বিশ্বাস নিরপেক্ষতা; এবং সর্বোপরি—যদি ’রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার অর্থ হয় দারিদ্র্য দূরীকরণ। তবে তো একই নিঃশ্বাসে উল্লেখনীয় যে সেই রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠার কথা গান্ধীজী বহু আগেই, বহুভাবেই বলেছিলেন। আধুনিক গণতান্ত্রিকতায়, (দশে মিলি করি কাজ-এর আবহে) রাজপুরুষের মহানুভবতার সুযোগ কোথায়? রাজতন্ত্র হল এমন এক ব্যবস্থা যেখানে রাজাই আইন-প্রণেতা কাম আইনের রক্ষাকর্তা কাম সর্বময় অধিকর্তা। রাজা প্রজানুরঞ্জক হতেও পারেন। নাও হতে পারেন। পিতৃ সুলভ আচরণ, জনসেবার্থ জীবনযাপন ইত্যাদি সম্পূর্ণতই—তার নিজস্ব মর্জি। দেশ-কাল-রাজত্ব সুরক্ষায় রাজাকে যুদ্ধ করতে হত, দোষীকে শাস্তি দিতে হত, সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে হত। ধর্মশাস্ত্রানুসারে। এই শাস্ত্র, আদতে, একটা কোড অব কন্ডাক্ট। (সেসময়ে) ধর্মের অর্থ ছিল সততা। যাপনচিত্রের অঙ্গ ছিল ধর্ম। পরিভাষায় যা righteousness। ধর্ম = ধর্মপুস্তকের অনুশাসন নয়। বরং সর্বভারতীয় জীবন-চরিত-মার্গ। Hindu way of life, Hindu religion নয় — যে পদ্ধতি ঠিক করে দিত আদর্শ রাজতন্ত্র কী, রাজত্ব কী, রাজা কেমনতরো, সতীত্ব কী বা ভক্তি বস্তুটি কী বা কেমনতর! সে যুগে রাজার আদেশই ছিল আইন। আইন প্রণয়ন নাগরিক কর্তব্য ছিল না। এ-যুগের আইন প্রণেতা হল পার্লামেন্ট। ‘বাই দ্য পিপল’ শাসনপ্রনালী। রাজার জায়গা কোথায়? আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত হয় আইনসভার সদস্য। আধুনিক স্টেট ক্রাফট বা রাজ্য পরিচালনায় শাসনক্ষমতাধর ব্যক্তি চরিত্রের ধর্ম-অর্থ-মোহ-কাম কতখানি জরুরি বা প্রতিফল–প্রদায়ী? আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি? মন্ত্রী-অমাত্য ছিল বটে তৎকালে। কিন্তু রাজা ছিলেন একাই একশো। সবকিছুই তার ইচ্ছা নির্ভর। রাজা চাইলে কারখানা বসাতে পারতেন, করমুক্তি ঘোষণা করে ‘কালকেতু’ হতে পারতেন কিংবা দিন-এ-এলাহি প্রচার করে বাদশাহ হইতে পারিতেন। তিনি জিজিয়া কর-ও চাপাতে পারিতেন কিংবা অপার গণতান্ত্রিকতার সুযোগে নির্বাচিত হয়ে হিটলারি আতঙ্ক হইতে পারিতেন। রাজতন্ত্র-সামন্ততন্ত্র-সমাজতন্ত্র-সামরিক-ধন বা গণ : সভ্যতার পাঁচ হাজার বছর পরেও কি আমরা তন্ত্র ও তান্ত্রিকের মায়াজালে আবদ্ধ থেকে যাব? আর্থ-সামাজিক রক্ষাকবচ কি হস্তগত, ইতিমধ্যেই সংগৃহীত? আ-বিশ্ব কোথাও? পরীক্ষিত হয়েছে অনেককিছুই:–সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কিংবা সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু, পৌর্ণমাসী কলঙ্ক ঘোচে কই? তাই, এক টুকরো নিজস্ব কবিতার সেই পুরনো ভাঙ্গা কাঁসিটিই বাজাই বরং,ফের:—
‘টার্নিং পয়েন্ট-ই নেই কোনো সামন্ত-ধন-সমাজ-সাম্যের চর্চিত বাদানুবাদে
যাযাবর বৃত্তি আমাদের ,চরৈবেতি,বৃত্তাকার কক্ষপথে
বিশ্রাম মাঝেসাঝে, নানান ইজমের তোবড়ানো— রক্তক্ষয়ী ঢালে…’ [পদ্মলোচন, (অন্ধ) কৃত্তিবাস-২০১১]
কিংবা — অতি প্রিয় ওই নিজস্ব পংক্তিটা—
“দুশো বাইশ পেরুলো বয়স ফরাসি বিপ্লবের / সাম্য এখনও ভোরে দেখা মিষ্টি স্বপ্ন
না,অন্য কিছু নয়।’… (জবানবন্দি—বই ’হেমন্তের জামিয়ার’) ।
চারিত্রিকতার ক্ষেত্রটি বাদ দিলে, রামায়ণের প্রধান উপজীব্য হল যুদ্ধ কাণ্ড। রাজ্য-রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিকতায় রামায়ণিক সাংস্কৃতিক দর্শন বা সাহিত্যের দিশা-দীক্ষা-দিকনির্ণয়ের ক্ষেত্রে অথবা সামগ্রিক রাষ্ট্র বা রাজ্যপরিচালনায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি। দ্বিতীয় শতকে ভাস কিংবা পরবর্তী সময়ে কালিদাস, কুমারদাস, ভবভূতি, মুরারি, রাজশেখর বা কবি কৃত্তিবাসকেও বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনী অনুপ্রাণিত করেছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনন-চিন্তনে গভীর, গভীরতর ছাপ ফেললেও, ভারতীয় রাজনৈতিকতার আদর্শ গঠনে বিশেষ ক্রিয়াশীল ছিল কি? আমরা জানি যে দেশীয় রাজা-প্রজা বাহিনীকে একত্রিত করেই রাম (যুদ্ধার্থ) লঙ্কায় পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সেই জোটবদ্ধতার বাস্তবায়ন ভারতীয় রাজনৈতিকতায় প্রায় দুর্লক্ষ্য বা অনুপস্থিতই বলা যায়। বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক একীকরণ ঘটেনি কোনোকালেই। পুরুর সময়েও ঐক্য ছিল না, পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময়েও (ঐতিহাসিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় উদ্ধৃত মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজাবলী’ অনুসারে) শিহাবুদ্দিন ঘুরীর বিরুদ্ধে ‘প্রতাপশালী’ ভারতীয় রাজন্যবর্গ একজোট হতে পারেননি। এমনকি, (অধিকাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সহযোগে গড়ে তোলা) ২২০০ জন ব্রিটিশ সেনার মোকাবিলায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি সৈন্য মজুত থাকা সত্ত্বেও পলাশীর প্রান্তরে করুণ আত্ম-সমর্পণের ইতিহাস লেখা হয়েছিল। সরল সত্যটি হল যে (যুদ্ধকালে) ভারতীয় রাজধর্ম বাল্মীকি মহাকাব্য কথিত চারিত্রিকতা, কলাকৌশলগুলোর অনুসরণ ও আত্তীকরণ তো করেইনি—এমনকি, দেশ-কুল-মান রক্ষার্থেও আমরা একজোট হতে পারিনি; বাঁদরের মধ্যস্থতায় কেবল রুটিটি খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। রামায়ণ একটি গীতিকাব্য ছিল, গীতিকবিতাই রয়ে গেছে। আদর্শ-প্রতিম ছিল, আদর্শ-প্রতিম হয়ে দেওয়ালে–দেরাজেই রয়ে গেছে।
রামায়ণ হল আদিকবির আদিকবিতা। কবিতার উৎস—সঙ্গমরত দুটি পাখির হত্যা। অর্থাৎ, দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা। বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। ব্যথা দীর্ণ কবি শাপশাপান্ত করেন। সেই বেদনা সঞ্জাত অনুভবেরই ফসল হল ‘রামায়ণ’ — যে মহাকাব্যের পরতে পরতে রয়েছে ব্যথা-বঞ্চনা-বিবাদ-বিষাদ-অবিশ্বাস-যুদ্ধ ও রাক্ষুসে নৃশংসতা। নিষাদীয় দুষ্কর্মের নিন্দা করেও আদিকবি, প্রকৃতপ্রস্তাবে, (কল্যাণকামী হলেও ভয়ংকর) যুদ্ধকাব্য রচনা করলেন। আজকের যুগ হলে ষাট দলীয়-বহুদলীয় রাষ্ট্র বা কর্পোরেট সংস্থা নিন্দিত হয়ে যুদ্ধবিষটিই হয়তো পরিত্যক্ত হত। UNO-র (1945) যুদ্ধবিরোধী চার্টারে বলা হয়েছে — The members of the Organization shall abstain, in their international relations, from resorting to the threat or use of force …”। যুদ্ধ কাণ্ডটি বাদ দিলে একালের আ-বিশ্ব গণতান্ত্রিক আচার-আচরণের দ্বি-প্রহরে প্রথমকাব্যকথাটি কেবলমাত্র একটি চারিত্রিক অণুবীক্ষণে পরিণত হয়ে যায় না কি? কিন্তু, সেখানেও প্রাণের স্পন্দন নেই, অনুসরণ নেই। ধরা পড়ে বরং ব্রিটিশ কুশাসনের অন্ধ অনুকরণ! ভেদ-বিভেদের নতুন প্রাচীর:—NRC— বা সংখ্যাতাত্ত্বিক রেজিস্টার গোছের অনুশাসন।
মনে পড়ে—রাহী মাসুম রাজা-র মহাভারতীয় সিরিয়াল। মহাভারত সিরিয়ালটির চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। ‘ম্যয় তুলসী তেরে অঙ্গন কি’ ছবির সংলাপের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন, ১৯৭৯-এ। তুলসী এবং একজন মুসলমান। সবকিছু তালগোল পাকালো কি? ইয়েস, ওই গোলকধাঁধাই ওয়াজ মাই ইন্ডিয়া। আ ওয়ান্ডারল্যান্ড। লোকে বলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। অর্থাৎ, মহামানবের মহাসাগরে লীন দেয়া ও নেয়ার আবহ। মনন-চিন্তনের বার্টার-সিস্টেমের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক একীভূত সম্মেলক সংস্কৃতি। কিন্তু, আমার এখতিয়ার তো—স্বাধীনতা ও রামায়ণ। কিন্তু, শাস্ত্র বলছে যে আরব্ধা হি সমাপ্তৈব,…শুরু করিলে শেষ করিতে হয়। কথামানবী লিখেছেন বটে যে “স্ত্রীকে পণ রাখবার অধিকার কে দিল স্বামীকে?’ তবু—দুর্বাসার জন্য দ্রৌপদী নতুন করে রান্না চাপায়নি। বস্তুত, সেটিই ছিল নারী জিহাদের দ্বিতীয় উদাহরণ। বিস্ফোরক ওমেন্স লিব! অর্থ হয়, নারীমুক্তির বিষয়ে অন্তত—ইয়োরোপ একটি কপিক্যাট। নির্ভেজাল টুকলিবাজ।
হে উত্তরাধুনিকতা, এই ওল্ড-এজ হোমের যুগে, ‘হম দো-হামারা এক’-য়ের মতো অ্যাটমাইজড্ পরিস্থিতিতে পিতরি প্রীতিমাপন্নে নিয়োজিত মনন-চিন্তন কি খানিক দুচ্ছাই-অচল নয়? ধন্দ রয়েছে কি ? তাহলে, চেক ও রি-চেক পদ্ধতিতে একটা নয়, দু-দুটো (তলিয়ে থাকা, নীচের সারির) ভাত টিপে দেখব। বিন্ধ্যাঞ্চল কিংবা দখিন ভারত জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে বনাঞ্চলেই অজস্র মুনি-ঋষিগণের তপোবন ছিল। বাল্মীকির আশ্রম ছিল অরণ্যছায়াঘেরা। শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠত প্রকৃতির গভীরতায়। হালে—উত্তরাধুনিক পশ্চাৎপটে,পরতে পরতে আধুনিকতার প্রাচীর-পরিখা উঠতে শুরু করেছে যদিও অত্যাধুনিক এ সময়ে। ঢের ঢের জায়গায়, প্রায় সারা দখিনভারত জুড়ে প্রশ্নহীন প্রতিপত্তি ছিল বানর-প্রজাতির। নল ও নীল উপাখ্যানের সূত্রে জানা গেছে যে প্রকৌশলী বিদ্যায় অভ্যস্ত, চূড়ান্ত পারদর্শী ছিল তারা। উপসাগরীয় দখিন ভারত অঞ্চলে রাক্ষস-খোক্কসেরও অবাধ বিচরণস্থল ছিল। সবিশেষ লক্ষণীয় যে রাবণ উড়ে এসেছিল। সুর্পণখা এবং মারীচও হাজির হয়েছিল উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে। তবে কি সে-যুগেও সীমান্ত হীনতা ছিল। অবাধ গতায়াত; বিধিনিষেধের তেমন কড়াকড়ি ছিল না সেকালের ভারতীয় উপমহাদেশে অথবা মায়াবী-অনাচারী-দুরাচারীরা (রাক্ষস-খোক্কসেরা) বিমানযোগে বা মন্ত্রবলে ইচ্ছামতো যেথাসেথা যেতে পারত। কল্পকথার দুনিয়া থেকে বাস্তবের ইতিহাস কথায় পৌঁছলে অবশ্য অবশ্য দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মজুদ্গি নজরে পড়ে!
ভুবনায়ন কি আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্কৃতির বাইনারিজমের মূলেই কুঠারাঘাত করছে না? ব্রেক্সিট কি শুধুই ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সমস্যা? মজার কথা হল যে বিশ্বায়ন পরবর্তী দুনিয়ার অত্যাধুনিক পরিস্থিতি এমনই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে একটি রাজনৈতিক বর্ডারের পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক র্যানডক্লিফ লাইন-ও টানা দরকার হয়ে পড়েছে। হাইপার-গ্লোবালিস্টরা মনে করেন শেষমেশ সবকিছুই এক বিশ্ববাজারে লীন হয়ে যাবে। অপরপক্ষে, স্থিতাবস্থা-বাদীরা মনে করেন যে রাষ্ট্রগুলো নিশ্চিতই বহু দেশীয় আর্থ-সামাজিক ও টেকনোলজিক্যাল গতি প্রকৃতির বিষয়টি সামলে নেবে। আদতে তো বর্ডারলেস বিশ্বের, সীমান্তহীন দুনিয়ার বহ্বারম্ভ, তার বারফট্টাই-য়ের দিনকাল অস্তমিত। চীনা পণ্যের আমেরিকায় প্রবেশের ওপর চড়াদামের শুল্ক চাপানো হয়েছে। চীনা জিনিস এবং চীনা মূলধন ভারতে নিষিদ্ধ হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক স্বপ্নেরা একসময়, হোলটাইমারের মতন, সর্বহারাদের নিত্যঘুমে রাতদিন দেওয়াল লিখত, সদলবলে। কেন যে বারবার মনে হয়—খোলাবাজার হয়তো জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিপন্থী—স্বদেশিয়ানার মৃত্যুঘন্টা কি দ্রিমিদ্রিমি,ধিকিধিকি বাজতে শুরু করেছে: করোনা-পরবর্তী আবহে, কবিগুরুর বিশ্বজনীনতা, ইউনিভার্সাল মানব-এর আদর্শ বোধহয় পিছনপানে ভীত-সন্ত্রস্ত দৌড় লাগিয়েছে !
হাতদুটো ক্রীতদাসের
গন্তব্যের জটিলতায় পা দুটি জড়, আজন্ম কয়েদী নেত্রদ্বয়। নাম—সিসিফাস ।
স্তব্ধ হয়েছে উৎপাদন! গ্রোথরেট খাল্লাস
আপাতত নোজ-ডাইভড্ মাইনাস (-2 +)
অ্যান্টি–ক্লকওয়াইজ হাঁটছে ভারত
তারস্বরে ফুঁসছে জোকার, হুলুধনি, হেথা-
হোথা শাঁখেও পড়ছে ফুঁ, অনবরত, বৃষ্টিও এসেছে মিছিলে, পুষ্পবৃষ্টি ঢিমা
রাজতন্ত্র ছেড়ে, সামন্তবাদ পেরিয়ে এমনকি সর্বহারার সোভিয়েত রাষ্ট্রতন্ত্রকে পিছনে ফেলে সারা পৃথিবীর বহুলাংশই এখন অংশভাগ গণতান্ত্রিকতার দিকে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। এখনও ওই অতি পুরাতন রাজতন্ত্রের ভাবধারাকে রাষ্ট্র রাজনীতির প্রধান উপজীব্য হিসাবে জিইয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? ভারতীয় শাসনব্যবস্থা বেপথু না হওয়ার রক্ষাকবচ হিসাবে পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিকতা রয়েছ। স্বীকৃত সংবিধান রয়েছে। ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপলস রয়েছে। সর্বোপরি, নির্বাচনী বিধিব্যবস্থা রয়েছে। প্রায়োগিক দিক থেকেও বিচার-শাসন-আইনের ত্রিধারার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সুতরাং, বিশ্বায়িত বিশ্বের জনগণতান্ত্রিক সমাজে সুপ্রাচীন রাজতন্ত্রের পৌরাণিকতার আবাহন কি শূন্যে সৌধ নির্মাণ নয়? একমুখে ’হাইপার মর্ডানিটি’-র স্তোত্র আওড়াব আর অন্য মুখে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-চতুর্থ শতকীয় রাজধর্ম প্রবর্তনের ভজনা করব—এমন দোটানার ভজন-পূজন কেন? কেননা, যুদ্ধ এখন বড়ো প্রয়োজন, তাই তো বাজারময় যুদ্ধ-বিশ্বায়ন, এতো অনাহার, অর্ধাহার, করোনা-আবহে কয়েক মিলিয়ন জব-লস; তবুও—জাতিবাদের প্রসাদী চড়ে, (পুনর্জীবিত) জাতীয়তাবাদের ধ্বজা ওড়ে, ধর্মীয় অন্ধত্বের জিগির ওঠে, নানান কিসিমের ‘গ্লোকালাইজড্’ টুকরা টুকরা ‘হিংস্র’ গ্যাং-য়ে ভরে যায় দেশ; এখন যুদ্ধ-ঐকতান: যুদ্ধে এখন বিশ্ববাসীর সমবেত যোগদান। পারস্পরিক সহযোগিতা, আদান-প্রদান, দিবে আর নিবে’-র বৈচিত্র্য-বিভিন্নতা গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও। সহমর্মিতার নিঃশর্ত ইন্টিগ্রেশনের বদলে ঘটছে অবিশ্বাসের লঙ্কাকাণ্ড? আদতে, এ হল পোস্ট-ট্রুথের সময়! পোস্ট-ট্রুথ হল সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা মানুষের আবেগকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে; যার সঙ্গে তথ্য-বিশ্বের কোনো আত্মীয়তা নেই, নীতি ও ন্যায়বোধের কোনো স্বীকৃতি নেই। স্রেফ জুকারবৃত্তি। মিথ্যার আশ্রয়।
যা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি তা হল ফরাসি বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের পতাকায় ইকুয়ালিতে-ফেতারনিতে-লিবারতির আদর্শের সঙ্গে ডেথ বা মৃত্যু-র উল্লেখও থাকত। পরে সেই অংশটি মুছে দেওয়া হয়। গণতন্ত্রের অর্থ হল সবার যোগদান, মানুষে-মানুষে সম্পর্কের টলটলে স্বচ্ছতা। পাশাপাশি বিশ্বায়নের অর্থ হল ভাব-ভাবনা-মূলধন-পণ্য ও মনুষ্য–প্রজাতির অবাধ গতায়াত। বিশ্বায়ন অর্থাৎ বসুধৈব কুটুম্বকম। স্বাধীনতা পাবার অব্যবহিত পরেই ২৩০ বছর পুরোনো ইকুয়ালিতে-ফেতারনিতে-লিবারতি ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক–সামূহিক মঙ্গলকামনার বিষয়গুলিকে সাংবিধানিক স্বীকৃত দিয়েছিল ভারতীয় প্রজাতন্ত্র। এমার্জেন্সি কালীন বিধি লঙ্ঘন বা গণ্ডি পার করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। রাজকীয় উপায়ে নয়, সাংবিধানিক পথেই আপামর জনতা সেই দুরাচারের প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছিল। রামায়ণের বড়ো অংশ জুড়ে যুদ্ধ ভাবনার অবস্থান। বর্তমান সময়ে—দুটি দেশের মধ্যে আন্তর-রাষ্ট্রীয় ‘ডুয়েল”-এর আয়োজন কি সম্ভব? এসময়ের যুদ্ধ কি অন্তর্দেশীয় অবিচার-অন্যায়-ভুখমরি-‘বন্ডেড’শোষণের বিরুদ্ধেই কাম্য নয়? ৫০০ কি.মি পথ মানুষ হেঁটে অতিক্রম করছে: গ্রেট এক্সোডাসের কতো হাজার বছর পরে? তাঁকে পথচারী বলব কি করে? আজ আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সহযোগিতা-সমমর্মিতা নাকি অবিশ্বাসের লঙ্কাকাণ্ড!উপসাগরীয় যুদ্ধের তেল চিটচিটে সামুদ্রিক পাখি নাকি “পৃথিবীর পরে ওই নীলাকাশ” !
সে এক সময় ছিল যেখানে আর ফিরে যাওয়া যায় না। সাইকেলের চাকার মতন ঘুরত শাঁইশাঁই ৭৮/৪৫/১৬ আর.পি.এম। দণ্ড-পল-অনুপল অনুযায়ী পিন ঢুকে পড়ত গানের এলাকায়, সুর-তাল-লয়…সে এক সময় ছিল যখন রাজতন্ত্র ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। দূতিয়ালি, সরেজমিন যাচাই-অনুসন্ধানের প্রাচীনতার বদলে ক্যালিফোর্নিয়ার ঘটনার খবর চোখের পলকে আ-বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। রাবণ-শকুনি-দুর্যোধনের বদলে দুনিয়ার কোণে কোণে ট্রান্স-ন্যাশনাল কর্পোরেশন বা TNC’-র উদয় ঘটেছে। চিনের পরিকল্পিত “অর্থনৈতিক’ রণনীতিতে টলোমলো-প্রায় মার্কিনী বাজার-বিজ্ঞান। ইওরোপ জুড়ে চীনা পণ্য বহিষ্কারের দাবি উঠেছে। ViVo একবছরের জন্য আই-পি-এল থেকে বিতাড়িত। এইসব উত্তর-ঔপনিবেশিক, উত্তরাধুনিক বা নব্য-সাম্রাজ্যবাদ জাতীয় আধুনিকতম হেঁয়ালিগুলোর কোনো সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কি প্রাচীন কাব্যসাহিত্যগুলোয়? (জলপথে নয়, আকাশপথে বরং) ললিত-মাল্লারা নীরবে সটকে পড়লেন—আকাশপথেই করোনা-সাপ উড়ে এলো, কেঁচো-জ্ঞানে আমরা দুয়ার খুলে দিলাম। ডিমানিটাইজেশনের অর্থ বুঝিনি। কিন্তু গ্রোথ রেট নাকখত দিচ্ছে শুনেছিলাম। টাকার নাভিশ্বাস আগেই উঠেছিল, ২০১৯ থেকেই শূন্য ভাঁড়ার হিক্কা তুলছিল—রাবণ সুলভ এইসব হালফিলের সর্বভারতীয় সমস্যা, অর্থসঙ্কটগুলোর সঠিক মোকাবিলার জন্য আদিতম কাব্য সাহিত্যে কি কোনো পথনির্দেশ রয়েছে? এখন যে যুদ্ধ জারি আছে সেগুলোয় গোলাগুলি চলে না, অ্যাটম-বর্ষণ হয় না, কামান-তান বা মর্টার-গান শোনা যায় না, বরং পণ্য-বারিপাতের ও ঝরঝর বরষা! আদুরে নাম রেখেছেন ওরা – ডাম্পিং। আমেরিকা–ব্রিটেনের নাভিশ্বাস উঠেছে। (অর্থনৈতিকতার বিশ্বভারতী-তে) ভারত পাঁচিল তুলেছে। চীনা টমাস রো-বাবুরা আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় ভিড় বাড়াচ্ছেন।
সেযুগেও আধুনিক ক্যাবিনেট সিস্টেমের মতন মন্ত্রীপরিষদ ছিল। ‘মহাভারতীয়’ রাজা শক্তিমান ছিল কিন্তু সর্বশক্তিমান ছিল কি? রাজ্য-পরিচালনার ঢেরগুচ্ছের নীতি নির্দেশ, রাজকর্তব্যের ব্যাপারে অনেক বিস্তারিত ডু’জ অ্যান্ড ডোন্ট’স, বস্তুত, মহাভারতে রয়েছে। রামায়ণী অনুশাসনগুলো কিন্তু চারিত্রিক ও ন্যায়নীতির নৈয়ায়িকতা। ব্যক্তিগত আচার-আচরণের বিষয়। তবু রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। বলা হয়েছে স্ত্রীজাতিকে রক্ষা করা পুরুষের ধর্ম। ইউনিভার্সাল ফ্রাঞ্চাইজ প্রবর্তনের পরে সেই ধারণা খানিকটা টোল খেয়ে যায় নি কি? প্রাচীনযুগের মহিলাদের আর্থ-সামাজিক পরস্মৈপদী গঠবন্ধনের সঙ্গে পোস্টমডার্ন মহিলার আর্থ-সামাজিক হাল-হালত-হকিকত কি একই লেভেলে রয়ে গেছে? মহিলারা কি আজও কৈশোরে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র? আধুনিকার স্তর-বৈভিন্ন্যের দিকে তাকালে পাই প্রাচীনা তিনি ‘গণ্ডি”-সমাদৃতা; মধ্য দিনমানে অসুর্যম্পশ্যা, উত্তরখণ্ডে বহুবর্ণবিভূষিতা : প্রথমাবস্থায়–মা। ভার্যা-গৃহিণী-মাতৃস্বরুপিনী। তদনন্তর সমানাধিকারী ভোটার-ললনা; এবং ততপশ্চাৎ স্বাধীন, স্ব-উপায়ী, স্বাধিকারী—রাষ্ট্রকর্মে নিয়োজিতা। ইবসেনীয় ডলস্ হাউস-বন্দি নন তাঁরা, একুশের মহানগরবাসী, মহানাগরিক। নাই বা রাখা হল কারো নাম সীতা-অহল্যা-সুর্পণখা।
কু-ঝিক-ঝিক শুনলেই নস্টালজিয়ার জন্ম হয় মনে। বটেই তো। সেজন্য হয়তো তার প্রয়োজনও আছে। কিন্তু নাকে- মুখে গুঁজে সকাল নয়টার মিছিলে নিত্যদিন দৌড়োবার সময়ে আচমকা লাল হয়ে ওঠা সিগন্যাল দেখে আমরাই সমস্বরে বলে উঠি: “এই গরু—হ্যাট!” বলি না কি? ভাবি না কি—ইস! বারাসত টু ডালহৌসি যদি বুলেট ট্রেন থাকত! এমনটি যদি ভাবেন, ভেবে থাকেন, তাহলে আমার ওয়ানলাইনার সারকথার সঙ্গে আপনিও একমত হবেন যে বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থার বর্তমান কালখণ্ডে রাষ্ট্রিক দ্বন্দ্বযুদ্ধের পৌরাণিকতা, মিথো-রাজনৈতিকতার কল্পনা নিছকই বাতুলতামাত্র; কেননা, রাজা ব্যক্তিমাত্র, এখন দেশ চালায় দল। আর আপনি একমত না হলেও আমি বক্তব্যটি পেশ করব, নিজেরই ঢঙ্গে, চাবুক বাঁচিয়ে। এবং আগ্রহীর নিবিড় পাঠ চলাকালীন আরতির গলায় গলা মিলিয়ে সর্বক্ষণ গুনগুনাবো—“বয়েই গ্যালো’।
Posted in: ARTICLE, August 2020 - Cover Story