স্বাধীনতার রামায়ণ… একটি কাল্পনিক সত্য ঘটনা ও পরিবর্তনের খসড়া : প্রদীপ চক্রবর্তী
এক
মাথার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা হাল্কা দপদপানি শুরু হয় আমার| এবং একটা নীল রঙ স্বচ্ছ জলের মধ্যে একটু একটু করে ছড়িয়ে যেতে থাকে| ছড়িয়ে যেতে যেতে একসময় একটা অদ্ভুত অবয়ব তৈরী হয়| সেই ঈষৎ ব্যথা মেশানো, রঙের ভেতর ডুবে যায় একটা অস্তিত্বের সমস্তটা| একটা হ্যালুসিনেশন, একটা না ঘুম না জাগা প্রক্রিয়া| দেখি, একটা শীর্ণকায় বালক আদিগন্তবিস্তৃত মাঠের মধ্যে দিয়ে অবিরাম ছুটে যাচ্ছে, হাতে তার কাটা একটা ঘুড়ি ও ছেঁড়া সুতোর অংশ| সে ছুটছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে| তার অবস্থান বদলাচ্ছে না| তবু সে প্রাণপণ ছুটছে| একজন interlocutor, যা তার প্রতিসত্তা, যা তার স্বোপার্জিত, তার সঙ্গে ভুতুড়ে আলাপন শুরু হয়| অনেকটা ওরহান পামুকের, ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসের মৃত ব্যক্তিটির মতো| উপন্যাসটির স্থান – ইস্তাম্বুল| ঊনষাট পরিচ্ছেদ| বাইশটি চরিত্র| ১৫৯১ সালের তুর্কিতে ঘটে যাওয়া নয় দিনের গল্প| আন রিয়েল রিয়েলিটি নিয়ে এই উপন্যাস শুরু হয়, একজন মৃতদেহের নিজের মুখের কথা দিয়ে| কুয়োর ধারে পড়ে আছে মৃতদেহ| তখনো মৃতদেহ কবরের নীচে শুতে পারে নি| তাই তার আত্মা তখনো তাকে ছেড়ে যায় নি| যে বলছে, ‘I am a corpse, I am nothing but a corpse now, a body at the bottom of a well’…
এখানে পামুক, সময়কে রিওয়াইন্ড করছেন, স্ট্রিম অফ থটস, দিয়ে| তাঁর চরিত্র সময়ের ফাস্ট ফরোয়ার্ডে আর যাবে না কিন্তু সময়ের ফ্রীজড পয়েন্ট থেকে পামুক, তাঁর ভাবনাকে তুলে আনেন|
এভাবেই অসংখ্য মৃত ও জীবিত ঘটনা আমার মধ্যে কথা বলে| দেশ বলতে কোনো কনসেপ্ট আমার মধ্যে দানা বাঁধে না| কাঁটাতারহীন একটি গ্রহ বা পৃথিবীকে কল্পনা করে নিই| যেখানে পাশাপাশি অনেক পতাকা, নানারঙের অবয়ব নিয়ে খোলা আকাশের নীচে মনের সুখে আন্দোলিত হচ্ছে| অনেকটা, অনেক ক্লাবকে নিয়ে তৈরী কোনো বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা| অনেক ক্লাব, অনেক পতাকা| তার নীচে সাদা কালো হলুদ লাল সবুজ মেটে শ্যাম ঈষৎ ফ্যাকাসে বেগুনি, নানারঙের বাচ্চারা দাঁড়িয়ে আছে| মনের আনন্দে পটাকা ফাটাচ্ছে| চকলেট খাচ্ছে| নানাভাষার জাতীয় সংগীত গাইছে বাচ্চারা| অবিমিশ্র সেই ভাষার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে| সম্মিলিত সেই ফিউশন সুর এভাবে এর আগে কেউ শোনে নি|
আমার স্বপ্ন ভেঙে যায়| ভেতর থেকে সুর আমাকে ছাপিয়ে উথলে উঠছে আর সেই সুরে অবিকল, কাফকার মেটামরফোসিসের মতো আমি একটি বৃহৎ পোকায় রূপান্তরিত হয়ে উড়ে যাচ্ছি প্রান্তিক ডানার শক্তিতে| আধা ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে আমি কেবল নানান সুরের ভেতর এক হার্মোনিকাল টিউন মাথার ভেতর দপদপ করতে দেখি| নীল রঙ কখন, ইন্দ্রধনুষের মতো অনেক রঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার নিহিত রক্তে…
দুই
খুব ছোটবেলায়, সেই সত্তর দশকের শেষে, আমার তখন বছর আট নয় বয়স| আমাদের শিল্পাঞ্চল শহরে, এই বর্ষণমুখরিত শ্রাবণের শেষে, দুটো জিনিস দেখতাম| সন্ধে বেলায় সারা আকাশজুড়ে খুব শক্তিশালী সার্চ লাইট এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে| বুঝতে পারতাম, শহরে নতুন কোনো সার্কাস পার্টি এসেছে| আরেকটা মজার জিনিস দেখতাম, সেটি হলো হিন্দিভাষী কারখানার ছোটো ছোটো ব্যারাকের কোনো ছোটো মাঠে “রামলীলা” এসেছে| আসলে যাত্রার ঢঙে রামায়ণ গান| সবাই পুরুষ| রাম সীতা ভরত লক্ষ্মণ কৌশল্যা কৈকেয়ী দশরথ রাবণ ইন্দ্রজিৎ হনুমান সুর্পণখা বাল্মীকি বিশ্বামিত্র বশিষ্টমুনি রাজা জনক মন্দোদরী অহল্যা বালী সুগ্রীব কুম্ভকর্ণ লব কুশ সবাই পুরুষ| সীতাবেশী চরিত্রটি, রাবণ এবং হনুমানের সঙ্গে কানাৎছেঁড়া গ্রিন রুমে বসে চুটিয়ে চুট্টা বা বিড়ি টানছে| যখন যার পাঠ আসছে, তখন সে কয়েকটি একশো পাওয়ারের বাল্বের নীচে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে মেলোড্রামাকেও লজ্জা দিয়ে, রঙটং মেখে পাঠ বলছে| চারদিকে ঘিরে বসেছে উৎসাহী কয়েকশো দর্শক| মহিলারা ঘনঘন চোখের জল মুচ্ছেন| এরমধ্যে সবচে আকর্ষণীয় হলো ‘মালা ডাক’ দর্শকদের মধ্যে, কে কতো মোটা মালা তৈরী করে আনতে পারে| সে এক প্রবল উৎসাহের ব্যাপার| দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে অতিকায় একেকটি হৃষ্টপুষ্ট মালা| অধিকাংশই বড়ো| দুএকটা ছোটো| এই “মালাডাক” রামযাত্রা চলাকালীন মধ্যম প্রহরে শুরু হত| সে কি বিপুল উৎসাহ! যাত্রার অধিকারীমশাই এই “মালাডাক” ডাকতেন| প্রায় ঘন্টাখানিক “মালা ডাক” গলার শির ফুলিয়ে ডেকে, এর মধ্যে থেকে শেষে তিনটি নির্বাচিত হত| এরমধ্যে সবচে বড়ো মালাটি পড়ানো হত, রামচন্দ্রকে| পরের টি সীতা এবং এদের চে একটু ছোটো, হনুমানকে| তিনটি নির্বাচিত মালার, মালাকারকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হত| এই তিনজনকে মনে করা হতো “পাড়ার রত্ন”| এবং এই তিনটি মালা নিলামে চড়িয়ে যে পয়সা পাওয়া যেত, সেটি ছিলো “রামলীলা” দলের সেদিনের প্রধান উপার্জন| এবং যাঁরা কিনতেন, দর্শকরা তাঁদের বিশেষ সম্মান জানাতেন| একেকদিন রামায়ণের এক এক পালা, এবং একই ভাবে একই অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তি| প্রায় এক মাস এই দল থাকতো|
এরপর ‘আশির দশকের মধ্য সময়ে, পরিচালক, রামানন্দ সাগর, অরুণ গোভিল ও দীপিকা চিকলীয়া কে নিয়ে তৈরী করলেন তাঁর বিখ্যাত রামায়ণ| তখন প্রায় সাটার দেওয়া সাদাকালো টি ভি’র যুগ| আমাদের শহরে ঘরে ঘরে টিভি নেই তখন| দেখতাম, সপ্তাহান্তে প্রচুর উৎসাহী দর্শকের ভিড় আমাদের বাড়িতে| সৌভাগ্যবশত তখন বাড়িতে টি ভি আছে| চায়ের যোগান দিতে দিতে মা ক্লান্ত| মহেন্দ্র কপূর ভক্তি গদগদ হয়ে গান করছেন| দর্শক উৎসাহে আবেগাপ্লুত|
বাঙালির অন্দরমহলে রাম তখন খুবই ভালোবাসার| তাতে ভক্তিও আছে| কিন্তু তখনো “দেশপ্রেম” বা “ভক্তি” রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়| রামচন্দ্র তখনো বাঙালির কাছে, যতটা না বাল্মীকির তারচে বেশী, কৃত্তিবাসের| বাঙালির তেতত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে রাম ছিলেন কি না আমার জানা নেই| যদিও তখন বেশকিছু অশ্বথ গাছের ছায়ায় আমি হনুমান মন্দির দেখেছি| উত্তর পূর্ব ভারতের যাঁরা জীবিকার জন্য এই শহরে আছেন, তাঁরা রামনবমী বেশ ভালো ভাবেই পালন করেন| কোথাও কোনো সামাজিক ভাবে দেবদেবী নিয়ে বিভাজন নেই| একই শহরে, ইদ মহরম বড়দিন রামনবমী দূর্গা কালি বিশ্বকর্মা শীতলা সব পুজো হয়| ধর্ম যার যার নিজের| এনিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই| তখনো রামজন্মভূমি, বাবরি মসজিদ, আদবানির রামরথ, কাশ্মীর নিয়ে মাতামাতি এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো আন্দোলনই সেভাবে মাথাচাড়া দেয় নি ভারতবর্ষে| যদিও কিছুদিন আগে ইন্দিরা গান্ধী, তাঁরই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত| সেই প্রথম শহরে কার্ফু| জায়গায় জায়গায় শিখ পাঞ্জাবিদের গাড়িতে আগুন| তবে সবাই মিলেমিশে বুক পেতে রক্ষা করেছে একে অপরকে| খালিস্থানিপন্থীরা কোন দাবি নিয়ে এরকম একটি গুরুতর ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, কিংবা একে কেন্দ্র করে কোনও উগ্র মনোভাব কোনোটাই সেভাবে মাথা তুলতে পারে নি আমাদের কসমোপলিটান সিটিতে….
কারণ, তখনো ভারতবর্ষে বহু স্বর, বহুত্ববাদের বিরোধিতার কথা মানুষ ভাবতে পারতো না| যদিও জাতপাত, ধর্মীয় গোড়ামি এই দেশ থেকে কখনো পুরোপুরি মুছে যায় নি| অন্তত, যে যার মতো ধর্মাচরণে স্বাধীন ছিলেন| বাঙালির বারোমাসের তেরো পার্বনে অন্য ধর্মের মানুষ অনায়াসে যোগদান করতেন এবং অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানেও সবাই স্বাগত| কিন্তু, আজ দুহাজার কুড়িতে এসে, এক দেশ এক ধর্মের যে নিশান উড়ছে সেটি ভারতবর্ষের চিরকালীন পরম্পরা ও ঐতিহ্যে নিঃশব্দে একটি ভবিষ্যতের অশনিসংকেত তো বটেই|
বাঙালি কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের দেব দেবী নিয়ে নানারকম রঙ্গ রসিকতা করে এসেছেন অনেকদিন ধরে| ধর্মমঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, শিবায়ন কাব্যে, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলীতে, এমনকি পরবর্তী কালে, সুকুমার রায় একটি উৎকৃষ্ট নাটক, “লক্ষ্মণের শক্তিশেলে” প্রচুর মজা করেছেন, রামচন্দ্র, লক্ষণ, হনুমান ও রামায়ণের বিবিধ চরিত্রগুলোকে নিয়ে|
কবিদের ক্রীড়া কৌতুকে অনায়াসে আনন্দরস খুঁজে পেয়েছেন পাঠক| রামচন্দ্র বাঙালির আর দশটা দেবতার মতোই ছিলেন কাছের| রঘুকুলপতি, মর্যাদা পুরুষোত্তম, প্রজানিরঞ্জনী রাম ছিলেন একজন সৎ ও আদর্শবাদী মানুষ|
যিনি পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য, অনায়াসে রাজ্যপাট ছেড়ে অসীম অনিশ্চিত দুঃখের ভবিষ্যতে পা বাড়াতে পারেন| প্রজাদের কথায়, সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেন এবং আত্মগ্লানিতে ডুবে, সরযূ নদীতে প্রাণ বিসর্জন করেন| বাল্মীকির ক্ষত্রিয় তেজে দীপ্ত রামের চেয়ে, বাঙালি মানসে কৃত্তিবাস ওঝার রাম, অনেকবেশি ঘরোয়া ও বাঙালির কাছের মানুষ|
ঊনবিংশ শতকে, আধুনিক মননের ফলশ্রুতি হিসেবে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, “মেঘনাদ বধ” কাব্যে, মূল কাহিনীকে রেখে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন করে বিশ্লেষণ করেন রাম ও রাবনকে| গ্রিক মহাকাব্য ও ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফসল, নতুন সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি দেবতা প্রসাদপুষ্ট রামের চেয়ে, অধিক সৎ ও নিজস্ব পুরুষাকারে বিশ্বাসী রাবণ এবং মেঘনাদকে তিনি নায়কের মৰ্য্যাদায় ভূষিত করেন|
বাঙালি অনায়াসে এই আধুনিক মহাকাব্যকে গ্রহণ করে|
রাম অনেকের কাছে অনেকরকম| বহুত্ববাদের প্রতীক| ১৯২৯ সালে ‘ইয়াং ইন্ডিয়া’-তে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, “তাঁর কল্পনায় রামরাজ্য আর হিন্দুরাজ্য এক নয়|”
কতো রকমের কবির হাতে কতো রকমের রাম| বাল্মীকি, গোস্বামী তুলসীদাস, কৃত্তিবাস, ভবভূতি, মহাকবি কালিদাস, চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, এ ছাড়াও দণ্ডকারণ্যের যে সব অঞ্চলে রাম সীতা লক্ষ্মণের পদচিহ্ন পড়েছিল বলে জনপ্রবাদ, আজকের সেই বস্তার কোরাপুট মালকানা গিরি কালাহান্ডির কাছাকাছি এওয়া পাড়ার সুনাবেড়া মালভূমি, বোনডা আদিবাসী, গোন্ড জনজাতি বা কতরকম উপজাতির কাছে রামচন্দ্র কতরকমের ভাবনায়
প্রতীকে, ভালোবাসায় পূজিত| এই বিবিধ উদাহরণ আমাদের কাছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকেও তুলে ধরে|
আমার কাছে সতীনাথ ভাদুড়ির রামচন্দ্রের প্রতীক, ঢোঁড়াই বা ঢোঁড়াই চরিত মানস অনেকবেশি জনগণের কাছাকাছি এক ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরে| ঢোঁড়াই মানেই, আঘাত বা বিচ্ছেদের প্রতিমূর্তি| রামায়ণ যেমন নানা কাণ্ডে বিভক্ত ঠিক তেমনই, ঢোঁড়াই চরিতেও আমরা দেখি, বাল্যকান্ড, পঞ্চায়েত কান্ড, রামিয়া কান্ড প্রভৃতি| ঢোঁড়াই সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি, এ যুগের রামচন্দ্র| ঢোঁড়াই বাল্যকাল থেকেই ট্র্যাজিক চরিত্র| ঢোঁড়াইয়ের জীবনের উদ্ভব বুনন চিড় ধরে দেড়বছর বয়সে যখন তার বাপ্ মারা যায়| তার মা বুধনী আবার বিয়ে করে বাবুলাল চাপরাসিকে| ঢোঁড়াই মানুষ হয়, গ্রামের দেবস্থানের পূজারী বৌকা বাওয়ার কাছে| যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন এই উপন্যাসের বহুস্তরীয় দিকগুলো| কিন্তু ঢোঁড়াই শেষ হয়ে যায় একটি নারীর মনস্তাত্বিক আচরণ ও উপেক্ষায়| তাৎমাটুলীর মেয়েরা অঘ্রাণে পশ্চিমে ধান কাটতে যায় এবং এখান থেকেই রামিয়া কাণ্ডের শুরু| রামিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় একসময় ঢোঁড়াইয়ের| বছর না যেতেই রামিয়া গর্ভবতী হয়, তার পেটের বাচ্চা ঢোঁড়াইয়ের কিন্তু রামিয়া জড়িয়ে পড়ে রবিয়ার সঙ্গে| যে রামিয়ার হাস্য লাস্য লচকভরা জওয়ানিতে মুগ্ধ ছিলো ঢোঁড়াই, রবিয়ার বউ এর চক্রান্তে ও নানান কারণে একসময় ঢোঁড়াই সরে যায় রামিয়ার জীবন থেকে| পরে রবিয়ার মরা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা যায় রামিয়া| মনে প্রাণে ব্যর্থতায় বিবাগী ও তিরিক্ষি মেজাজের হয়ে ওঠে ঢোঁড়াই| আসলে ঢোঁড়াইরা প্রয়োজনে নিষ্ঠুর, মিথ্যেবাদী অথচ বিষহীন ঢ্যামনা সাপ| প্রকৃত বিষধর সাপের বিষে নীল হয়ে রিক্ত হয়, কিন্তু ছোবল মারতে পারে না| এ আরেক রামচন্দ্রের প্রতীকী চরিত্র| যে ইস্কুলিয়া এন্টনিকে নিজের ও রামিয়ার ছেলে ভেবে ভুল করে বারংবার| যার ভুল ভাঙে না কখনোই, সারাজীবনে|
তো আরেকদিকে দেখি, গোস্বামী তুলসীদাসজি কে| হিন্দু সন্ত কবি| জন্ম ১৪৯৭ বা ১৫৩২ মৃত্যু ১৬২৩| ধর্ম সংস্কারক ও দার্শনিক| তিনি রামানন্দের গুরু পরম্পরায় রামানন্দী সম্প্রদায়ভুক্ত| জন্ম, রামবোলা, গোন্ডা, উত্তরপ্রদেশ| মৃত্যু, অসিঘাট, বারাণসী| গুরু, নরহরি দাস| দর্শন – বৈষ্ণব ধর্ম| রামচরিতমানস যেমন তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি ঠিক তেমনই হনুমান চালিসা| তাঁর লেখায় ভক্তিভাব ও কোমল রস এতো প্রগাঢ় এবং সুমিষ্ট যে পশ্চিমোত্তর মধ্য ভারতে তুলসীদাসের রামচরিত, বাল্মীকির মূল সংস্কৃত রামায়ণকেও ছাপিয়ে গেছে জনপ্রিয়তায়| আজকের রামলীলা যাত্রার তিনিই প্রবর্তক| এবং তিনিই প্রথম “রামলালার” স্রষ্টা| বৈষ্ণব রসসাহিত্যের গভীরতায় ভক্ত কবি এতোই নিমজ্জিত ছিলেন, যে, বাল্মীকির রামায়ণে যা সেভাবে নেই, শিশু কৃষ্ণের বাল্যলীলার মতো তিনি রামচন্দ্রের বাল্যলীলা অত্যন্ত ভক্তিভরে রচনা করেন| কৃষ্ণলীলার আধার ভাগবত পুরাণের অনুকরণে রামচন্দ্রের জন্মকালে কৌশল্যার মুখে বিষ্ণুস্তুতি বসিয়ে দিয়েছে এবং এই অধ্যাত্ম রামায়ণ–ই রামচন্দ্রের বাল্যলীলার বর্ণনা করেছে যশোদা দুলাল কৃষ্ণের ছাঁচে ফেলে|
কৃষ্ণের বাল্যলীলার মতোই তিনি রামচন্দ্রের বা রামলালার বাল্যলীলা নিয়ে লেখেন “কৌশল্যা জব বোলন জাই| ঠুমকি ঠুমকি প্রভু চলহি পরাঈ||” বা, “ভাজি চলে কিলকত মুখ / দধি – ওদন লপটাই” প্রভৃতি|
কিন্তু তুলসীদাসজী, ব্যক্তিজীবনে ছিলেন উদার সর্বধর্মসমন্বয়ী এক বিশাল মনের মানুষ| ব্রাহ্মণ্যসমাজের উৎপীড়নে অত্যাচারে নিজস্ব কুটীর হারিয়ে তিনি মসজিদের চাতালে গিয়েও শুয়ে থাকতেন| কাশীর ব্রাহ্মণ-পন্ডিতদের কথায় উত্যক্ত হয়ে বিরক্ত মনে বলেছিলেন,
“আমাকে ধূর্তই বলো, আর নাস্তিকই বলো, আমাকে রাজপুতই বলো, মুসলমান তাঁতি জোলাই বলো, আমি তো কোনও বড়ো ঘরের মেয়ের সঙ্গে ব্যাটার বিয়ে দেবো বলে এখানে বসে নেই যে, আমি জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাবো, আর আমি তো একটা লোকের সঙ্গেও এতটুকু মাখামাখি করতে চাইছি না, যাতে তোমরা বলতে পারো যে, আমি কারো জাত মেরে দিয়েছি| আমি শুধু ঠাকুর রামচন্দ্রের গোলাম…আর কারোর নয়..
“কাহুকী বেটিসে বেটা ন ব্যহব কাহুকী জাতি বিগার ন মোউ| / তুলসী সরনাম গুলামু হৈ রামকো, জাকো রুচৈ সো কহৈ কছু অউ|”
মনে রাখতে হবে, বিশুদ্ধ ভক্তিবাদী,
তুলসীদাসজী, আকবরের রাজত্বের সমসাময়িক| আকবরের দিন-ই-ইলাহী ধর্মমত, সর্বধর্মের সমন্বয়ের কথা বলে| আব্দুর রহিম খান-ই-খানখানা, তুলসীদাসজির পরম মিত্র ছিলেন| আব্দুর রহিম খান নিজে ছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত, উদার, সর্বধর্ম সমন্বয়ের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিকোণের স্বচ্ছতা ছিলো| তিনি ছিলেন আকবরের বিশিষ্ট সভাসদ| আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের পুত্র| নিজেকে উজাড় করে দেওয়া দাতা| তাঁর অনুরোধেই, সংক্ষিপ্ত রামায়ণ লিখেছিলেন তুলসীদাসজী|
তুলসীদাসজী’র মানসহংস রামলালা, প্রভু রামচন্দ্র ছিলেন মানুষের দেবতা| যে দেবতাকে কখনো আড়ম্বর সর্বস্ব প্রতীকী আনুষ্ঠানিক ও বাহ্যিক মন্দিরে পাওয়া যায় না| যিনি উঁচু নীচু জাতপাতের উর্দ্ধে, মানুষের ভালোবাসা ও ভক্তির আশ্রয়ে সর্বজনীন|
এই ভক্তি ও ভালোবাসার কোনও আনুষ্ঠানিক লোকাচার নেই| নেই জোরপূর্বক ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনৈতিক বাধ্যবাদকতা| নেই কেবল পাথুরে মূর্তির আনুষ্ঠানিকতায়| তিনি দেশ কাল সমাজ ভেদ ভাবনার উর্দ্ধে, মানুষের ভালোবাসার দেবতা…
তিন
স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অনেক রক্তক্ষয়ের ফসল| অখণ্ড ভারতবর্ষের অঙ্গহানি আমাদের আজও প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়|
দেশভাগের যন্ত্রণা আজও প্রশ্ন করে, এই স্বাধীনতাই কী আমরা চেয়েছিলাম? এই রিক্ত ও রাজনৈতিক সুবিধাসর্বস্ব স্বাধীনতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে, একসময় “গানহী বাওয়া”-র আদর্শে বিশ্বাসী সতীনাথ ভাদুড়ী নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন| পরাধীন ভারতবর্ষে যিনি জেল খেটেছেন, পূর্ণ স্বরাজের জন্য| জেলে যাঁর সঙ্গী ছিলেন, সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেনু, রাজেন্দ্রপ্রসাদজী, আচার্য কৃপালনী| পূর্ণিয়ার ‘সবুজ কুন্তলা’ ভাট্টাবাজারের দুঁদে আইনজীবী ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী ও রাজবালা দেবীর ষষ্ঠ সন্তান সতীনাথ, যিনি জেলের গরাদের লৌহ বেষ্টনীর ভেতরে আসা সূর্যের আলোয় বসে লিখে ফেলেছিলেন, মোটামোটা দুটো সবুজ খাতায়, “জাগরীর” মতো একটি কালজয়ী উপন্যাস, স্বাধীনতার পর, কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে, তা উপলব্ধি করেই তিনি পুরোপুরি সরে আসেন রাজনীতি থেকে| সঙ্গী পরিচারক, বাবাজি এবং প্রিয় সারমেয় পাহারাকে নিয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন বাগান চর্চায়| আর ফেরেন নি কখনো রাজনীতিতে|
১৯৪৭ সালের ১৫’ই অগাস্টের পর মনে হয়, ধীরে ধীরে স্বাধীনতার গৌরব পতাকা আরও বেশী অস্তমিত হতেই শুরু করলো| এ যেন সেই মহাভারতের ধর্মযুদ্ধের মতো| যুদ্ধশেষে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে পড়ে আছে হাজার হাজার নিরীহ সৈনিকের লাশ| কাঁদছে, অসংখ্যা ভাগ্যহত বিধবাদের সঙ্গে কৌরব বধূরা| গান্ধারী পুত্রশোকে আকুল| এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের শেষে হতোদ্যম ক্লান্ত তীব্র বিষাদে আচ্ছন্ন পান্ডব ভ্রাতারা| যুদ্ধ যদি, সবারই প্রাণ কেড়ে নেয়, তাহলে কাকে নিয়ে রাষ্ট্র শাসন? কিসের জন্য এ যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ?
দেশভাগের পর এই একটা প্রশ্নই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিলো| কিসের স্বাধীনতা তবে?
ভারতীয় চলচিত্র শিল্পে এই দেশভাগের হাহাকার নিয়ে আমরা কতো মর্মন্তুদ সিনেমা দেখেছি|
নিমাই ঘোষের “ছিন্নমূল” সিনেমাটি নিয়ে মৃণাল সেন লিখেছিলেন “পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি চিরকালের মতো ছেড়ে নিরাশ্রয় বাস্তুহারার দল কলকাতার ইট পাথরের রাস্তায় কীভাবে মাথা খুঁড়ে মরেছে, কীভাবে শিয়ালদার প্ল্যাটফর্মের নোংরা পরিবেশে তারা রাতের পর রাত কাটিয়েছে, খিদের তাড়নায় তারা রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেরিয়েছে কাজের আশা নিয়ে – “ছিন্নমূল” সেই সব বুকভাঙা ঘটনারই জীবন্ত দলিল”…
এভাবেই যখন দেখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যায় দেশভাগের যন্ত্রণা, এবং গভীর বিষাদ তৈরী করে, ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা”, “কোমল গান্ধার”, “সুবর্ণরেখা”-সিনেমা গুলো, এমনকি একই ভাবে অনর্গল দেশভাগের যন্ত্রণা আর কুফল নিয়ে দেখতে থাকি এই সিনেমাগুলো…. জি অরবিন্দনের “বাস্তুহারা”, ভীষ্ম সাহানি ও গোবিন্দ নিহালানির “তমস”, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের “তাহাদের কথা”, গৌতম ঘোষের “শঙ্খচিল”, সুপ্রিয় সেনের “আবার আসিব ফিরে”, তানভীর মোকাম্মেলের “সীমান্তরেখা”, দীপা মেহেতার “দ্য আর্থ ১৯৪৭”, নন্দিতা দাশের “মান্টো”, গুরিন্দার চাড্ডার “পার্টিশান”, … তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কী এই স্বাধীনতা এভাবে দরকার ছিলো?
আজও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরী করা খাঁচার ভেতর নারীর স্বাধীনতা নিঃশেষিত| হ্যাঁ, সমাজের একটা অংশে হয়তো নারী স্বনির্ভর, শিক্ষিত, অর্থনৈতিক ভাবে দৃঢ়| কিন্তু, ১৩৩ কোটির দেশে, আজও কজন নারী উপলব্ধি করতে পারেন স্বাধীনতাকে? মুসলমান জেনানা মহলের অলিতে গলিতে গিয়ে আমরা, ইসমত চুঘতাইয়ের চোখ দিয়ে দেখি, আজও নারী কতো বলিপ্রদত্ত, অসহায়!
আজও সমাজ চলে সাবসিডি বা ভর্তুকিতে| পার্থক্য এই বর্তমানের, মেলোড্রামা সর্বস্ব ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রনোদিত সমাজে, যেখানে এক দেশ এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম এবং একই ছাঁচে ঢালার কথা বলা হচ্ছে! এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা!
এমনিতেই জাত পাত, নানা অলীক ধর্মীয় ফতোয়া, হিংসা রিরংসা, বাধ্যতামূলক ধর্মাচরণ, কালবুর্গ, রোহিত ভেমুলার দগদগে স্মৃতির অভিঘাত, বা কাশ্মীরে বিলুপ্ত হলো ৩৭০ ধারা|
এমনিতেই অন্যকে খুঁচিয়ে মারার পৈশাচিক আনন্দে এখন মগ্ন ধর্মীয় ফতোয়ায় বিশ্বাসী ভারতীয় নাগরিক সমাজের অনেকাংশ| তারপর এই নয়া ভারতের এই সাবসিডি নীতি আসলে, মেরুদণ্ডকে কিনে, সাংবিধানিক স্বীকৃত নাগরিক ও গ্রামীণ সমাজকে “জো হজুর” বলানোর যে সূক্ষ্ম ফ্যাসিস্ট চক্রান্ত, সেই মনোভাব চায় …করোনা কালীন সময়ে, চিকিৎসার সমতুল ঘন্টা পিটিয়ে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলতে! গো মূত্র পান করে, শুদ্ধতা আনতে! ঘুঁটে হয় গ্রামীণ অর্থনীতির নয়া দিকদর্শন! আধুনিক যুক্তি বিজ্ঞান পরমত সহিষ্ণুতা ও ভারতীয় আত্মার যে উদার সর্বভৌম্য ঐতিহ্য ও পরম্পরার কথা আমরা জেনে এসেছি তা হয়ে ওঠে সমকালীন সময়ে মিথ্যে ও তামাশার সমতুল….
এরফলে, রামচন্দ্র কেবল ভক্তের অবিচল ভক্তির আশ্রয় নন এখন কেবল, নতুন বিদ্যৎসভায়, অহৈতুকী ভক্তির ঠেলায় তিনি হয়ে যান তাত্বিক সেবায়ত ও সুবিধাভোগী মহন্তদের আদালতের বিষয়| তিনি আর জগৎ পিতা নন, তাঁকেও আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হয়, নিজের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করার জন্য !
রামচরিত মানসের স্রষ্টা, শুদ্ধাত্মা পরম বৈষ্ণব ও শ্রেষ্ট ভক্তিবাদী কবি, তুলসীদাসজী, এই মহান্ত – সেবায়তদের সেবিত মন্দির চত্বরে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোনোরও সুযোগ পান নি| তাঁর রামলালা আজ, যিনি এই অনাদ্যনন্ত সংসার মহীরুহের বীজ, যিনি অখিল-রসামৃতমূর্তি বলেই বাল্মীকি, কালিদাস, তুলসীদাস-কৃত্তিবাসের মনের গভীরে স্বত:বিভিন্ন লীলা রসের স্ফূর্তি ঘটান, সেই প্রভু রামচন্দ্রের কী প্রয়োজন ছিলো চবুতরায় বসে তাঁর প্রবেশাধিকারের জন্য অপেক্ষা করার? তাঁর কী প্রয়োজন ছিলো সেবায়েত-মহান্তের ক্রীড়া পুত্তলিকায় পর্যবসিত হয়ে বটতলার মামলায় জড়িয়ে পড়ার??
আসলে নয়া ফ্যাসিস্ট নির্মিত নয়া ভারতের সুচতুর রাজনীতিতে, আরাধ্য দেবতা বা সাধারণ মানুষ, কেউই স্বাধীন নন| সবাই রাজনীতির হিসেবি চক্রব্যূহ-এ অসহায় অভিমন্যু ! যেখানে ঢোকা যায় বেরোনো যায় না| হয় মানো রাজার আদেশ না হলেই শিরোচ্ছেদ!
এই তো আমাদের আজ, বিবিধের মাঝে মিলনের গান….
হায় রাম! এই ধ্বনিতে রক্তাপ্লুত শরীরে পড়ে আছেন গান্ধীজি| আর একটি প্রতীকী বন্দুক তাক করা আছে, ভারতবর্ষের অখণ্ড মানচিত্রের নীচে দাঁড়ানো, গাঁধীবাবার পেছনে অসহায়, ১৩৩ কোটি মানুষ!
একদিকে করোনা অন্যদিকে দেশাচার….
ভ্যাকসিন আসলে কার লাগবে? কার?
প্রভু রামচন্দ্রের, যিনি মানবপ্রেমী ও ভক্তের প্রিয় রামলালা না নয়া ফতোয়াবাদীদের….?
“বহুত্ববাদ” ও “অহিংসা” এই দুটি স্তম্ভের উপর নির্ভর করে এবং “গীতা”-কে উপজীব্য করে দেওয়া বক্তৃতামালায় গান্ধীজি বারংবার জোর দিয়েছিলেন “গীতা” – কথিত পরিণামের কথা বিস্মৃত হয়ে একাগ্র অধ্যবসায়ে নিষ্কাম কর্ম করে চলার উপর| তাঁর ঈশ্বর চেতনা মানুষের জন্য, জাত পাতের উর্দ্ধে মানুষের সেবায় আত্মউৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে| অন্যদিকে, “মানুষের ধর্ম” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষের দেবতা মানুষের মনের মানুষ, জ্ঞানে কর্মে ভাবে যে পরিমাণে সত্য হই সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে পাই – অন্তরে বিকাশ ঘটলে সেই আমার আপন মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাই নে| মানুষের যত কিছু দুর্গতি আছে সেই আপন মনের মানুষকে হারিয়ে, তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে, অর্থাৎ আপনাকেই পর করে দিয়েছে|”
আসলে দেশাচার বা দেশপ্রীতি কখনো কেবল বাহ্যিক প্রদর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না| আমার দেশ, আমার রক্ত আমার মজ্জা আমার শিরা উপশিরা| দেশ না থাকলে আমার অস্তিত্ব কোথায়? আমি এবং আমরা এই দেশের এটা না চেঁচিয়ে ফলাও করে না বললেও চলে| এদেশের হাজার হাজার মানুষের বলিদানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতার কঠিন ভিত্তিপ্রস্তর| একে আলগা করার ক্ষমতা কারোর নেই| কিন্তু পুনরায় যেন, নানা পরিকল্পনা করে, দেশের সমস্ত মানুষকে আবার দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করে, নিজের দেশে পরবাসী না হতে হয়, সেদিকে সবার অতন্দ্র নজর দেবার সময় এসেছে| কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি যেন আমাদের একাগ্র চেতনাকে নষ্ট করতে না পারে, আজ সেই ব্যক্তি থেকে সমস্ত জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে হয়তো আপোষহীন সংগ্রামের সময় এসেছে| আমাদের জাতীয় ঐক্যে যেন ভেতর থেকে চিড় না ধরে কোনোভাবেই, আমাদের মানবিক সংবেদের কাছে আজ এটাই বড়ো প্রশ্ন|
কবির কল্পনা ও মনোভূমি সৃষ্টি করে অমোঘ কালজয়ী চরিত্রদের| রক্তমাংসের মানুষের সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার পেছনে যে গুণসমূহ আর সাধারণ মানুষের সেবায়, আত্মত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরী করেন, সেই দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে পড়ে যুগে যুগে| কাল অতিক্রান্ত সেই অসাধারণ হয়ে ওঠা মানুষের জার্নিকে শ্রদ্ধা জানায়, ঋদ্ধ হয় ভবিষ্যতের মানুষ| কিন্তু তাঁকে সবসময় প্রামাণ্যের আতশ কাঁচের নীচে ফেলে ইতিহাস বলে চালালে কখনো কখনো সত্যেরও অপলাপ হয়|
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এসেই যায়| বিনায়ক দামোদর সাভারকার ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পান| দ্বিতীয় সরসংঘচালক, মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে জাতীয়তাবাদ বলে মনে করতেন না| আর এস এসের অনেকেই মুসোলিনিকে সমর্থন করতেন| সাধারণভাবে আর এস এস এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় “ভারতছাড়ো” আন্দোলন সমর্থন করেন নি| ইংরেজ সরকারকে এই আন্দোলন দমন করারও উপদেশ দেন| মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আর এস এসকে নিষিদ্ধ করেন|
এই রকম কতো ইতিহাস! আজ ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড়ো দরকার, নানারকম মূর্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে, বিপুল অর্থব্যয় না করে, সাধারণ পিছিয়ে পড়া মানুষের নূন্যতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের পেছনে এই অর্থ ব্যয় করা| যাতে আর কোনও এদেশের মানুষ নতুন করে গৃহহীন না হন, দেশ ভাগের যন্ত্রণা যাতে আর না কোনও ভাবে এদেশের মানুষকে সহ্য করতে হয়, সেই ব্যাপারকে সুনিশ্চিত করার দরকার, রাষ্ট্রীয় শাসকদের| প্রভু রামচন্দ্রও তাইই চাইতেন| তিনি এখন এই দুর্দিনে নিশ্চই প্রজাদের কাছে জাকজমক করে উপঢৌকন চাইতেন না!
“রাম তো ঘর ঘর মে হ্যায় / রাম হর অঙ্গন মে হ্যায় / মনসে রাবণ জো নিকালে / রাম উসকো মন মে হ্যায়… (সাম্প্রতিক একটি হিন্দি সিনেমার সংলাপ)
আগামীর ভারতবর্ষ হোক এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার |
মনের অন্ধকার দূর করার স্বপ্ন নিয়ে সেজে উঠুক নয়া ভারতবর্ষ …. এটুকুই স্বপ্ন দেখি …এটুকুই ….
বিশেষ দ্রষ্টব্য — এই লেখাটি রচনার ক্ষেত্রে, তথ্য সূত্রের জন্য, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, রামচন্দ্র গুহ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, সুকুমারী ভট্টাচার্য সহ, কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালি ও তুলসীদাসজীর ওপর লেখা আরও অনেক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধের কাছে ঋণ স্বীকার করছি…
[লেখক – কবি, গদ্যকার, সম্পাদক।]
Posted in: August 2020 - Cover Story, PROSE