বিবর্তনের ধারায় মুখোশ নৃত্য : মৌ মুখার্জী
শেষ পর্ব
বর্তমান কালে পশ্চিমবঙ্গে মুখোশের ব্যবহার হয়ে থাকে ধমীয় নৃত্যে, আচারনৃত্যে, যুদ্ধনৃত্যে, লোকনাট্য নৃত্যে অথবা প্রমোদ নৃত্য পর্যায়ে। তবে সব থেকে বেশি মাত্রায় মুখোশ নৃত্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায় ধর্মীয়-আচার কেন্দ্রিকনৃত্য পর্যায়টিতে, যার মধ্যে আবার কিছু কিছু ধর্মীয় লোকাচার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রমোদনৃত্য পর্যায়ে অবস্থান করছে। তবে কেবল ধর্মীয়-আচার কেন্দ্রিক পর্যায় বললে ভুল হবে, প্রমোদনৃত্য পর্যায়ের সাথে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধনৃত্য ও লোকনাট্যে নৃত্য পর্যায় দুটিও।
মুখোশ নৃত্যের প্রকৃত কাল সঠিক ভাবে বোঝা না গেলেও, আদিতে মুখোশ উৎসের কারন ছিল- বাস্তব প্রয়োজন ও আচার কেন্দ্রিকতা। এই দুইয়ের সংযোগে গড়ে উঠে ছিল এর প্রাথমিক রূপটি; অর্থাৎ, জাদু শক্তি ছিল মুখোশ সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ। ধর্মীয় ও আচার কেন্দ্রিক মুখোশ নৃত্য প্রসঙ্গে বলাযায় – আচার ও ধর্মই যে মুখোশ নৃত্যকে জন্ম দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। আচার নৃত্যকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয় – লোকাচার ও ধর্মাচার; কিন্তু ধর্মীয় নৃত্য ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। ধর্মীয় নৃত্যের আচার ধর্মের অঙ্গ যার মধ্যদিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। অন্য দিকে লোকাচার কেন্দ্রিক নৃত্যের মধ্যেও মুখোশের ব্যবহার বিশেষ ভাবে হয়ে থাকে। এই লোকাচার ও ধর্মীয় নৃত্যে ব্যবহৃত আচার নৃত্যের মধ্যে গাজন কেন্দ্রিক নৃত্য, ছাম ও বিবিধ নৃত্য সমূহে মুখোশের ব্যবহার হয়ে থাকে।
আচার কেন্দ্রিক মুখোশ নৃত্যের মধ্যে গাজনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুখোশ নৃত্যের প্রভাব বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গাজনকেন্দ্রিক মুখোশ নৃত্যে লোকাচার ও ধর্মাচার উভয়েরই প্রভাব লক্ষকরা যায়। গাজন বা চড়ক পূজার অনুষ্ঠানটি প্রচীনকালের সূচনা লগ্ন থেকে আদিম কৌম সমাজের ভূতবাদ এবং মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের বিশ্বাস থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা যায়। তবে আদিম কৌম সমাজের পরবর্তী কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কৃষিভিত্তিক সমাজের গুহ্য জাদুবিদ্যার দ্বারা প্রজনন শক্তি বৃদ্ধির আচার, যা পরবর্তী কালে কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য লোকায়ত ধর্মাচার যুক্ত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। এই রূপ কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য লোকায়ত ধর্মাচার যুক্ত একটি অনুষ্ঠান হল গাজন। গাজন স্থান ও নাম ভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে, একে চড়ক পূজাও বলা হয়ে থাকে। যাকে বর্ষ পরিক্রমনের চিহ্ন স্বরূপ ধরা হয়। এক কথায় চড়ককে অনার্য জাতির কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনের সূর্যের বাৎসরিক আবর্তন বিষয়ক জাদুআচার ভিত্তিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলাযায়, যা প্রাগৈতিহাসিক সূর্যোপাসনার লৌকিক রূপও বলতে পারা যায়।
কৃষিভিত্তিক সারা গ্রাম বাংলার সমাজ চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ় মাসের অম্বুবাচী অর্থাৎ চৈত্রের শেষ, বছরের শুভারম্ভ থেকে বর্ষা শুরুর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলভেদে গাজনকে উপলক্ষ্য করে উদ্বেল হয়ে ওঠে। সারা বাংলায় এই সময়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নামে বহু আচার অনুষ্ঠান ও লোক-নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। এদের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম হলেও এদের উদ্দেশ্য সর্বত্রই এক। এটি প্রকারান্তরে সূর্যোৎসব হলেও, অঞ্চলভেদে এটি কখনও শিবের উদ্দেশ্যে গাজন, কখনও আবার ধর্মের উদ্দেশ্যে গাজন। নীলের গাজন, গম্ভীরা, গমিরা ইত্যাদি শিবের গাজন হিসেবেই পরিচিত। গাজনকেন্দ্রিক প্রায় সকল আচারই গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজের আদিম ধর্মকেন্দ্রিক আচার তথা জাদুবিশ্বাসেরই রূপ বলে মনে করা যায়। অর্থাৎ, গাজন হল – “কৃষিকার্য মূলক” আচার অনুষ্ঠান, যার মধ্যে আদিম ধর্মকেন্দ্রিক আচারের প্রভাব, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, হিন্দু ধর্মের শাক্ত ও শৈব প্রভাব এই সকল কিছুই পড়েছে। গাজনের আচার অনুষ্ঠানের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নৃত্য। আবার অন্য দিকে বলা যায় আচার নৃত্যের মধ্যে গাজন হল প্রধান বিষয়; এবং এর মধ্যে মুখোশ নৃত্য একটি বড় ভূমিকা পালন করে। প্রধানত মুখোশ নৃত্য শিল্পীদের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের জীবিকা হল কৃষি। তাই তারা তাদের জীবিকা সংক্রান্ত বিষয় ভিত্তিক ধর্মীয় আচার কেন্দ্রিক মুখোশ নৃত্য নিজেরাই উপস্থাপন করেন। এই নৃত্য পুরুষ কেন্দ্রিক হয়ে থাকে তাই এখানে নারীর স্থান নেই। গম্ভীরা, গমিরা, বোলান, নীলের গাজন, ধর্মের গাজনে মুখোশ বা মুখা নৃত্য খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিপরীত ভাবে বলা যায় – গ্রাম বাংলার জনগোষ্ঠী কেন্দ্রিক প্রায় সব মুখোশ নৃত্যই গাজনকেন্দ্রিক নৃত্য হয়ে থাকে। এটি গুহ্য জাদুবিদ্যা অথবা তান্ত্রিক আচারের একটা অঙ্গ হিসেবেও ধরা যায়। তবে মুখোশ নৃত্যের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের ও হিন্দু ধর্মের শাক্ত ও শৈব তন্ত্র ক্রিয়ার প্রভাব আছে বলেই মনে করা হয়, কিন্তু এই মুখোশ নৃত্য আদিম কালের জাদু ক্রিয়ার দ্বারাই প্রভাবিত বা সৃষ্টি হয়েছিল কিনা তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে ছাম প্রসঙ্গে বলাযায় ছাম হচ্ছে তিব্বতের বৌদ্ধসন্ন্যাসী ‘লামা’ সম্প্রদায়ের তান্ত্রিক ধারার মুখোশ নৃত্য পদ্ধতি। এই নৃত্যশৈলী তিব্বত ছাড়াও ভূটান, নেপাল ও ভারতের হিমালয় পর্বতমালার পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ মন্দিরে প্রধানত দেখতে পাওয়া যায়। ছাম সহ পবিত্র বৌদ্ধ ধর্মীয় নৃত্য প্রধানত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মাসের দশম দিনে গুরু পদ্মসম্ভবের জন্মদিনে। গুরু পদ্মসম্ভবকে গুরু রিনপোচে বা উচ্চারণভেদে রিম্পোচে নামেও চিহ্নিত করা হয়। গুরু পদ্মসম্ভবের সময় থেকেই তিব্বতে মুখোশ নৃত্যের সূচনা হয়। আবার আচারকেন্দ্রিক বিবিধ নৃত্য পর্যায় সমূহে মুখোশের ব্যবহার হয়ে থাকে বাঁকুড়া জেলার রাবণকাটা নৃত্যে, উত্তরবঙ্গের ভান্ডী, চণ্ডী, লাখে, তামাং-দের বাকপা, রাভাদের মুখোশ নৃত্য গুলিতেও।
এবার আসাযাক যুদ্ধ নৃত্যের বিষয়ে। আদিম গুহা মানবেরা জীবজন্তুর সঙ্গে বনে জঙ্গলে থাকতে থাকতে একদিন পশুদের প্রতিহত করার কৌশল শিখে নিল, যাকে আমরা রণকৌশল বলতে পারি। এই প্রতিহত করার পদ্ধতিই একদিন হয়ে গেল আত্মরক্ষার জন্য জন্তু শিকারের পদ্ধতি, যা ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো মানুষের খাদ্য বস্তু; অর্থাৎ আগে পশুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে মানুষ পশুকে মেরেছে, এবার খাদ্যের জন্য মানুষ পশু শিকার করলো। মানব জাতির সূচনাকালের পশু শিকারই ছিল প্রথম যুদ্ধ বা রণের সূচনা পর্ব। আর তার প্রস্তুতি ও যুদ্ধজয়ের আনন্দের বহিঃপ্রকাশই হল রণনৃত্য বা যুদ্ধনৃত্য। অর্থাৎ, গুহা মানবের সময় থেকেই শিকারে যাবার পদ্ধতির এই ধারাকে অনুসরণ করেই হয়তো পরবর্তী কালের যুদ্ধনৃত্যের প্রথম সৃষ্টি বা উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। এরপর আদিম কালে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে যখন মানুষ জীবন যাপন করে তখন অন্য গোষ্ঠীর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে যুদ্ধ করে, আর যোদ্ধার যুদ্ধ জয়ের মনস্কামনাও করে। তাই যুদ্ধে বেরোবার আগে যুদ্ধ জেতার আশায় তারা দল বেঁধে যুদ্ধের অনুশীলনে সম্মিলিত হত নাচের ছন্দে ছন্দে, অর্থাৎ যুদ্ধের মহড়া হিসেবে যুদ্ধ নৃত্যকে ব্যবহার করত। এ সবই আদতে নকল, অর্থাৎ এ যেন নকল জয়ের মধ্য দিয়ে আসলকে জয় করার বিশ্বাস; এবং এই বিশ্বাস থেকেই প্রকৃত জয় ঘটলো। এই জয়ের আনন্দে মানুষের মনে ও শরীরে লাগলো ছন্দের দোলা ও তালের ছোঁয়া, মানুষ মনের আনন্দে নেচে উঠলো। এই ভাবেই যুদ্ধ নৃত্যের সূত্রপাত ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। বঙ্গ তথা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে বাঙালিকে এক প্রবল সামরিক শক্তি সম্পন্ন জাতি বলা হয়েছে, মধ্যযুগে তথা সামন্ততন্ত্রের যুগে এই সামরিক জাতির ও তার নৃত্য বিষয় সম্পর্কে মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যেও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে বাঙালির এই যোদ্ধা চরিত্রের বিলুপ্তি ঘটলেও নামের পদবি থেকে আজও বৃত্তিগত ভাবে সৈন্যদের চেনা যায়, যেমন- পদাতিক থেকে পাইক, ঢাল থেকে ঢালী ইত্যাদি। যুদ্ধ নৃত্য প্রসঙ্গে বলাযায় যে এই নৃত্যে বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার আমরা লক্ষ করি, এই উপকরণের মধ্যে মুখোশের ব্যবহারও করা হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলাযায় যুদ্ধ নৃত্যের সঙ্গে যুক্ত মুখোশ নৃত্যের মধ্যে পরভা ছৌ-কে পেয়ে থাকি (‘চিলকিগড়ের দেও ধবলদেব রাজবংশের মুখোশ নৃত্য পরভা ছো বা পরভা ছৌ’ শিরনামে “অপরজন”-2020-January-র সংখ্যায় বিস্তারিত ভাবে পরভা ছৌ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে)।
প্রমোদ নৃত্য প্রসঙ্গে বলাযায় যে- এই নৃত্যের মধ্যেও মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। কেবল মাত্র আমোদ-প্রমোদের উপলক্ষ্যেই এই নাচ হয়ে থাকে। এর সংখ্যা খুবই কম, তবে এর মধ্যে কিছু নৃত্য পূর্বে আচার বা ধর্ম সংক্রান্ত নৃত্যের মধ্যে ছিল যা পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে লুপ্ত হওয়ার ফলে বা দর্শকের চাহিদায় সেই আচার ও ধর্ম সংক্রান্ত নৃত্য প্রমোদ নৃত্যের রূপ লাভ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ প্রাচীন গম্ভীরা এবং গমিরাকেন্দ্রিক হনুমান মুখোশ নৃত্য যা তার স্বরূপ বদলে বর্তমানে প্রমোদ নৃত্যতে পরিবর্তীত হচ্ছে বলেই মনে করাযায়।
লোকনাট্যে নৃত্য বিষয়ে বলাহয় যে- মধ্যযুগের সময় কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সাহিত্যকে অবলম্বন করে বা নাট্যগীত, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অভিনীত হওয়া লোকনাট্যে ব্যবহৃত নৃত্য-কে এই পর্যায়ে ধরা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এই নৃত্যেও মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ খন গান বা রাভান পালার উল্লেখ করাযায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান কালে মুখোশের ব্যবহার দেখা যায় সাধারণত ধর্মীয় আচারকে কেন্দ্র করে, ও প্রমোদ মূলক নৃত্য শৈলীকে কেন্দ্র করে। বাকি মুখোশ নৃত্য পর্যায়ের ব্যবহার কমে আসার জন্যই নৃত্য গুলো সবই এখন প্রায় প্রমোদ পর্যায় ভুক্ত হয়ে উঠেছে। প্রাচীন নৃত্য ধারাকে সঙ্গে নিয়ে যে সকল নৃত্য এখনো টিকে আছে তারা প্রধানত ধর্মীয় পর্যায় ভুক্ত বলেই দেখা যায় এই স্তরে দেব-দেবীর মুখোশের বৈচিত্র্য সকল পর্যায়ের মুখোশের থেকে বেশি বলে ধরা যায়। প্রধানত লৌকিক দেব মাহাত্ম্য, মহাকাব্য ও পুরাণ কে আশ্রয় করে এই মুখোশের উপস্থাপনা হয় বলে ধরে নেওয়া যায়। এই বিষয় ধর্মী চরিত্র গুলোকে কেন্দ্র করে মুখোশের নির্মাণ ও নৃত্য বৈচিত্র্য অন্য সব পর্যায়ের থেকে বেশি। এই পৌরাণিক ও লৌকিক দেব-দেবীদের মুখোশের দ্বারা তাদের মাহাত্ম্য ফুটিয়ে তোলাই এই মুখোশ নৃত্যের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এছাড়াও আছে সামাজিক পালা বা বিষয় কেন্দ্রিক নৃত্যধারা, তবে এই পালাকেন্দ্রিক বা লোকনাট্যের মুখোশ নৃত্য কেবল অঞ্চল ভেদেই তাদের জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
মুখোশ নৃত্যের বিবর্তনের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে লক্ষ করা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের মানব জাতির বিবর্তনের ইতিহাস লিখিত অবস্থায় মেলে প্রায় চতুর্থ-পঞ্চম শতক থেকে। তাই তার আগের ইতিহাস জানতে আমাদের সাহায্য নিতে হয় বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় থেকে, যার অনেক কিছুই আমাদের কাছে অজানা। ব্রিটিশদের পশ্চিমবঙ্গে বসতি স্থাপনের আগে পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস রচনা করা হয়নি। তাই তৎকালীন ইতিহাস জানতে হত প্রাচীন রাজ অনুশাসনের দলিল, বিবিধ শিলালিপি, তাম্রপত্র, শিলমোহর, মন্দিরলিপি, বৌদ্ধ বিহার-প্রতিমালিপি ইত্যাদির থেকে। তবে, বিশেষত মুসলিম রাজত্ব কালে প্রায় দেড়হাজার বছরের হিন্দু ও বৌদ্ধ ইতিহাস প্রায় সবই ধ্বংস করা হয়। অন্যদিকে দেখাযায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর আগমনের ফলে ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেল বন্ধন ঘটে ছিল। যার ফলে মুখোশের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যতা। বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার যা তান্ত্রিক সাধন রীতিকে সুদৃঢ় করে, এবং তা মুখোশের বৈচিত্র্য ও বহমানতাকে আরো দীর্ঘায়িত করেছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোনো মুখোশের ব্যবহার ছিল না। উপর্যপরি মুসলিম শাসন কালের বিশৃঙ্খলতার ফলে এই মুখোশ সংস্কৃতির দীর্ঘ বিচ্ছেদ পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। এই সকল অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি তথা লৌকিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ধারা থেকে মুখোশ নৃত্যের বিবর্তন সম্পর্কে ধারাবাহিক তথ্য পাওয়া খুবই অসম্ভব এক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তবুও নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিবিধ গুহাচিত্রকে বিশ্লেষণ করে এবং প্রাগৈতিহাসিক বহির্দেশীয় ধারার ইতিহাস থেকে তথ্য সঞ্চয় করে মুখোশ নৃত্যের সূচনা পর্ব সম্পর্কে এক ধারণা গঠন করা গেলেও তার সঠিক কোনো প্রমাণ লাভ করা যায়না। এর পরবর্তী সময় নৃত্য বিষয়ে বিবিধ উল্লেখ পেলেও মুখোশ নৃত্য বিষয়ে ব্রিটিশ শাসন কালের আগের সময়ের কোনো তথ্য প্রমাণ মেলেনা; তবে উনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে ও স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে এই বিষয় নিয়ে বেশকিছু তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলায় ব্যবহৃত মুখোশ নৃত্যের সর্ব প্রধান উপকরণ হিসেবে কাঠের মুখোশের ব্যবহারই সবথেকে বেশি। কারণ প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গে কাঠের মুখোশের ব্যবহার লক্ষ করাযায়। তবে কাঠ ছাড়াও মুখোশ বানানোর অন্য উপকরণ বলতে ব্যবহার হয় শোলা, মাটি, কাগজের মণ্ড, বাঁশ, লাউ-এর খোল, চাঁটাই, গাছের ছাল, কাপড়, প্লাস্টিক ইত্যাদি। তবে এই মুখোশ নৃত্যের ধারাটি বর্তমানে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। যার প্রধান কারণ হিসাবে বলা যায় গ্রামীণ মানুষ আগে ছিল কেবলই কৃষি নির্ভর। কৃষিকে সম্বল করেই তাদের আর্থিক ও সামাজিক দিক গুলো গড়ে উঠে ছিল, যা তাদের কৃষি ভিত্তিক কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতেও সাহায্য করত। কিন্তু বর্তমানে কৃষি নির্ভর শিল্পীদের যথাযথ আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় শিল্পের প্রতি অমনোযোগিতাও লক্ষ করাযায়। যার জন্য শিল্পী ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম অন্য পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। সেই জন্য অর্থ উপার্জনের কারণে বংশ পরম্পরা ভিত্তিক জীবিকা ছেড়ে ভিন রাজ্যে বা ভিন শহরে চলে যাওয়া ও ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের কারনে শিল্পী ও তাঁর শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে সমাজে এক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। আবার বিশ্বায়নের ফলে গ্রামীণ সমাজে আধুনিকতার প্রবেশের ফলে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারকে বর্তমান প্রজন্ম কুসংস্কার বলে চিহ্নিত করে, যার ফলে দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে না মানার কারনে শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মদের শিল্পের প্রতি অনুরাগ দেখতে পাওয়া যায় না। সেই কারনে প্রবীন শিল্পীদের মৃত্যুর পর সেই অভাব পূরণের জন্য নতুন শিল্পীদের এগিয়ে আসতেও বিশেষ দেখা যায় না। এছাড়াও সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে নৃত্য, গীত, ও বাদ্য শিল্পীদের জন্য সরকার যদিওবা সামান্য কিছু মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু মুখোশ তৈরির শিল্পীদের ক্ষেত্রে এইরূপ কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা নেই। প্রাথমিক ভাবে এই সকল কারণের জন্যই বর্তমানে মুখোশ তৈরির দক্ষ শিল্পী ও মুখোশ নৃত্যের শিল্পীর উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ অভাব লক্ষ করা যায়।
[সমাপ্ত]
[লেখক – কুচিপুড়ি নৃত্যশিল্পী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশনৃত্য নিয়ে গবেষণারত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের অধ্যাপিকা।]
Posted in: ARTICLE, August 2020 - Serial
Sotti e opekkha tei chhilam abar kobe aschhe apnar lekha… Notun notun tothyo ato sundor vabe barnita ar ato darun vabe lekha j porteo bhison i bhalo laglo.onek onek dhonyobad amader kache ato sundor kichhu tothyo tule dhorar jonyo ebong sottie e jeno upohar sarup abaro dhonyobad janaim bhison i bhalo laglo..