স্বাধীনতার রামায়ণ : মৌ দাশগুপ্ত

আমাদের ছোটবেলায় রামায়ণ ছিল পৌরাণিক কাব্য, রাম ছিলেন শুধুই এক পৌরাণিক চরিত্র। স্বয়ং দেব নারায়ণের এই পিতৃভক্ত, প্রজাপালক, সপ্তম অবতারটি কিন্তু বাঙালী সমাজে বিশেষ কল্কে পেতেন না, সে সীতার কারণেই হোক কি গুহকরাজ, শম্বুকের সাথে অস্বৈরেণ ব্যবহারের জন্যই হোক।যদিও সেই রামের অকালবোধন সম্পর্কিত শারদীয়া দুর্গাপুজোই কিন্তু বাঙালীর মুখ্য উৎসব।বরঞ্চ শ্রীরামচন্দ্রের তথাকথিত জন্মদিন রামনবমীর আড়ালে ধামাচাপা পড়ে আছে বাঙালীর বাসন্তী পুজোর রমরমা। ভারতের অন্যত্র রামনামের বিশেষ মহিমা আগেও ছিল, এখনও আছে, ক্রমশ তো বাড়ছেই বলা যায়। আমাদের ছোটবেলায় বেলঘরিয়ায় মোহিনী মিলের পাঁচমিশালি শ্রমিক বস্তিতে বছরে একবার প্রবল উৎসাহ সহকারে রামলীলা অনুষ্ঠিত হত।লাউডস্পিকারে সোচ্চারে বাজত, রামগান, কি ভজন, “বোলো রাম রাম রাম, বোলো শাম শাম শাম”… স্কুলের দুনিয়াচাচার মুদ্রাদোষ ছিল ” রাম রাম” বলা…আর জানতাম গান্ধীজীর সুরেলা রামধুন এবং আফ্রিকান ব্যান্ড ওসাবিসার সেই প্রলয়ঙ্কর “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম” । জানতাম রাজা শশাঙ্কের সেনাপতি মোহন আগুরির মোক্ষম অস্ত্র ছিল নাকি রামদা। রামের সুমতিও পড়েছিলাম। রামায়ণের সাথেও অপরিচিত ছিলাম না। ব্যস রামনামের সাথে আমার পরিচয় এইটুকুই।পরে মামাবাড়ি কুলটি গিয়ে জেনেছিলাম ওখানকার অবাঙালী জনগোষ্ঠীতে রামের প্রভাব এতটাই যে মৃতদেহ নিয়ে যাবার সময়ও বলে রাম নাম সৎ হ্যায়। সত্য অসত্য জানি না, আমাদের বাংলা ভাষায় ‘রাম’ কিন্তু চিরকাল তর/ তম বোধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন, রাম বোকা, রাম চিমটি, হাঁদারাম, রামদা, রাম ফল থেকে বৃহদাকার ছাগল অব্ধি আমাদের ভাষায় রামছাগল কি রাম পাঁঠা।

তবে ধর্মকে যবে থেকে সুচারুভাবে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হচ্ছে তবে থেকে রামের বোলবোলার গ্রাফ ভারতভূমিতে ক্রমশ ঊর্ধ্বগতিতে চলছে। এই যেমন, হিন্দু মুসলমান মানেই ‘রাম-রহিম’।রামরাজ্য তো জানেনই সবাই। প্রজাতান্ত্রিক শান্তশিষ্ট রাজ্য।

সত্যি কথা বলতে কি এখন ভারতীয় হিন্দুত্বের প্রতীক রাম। ‘জয় শ্রীরাম’, রাম জি কি কিরিপা ( কৃপা), এখন সর্বজনবিদিত।রাজনীতিও এখন শ্রীরাম চরণাশ্রিত। রামের পাদুকা, তীর ধনু, রুদ্রাক্ষমালা, গেরুয়া বস্ত্র এবং রাম জন্মভূমি, ভারতীয় রাজনীতিতে এক সংযোজন। এর শুরু কোথায় বলা মুশকিল, তবে মোটামুটিভাবে মহাত্মা গান্ধীর দ্বারাই এর প্রচার ও প্রসার ব্যাপক রূপ নিয়েছে এ কথা বোধহয় বলাই যায়। ওনার অন্ত্যজ জনদের হরিজন বলে সম্বোধন, রামধুন গান এবং নাথুরাম গডসের গুলির আঘাত সহ্য করে শেষ আর্তনাদ ‘হে রাম’ রাম নামকে ভারতীয় রাজনীতিতে এক স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছে।

ঐতিহাসিকরা বলছেন, রামরাজত্ব মুছে গেছে,সে আজ ২৫০০ বছর পার হয়ে গেছে। অথচ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আজও সেই শ্রীরাম ইস্যু। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর,ভারতের ধর্ম-সহিষ্ণুতার ইতিহাসে এক কালো দাগ। উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত, ১৬শ শতকের নির্মিত বাবরি মসজিদের খানিকটা ভেঙে ফেলেছিল উত্তেজিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতা। কেন? কেননা সেখানেই নাকি ছিল রাম জন্মভূমি, রামমন্দির। এর স্বপক্ষে ও বিপক্ষে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ এখনো অন্তর্জালে মজুত।তা নিয়ে কচকচিতে গিয়ে লাভ নেই, যাচ্ছিও না। দেশ জুড়ে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাঁধে, প্রাণহানি, সম্পত্তি ক্ষয় হয়, আর সেদিন থেকেই ওখানে রামমন্দির গড়ার দাবী শক্তিশালী হতে শুরু করে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজনীতির খেলুড়েরা, ভারতীয় জনতা পার্টি এই সুযোগে তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে একে অন্যতম ইস্যু করে তোলে।

রাম যুবরাজ হিসাবে যেমন এক বিনয়ী, সত্যব্রতী, আদর্শ ভারতীয় পুত্রের নিদর্শন তিনিই কিন্তু আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। রাজ্যের এক প্রজার অযৌক্তিক ও প্রমাণ বিহীন দোষারোপে যিনি নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন তাও কিনা একই ইস্যুতে অগ্নিপরীক্ষার পরে,একে কিন্তু আমি মেল শভিনিজমের দৃষ্টান্তই বলব। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে দেবার ধৈর্য কি শালীনতাটুকুও দেখান নি পুরুষোত্তম। শুধু তাইই নয়, মনে আছে বালী হত্যা? তাও কিনা পিছন থেকে লুকিয়ে বাণ মেরে। আসলে শুধু সুগ্রীবের জন্য বালী হত্যা নয়, পরমবীর বালী যে অনার্য নৃপতি হিসাবে আর্যসমাজের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। এইখানেই রাম আর কৃষ্ণের তফাত। কৃষ্ণ বাক্য আশ্রিত শ্রীমদ্ভাগবতগীতা হিন্দু ধর্মের কাঠামো হলেও আজকের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের পারানির কড়ি কিন্তু সেই রাম, কৃষ্ণ নন। মজার কথা, মহাত্মা গান্ধির ভজনে, উপদেশে এই রামচন্দ্রই বারবার উপস্থাপিত হয়েছেন অহিংসা, উদারতা ও সত্যাগ্রহের আদর্শ হিসাবে। বাস্তবে যেখানে রাম রাজধর্মের প্রতীক।একনায়কতন্ত্রের প্রতীক। তার কাহিনীতে নারী হবেন নরম বেতসপত্রীস্বভাব, যখন যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চাইবেন সেভাবে, সেই ধাঁচে নিজেকে মানিয়ে নেবেন। সূর্পণখার মত নিজের পছন্দ সোচ্চারে জানাবেন না, অহল্যার মত প্রতিবাদী হবেন না, শান্তার মত স্বাভিমানী হবেন না, বিয়েই নারীজীবনের মোক্ষ এবং তারপরে শুধুই স্বামীর ছায়া মাত্র হয়ে অনুগমন করবেন। যেখানে মহিলাদের নিজস্বতা, আলাদা অস্তিত্ব এবং কথার কোন দাম নেই। সর্বংসহা সীতা সে রামরাজ্যের আদর্শ।ব্রাহ্মণ্যধর্মই মহত্তম। শূদ্র যদি গুহকরাজার মত সেবক হয়ে থাকেন তো ঠিক আছে, নয়ত শম্বুক হতে হবে। এই রাম-নীতি কি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে অনুকরণ যোগ্য?

রাজনীতিতে সুবিধামত ইস্যু থাকতে হয়, বা প্রয়োজনমত ইস্যু তৈরি করতে হয়।রাজনীতির মাঠে পক্ষ বিপক্ষ দুটি আলাদা দল লাগে।যখন ব্যক্তিগত স্বার্থে দেশের মুল সমস্যা জিইয়ে রাখতে হয় অথবা সমস্যাগুলো আর সুলভে সমাধানযোগ্য থাকে না, তখন সেখান থেকে আম জনতা/ সাধারণ ভোটারদের নজর সরাতে অনেকসময়েই ইস্যুলেস টপিক বা এককথায় অদৃশ্য এক শত্রুর প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশে ধর্ম নামের আফিমের নেশা এত তীব্র যে ওই এক ইস্যুই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ইস্তাহারের মোড়কে মুড়ে আমাদের সামনে খুড়োর কলে দোলানো হয়। এসব না করলে রাজনীতির খেলায় দাঁওপ্যাঁচ জমে না। আর এই রামজন্মভূমি , বাবরি মসজিদ, গোরক্ষা, এনআরসি এসবই এই রাজনৈতিক দাঁওপ্যাঁচের উপাদান মাত্র। এগুলো না থাকলে সুবিধাবাদী রাজনীতিই হারিয়ে যাবে। ফলে দেশজুড়ে যে নতুন রামকথার ঢেউ উঠছে তাতে রামের মুখোশ পড়ে নায়ক কিন্তু সেই রাজনীতিই।ধনুর্ধারী গেরুয়া বসন পরিহিত শ্রীরামচন্দ্র যার পোস্টার আইডল মাত্র ।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আমাদের মানসিক ধ্যানধারণার অনেক তফাত এনেছে। আমরা স্বাধীন রাজনীতির, স্বাধীন ধর্মাচরণের স্বাধীনতা পেয়েছি। আইনের পথেই পেয়েছি। তার আগে ধর্মের জিগির তুলে দেশভাগ হয়েছে।আর এই দেশভাগের তিক্ত স্মৃতিই ধর্মীয় মেরুকরণের বীজে জল সিঞ্চন করে তাকে লতায় পাতায় পল্লবিত করে গেছে। মণ্ডল বনাম কমন্ডলের ( বা কমণ্ডলু) রাজনীতির জোয়ার ভাঁটায় ফেনার মত ভেসে উঠেছে গেরুয়া রাজনীতি,উদ্দেশ্য রাম মন্দির নিয়ে হিন্দুদের আবেগকে নিয়ে দাবাখেলা। আর সেই ইস্যুকে সম্বল করেই ১৯৮৯ সালের ৮৪ সাংসদের দল আজ দিল্লীতে, শাসকের স্থানে।১৭তম লোকসভা নির্বাচনে অব্যবহিত পরে
৫৪৩ বিশিষ্ট লোকসভা আসনের (৫৪২ আসনে ভোট হয়) মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৫৩ টি আসন। এর মধ্যে বিজেপির একারই আসন ছিল ৩০২। ভারতবর্ষের এই রাজনৈতিক গেরুয়া করণের পুরোটাই কিন্তু সেই রামভরোসা।

বিগত ৫ই আগস্ট ২০২০, দেশের অতিমারী, ভুখমারী,পরিযায়ী শ্রমিক বিপর্যয়, কাশ্মীর সমস্যা, চৈনিক আগ্রাসন, বেরোজগারী, বেহাল বাণিজ্য, থমকে যাওয়া শিল্প, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সবকিছুকে
পাশ কাটিয়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ভূমি পুজোয় পৌরোহিত্য করেন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় নরেন্দ্র মোদী। রামমন্দির নির্মাণের জন্য রূপোর তৈরি প্রথম ইটটি গাঁথার পরেই তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন,
“আজ পুরো ভারত রাম ময়। পুরো দেশ রোমাঞ্চিত। প্রত্যেকের মনে যেন দীপাবলি। বহু বছরের অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে। কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসই হয়তো হচ্ছে না যে জীবদ্দশায় তাঁদের এই স্বপ্নপূরণ হচ্ছে”। তাঁর কথায়, “অনেক বছর ধরে কাঠ আর তাঁবুর নিচে থাকা রামলালার জন্য এবার মন্দির নির্মাণ। ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে উঠে আসা এই মন্দির ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে”।

আমরা তো জানি, যে, রাম তো শুধু যুগ পুরুষই নন। রাম এক মোক্ষলাভের আনন্দও।
…” যস্মিন রমন্তে মুনয়ঃ বিদ্যয়া জ্ঞানবিল্পবে।
তং গুরু প্রাহ রাম রমণাদ্রাম ইত্যপি।।”…
কিন্তু রাম জন্মভূমির প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে যে গেরুয়া বসনধারী ধনুর্ধর রাম দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক সমস্যাগুলোকে আড়াল করে যুদ্ধলিপ্সু চোখে তাকিয়ে আছেন আমাদের মত সাধারণ ভারতবাসীর দিকে, তার সাথে ‘রাম’ শব্দের কোন প্রচলিত সংজ্ঞাই খাপ খাচ্ছে না। এ যেন স্বাধীন ভারতবর্ষে এক অন্য রামায়ণের সূচনা , যার বিষয়বস্তু যুগ পুরুষের ভক্তিমার্গ থেকে রাজনীতিমার্গে ক্রম-অবনমন।

[লেখক – কর্মসূত্রে প্রবাসী বাঙ্গালী। মূলত কবিতা আর ছোটো গল্প লেখেন দু’বাংলা থেকে প্রকাশিত একাধিক লিটিল ম্যাগাজিন, ব্লগাজিন, ই- ম্যাগাজিন–এ। পেশায় একদা এন.আই.টি (রাউরকেলা)-র রসায়ন বিভাগের অধ্যাপিকা ছিলেন, ভারত সরকারের স্কলারশিপ (WOS-A) নিয়ে রিসার্চ করেছেন বায়ো-মেটেরিয়াল-র ওপর।]

Facebook Comments

Leave a Reply