গন্ধ : মিতালি জানা

“হেইয়া কী করস? তোরে কইছি না হইদিকে মাথা দিয়া শুইবি না। মাইনষে মরলে উত্তরে মাথা দিয়া চিতায় দেয়” কাঁপা গলায় কেটে কেটে কথাগুলো বলেই হাঁফিয়ে পরলেন গিরিবালা। কোটরে বসে যাওয়া উজ্জ্বল দুটো চোখের চারপাশের বলিরেখা জানান দিচ্ছে এ গ্রহের ৮১ টি পরিক্রমনের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।

কথাটা শেষ করে হাতে থাকা পূজোর নাড়ু কটা নিজের কপালে ঠেকিয়ে হাতে দিলেন সানির। সানি নাড়ু গুলো মুখে পুরে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মোহর হাসছে ফিকফিক করে। সে জানে তার আম্মার (বাবা আম্মা বলে তাই সেও আম্মা বলে) বলা কথা গুলোর সামান্যতম বোধগম্য হয়নি তার এই তিনদিন হল এ বাড়িতে আসা হিন্দিভাষী সানি দাদার।

গিরিবালা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মোহর হিন্দিতে অনুবাদ করে দিল তার আম্মার বক্তব্য। আর এও জানালো ইতিপূর্বে এই কথা গুলো তিনি আরোও একবার বলেছিলেন ফলে এবার যদি ভুল হয় তাহলে আম্মা চন্ডীর রূপ ধারন করবেন। ত্রিশূল হাতে ৮১ বছরের আম্মাকে কেমন লাগবে এটা কল্পনা করেই দুজনে হো হো করে হেসে ফেললো।

এ বাড়িতে গিরিবালার কথা কেউ অমান্য করে না। রত্নগর্ভা গিরিবালার তিন সন্তান। সুব্রত, দেবব্রত ও তিথি। সকলেই প্রতিষ্ঠিত। কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক বড় ছেলে সুব্রত সস্ত্রীক থাকে পুনেতে। তাদের একমাত্র কন্যারত্নটি বিবাহ সহ কর্মসূত্রে বসবাস করে বেলজিয়ামে। গিরিবালার ছোট ছেলে দেবব্রত বাস করে দিল্লির রোহিনিতে। একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। স্ত্রী গার্গী ও দুই ছেলে তথাগত, অরুনাভ ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত। তথাগতের স্ত্রী পর্না ও মেয়ে মোহরকে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার গিরিবালার। যদিও গিরিবালা নিজের ইচ্ছামতো বড় ছেলে সুব্রত-এর কাছে পুনেতে গিয়েও থাকেন। গিরিবালার মেয়ে অবিবাহিতা তিথি বিশ্বভারতীর অধ্যাপিকা।

একটু পিছনে গেলে দেখা যাবে গিরিবালার জন্ম তৎকালীন অখণ্ড বাংলায়, ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বনেদি যৌথ পরিবারে। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক কলকাতাসহ সারা বাংলায় যখন আগুন ধরালো গিরিবালা তখন নিতান্ত শিশু। যদিও পারিপার্শ্বিক অবিশ্বাসের বাতাবরন শিশুমনকে ছুঁয়ে গেছিল যখন তার সই সালেমা ও তার দাদা কাদির-এর এ বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ হল। লুকিয়ে দেখা করার শাস্তিস্বরূপ জেঠামশাই একদিন সারাদিন শিশু গিরিবালাকে একটা ঘরে বন্দী রাখেন। যদিও লুকিয়ে চুরিয়ে ওরা দেখা করতো। ৪৭-এ আলাদা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল অবিশ্বাস ও সন্দেহের ভারি গুমোট হাওয়ায়। এর পর শুরু হল ধারাবাহিক দাঙ্গা। ধর্ম,ভাষা,সংস্কৃতি সব বিষয়ে আলাদা স্বীকৃতির দাবি। ইতিহাস সাক্ষী, দখলদার কখনোও বিনা যুদ্ধে নাহি ছাড়ে সূচাগ্র মেদিনী। একদল লড়ে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই অন্যদল লড়ে ক্ষমতা কায়েম রাখার লড়াই।

১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ – এই চারবছরে আমূল বদল এলো সাধারনের জীবনে। যারা দেশভাগের সময় দেশ ছেড়ে কলকাতায় গেল তাদের খবর আর কেউ রাখে না। তাদের ছেড়ে যাওয়া উঠোন নিকোয় এখন অন্য কেউ। প্রতিবেশী হয়ে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বী। একে অপরের উপর নজরদারি চালায় বাঁকা চোখে। গিরিবিলা সহ যে ক’টি পরিবার বিক্রমপুরে থেকে গিয়েছিল তারা ভেবে পায়না কী করবে। যে যার মতো করে আত্মরক্ষার অস্ত্র মজুত করে ঘরে। যদিও জানে এ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। দেশভাগের সময় দেশছাড়া পরিবার গুলোর পরিনতির ঘটনা তখনোও টাটকা তাদের মনে। পরিবারের মেয়েদের সম্মান রক্ষা যে পুরোপুরি ভাগ্যের হাতে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই তাদের। তবুও নিজের মাটি, নিজের ঘর, নিজের জমির মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে না এরা।

শীতের শেষ দিকে হঠাৎ পরিস্থিতি সরগরম হয়ে ওঠে। রেডিওতে শোনা যায় শহরের দাঙ্গা পরিস্থিতি ভয়ানক। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ পায়নি বহু পরিবার। বিক্রমপুরেও লাগল দাঙ্গার আঁচ। গিরিবালার জেঠামশাই সিদ্ধান্ত নিলেন রাতের অন্ধকারে গিরিবালার মা-বাবা পরিবারের সব মহিলা ও বাচ্চাদের নিয়ে একটা ছোট নৌকায় যতোটা সম্ভব সোনাগয়না ও টাকাপয়সা সহ নারায়ণগঞ্জ যাবেন সেখান থেকে গোয়ালন্দ হয়ে শিয়ালদা। কলকাতার গ্রিন ভিউ রোডে এক দূর আত্মীয়ের বাড়িতে উঠবে ওরা তারপর সুযোগ মতো গিরিবালার চার জেঠামশাই কলকাতায় যাবে। গিরিবালার বয়স তখন এগারো।

নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকেই বাড়িতে শোকের ছায়া। দমকে দমকে উঠছে কান্নার রোল। তবে সবটাই খুব চাপা স্বরে যাতে বাইরে কেউ কিছু টের না পায়। গিরিবালার মন টা হু হু করে উঠল তাদের ছোটবেলার সই সালেমার সাথে আর জীবনেও দেখা হবেনা ভেবে। সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিছনের পুকুর ধারের সরু পথটা দিয়ে গিয়ে পৌঁছল সালেমাদের খিরকির দরজায়। প্রায় সাতমাস পর এল সে সালেমাদের বাড়ি। দরজা খুলেই মুখোমুখি হলো কাদিরের।

“অহন কীয়ের লাইগ্যা এহেনে? তুই বাড়ি যা, কেউ দেইখ্যা ফালাইলে সর্বনাশ ওইবো।” অস্থির হয়ে বলল কাদির।

“আমাগো আইজ চইল্যা যাওয়ার দিন, সালেমার সাথে হগ্গল জীবন আর দেখা হইব না, একবার দেইখ্যাই চইলা যায়ুম। কাদির দাদা তুমি কাউরে কইও না।”

কাদির গিরিবালাকে দরজার বাইরে রেখে দরজাটা বন্ধ করে ডেকে নিয়ে আসে সালেমাকে। তিনজনে গিয়ে দাঁড়ায় পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছটার নীচে। গিরিবালা সালেমা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে হাপুস নয়নে। ওরা একে অপরকে কথা দেয় বড়ো হয়ে একদিন ঠিক দুজন দুজনকে খুঁজে নেবে। কাদিরের গাল বেয়ে নেমে আসে নোনাধারা।

রাতে খিড়কির দরজা দিয়ে পিছনের পুকুরের পার ধরে রেজ্জাকদের বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে খালের ধারে এসে উপস্থিত হয় সবাই। নিঃশব্দে চোখের জল ঝরতে থাকে অবিরত। নৌকার মাঝি একে একে হাত ধরে তুলে নেয় সকলকে। বাঁশবাগানের শুকনো পাতার উপর কারো একজনের পায়ের শব্দ শোনা যায়। দ্রুত নৌকা ছাড়ে মাঝি। ভয়ে সিঁটিয়ে যায় যাত্রীরা। খালের পার ধরে ওদের নৌকার পাশে পাশে চলতে দেখা যায় এক অবয়বকে। তবে কী শত্রুপক্ষ জানতে পারলো তাদের দেশত্যাগের খবর।এবার উপায় কী?

নৌকার মাঝি অভয় দেয় “ডরাইয়েন না, আমি আফনাদের হগ্গলরে মুক্তি দিয়াম, হেই আমাগো লোক, আফনেরা দ্যাশেই থাইয়েন, আমাগো লোক হেই সাইমনের পাড়ায় আফনাগোর অপেক্ষায় খাড়ায় আছে। সোনা যা কিছু আছে আমারে দিয়া দ্যান, আফনাগো তো হেমনেই মাইরা ফেলাইবানে আর হেই খালের নিচে পুইত্যা দেবানে, শুদ্দু শুদ্দু সোনাগুলান আর নষ্ট কইরেন ক্যান।” চাঁদের আলোয় দেখা গেল মাঝির লোভাতুর চাহনি।

যে কান্না এতক্ষণ গোপনে ছিল তাই এখন গগনভেদী হয়ে উঠল। খালের জলে ঝপাৎ শব্দে লাফিয়ে পরলো ছায়া অবয়বটি। নৌকার যাত্রীদের ভয়ে হুটোপাটিতে দুলে উঠল নৌকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঝির উরুতে চেপে বসল চকচকে কাটারিটা, কঁকিয়ে উঠে টাল সামলাতে না পেরে জলে পরলো মাঝি, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাঝির বৈঠা দখলে নিল ছায়ামানুষটি। ততক্ষনে সকলের চিৎকার আর কান্নার মিশ্রিত শব্দে খানখান হয়ে যাচ্ছে চারপাশ।

কাদির দ্রুত হাতে নৌকার মুখ বিপরীত দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে শুধু বলল “আফনেরা স্থির হইয়া বহেন, আমি আফনাগো কুন ক্ষতি হতে দিতে পারুম না। আইজ সন্দাবেলা বাবারে কইতে শুনলাম আফনেরা আইজ দ্যাশ ছাইড়া যাবেন হেইডা শত্রুপক্ষ জাইনা গেছে, তখনই আমি বুঝ্ঝি আফনাগো কুন বিপদ হইতে পারে। অহন চুপচাপ বইসা রয়েন আমি আফনাগো নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাইয়া দেই।”

বলাই বাহুল্য এরপর আর গিরিবালার জেঠামশাইরা কেউ ফিরতে পারেননি।

কালের স্রোতে বিয়ে সংসার এসবের কারনে গিরিবালা কখনোই থিতু হয়নি কোথাও। গিরিবালার স্বামী নীহাররঞ্জনের ছিল বদলির চাকরি ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে থাকতে হয়েছে। আর এখন তো ছেলে মেয়েরাও ভারতের বিভিন্ন জায়গায়।

শীতের মাঝামাঝি দিল্লীর সর্বত্র জ্বলে উঠল দাঙ্গার আগুন। শেষ চারদিন বাড়ি থেকে কেউ বেরোতে পারেনি। দেবব্রতরা যে এলাকাটিতে থাকে সেটি বেশ অভিজাত। পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে এই পরিস্থিতিতে। তবুও সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক। একতলায় রাস্তার দিকের ঘরে গিরিবালা ঘুমোন। সন্ধ্যে থেকেই এলাকায় উত্তেজিত মানুষজনের চিৎকার শোনা যায়। বোমার শব্দ সাথে কাচ ভাঙার শব্দ। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে সবাই। গিরিবালা সবাইকে সাহস জোগান। মাত্র এগারো বছর বয়সে দেশ ছেড়ে অচেনা দেশে টিকে থাকার লড়াই তাকে শিখিয়েছে ভয় পেতে নেই।

চারিদিক একদম নিস্তব্ধ। চেনা পাড়াটাকে রাতের বেলায় একদম অচেনা লাগছে। রাস্তার যে জায়গাগুলোতে আলো জ্বলছে না সেখানে যেন ভয় গুলো জমাট বেঁধে ঘাপটি মেরে সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। নির্দেশ পেলে বা সুযোগ বুঝলে বাকি আলো গুলোকেও গিলে নেবে।

সারারাত জেগে থেকে সবাই এখন একটু ঘুমিয়েছে। হঠাৎ একদল মানুষের চিৎকার আর অশ্রাব্য ভাষায় কথপোকথন শুনে সবাই চমকে উঠে পরেছে।দৌড়ে গিরিবালার ঘরে এসে ঢুকেছে সবাই। গিরিবালা আঙুলের ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলে কান পেতে শুনতে থাকেন বাইরে কি কথা হচ্ছে।

“শালা জায়েগা কাঁহা, চপ্পল ইধার হ্যায় মতলব ইস ঘরমে ঘুসা হোগা, অর বাইকবালা শালা নিকল গ্যায়া। আজ দোনোকো খতম করনা থা, এক তো নিকল গ্যায়া দুসরে কো ঢুন্ড, শালেকো আজ জিন্দা জালায়গা।” আশেপাশের বাড়িগুলোর সাথে দেবব্রতদের বাড়ির চারপাশটাও একচক্কর ঘুরে দেখে নেয় মুখে কাপড় বাঁধা হাতে বিভিন্ন অস্ত্র সহ কিছুজন। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে এলাকা ছাড়ে তারা।

সব শান্ত হয়ে গেলে গিরিবালা ঠাকুরঘর থেকে ডেকে আনে সানিকে। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সানির দিকে। গিরিবালা বলেন এ হলো আমার ছোটবেলার সই সালেমার নাতি সাদেক– ডাক নাম সানি। ওর ঠাকুমা ওকে পাঠিয়েছে আমার সাথে দেখা করতে।

তথাগত বলতে চেষ্টা করে “আম্মা ও এলো কোথা থেকে? কাল রাতেও তো ও ছিলোনা আর ওকে লুকিয়েই বা রেখেছিলে কেন? ওকে তুমি চিনলে কী করে?”

“কোথাও তো যায় নাই আইব ক্যামনে, আমার মনের মদ্দেই তো আছিল, আর লুকাই নাই তো, তুরা কখনো জিগাস নাই তাই বলি নাই, ওর গায়ে যে আমার দ্যাশের মাটির, শৈশবের, সইয়ের, গন্ধ লাইগ্যা আছে অর গায়ে। ওরে চিনুম না।”

Facebook Comments

Leave a Reply