সম্পাদকীয়
কবি কামবনের রামায়ণে স্বয়ং রামচন্দ্রকে সস্ত্রীক মৎস্য ভক্ষণ করাইয়া তাঁর রক্তিয় ভ্রাতৃত্ব লাভ করিয়াছিল দলিত গুহ। সেই রামচন্দ্রই আবার কামবনের পূর্বসূরি বাল্মীকির মহাকাব্যে মনুবাদী ইন্টারপোলেশন মারফত বেদবেত্তা শূদ্রঋষি শম্বুককে অর্ধচন্দ্র দর্শন পূর্বক ব্রাহ্মণ্যবাদের বিজয় রথের গতি বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। তবে আধুনিক ভারতবর্ষের সারাৎসার প্রকৃতপক্ষে উঠিয়া আসিল তখনই যখন মর্যাদা পুরুষোত্তমের বাণবিদ্ধ হইয়া জনৈক মেন্ডক “রাখে হরি মারে কে”-র সামান্য পরিবর্তন ঘটাইয়া “মারে হরি রাখে কে” করিয়া দিলেন। সাত দশকেরও অধিক কাল অতিক্রান্ত হইয়া ক্ষমতা হস্তান্তর-পরবর্তী যুগে আমাদের অবস্থা ঠিক কী দাঁড়াইয়াছে তা আর সেইহেতু না বলিলেও চলে। মহর্ষি কাশ্যপের পুণ্যভূমিতে কলহনের রাজতরঙ্গিনীর মন্দ্রিত উচ্চারণ বদল হইয়া বুলেট ধ্বনির রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। তিনশ সত্তর এবং পঁয়ত্রিশ-এ বিলুপ্ত হইয়াছে, তার ঠিক এক বছরের মাথায় জনগণের কষ্টার্জিত টাকা ফাঁকা করিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হইয়াছে রাম মন্দিরের। হুলুধ্বনি উঠিয়াছে! রামলালা ভিটামাটি পাইয়াছেন। তবে, বড়দার কপালে দীর্ঘ আইন আদালতের সমাপ্তিতে জমি জুটিলেও মেজো-সেজো-ছোট বঞ্চিত হইয়াছে। তালিকা হইতে অবশ্য গুহকে আগেই বাদ রাখিয়াছি। তাহার তো একটাই ভবিতব্য : ব্রাহ্মণ্য মার্সেনারীর হস্তে লিঞ্চড্ হওয়া। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। হিন্দুত্বের আফিম গিলিয়া নির্মলা দেব্যার চাবুকাঘাত চুম্বন স্বরূপ লাগিতেছে। ত্রেতা যুগের মর্যাদা পুরুষোত্তমও নির্মল হৃদয়ে কলিযুগে পদার্পণ করিয়া গাঁটকাটায় রূপান্তরিত হইয়াছেন। যুগ মাহাত্ম্যের কারণে তস্কর পেয়াদা হইয়াছেন, আর সেকারণে পি.এম. কেয়ার্সের অধুনা সঞ্চয়ের হিসাব জানিতে চাহিলে শ্রীঘরে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। প্রশান্ত কিশোরকেও রাম রদ্দা কষাইয়া দিয়াছেন রামপেয়ারি ন্যায়ালয়! “চোপ! আদালত চলছে!” চলছে, তবে শ্রীরামের “মন কি বাত”-এর জুরিস্প্রুডেন্স অনুসারে। আদানি, আম্বানি আপন হইয়াছেন; সাধারণ জনগণ হইয়াছেন অপর, ইংরাজিতে যাহাকে Other বলে। আমরা স্বাভাবিকভাবেই “অপরজন”। কিন্তু যাহাদের উহারা other করিয়াছে, সেই অপরেরও তো কণ্ঠস্বর থাকে। যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে কন্ঠস্বর ছিল প্রতিবাদী শূদ্রের। যেমন আজ আছে জল-জঙ্গল-জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রতিরোধী আদিবাসীর, দলিতের এবং নাগরিক সমাজে অবস্থানকারী প্রশান্ত কিশোরের। এই কণ্ঠস্বরসমূহের অধিকারীগণ যেমন গুহর মতো ভালোবাসিতে জানে, তেমন শম্বুকের মতো বুক চিতিয়ে তীরও গ্রহণ করিতে পারে; একইসঙ্গে পারে কালাশনিকভ হাতে দান্তেওয়াড়ার মাটি লাল করিয়া দিতে, প্রশান্ত কিশোরের মতো অনমনীয় রহিতে। রাম-লঙ্কেশের লড়াইয়ে আম্বানি-আদানির রাম-লক্ষণ জুটির সহিত গোবৎস (জাম্বুবানের পরিবর্তে) ও মর্কট সেনা যে বারংবার গৌরী বধ করিবে এমনটা গণতন্ত্রের শিক্ষা নহে, শিক্ষা নহে ইতিহাসের। গৌরী যখন কালরাত্রি হন তখন মুন্ডমালিকা তাঁহার আভূষণ এবং আভরণ দুইই হয়। সময়চক্রে গৌরীর এই কালরাত্রিতে রূপান্তর খুব বেশি দূরবর্তী ব্যাপার নহে। রামচন্দ্রের দৌলতে স্বর্গরাজ্যে বিশৃঙ্খলার সূচনা হইয়াছে। নতুন তারকার জন্ম তাহার বিলুপ্তি রচনা করিবে। আমেন!
অগাস্ট, ২০২০
Related posts:
Posted in: August 2020, EDITORIAL