সব কিছু আজ রামের নামে : দেবাশিস মল্লিক
অতিমারী আক্রান্ত বিশ্বের চরিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের দেশে এই পরিবর্তনের গতিবেগ এতটাই দ্রুততর যে একথা মোটেও অত্যুক্তি হবে না আজ ভারতবাসী হিসেবে আমরা এক আমূল রূপান্তরের মধ্যপর্বে রয়েছি। এতকাল অবধি ভারতবর্ষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ভারতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহুরূপতাকে মান্যতা দিয়ে এসেছিলো, বিশ্বাস করেছিলো নানা ভাষা, ধর্ম ও জাতির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি মিলে মিশে লীন হয়েছে ভারতীয়ত্বে, গড়ে উঠেছে ভারতের জাতীয়তাবাদী চরিত্র। কিন্তু আজ যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা এই ধারণার শুধু বিরোধীই নন, তাঁরা ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখার যে স্বপ্ন লালন করেন, তাকে বাস্তবায়িত করতে দৃঢ় সংকল্প হয়ে ‘এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা’র বুলডোজার চালিয়ে ধূলিসাৎ করতে চান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এতকালের পরম্পরাকে। এরজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে তাঁরা এতটাই মরিয়া যে যেনতেন প্রকারে রাজ্যে রাজ্যে আইনসভাগুলিতে এবং সংসদের উভয় কক্ষে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা অর্জনে লোলুপ। এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বলেই গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলির ওপর আঘাত হানতেও তাঁরা অকুণ্ঠিত। এই সরকারের গৃহীত আর্থিক নীতি একদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, গত ৪৫ বছরের নিরিখে বেকারত্ব এখন সূচকের সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে আর অন্যদিকে পুঁজির নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লকডাউনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকার রাতারাতি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ তুলে দিচ্ছেন পুঁজিপতিদের হাতে। যখন অগণিত শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে, কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, সরকার তখন পুঁজিপতিদের কোটি কোটি টাকার ঋণ মকুব করছেন। আসলে নাগরিকদের প্রতি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের যে দায়দায়িত্ব থাকে, তার প্রতি গভীর অস্বীকৃতি যেন সরকারের পরিচালনায়, দৈনন্দিন কাজকর্মে অনুভূত হচ্ছে, যেন আর পাঁচটা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। সরকারের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলির কাছে ভারত আগ্রাসী শক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, ‘নতুন ভারত’ প্রতিবেশীর সঙ্গে বহুকালের সুসম্পর্ককে বিনষ্ট করেছে। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন যাঁরা, আশ্রয় খুঁজতে চাইলেন এক উগ্র জাতীয়তাবোধে, পুলওয়ামা বা গালওয়ানের ঘটনা বুঝিয়ে দেয় দরকারে তরুণ ফৌজির বলি চড়িয়ে ও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি ক’রে কড়াপাকের দেশপ্রেম আমদানি করতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত। যখন কোভিড মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রতিদিন দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা বারে বারে নজরে পড়ছে, তখন অন্য সব কিছু সরিয়ে রেখে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির প্রচেষ্টা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমরা দেখলাম তার পরিবর্তে কোটি কোটি টাকা দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র কেনা হলো, এই কাজকে বৈধতা দিতেই কি সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করতে সীমান্ত সংঘর্ষ? ঘটাতে হলো গালওয়ানের মতো ঘটনা?
দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করার অক্ষমতা তাঁদের প্ররোচিত করেছে ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে দিতে। মানুষ যেন তার যাবতীয় অপ্রাপ্তির জন্য সরকারকে নয়, নিজের প্রতিবেশী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেই দায়ী করে। জনগণ যত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ব্যস্ত থাকবে, সরকারও নির্দায় থেকে নিরুপদ্রবে শাসনকার্য চালাতে পারেন। তাই সাধারণ মানুষকে নিয়ত ব্যস্ত রাখতে কখনো হিন্দু মুসলমান, কখনো CAA / NRC / NPR, কখনো গণসম্মোহক হিসেবে বুলেট ট্রেন আবার কখনো রামমন্দির ইস্যু সামনে এসে যাচ্ছে। আসলে ভারতীয় সংস্কৃতিতে আরো স্পষ্ট করে বললে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে রামচন্দ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। এখানে প্রতিটা দিন শুরু হয় রামনামের স্মরণ নিয়ে, মানুষ কোনো পরিচিতকে দেখে আলাপচারিতা শুরু করে “রাম রাম” ব’লে, ব্যবসায়ী রামনামে গণনা শুরু করে, ভিক্ষুক রামের নামে ভিক্ষা চায় আবার শেষযাত্রায় শববাহকের দল ধ্বনি তোলে “রামনাম সত্য হ্যায়”। কিন্তু দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলায় রামকে নিয়ে উন্মাদনার প্রচলন একান্তই অর্বাচীন। হাওড়ার রামরাজাতলার রামের মন্দির ও উৎসব কিছুকাল আগে অবধি একটি আঞ্চলিক উৎসব হিসেবেই পরিচিত ছিলো। বাংলার অনেক জেলাতেই শ্রীরামপুর নামে জনপদ আছে। তবুও বাংলার গ্রামেগঞ্জে শিব, কৃষ্ণ বা কালীর মন্দির যত সহজলভ্য, এমনকি দুর্গা বা মনসাও যে হারে পূজা পেয়ে থাকেন রামচন্দ্র তার সিকির সিকিভাগও পান না। তবে বড় অনুকরণপ্রিয় জাত আমরা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ভারতের প্রভাবে রাম ও হনুমান বন্দনা এবং পশ্চিম ভারতের প্রভাবে গণেশ পূজার প্রচলন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বিশেষত রামমন্দিরের ভূমিপূজা উপলক্ষে সম্প্রতি সারা দেশজুড়ে যে গণ হিস্টিরিয়া দেখা দিলো, পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। মুহুর্মুহু হিন্দুত্ববাদের “জয় শ্রীরাম” জয়ধ্বনিতে সোচ্চার এই আবিল ভক্তির ধোঁয়াচ্ছন্ন সমাজবাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখে নিতে চাইছি রামকথার পরম্পরাটিকে।
সমগ্র ভারতে ও বর্হিভারতে রামায়ণের পাঠভেদে রামের যে বহুমাত্রিক রূপ, তার সঙ্গে বর্তমান ভারতে বহুলপ্রচারিত ধনুর্ধর রামচন্দ্রের রণংদেহী একমাত্রিক মূর্তির ফারাক অনেকখানি। রামায়ণে তিনি তো শুধুই বিষ্ণুর অবতার নন, তিনি পরম মিত্রতায় গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করেন, সখা সুগ্রীবকে রক্ষা করতে বালীবধের মতো অন্যায় করতে পারেন! একদিকে প্রিয় পত্নী সীতাকে হারিয়ে তিনি বিরহে বিহ্বল হয়ে ক্রন্দন করেন আবার প্রজার মনোরঞ্জনের জন্য অক্লেশে তাঁকে বিনা অপরাধে নির্বাসনে পাঠাতে পারেন! শাসন পরিচালনায় তাঁর অর্জিত সুখ্যাতি “রাম রাজত্ব” নামক প্রবাদে পরিণত হয়েছে, অথচ সেই তিনিই আবার ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নির্দেশনায় চালিত হয়ে শম্বুকের মতো নিরপরাধ বিদ্যানুরাগীকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে পারেন! এই বিচ্যুতি, এই মানুষী দুর্বলতাগুলি রামকে তাঁর ভক্তদের থেকে ঈশ্বরপ্রতিম অলঙ্ঘ্য দূরত্বে সরিয়ে দেয়নি, বরং তাঁকে ভক্তদের আরো কাছের, আরো প্রিয় করে তুলেছে বলে আমাদের মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের কথায় “ রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা, দেবতার কথা নহে। রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।”১
বাল্মীকির মূল সংস্কৃত রামায়ণে যে আখ্যান পাই তারই রূপান্তরিত পাঠ মেলে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ জাতকের কাহিনীতে, মহাভারতের দুটি পর্ব, দ্রোণ পর্ব ও শান্তি পর্বে, হরিবংশের আখ্যানে। তার থেকে আমাদের কৃত্তিবাসের কিংবা হিন্দিতে তুলসীদাসের রামায়ণ অনুবাদের পাশাপাশি সন্ত কবি একনাথের মরাঠি রামায়ণ, কম্বনের তামিল রামায়ণ, ত্যাগরাজের তেলেগু রামায়ণ, মাধব কন্দলী রচিত অসমীয়া রামায়ণ, ভানুভক্তের নেপালি রামায়ণে রামকথার বহু বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষপ্রধান রামকথার পাশে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বহুদূরে প্রান্তিক অবস্থানে নির্দিষ্ট নারীর বয়ান খুঁজে পাই বাংলায় চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কিংবা শারলা দাসের ওড়িয়া বিলঙ্কা রামায়ণে। আবার উচ্চবর্ণীয় কবিকুলের ভিড়ে পঞ্চদশ শতকের শেষ দশকে বলরাম দাস নামে এক শূদ্র বংশীয় কবি ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ বা দাণ্ডি রামায়ণ নামে বিপুল জনপ্রিয়তাধন্য কাব্য রচনা করেছিলেন। সীতা কোথাও রামের ভগিনী, কোথাও রাবণের অলক্ষণা কন্যা। কোনো কাহিনীতে রাজপুত্রেরা দুই ভাই সীত ও লক্ষ্মণ, কোথাও আবার পরশুরাম দশরথকে হত্যা করেছেন, রাম বড় হয়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছেন। কোথাও আবার রাবণ পরাজিত হয়ে রামের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে করুণা পরবশ হয়ে রাম তা মঞ্জুর করেছেন। কোনো রামায়ণে সীতাই মূল শক্তির আধার, তিনি না আসা অবধি কিছুতেই রাবণবধের মাধ্যমে যুদ্ধজয় সম্পূর্ণ হচ্ছিলো না। এই যে রামায়ণ, তা একই সময়ে রচিত নয় বা কোনো একজন কবির রচনা নয়, নয় কোনো অবতারের জীবনবৃত্তান্ত। নানা দেশে তার যে ছড়িয়ে যাওয়া প্রমাণ করে আমরা মানব জাতি আসলে একই পরিবারভূক্ত, তাই সাহিত্য যখন ছিলো শুধুই মৌখিক ও একান্তভাবে শ্রুতিনির্ভর, তখন সেই লৌকিক গল্পগুলি বীজাকারে ছড়িয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তারপর সেই দেশের জল হাওয়ার আনুকূল্যে বেড়ে উঠেছিলো নিজের মতো করে, আর তাই বহিরঙ্গের ভিন্নরূপকে সরালে অল্প আয়াসেই মিলতে পারে তাদের অন্তর্সাদৃশ্য। সাতকাণ্ড রামায়ণের আখ্যান মূলত তিনটি আখ্যান বীজ, যা হয়তো এককালে তিনটি স্বতন্ত্র আখ্যান ছিলো, তাদের আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। সেগুলি হলো ১) রামের নির্বাসন ও বনবাস , ২) দুষ্ট রাবণ কর্তৃক রামের স্ত্রী হরণ ও রামের পত্নী উদ্ধার এবং ৩) পত্নী হারা রামের পুত্রলাভ। সমগ্র রামায়ণ আসলে কবিকল্পনায় এই তিনটি আখ্যানকে জুড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। আবার হো-দের উপকথায়, ফিলিপিনি রামকথায় কিংবা মালয় রামকথায় নায়ক কিন্তু রাবণ, তাঁরই ঐশ্বর্যময় জীবন ও মহতী পতন এখানে বিবৃত হয়েছে, রাম এখানে আগন্তুক মাত্র। প্রচলিত কাহিনীতেও শুধু দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যে নতুন আস্বাদ এনে দিতে পারে তা অনেক পরে উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদনও দেখাবেন “মেঘনাদ বধ কাব্য” রচনার মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হলো নানা রামচন্দ্রের মধ্যে কাকে আমরা আদর্শ ব’লে মানবো? আমরা জানি মহাভারত যে অর্থে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বের কথা বলে, রামায়ণ বলে সৌভ্রাতৃত্বের কথা, সম্প্রীতির কথা। যিনি যুদ্ধজয়ের পর মনে আর কোনো অসূয়া রাখেন না, বিজিত রাজ্যের অধিকার নিজের কাছে না রেখে সেই রাজ্যের অধিবাসীদের ওপর অর্পণ করেন, কী করে বিশ্বাস করবো চিকীর্ষা নয়, জিগীষাই তাঁর মূল প্রবৃত্তি? আর ‘অযোধ্যা’ নামটির ভারি সুন্দর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আচার্য সুকুমার সেন – “দশরথের রাজধানীর নাম অযোধ্যা। নামটির মানে কী। অথর্ব সংহিতায় ‘অযোধ্য’ শব্দটি আছে, মানে “যার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না, অজেয়”। কিন্তু নগরের দুর্গ অথবা রক্ষীর কোন উল্লেখ নেই। তা ছাড়া নামটি ঐতিহাসিকও নয়। ইতিহাসে ও বৌদ্ধ সাহিত্যে এ নগর ‘সাকেত’ নামেই প্রসিদ্ধ। সুতরাং নামটি রূপকথার হওয়াই সম্ভব। তাহলে অর্থ হবে “যুদ্ধ করবার অনুপযুক্ত, শান্তিপূর্ণ।”২ অথচ গত তিন দশকের বেশি সময়কাল ধরে এই শান্তিপূর্ণ অযোধ্যানগরী নিয়ে যত বিতর্ক, যার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশকে বারেবারে অশান্ত ক’রে তুলেছে। আসলে রাজনীতির দায় বড়ো দায়, রাজনীতির কারবারিদের ক্ষমতায় আসতে কিংবা ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় থেকে যাওয়া নিশ্চিত করতে বারেবারেই পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের ধনুর্ধর শালপ্রাংশু মহাভুজ ভাবমূর্তির শরণ নিতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও যে হবে এ আমাদের অজানা নয়। বরং বিষয়টিকে আর একটু বড়ো প্রেক্ষিতে দেখতে চাইছি। ভারতীয় সংস্কৃতির বহুরূপতাকে অস্বীকার ক’রে আজকের ক্ষমতাসীন দলের বিশ্বাস বা ঘোষিত অবস্থান সারা দেশে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়নের কাজে তাঁদের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক হলেন রামচন্দ্র। ইসলাম তার জন্মলগ্ন থেকেই এবং কিছুকাল পর থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম ধর্মীয় ভাবাবেগের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ধর্মের একটি আগ্রাসী অবয়ব তৈরি করে। এরফলে সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৈরিতার ইতিহাস অন্তত দুশো বছরের পুরনো। সে তুলনায় হিন্দু ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণাত্মক ভাবাদর্শে পরিণত করার চেষ্টা বেশিদিনের নয়। ১৯২৫ সালে নাগপুরে কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সে বছর দশেরা উৎসবকে বেছে নিলেন হিন্দু পুনরুত্থানের উৎসব পালনের জন্য। লোককথার রঘুপতি রাঘব রাম পরিণত হলেন যোদ্ধা রামে, তাঁর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া গেলো শিবাজীর ভাবমূর্তিকে, সেইসঙ্গে রাবণ হলো ঔরঙ্গজেব। মিথের সঙ্গে বিকৃত ইতিহাস জুড়ে তৈরি করা হলো নতুন আখ্যান, যা পরবর্তী দশকের পর দশক ধরে চতুর পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে বিষিয়ে তোলা যাবে বৃহত্তর জনমানস। এই ছিলো ইসলাম বিরোধী মতাদর্শ নির্মাণের সূচনা। সেইসূত্রেই সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ, রাম জন্মভূমি মন্দির পুনরুদ্ধারের ভাবনা। স্বাধীনতার আগে থেকেই বিতর্কিত সৌধে তালা লাগানো ছিলো। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়লো রাজীব গান্ধির সুবিধেবাদী মনোভাবের জন্য। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট শাহবানো মামলায় খোরপোষের ব্যাপারে যুগান্তকারী রায়দান করলেন, যা মুসলিম মেয়েদের স্বাধিকার ও মর্যাদা এনে দিলো। মুসলিম রক্ষণশীল সমাজ এই রায়ে রুষ্ট হয়ে কংগ্রেসের থেকে মুখ ফেরাবে এই ভয়ে রাজীব তাড়াতাড়ি মুসলিম নারী বিল এনে শাহবানো মামলার রায়কে ব্যর্থ করে দিলেন, আবার হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিলেন। ব্যাস, মৃত্যুপথযাত্রী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পেয়ে গেলো, চার পাঁচ বছরের মধ্যে বিরাট জনসমর্থন নিয়ে তারাই ক্রমে ভারতীয় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ালো। অথচ ১৯৯০ থেকে আদবাণীর রামরথ বের করা থেকে শুরু করে ১৯৯২ সালে রাম জন্মভূমি মন্দির প্রতিষ্ঠায় বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক সৌধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার সেই উত্তাল দিনগুলিতে হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদারদের রণহুঙ্কারকে ছাপিয়ে অযোধ্যার দু’জন সাধুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, শান্ত অথচ ভারতাত্মার অন্তরস্পর্শে দৃপ্ত সেই স্বর। প্রথম থেকেই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বি জে পি-র ধর্মকে ব্যবহার করে অস্থিরতা সৃষ্টির রাজনীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত মোহান্ত লালদাস। ইনি শেষপর্যন্ত বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক সৌধকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দেশের সমস্ত বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেছিলেন। অবশ্য এই বিরোধিতার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছিলো। ১৬ই নভেম্বর, ১৯৯৩ কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর আক্রমণে লাল দাস গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। আর একজন সাধু বাবা জ্ঞান দাস, অযোধ্যার হনুমানগড়ি মন্দিরের পুরোহিত। ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জ্ঞান দাস বলেছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনর্নির্মাণ ক’রে সেখানে মুসলিম ভাইদের নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা করা হিন্দুদের দায়িত্ব। স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একথা বলেছিলেন বলে এঁরা আজো শ্রদ্ধেয়।
এবার একটা ছোট্ট গল্প বলবো, ঐ অযোধ্যার ক্ষমতাচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ আর বেনারসের গল্প। ১৮৫৭ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি অযোধ্যা অধিকার করে নেয়। অযোধ্যা থেকে কলকাতায় যাওয়ার পথে ক্ষমতাচ্যুত নবাব বেনারসে এসে কয়েকদিন থেকেছিলেন। তখন তিনি কাশীর সংকট মোচন মন্দিরের নহবতখানায় নিত্য সানাই বাজানোর ব্যবস্থা করেন। সেসময়ে কাশীর হিন্দু রাজা মহরমের তাজিয়া রাখতেন। ১৮৫৮ সালে মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর যখন সবকিছু ইংরেজদের অধীনে চলে যায়, তখন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির চিহ্ন বহনকারী এই দুটি প্রথাকেই তারা বন্ধ করে দেয়। তার আগে অযোধ্যায় সিপাহীদের দুই বিদ্রোহী নেতার কথা বলতে হয়। আছাই খান ও বাবা রামচরণ দাস, যাঁরা ১৮৫৬ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে আপোষ মীমাংসায় বসে একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বিতর্কিত স্থাপত্যের একদিকে হিন্দুরা রামলালার পূজা করবে, অন্যদিকে মুসলমানরা নামাজ পড়বে। এই সিদ্ধান্ত উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো। বিদ্রোহ শেষে ইংরেজরা দুজন নেতাকে বাবরি মসজিদের পাশে এক তেঁতুলগাছে ফাঁসি দেয়। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ঐ তেঁতুলগাছটিকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা শুরু করলে ইংরেজরা তেঁতুলগাছটিকেও কেটে দেয়। স্বাধীনতার পর সংকট মোচন মন্দিরে ওয়াজেদ আলি শাহের নাতির ছেলের উদ্যোগে আবার সানাই বাদন শুরু হয়, যার সূচনা করেন বিশ্ববিশ্রুত সানাইবাদক ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ। এই বিসমিল্লা খাঁ, যিনি অর্থ, যশ বা প্রতিষ্ঠা কোনো কিছুর প্রলোভনেই বেনারস ছেড়ে কোথাও যান নি। এমনতর প্রস্তাব পেলে তিনি বলতেন বেনারসের গঙ্গা আর গঙ্গার ঘাট তিনি আর কোথায় গেলে পাবেন! ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের অন্যতম বেতাজ বাদশার অন্তরে দেশের প্রতি টান ছিলো এতোটাই। সম্প্রতি শোনা গেলো তাঁর বেনারসের বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, সরকার আগ্রহী হলে যে বাড়ি হতে পারতো ওস্তাদজীর স্মারক নিয়ে সংগ্রহশালা, হয়ে উঠতো ভারতীয় মার্গ সংগীতের অনুরাগীদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান, তার জায়গায় তৈরি হবে অত্যাধুনিক শপিং মল। আমাদের যা কিছু অহংকারের, সে সবই আমরা এভাবে চরম অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি।
তবে কোনো কিছুই আর আমাদের বিস্ময় জাগাতে পারে না। আমরা দেখে ফেলেছি দেশের সর্বোচ্চ আদালত যুক্তি বা ঐতিহাসিক প্রমাণের পরিবর্তে শুধু মানুষের বহুকাল ধরে লালন করে আসা বিশ্বাসের ওপর ভর ক’রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় দিতে পারেন! আমরা জেনেছি স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পর দেশের কোনো জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন মহারানী ভিক্টোরিয়ার দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে পারে! দাসত্বের বীজ অস্তিত্বের কোন শিকড়ে পৌঁছলে তবে একটা স্বাধীন দেশের তরুণ প্রজন্ম এটা করতে পারে! সমস্যা হলো এঁরাই আবার স্বাদেশিকতার ঠিকা নিয়ে ফেলেছেন, আপামর ভারতবাসীকে নিজেদের স্কুলে দেশপ্রেমের পাঠ দিতে চাইছেন। বরং আজকের সংঘর্ষময় বর্তমানকে ভুলে আমরা ফিরে পেতে চাই সদ্য আলোফোটা ভোরের প্রসন্নতায় ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের কণ্ঠে ভজন ‘হরি ওম তৎসৎ’, দিনাবসানের ক্লান্ত করুণ আবহে ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের সানাইয়ের রামধুন কিংবা গান্ধীজীর প্রার্থনার পতিতপাবন সীতারামকে, যিনি একাধারে ঈশ্বর ও আল্লা, যিনি আমাদের সকলকে সুমতি দিয়ে থাকেন। এই সকলের সুমতির আশাতেই বেঁচে থাকা।
তথ্য সূত্র :-
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “রামায়ণ”প্রবন্ধ, প্রবন্ধ গ্রন্থ “প্রাচীন সাহিত্য”
২) সুকুমার সেন, “রামকথার তন্ত্র” প্রবন্ধ, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, বৈশাখ – চৈত্র, ১৩৭৬-৭৮
[লেখক – অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীল কলেজ, কোচবিহার।]
Posted in: ARTICLE, August 2020 - Cover Story