অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
ইউরোপীয় মননের সূচনা পর্ব : তরু দত্তের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ
দশম কিস্তি
ভারতীয় নারীর কবিতার ধারার এই পর্ব থেকে আমরা ঢুকে পড়ছি একটি ভিন্ন কালখণ্ডে। যেই খণ্ডে প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় নারীর স্বর মিলিয়ে যাবে, স্পষ্ট হয়ে উঠবে ঔপনিবেশিক সময়ের ভারতের নারীর স্বর। এই স্বর আধুনিকতার অভিমুখে যাত্রা, নাকি , বাধ্যবাধকতার ফলাফল তাই নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। এই ভারতকে আমরা ‘আধুনিক’ ভারত বলবো, নাকি ‘ঔপনিবেশিক সময়ের’ ভারত এই নিয়েও দ্বিধা রয়েছে। কালখণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করার সুবিধার্থে এই ভারতকে এই প্রকল্পে ঔপনিবেশিক সময়ের ভারত হিসেবেই উল্লেখ করা হবে। অবশ্যই এই কথা অনস্বীকার্য যে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি, ইউরোপীয় আধুনিকতা, ইউরোপীয় মনন ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্গের ও ‘শোষক বর্ণের’( ‘উচ্চবর্ণ’-এর পরিবর্তে এই শব্দই ব্যবহৃত হবে) নারীদের ভিতর একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করে। এই পরিবর্তনের কিছু ইতিবাচক ফলাফল ‘দলিত’ নারীর মাটির কাছাকাছি আসতে আসতে প্রায় এক শতাব্দী দূরে তখনও। এই নারীদের ভিতর বেশিরভাগ হিন্দু ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ; অল্পভাগ মুসলমান, কিছু ‘ শোষক বর্ণের’ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান, ব্রাহ্ম; এবং বেশ কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তবে এটি সংশয়াতীত ভাবেই বলা চলে যে এর আগে ভারতীয় নারীর ‘স্বরে’ কখনোই এত বড় বাঁক বদলের আভাস ছিল না। ভারতীয় নারীর কাব্য চর্চার ধারায় একটি বড় বাঁক বদল আনে ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা। এই বাঁক বদল শুরু হয় ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার দখল ব্রিটিশদের কুক্ষিগত হওয়া থেকে। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা এই কালখন্ডের নারীদের কাব্যস্বরের একটি মাইলফলক বিশেষ। এই শিক্ষাব্যবস্থার ফলেই উপরোক্ত শ্রেণির নারীদের ভিতর তথাকথিত নবজাগরণের শুরু। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দিয়ে শুরু হলেও নবজাগরণের মূল সুরটি ধীরে ধীরে ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় কবিতা চর্চা করা নারীদের কবিতায় স্পষ্ট হতে থাকে। এই কালপর্বের কবি হিসেবে আমরা ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার বছরকে ( ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) সূচক হিসেবে চিহ্নিত করবো না। আমরা সেই সমস্ত কবিদেরই এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত করছি যাদের জন্ম , বড় হয়ে ওঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্রিটিশ ভারতেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এই প্রেক্ষিত থেকেই এই পর্বে ভারতের স্বাধীনতার পরেও কাব্যচর্চা বহাল রাখা অমৃতা প্রীতম থাকবেন এবং কমলা সুরাইয়া এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
এই কালপর্বে সূচনার কবি নিঃসন্দেহে তরু দত্ত (১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ—১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)। কলকাতার ব্রিটিশ স্নেহধন্য পরিবারে জন্মানোর সুবাদে ইউরোপীয় শিক্ষার পরিবেশেই তরু দত্ত বড় হন। তরু দত্তের ছয় বছর বয়সে তাঁর বাবা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেন এবং তরু দত্ত সহ তাঁর বাকি দুই ভাই-বোনও ধর্মান্তরিত হন। তাঁর মা প্রাথমিক ভাবে ধর্মান্তরের বিরোধিতা করলেও ধীরে ধীরে প্রাত্যহিক জীবনে খ্রিষ্টান ধর্মাচারণই করতে শুরু করেন। তাঁর মেয়েবেলা কলকাতা শহরেই কাটে। বাড়িতে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। বাবা ছাড়াও তাঁর শিক্ষক ছিলেন একজন বাঙালি খ্রিষ্টান বাবু শিবসুন্দর ব্যানার্জী। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও ফরাসি দুই ভাষাতেই তাঁর শিক্ষা চলতে থাকে, তাঁকে সংস্কৃতও যথেষ্ট যত্ন সহকারে শেখানো হয়। শিক্ষক ও বাবার কাছ থেকে তিনি যেমন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পড়ছিলেন, একই সময়ে মায়ের কাছ থেকে ভারতীয় মিথগুলির গল্প শুনতে শুনতে বড় হচ্ছিলেন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ তরু দত্তের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দত্ত পরিবার এই সময়ে প্রথমে ফ্রান্স এবং তারপর ইংল্যান্ডে বসবাস করে। ফ্রান্সে কিছুদিন পড়াশুনার পর, ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাঁরা কেম্ব্রিজে বসবাস শুরু করেন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তরু ও তাঁর বোন অরু একসঙ্গে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লেকচার সিরিজে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। লেকচার সিরিজটির নাম: “Higher Lectures for Women”। কেম্ব্রিজে বসবাসকালীন তরু ইউরোপীয় মননের সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হতে থাকেন যা তাঁর খুব পছন্দের হয়ে ওঠে। তাঁর কাব্যচর্চার মাধ্যম হয়ে ওঠে ইংরেজি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন মেরি মার্টিনের সঙ্গে তাঁর যে সুগভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, কলকাতায় ফিরে এসে পত্রালাপে যে বন্ধুত্ব বজায় থাকে। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এসে তরু দত্তের নিখাদ ভালো থাকা হয়নি আর কোনোদিনই। তাঁর ইউরোপীয়ান দৃষ্টিভঙ্গি হেতু কলকাতার বাঙালি জীবন তাঁর কাছে খুব দমবন্ধকর ঠেকে। মার্টিনকে লেখা তাঁর একটি চিঠির অংশ আজকের দিনেও ভারতীয় মেয়েদের জীবনে প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে দেখে একটু হত্যদমই হতে হয়: “If any friend of my grandmother happens to see me, the first question is, if I am married.” [Toru Dutt: Collected Prose and Poetry, Ed. by Chandani Lokuge, p. 276] ।
একুশ বছরের জীবনকালে অবধি তরু দত্ত নিঃসন্দেহেই এমন কিছু কবিতা লিখে যান নি যা ভারতীয় নারীবাদের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তবু তরু দত্ত ভারতীয় নারীদের কবিতা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ একজন। তাঁর কবিতায় প্রথম একটি কাঠামো আমরা পাই যা প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় কবিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর ইউরোপ যাপন ভারতীয় নারীর কবিতার পৃথিবীতে বেশ কিছু প্রতীক, মোটিফ ও ফর্ম আমদানি করে যা পরবর্তীতে ভারতীয় নারীরা কবিতায় বৈপ্লবিক ভাবে ব্যবহার করেছেন। একইসঙ্গে ভারতীয় জীবনযাত্রা ও ইউরোপীয় জীবনযাত্রার ছবির উপস্থিতি ভারতীয় নারীর বাড়তে থাকা পরিসরকে সূচিত করে। খুব ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার হল তথাকথিত নবজাগরণের প্রভাবে প্রভাবিত ভারতীয় পুরুষ কবিরা যখন একের পর এক মিথকে বিনির্মাণ করে চলেছেন ইউরোপীয় রসে, তরু দত্ত তাঁর সীতাকে আঁকার সময় নারীর বহমান যন্ত্রণাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। পিতৃভূমির ধারণায় সম্পৃক্ত ইউরোপীয় জাতি চেতনাকে কবিতায় ধরতে গিয়ে নারীমূর্তি হিসেবে লিখে ফেলছেন। এইভাবেই নিজের অজান্তেই তিনি ভারতীয় নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে যান।
অনুবাদের সময় মূল কবিতার যতিচিহ্ন এক রাখা হয়েছে। অনুবাদের জন্য সোর্স টেক্সট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে Toru Dutt: Collected Prose and Poetry বইটি।
রুয়ার মানুষ
বারান্দার শীতলতায় বসে,
রোদ, আমি দেখি, মরে আসছে দ্রুত,
গোধূলি এগোচ্ছে শাসনে।
কাজের সময় প্রায় অতীত।
ছায়ারা দৌড়ায় জমি জুড়ে
শুধু একজন ঝুঁকে রুয়ে যায়,
সুপ্রাচীন, ছেঁড়া কাপড়, ধৈর্য্য নিয়ে দাঁড়িয়ে।
শিহরিত হই, যখনই তাকাই ।
কালো আর লম্বাটে, তার স্যিলুয়েট
লাঙলরেখাকে গভীরে দাপায়!
বপনের সময়ে এখন ললাটে।
শস্যচ্ছেদনের সময় আসবে শীঘ্রই।
সমতল ভেঙে সে এগোয়
এলোমেলো, ঈষদ বেসামাল
হাতে ঝুলে অমূল্য শস্য,
বিমোহিত আমি, তার পদক্ষেপে
আঁধার গাঢ় হয়। আলো মুছে যায়।
তার প্রতকৃতি আমার চোখে এখন
সুবিশাল ও বিস্ময়, সে দৈর্ঘ্যে
ছুঁয়ে ফেলছে নক্ষত্রখচিত আকাশ ।
সীতা
তিনটি সুখী শিশু একটি অন্ধকার ঘরে!
চোখ বড় বড় করে তারা কী দেখছে?
এক গভীর, গভীর এক অরণ্য, যেখানে সূর্য ঢোকে না,
আর তার হৃদে একটি পরিছন্ন স্থান । — যেখানে ফুটে
বিশাল সমস্ত ফুল গুঁড়িতে যারা জড়িয়ে রাখে
সুউচ্চ বৃক্ষদেরঃ সেইখানে একটি টলটলে হ্রদ
কিছু হাঁস ভাসে, কেকায় ভরে উঠে
ময়ূরের বসন্ত, সেখানে, বুনো হরিণের পাল ছুটে;
হলদেটে এক আলোর ঢেউয়ে ফুটে উঠে
নীলাভ এক ধোঁয়ার অবশেষ।
সেখানে শান্তিতে বাস করেন আদি-কবি।
কিন্তু এই মহীয়সী কে? কী যাতনা!
তিনি কাঁদছেন, — ইস! তাঁর প্রতিটি অশ্রুকণা
তিনজোড়া পায়ে শিশুর চোখের জল হয়ে ঝরছে ,
যাতনায় ঝুঁকে পড়ছে তিনটি শিশুর মাথা।
খুব প্রাচীন গল্প, খুবই প্রাচীন, আর যে সুতো
এখন সীতাকে গল্প থেকে টেনে আনছে
তা মায়ের গান… খানিক থাকবে
তারপর তাদের চোখ থেকে এইসব ছবি হারিয়ে যাবে।
তবু তারা স্বপ্নে দেখে যাবে এইসব বারবার!
কখন এই মেয়েরা তাদের মায়ের কোল ঘেঁষে
জড়ো হবে! আমিও তো একজন সেই দলের!
ক্রিসমাস
আকাশ কালো, বরফ পড়ছেঃ
ঘন্টা, ঘন্টার ধ্বনিতে আনন্দের আভাস!
যীশু জন্মালেন, কুমারীরা ঝুঁকে আছে
তার উপর। সুখী এ সময়!
কোনো রঙচঙে পশমিনা পর্দা ঝোলায় নি কেউ,
সদ্যোজাতকে ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে;
মাকড়সার জাল ঝুলছে কেবল
পুরানো কড়িবর্গার গায়েতে।
বিছানো খড়েতে শুয়ে আছে ছোট্ট সে,
কোনো মহলায় নয়, খামারে,
গাভী শ্বাস নিচ্ছে তার গায়ে
উষ্ণতা পাচ্ছে তার বিছানা।
ছাদের উপর বরফকুচি জমছে শ্বেত,
তার উপর নক্ষত্রখচিত সুগভীর নীলাকাশ,
আর সাদা পোষাকে এক দেবদূত
গবাদিদের গান শোনাচ্ছে, “যীশু জন্মেছেন”।
ফ্রান্স
মারা যায় নি, — না— মহীয়সী এভাবে মরতে পারে না!
অনেক রক্তপাতের পর মূর্চ্ছিত হয়ে আছে!
ইংল্যান্ড তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে,
সাহায্য করো সামারিটান! কেউ নিকটে নেই;
এই রক্তবন্যা থেকে কে আমায় টেনে তুলবে?
বাদামি চুল সরাও তার, তার চোখের উপর এসে পড়েছে,
সুশীতল জলের ছিটাও তার মুখে!
রক্তস্নাত সে , যেন প্রাণহীন,
তাকে দাও তোমার ঔদার্যের সুরা।
কেউ নেই, কেউ শুনছেও না, ঔদার্য নিয়ে এগোও।
মানবতার শির ঝুঁকে আছে,
এমন করেই কি মূর্চ্ছিত হয়ে থাকবে বাকি সময়?
চিন্তন, স্বাধীনতা, সত্য, এগুলি শাশ্বত,
কখন আবার আশা হয়ে সকলের উঠে দাঁড়াবে তুমি,
ঝাঁপিয়ে পড়বে সকল আঁধার সরাতে আবার!
সে তাকাচ্ছে!— আগুনের অবশেষ তার দৃষ্টিতে,
সাবধান, সাবধান এই ভাঙা তরবারি থেকেও!
একঘন্টা পেলেও সে নিমেষে করবে সাবাড়!
তাকে ঘিরে দাঁড়াও, দাও রণধ্বনি,
এটিলাও তার সম্মুখে দাঁড়াবার সাহস রাখে কি?
দেখো, সে উঠে পড়েছে, — দৃঢ় তার পা,
শক্তি এসেছে আবার যুদ্ধ করার,
চোখের মণিতে নক্ষত্র জ্বলছে
সে আলোয় আলোকিত দুনিয়া। তরী বাও, জাতি, তরী বাও
তাকে আবার এগিয়ে যেতে দাও।
Posted in: August 2020 - Serial, TRANSLATION
এ এক বিরাট শ্রমসাধ্য কাজ। তরু দত্ত-কে জানবার আগ্রহ আপনি বাড়ায়ে দিলেন। শ্রদ্ধা জানবেন।