আয়না ভাঙা অক্ষর – নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি : শুভ্র মৈত্র

আয়না ভাঙা অক্ষর: নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি

গল্প নির্বাচন, সম্পাদনা ও প্রাক-কথন: অদ্বয় চৌধুরী
গল্পের নাম: একনায়কের জীবনের দৃশ্যগুলি
গল্পকার: বাসমা আব্দেল আজিজ
রাষ্ট্র: ইজিপ্ট
মূল ভাষা: আরবি
অনুবাদের সোর্স ভাষা: ইংরেজি
বাংলায় অনুবাদক: শুভ্র মৈত্র 

চতুর্থ কিস্তি

[প্রাক-কথন: ইজিপ্টের রাজধানী কায়রো নিবাসী বাসমা আব্দেল আজিজ একাধারে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ভিজুয়াল আর্টিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। পাশাপাশি তিনি একজন সাপ্তাহিক কলামনিস্ট। মিশর সরকারের অতাচারী অবস্থানের কড়া সমালোচক। ২০১৬ সালে বাসমা বিদেশ নীতির একজন বিশ্বজনীন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। গল্প উপন্যাস ছাড়াও বেশ কিছু নন-ফিকশন লিখেছেন তিনি। একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন বাসমা তাঁর সৃজনশীল কাজের জন্যে।

‘সিনস ফ্রম দ্য লাইফ অফ অ্যান অটোক্র্যাট’ গল্পটি মূল ভাষা আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এলিজাবেথ জেকেট। কৌতুকের আড়ালে স্যাটায়ারের চাবুকক্ষত লুকিয়ে রাখা এই গল্পটির পাঠ মারিও বার্গাস য়োসা-র ‘দ্য ফিস্ট অফ দ্য গোট’ উপন্যাসটির পাঠস্মৃতি ফিরিয়ে আনে, যেখানে একজন স্বেচ্ছাচারী শাসকের দমনমূলক শাসনব্যবস্থার বর্ণনা উঠে আসে। তিনি শুধুমাত্র তাঁর দেশবাসীকে নয়, নিজেকেও কঠোর শাসনে বেঁধে রেখেছিলেন জীবনের অন্তিমকালে।

একনায়কতন্ত্র শুধুমাত্র একটি শ্বাসরোধকারী শাসনব্যবস্থা নয়, বরং একটি রোগ। সমাজব্যবস্থা, নাগরিকজীবন, এমনকি একজন একনায়ক শাসক নিজেকেও কঠিন ও অবাস্তব নিয়মের যাঁতাকলে পিশতে থাকে লাগাতার। ধীরে ধীরে তা এক মানসিক রোগে পর্যবসিত হয়। এই রোগ এতটাই সংক্রামক যে সেই স্বেচ্ছাচারী শাসকের মৃত্যু হলেও তাঁর নিয়মনিষ্ঠ অযৌক্তিক শাসনব্যবস্থা জারি থাকে নাগরিকজীবনে, অন্য কোনো শাসকের হাত ধরে। এখানে শাসকের কোনো ভূমিকাই থাকে না আর; মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে ওই শাসনতন্ত্র। এখানেও প্রোটাগনিস্ট আদতে শিরোনামে উল্লেখিত একনায়ক নয়, বরং একনায়কতন্ত্র নিজেই। এখানেই এই গল্পটি ইজিপ্টের একনায়ক শাসনব্যবস্থা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সমস্ত একনায়কতন্ত্রের গল্প হয়ে উঠেছে।]

একনায়কের জীবনের দৃশ্যগুলি

তাঁকে ঠিক লম্বা বলা যায় না, বা চওড়া কাঁধও তাঁর নেই, মানে যেরকম হলে তাঁর পদের সাথে মানানসই হত, তবে চওড়া একটা কপাল আছে বটে। ওই চওড়া কপাল আর পাতলা চুলেই ওঁর ব্রিলিয়ান্সটা ধরা পড়ে। আর কমবয়সে টাক পড়ে যাওয়া নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাবার লোক উনি নন, কারণ ওই চওড়া কপালটা যে তীক্ষ্ণ মেধারই বিজ্ঞাপন, তা ভালোই জানেন উনি। কমপ্লিট স্যুট আর গোলাপি টাই ছাড়া কেউ তাকে দেখতে পায় না। আর ওর ডিপার্ট্মেন্ট থেকেই যে গোটা দেশটা চালানো হয়, তাও সবার জানা। হ্যাঁ তিনি একনায়ক, দেশের মানুষের জন্য যে গণসূত্র, যা প্রতিটি নাগরিকের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার দায়িত্ব ওর একার কাঁধে।
ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগেই ওঠেন তিনি। গোটা দেশের ভার যার ওপর, তিনি কীভাবেই বা ঘুমোবেন বেশিক্ষণ! চমৎকার স্বাস্থ্য, আর মন? সে তো চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ করছে। নিজের শরীরের যথেষ্ট যত্ন নেন একনায়ক, সেটা অবশ্য নিজের জন্য নয়, বরং দেশের মানুষের স্বার্থেই তাঁর বেঁচে থাকা আর এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। মাঝে মাঝে চোখদুটো খানিক লাল হয়, সেটা নেহাৎই বেশি রাত জেগে কাজ করার ফল। সে জন্যে অবশ্য চোখে ড্রপ দিতে ভোলেন না।

কঠোরভাবে গোপনীয়, তাই ওর কাজের ব্যাপারটা খোলাখুলি আলোচনা করা যায় না, সেটা খুব রিস্কি। বরং এই যে গণসূত্র, সেটা অনেক সহজ। কোনো বাধা নিষেধ নেই, শুধু উৎসাহ দেওয়াই উদ্দেশ্য। যেমন এই আমাদের একনায়ক ওই পদে বসার পরেই, সরকারি সমস্ত খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, মানে যাদের টিকি সরকারের কাছে বাঁধা, তারা সকলেই জনগণকে শিক্ষিত করার কাজে নেমে পড়ল। উনি বেশ গোছানো মানুষ, নিয়ম নীতির প্রবল ভক্ত। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিয়ম চালু করলেন, তাঁর অধীনে সবাইকে যা মেনে চলতে হবে। না এগুলোকে ঠিক নির্দেশ বলা যায় না, বরং কিছু গাইডলাইন। নিয়ম করে প্রকাশিত হতে লাগল যখন তখন মানুষের মধ্যে খানিক ধাঁধাঁ ছিল বটে কিন্তু পরে যখন সম্পূর্ণ পরিকাঠামো প্রকাশ পেল, তখন আর অস্পষ্টতা রইল না। গণসূত্র সবাই মেনে চলতে লাগল— সবাই, কেউ বাদ গেল না। আর সবগুলি বিভাগও—নিরাপত্তা, গণমাধ্যম, খাদ্যব্যবস্থা এমনকি স্বাস্থ্যব্যবস্থা— সবাই মানতে থাকল সেই সাংস্কৃতিক বিভাগের নির্দেশ।

মাসের শেষ দিনটি আমাদের একনায়কের এই গণসূত্র তৈরি করার দিন। একেবারে নিখুঁত ভঙ্গীতে প্রবল উৎসাহ নিয়ে তাঁর চওড়া ডেস্কটায় বসবেন উনি, হাতে পেন। কেউ তাকে এখন ডিসটার্ব করার কথা ভাবতে পারে না। সে হোক না উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছেন চুপ করে, ঝকঝকে মনের থেকে একটা দুটো সুতো টানছেন, কাগজে পেনের আঁকিবুকি কাটছেন, তবু কেউ বিব্রত করে না ওঁকে। প্রতিবার শেষ করার পর একটা তৃপ্তির হাসি। সহকারীকে ডেকে সাম্প্রতিক গণসুত্রগুলিকে লিখে নিতে বলেন, এরপর সীলমোহর পড়ে তার উপর। আর সরকারি ভাষ্যে সেই সূত্র যোগ হয়ে যায়। সমস্ত ন্যাশনাল এজেন্সিগুলির দায়িত্ব সেই মতবাদ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার।

সরকারি ভাষ্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, আমাদের একনায়কের নানা উদ্ভাবন থাকে সেখানে। সেসব নিয়ে কোনো বিতর্ক অর্থহীন, আর তাছাড়া এত বছর ধরে মানবজাতির জন্য তাঁর অবদানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে কেউ? মূল্যবোধ, নীতি বা আদর্শ আচরণের যে অসংখ্য সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছে, সে তো তাঁরই সৌজন্যে! এর আগে কেউ এমন নিখুঁত ও যথার্থ ছিল না। মানুষের বোঝা কমানোর জন্য তিনিই প্রথম সমাজে অপ্রয়োজনীয় শব্দগুলি ছাঁটতে শুরু করেন। যেমন নির্বাচন— আর পরিবর্তে ঢোকান কিছু অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা যা দেশপ্রেমিক হতে সাহায্য করে। সেসব তো তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার। গড়পরতা মানুষ এই প্রথম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়, এমন অনেককে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পুরস্কৃতও করে। স্বাভাবিকভাবেই পুরস্কার পেয়ে যারপরনাই খুশি হয় মানুষ। টিভিতে এই পুরস্কার প্রাপকদের নিয়ে লাইভ শো হয়, তাদের টক শো-তে ডাকা হয়।

শুধু কী দেশপ্রেমিক তৈরি? তাঁর ঈর্ষনীয় দক্ষতায় একনায়ক বিশ্বাসঘাতকদের বৈশিষ্ট্যও উল্লেখ করেছেন, দিয়েছেন তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সংজ্ঞা। হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে, আর মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছে এতদিন ধরে চলা দুর্নীতি আবিষ্কার করে। তারা নিজেদের আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীদেরকেও খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতে চায়, সরকারকে আরও কোনো গুপ্তচরের সন্ধান দেওয়া যায় কিনা।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও ধর্মীয় ব্যাপারে একনায়ক সব সময়েই খুব সিরিয়াস। বিশেষ ছুটির দিনে তিনি তো মির‍্যাকেল-এর ব্যাখ্যাও দেন। তিনি ধর্মীয় বিধান জারি করেছিলেন, বিরাট উৎসব হল, আর নিজের বক্তৃতায় জানালেন কিছু বিশেষ মির‍্যাকেল-এর কথা যা তিনি নিজেই করেছেন। বলাই বাহুল্য, মানুষ বিপুল আনন্দ পেয়েছিল।

প্রতিদিন গণসূত্র অনুসরণ করা এখন জাতীয় বিনোদন। সরকারি কর্মচারীরা অফিসে তাদের স্বাস্থ্যসম্মত চায়ের কাপ অর্থাৎ ‘হেলথ টি’ আর কাগজ কলম নিয়ে ডেস্কে বসে আর চেষ্টা করে আজকের গণসূত্রে নতুন যে সব শব্দ যোগ করা হয়েছে তাদের অর্থ উদ্ধারের। একে অন্যের ব্যাখ্যা নাকচ করতেই কেটে যায় সময়। এই যেমন ‘হেলথ টি’ শব্দটাই তো নতুন ছিল তাদের কাছে। একনায়কের একদিনের বিধানে সেটা এল আর তারপরে যথারীতি সবাই এই গণসূত্র উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিছুদিন পরে সবাই বুঝতে পারল, ‘হেলথ টি’ আসলে চিনি ছাড়া চা। একদম সঠিক সময়ে এই সূত্র এসেছিল। চিনির তখন প্রচণ্ড সংকট, এক ব্যাগের দাম প্রায় এক ক্যারাট রুপো বা সোনার মতো। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য দপ্তর ঘোষণা করেছে নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য তারা কতটা উদ্বিগ্ন, তাদের নিজেদের থেকেও বেশি। বিপজ্জনক খাদ্যাভাস না পালটালে মানুষের শরীর ধ্বংস হয়ে যাবে। নিরাপত্তা দপ্তর তাদের কর্তব্যেও কোনো ফাঁক রাখেনি— নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি নাশকতায় যারা লিপ্ত, এই যেমন রাস্তায় যাদের এক কিলো দুই কিলো করে চিনি হাতে দেখা গেল— তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হল। ক্রমশ প্রচার আরও ব্যাপক ভাবে ছড়াল, স্কুলে যে সব শিশুরা সকালে চিনি খেয়ে খুব আনন্দে ছিল, তাদের আটকানো হল। ডেকে পাঠানো হয় তাদের মায়েদের। পরিস্থিতিটা মোটেই হালকাভাবে নেওয়ার নয়, একনায়ক এত বোকা নন যে ইচ্ছেমতো নিয়ম চালু করবেন— নাহ, মানুষ বুঝেছিল, স্বাস্থ্য বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। চা স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া দরকার, দুধও। এমনকি জুস, কুকি বা যে কোনো রকম ক্যান্ডির ক্ষেত্রেও তা সত্যি। মানুষ এক সময় চিনির কথা ভাবাও বন্ধ করল, উল্লেখ তো দূরের কথা। মায়েরা বাচ্চাদের বোঝাতে লাগল, মিষ্টি ছাড়া খাবার যারা খায় তাদেরই ভগবান ভালো করেন। খবরের কাগজগুলিও সেইসব গুজব নস্যাত করার কাজে নেমে পড়ল যে চিনির সংকট অন্য পণ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে। এসব গুজব সৃষ্টি করে যারা তারা শুধু দেশের সমস্যা বাড়ায়। সাংস্কৃতিক দপ্তর কড়া হাতে নিষিদ্ধ করল সেইসব সিনেমার দৃশ্য বা টিভির সেইসব বিজ্ঞাপন যেখানে নায়ক তার চায়ের সঙ্গে চিনি মেশান। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করা হল এই ট্যাগলাইনে, ‘এক ব্যাগ আচারের সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করুন’। আর এই সব কিছুর উত্তরে জনগণ শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকে, সত্যি একনায়ক সব জানেন, ডিপার্ট্মেন্ট সবকিছু কী নিখুঁত ভাবে সামাল দেয়!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই গণসূত্র মানুষের জীবনের ভরকেন্দ্রে পরিণত হল। নিজেদের কোনো ভয়ংকর পরিণতির আশংকা তো সবারই থাকে বা কোনো দুর্ঘটনার ভয়। সে কারণেই সবাই গণসূত্র অনুসরণ করতে শুরু করল। নির্দেশাবলির প্রতিটি লাইন খুঁটিয়ে পড়া ধীরে ধীরে এখন এক পবিত্র অভ্যাসে পরিণত, পুজো বা প্রার্থনার চেয়েও বেশি পবিত্র। কোনো কর্মচারী যখন অফিসে আসেন, গুড মর্নিং বলার সঙ্গেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, কিছু মিস করেছেন কিনা। তার সহকর্মীরা ছুটে এসে তাকে জানিয়ে দিয়ে যান, ইতিমধ্যে নতুন কোন নিয়মের কথা ঘোষণা হয়েছে। এই গণসূত্র সিলেবাসে ঢোকানো হবে তাতো স্বাভাবিক, এবং সেই বিষয়ে ভালো করাটা খুব জরুরী, কোনো ছাত্র যদি ফেল করে, তার আর পরবর্তী শিক্ষার কোনো আশা নেই।

একনায়কের জন্যে মাসিক গণসূত্র আর যথেষ্ট নয় ততদিনে। তাঁর দায়িত্ব বাড়ছে, এবং সূত্রকে এখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ছুঁয়ে যেতে হবে— ছোট বড় সব। মানুষের নিজস্ব বিচারের ওপর তো আর ছাড়া যায় না, তারা কী করে জানবে তাদের জন্য কোনটা ভালো, কোনটা সঠিক। উফফ কী পরিশ্রমটাই না করছেন একনায়ক, দ্বিগুন হয়েছে তাঁর খাটুনি। এই একটা সমস্যা মেটালেন তো অন্য সমস্যা দেখা দিল, একদিকের ফাঁক বুজলেন তো আরেক দিক খুলে গেল। এসব সামাল দিচ্ছেন একার হাতে, কিন্তু কাউকে জানতে দেন না ক্লান্তির কথা, নিজের সেক্রেটারিকেই বলেন না, তো অন্য কেউ!

দিনের পর দিন একনায়ক আরও চৌখশ হলেন, তাঁর ধারাবাহিকতা ঈর্ষনীয়। নতুন ধরনের নাস্তিকতার সৃষ্টি তো প্রায় বৈপ্লবিক আবিস্কার। সেখানে কোনো অবিশ্বাসীকেও ধর্মীয় ক্ষেত্রের বাইরে রাখা হয় না। প্রথমদিকে এমন আজব কথা শুনে তো মানুষ ভয় পেয়ে গেছিল, তুমুল হইচই শুরু হল। গণসূত্র জারি হল, নাস্তিকরাও নিজেদের ধার্মিক পরিচয় দেবেন এমনকি ধর্মীয় আচার আচরণও পালন করবেন, তা তারা সেসবে বিশ্বাস নাই বা করলেন। উলটোটাও গ্রহণ করা হবে যদি তারা গণসূত্রের প্রতি দায়বদ্ধ হন এবং সেই মতকে সমর্থন করে কিছু সূত্র মুখস্থ বলতে পারেন। এরপর একনায়ক বিচার পদ্ধতিতে এক নতুন শব্দ যোগ করলেন— ‘টার্বো জাস্টিস’। বিচার বা জাস্টিস শব্দটা লেখাই যাবে না ‘টার্বো’ বিশেষণটা ছাড়া। পোড়খাওয়া ভাষাবিদদের কাছেও এ এক কঠিন শব্দ সন্দেহ নেই, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মিডিয়া হাউসগুলি এগিয়ে এল এর ব্যাখ্যা নিয়ে। মানুষ শিখল, ‘টার্বো জাস্টিস’ হচ্ছে গণসূত্র অমান্যকারীদের তাৎক্ষনিক মৃত্যুদণ্ড। কোনো বিচার ছাড়াই এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, বা বিচার হলেও কয়েক মিনিটের একটা লোকদেখানো শুনানী। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিপুল জনপ্রিয় হল এই বিচার ব্যবস্থা, কারণ গণসূত্র দেশে রেনেসাঁ নিয়ে এসেছে, তার বিরোধিতা করলে তো শাস্তিই প্রাপ্য।

আইনের বিধান লেখা বইগুলো বা সেগুলোর উন্নতির জন্য তৈরি হওয়া কমিটি— সব নিষ্কর্মা হয়ে পড়ল, একনায়ক সবাইকে রিটায়ার করিয়ে দিলেন। বিচারক বা উকিলদের দৃষ্টি আর তাদের উপর পড়ে না, র‍্যাকে জমে জমে শুধু ধুলো পড়তে লাগল তাদের ওপর। এমনিতেই আইন ব্যাপারটা জটিল, আরও জটিল তার রূপায়ন। গণসূত্র দ্রুত সেই আইনের জায়গা নিয়ে নিল। মানুষ গণসূত্রের প্রতি আরও মনোযোগী হয়ে পড়ে, ডিপার্ট্মেন্টের খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন পড়তে থাকে, প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখে, সরকারি টিভি চ্যানেলে তাদের আকর্ষণ দেখলে মনে হয় যেন ঝকঝকে আলোয় হামলে পড়েছে মথের দল। কেউ আর হাঁটতে বেরোয় না, ক্যাফেতে সময় কাটায় না, থিয়েটারে যাওয়া ছেড়ে দিল, এমনকি কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফি দেখাও বন্ধ। মানুষের মনোযোগ দেখে মুগ্ধ একনায়ক নিজেও, গণসূত্র তৈরি করতে করতে ভাবেন তাদের কথা, তাঁর নিজের কাজের প্রতি চুম্বকের মতো আকর্ষণ মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর অধীনে চূড়ান্ত সুশাসন উপভোগ করে মানুষ। পরপর আসা নির্দেশাবলীর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই, আর সেই চেষ্টাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সবাই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। সরকারি বাসের জন্য লম্বা লাইন আর দেখা যায় না। জীবন থমকে গেছে, মানুষ শুধু অপেক্ষা করে কোন নতুন উন্নতির দিশা তিনি দেখান পরদিন ভোরে।

সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চোখের পাতা কেঁপে উঠেছিল। ডেস্কে বসার আগে রোজ যে আনন্দে মন ভরে থাকে, সেদিন কী জানি কেন, ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যালকনির জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন একনায়ক। সূর্যকে ওঠার জন্য অন্যদিনের মতোই ডাকতে থাকলেন, কিন্তু আজ যেন সাড়া পাচ্ছেন না। এই জানালার কাচটার জন্যই বুঝি নির্দেশ ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না। একবার ভাবলেন কাচ সরানোর জন্য নির্দেশ জারি করবেন। খানিক ইতস্তত করে দিনের কাজগুলি শেষ করাকেই গুরুত্ব দিলেন। কিন্তু আজ বড্ড বোঝা মনে হচ্ছে। নিজেই ভাবতে চেষ্টা করলেন কেন আজ এমন আপসেট লাগছে। মনে পড়ল গতকাল তাঁর মা মারা গেছেন। মিষ্টি স্বভাবের একান্ত অনুগত মহিলা ছিলেন, কখনও কোনো নীতির বিরোধিতা করেননি। এমনকি অসুস্থতার সময়েও গণসূত্রের প্রতিটি অক্ষর মেনে চলেছেন, একনায়কের তৈরি বিধি অনুযায়ী অসুখের মোকাবিলা করেছেন শুধুমাত্র নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে। একেবারে শেষের দিকে তাঁর নিমুনিয়ার জন্য ওষুধ খেতে চেয়েছিলেন, ততদিনে দুটো ফুসফুসেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে সব ফার্মেসি তাদের ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে, নাগরিকদের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে ইচ্ছাশক্তি আর সংকল্প দিয়ে। বৃদ্ধা তাঁর স্ব-আরোগ্যের চেষ্টা দ্বিগুন করলেন, এজেন্সির বিজ্ঞাপন মুখস্থ করতে লাগলেন, ধূপকাঠি জ্বাললেন, কোরাণ পাঠ করতে থাকলেন, কিন্তু শেষমেশ আত্ম সমর্পন করলেন সেই শত্রুর কাছে, যদিও দেশপ্রেম একফোঁটাও টাল খায়নি।

একনায়ক এখনও বুঝতে পারছেন না, কীভাবে তাঁর অনুমতি ছাড়াই মা মরতে পারে। এই চিন্তাটাই তাঁকে বিব্রত করছে। চিন্তাতেই চোখদুটো লাল হয়ে গেল, চোখের পাতা কাঁপছে— যা কয়েকদিনের মধ্যেই ডান চোখ থেকে বাঁ চোখে ছড়িয়ে পড়ল, ঘুম হবে না। এরপর কলম ধরতে গিয়ে তাঁর হাতটাও কাঁপতে লাগল, এটা বেশ ভয়ের। এক সপ্তাহের মধ্যে কিছু লিখতে পারছেন না। আর নিয়মিত নির্দেশাবলী ছাড়া জনগণও ভয় পেয়ে গেল। দিনে প্রায় একশোবার সংবাদপত্রের পাতা খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগল সবাই, কিছু আছে কিনা। গণসূত্রের নতুন কোনো বিধি এল কিনা যা তাদের বেড়ে চলা উৎকণ্ঠা কমাতে পারে। কিন্তু না, কিচ্ছু নেই। হঠাৎ করে সবাই যেন নগ্ন হয়ে পড়ল। কোনো সতর্কতা নেই, নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো গণসূত্র নেই তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার মতো, যা তাদের বলবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। কে বলবে তাদের, কী করতে হবে! এক অসীম শূন্যতা গ্রাস করছে সবাইকে, একনায়ক নিজে আরও বড় সংকটে।

কয়েক সপ্তাহ এভাবে চলার পরে শেষমেশ এক সমাধান তিনি পেলেন, আসলে সমাধান হাতের কাছেই ছিল। মৃত্যুর এক নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেন তিনি, সেই মতো তৈরি হল এক সংক্ষিপ্ত বিধান। সকাল অবধি আর অপেক্ষা করা যাবে না, রাতেই প্রকাশ হল নতুন নীতি। মাঝরাতে সহকারীকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দিলেন মৃত্যু সম্বন্ধীয় এক অসামান্য সংজ্ঞা। মানুষ যেভাবে জানে মৃত্যু আসলে তেমন নয়। মৃত্যু মানে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া বা ফুসফুসে বাতাস যাতায়াত বন্ধ হওয়া নয়। মৃত্যু আসলে আরও সহজ, মসৃণ, আর কাব্যিক— “কোনও ব্যক্তির নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িক অন্তর্ধান, যিনি একনায়কের কাছ থেকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ পেলেই আবার ফিরে আসবেন।”

মহা উৎসাহে সংবাদপত্র প্রকাশ করল সেই নতুন সংজ্ঞা। আর এরপর যখন কেউ গণসূত্রের অনুপস্থিতির কারণে উৎকণ্ঠায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল— খবরটা একদম অন্য রকম ভাবে ছাপা হল। জনগণ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করল এই সংবাদ। তারা বুঝতে পারল সব ঠিক আছে, তাদের জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এল, যেভাবে গণসূত্র তাদের এতদিন পথ দেখিয়েছে।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য শোকবার্তা লেখা হবে না। সেইদিন যখন দ্বিতীয় একজন ব্যক্তি পুলিসের হেফাজতে মারা গেল, তাঁর বাবা ছেলের স্মৃতিতে কয়েকটা লাইন দিতে চেয়েছিলেন সংবাদপত্রে, কাগজ প্রত্যাখ্যান করল সেই প্রস্তাব। সে জন্য বৃদ্ধ মানুষটি অবশ্য কিছু মনে করলেন না, কারণ একনায়ক নিজেও তো তাঁর মায়ের মৃত্যুতে কোনো শোকপ্রস্তাব ছাপেননি। বরং হেসে বারবার ক্ষমা চেয়ে গেলেন সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের কাছে, তাঁর অজ্ঞতার জন্য। আসলে ছেলের কবর নিয়ে এত নিমগ্ন ছিলেন যে সাম্প্রতিক নির্দেশ দেখার সুযোগ পাননি বৃদ্ধ, জানালেন। অফিসারদের ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে, প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেওয়ার আবেদনপত্র জমা করলেন। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলেন ছেলের দেহের জন্য।

ইতিমধ্যে একনায়ক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর মা কেন সাড়া দিচ্ছে না বা ফিরে আসছে না। মা তো সবসময়ে তাঁর সব নির্দেশ মেনে চলেছেন। তাহলে কি মাটির নিচে আছে বলেই নির্দেশ সেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারছে না? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তিনি সেই কবরস্থানে গিয়ে হাজির হলেন, তাঁর নির্দেশে খোঁড়া হলো কবর, বের করে আনা হল মায়ের দেহ। ওই সাদা চাদরের উপরে তাঁর নির্দেশ রাখলেন নায়ক। তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে, কিন্তু কই কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না তো! তাঁর প্রশংসার কোনো ইঙ্গিত কি দিচ্ছে না মা! একটা বড় পাথরের ওপর বসলেন একনায়ক, হাতের তালুতে রাখলেন ওই চওড়া কপালটা। আর হ্যাঁ, এই প্রথম বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল তার চওড়া কপালটায়।

ওই চওড়া ডেস্কটার ওপাশে তাঁর সম্পূর্ণ উচ্চতা নিয়ে তখন বসে আছেন একনায়কের সহকারী। স্যুট, টাই, আঙ্গুলের ফাঁকে কলম। লেখা শেষ করে তিনি হাঁক দিলেন। এক যুবক ঢুকল সেই শিলমোহর লাগানো কাগজটা নিতে। তারপর যখন নাগরিকদের হাতে এসে পৌঁছাল সেই নির্দেশ, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে তারা হেসেছিল, অভিনন্দন জানালো পরস্পরকে। হ্যাঁ, ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজ করে নিয়েছে সবকিছু। নিশ্চিন্ত।

_______________________________________

বাংলা অনুবাদক

শুভ্র মৈত্র জন্ম ও কর্মসূত্রে মালদাবাসী শুভ্র মৈত্র পেশায় শিক্ষক, নেশায় সাংবাদিক। প্রথম প্রকাশিত বই ‘পুরোনো ডাকঘর ফুরোনো রিফিল’ (অভিযান, ২০১৭) এবং দ্বিতীয় প্রকাশিত বই ‘দুগ্গাকুড়ুনি এবং’ (বৈভাষিক, ২০২০)।

Facebook Comments

Leave a Reply