মাসলোর চাহিদা তত্ত্ব : সোমালী
পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানে, বিংশ শতকের শুরুর দিকে দাপট দেখা যায় মনোসমীক্ষণ বা সাইকোঅ্যানালিটিক ও আচরণবাদ বা বিহ্যাভিওরিস্টিক স্কুলের। বাঁচার তাগিদে রাশিয়া থেকে আমেরিকায় চলে আসা ইহুদি পরিবারের ২য় প্রজন্মের বড় ছেলে আব্রাহাম মাসলো (১৯০৮-১৯৭০), এই স্কুলগুলিকেপেরিয়ে গিয়ে হিউম্যানিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ শুরু করেন। তার মূল বক্তব্য ছিল, কেবলমাত্র মানসিক রোগের পরিসরেই মনস্তত্ত্বের চর্চা আটকে থাকতে পারেনা। মানুষের ভাবাবেগের অস্বাভাবিকতার পাশাপাশি ব্যক্তিমানসেরমানসিক প্রশান্তি, আনন্দ, সন্তুষ্টি, প্রেষণা ইত্যাদিকেও চর্চার পরিসরে নিয়ে আসতে হবে।তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং মনোবিজ্ঞানের অন্যতম জনপ্রিয় প্রেষণা বা মোটিভেশনের তত্ত্বটি হল – চাহিদা সোপান তত্ত্ব বা হায়ারার্কি অফ নিডস থিয়োরি (১৯৪৩)। এতে তিনি মূলত ৫ রকমের চাহিদা বা প্রয়োজনের কথা বলেছেন — দৈহিক চাহিদা বা ফিজিওলজিক্যাল নিডস, নিরাপত্তার চাহিদা বা সেফটি নিডস, প্রতিপত্তি ও প্রীতির চাহিদা বা নিড ফর লাভ এন্ড বিলঙ্গিংনেস, আত্মমর্যাদার চাহিদা বা এস্টিম নিডস ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা বা নিড ফর সেলফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন। মাসলো এই পাঁচ রকমের চাহিদাকে এবার বোঝার সুবিধার্থে ভাগ করে দিলেন দুটি প্রধান ভাগে — প্রাথমিক বা ‘নিম্ন’ শ্রেণীর প্রয়োজন এবং ‘উচ্চ’ শ্রেণীর প্রয়োজন। নিম্ন শ্রেণীর চাহিদার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যতক্ষণ এই চাহিদা অপূর্ণ থাকে, ততক্ষণ বোঝা যায়, উচ্চ শ্রেণীর চাহিদা কত তুচ্ছ, কত মামুলি তার দাম এই জীবনকালে। কিন্তু একবার যদি এই নিম্নশ্রেণীর চাহিদা পূরণ হয়ে যায়, তখন আর এই চাহিদা মানুষের ব্যবহারকে সরাসরি চালনা করে না। মানুষ তখন হাঁটা দেয় পরবর্তী উচ্চ শ্রেণীর চাহিদাপূরণের দিকে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন শ্রেণীর চাহিদাগুলি অনেক বেশি বলশালী ও পূরণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়, তুলনায় উচ্চ শ্রেণীর চাহিদাগুলি অনেকদুর্বল প্রকৃতির এবং জীবনধারণের পক্ষে কম প্রয়োজনীয়। ফলে এই নিম্ন শ্রেণীর চাহিদাগুলি পূরণ না হলে জীবনে একরকমের সঙ্কট তৈরি হতে পারে, যার ফলে তিনি এদের ‘অভাবজনিত চাহিদা’ হিসেবে নামকরণও করেন। অপরপক্ষে উচ্চ শ্রেণীর প্রয়োজনগুলি ‘বেড়ে ওঠার’ এবং ‘দীর্ঘায়ু’ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়, তাই এর তিনি নাম দেন বৃদ্ধির ও অস্তিত্বের চাহিদা।
এই চাহিদাগুলি আরও গভীরভাবে আলোচনার খাতিরে, মাসলো পিরামিডের গড়নের অবতারণা করেন, ও জীবনধারণে চাহিদাগুলির গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের ওই পিরামিডে স্থাপন করে দেখান, যা পরবর্তীকালে তার এই তত্ত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। এই পিরামিডে আত্মপ্রতিষ্ঠা থাকে শিখরে, এবং দৈহিক চাহিদা থাকে সর্বনিম্ন স্তরে।দৈহিক ও নিরাপত্তার চাহিদা থেকে, সোপান বরাবর যত উপরে ওঠা যায়, ধীরে ধীরে আসে প্রতিপত্তি ও প্রীতি, আত্মমর্যাদার চাহিদা ও সবশেষে অর্থাৎ পিরামিডটির সর্বোচ্চ স্তরে দেখা যায় আত্মপ্রতিষ্ঠা বা সেলফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, কোন এক মানুষ এক প্রমাণ সময়ে ৮৫% দৈহিক চাহিদা মেটাতে পারলে, ৭০% নিরপত্তার, ৫০% প্রীতি ও প্রতিপত্তি, ৪০% আত্মমর্যাদা ও ১০% মাত্র আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা পূরণ করে থাকতে পারেন। অর্থাৎ প্রায় স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, যে ‘নিম্ন’ শ্রেণীর চাহিদা যদি একেবারে অপূর্ণ থেকে যায়, তাহলে মানুষের ব্যবহার আত্মমর্যাদা বা আত্মপ্রতিষ্ঠার মত উচ্চ শ্রেণীর চাহিদা দ্বারা পরিচালিত হতে পারেনা।
বলা হয়, এই তত্ত্বটি মানুষের অস্তিত্বের কাঠামোগত সত্যকে তুলে ধরে। জ্যামিতিক চিত্র হিসেবে, পিরামিডের ব্যবহারও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সবচেয়ে নিচের স্তরটি সবথেকে বেশি জনাকীর্ণ। ফলে উপরের সমস্ত স্তর ঋজু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এর উপর ভর করে। তাতেযতই উপরের দিকে ওঠা যায় (এবং উপরের দিকে ওঠাই দস্তুর), ততই স্থান সঙ্কুচিত হতে থাকে। ফলে এক প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতিও যে পাশাপাশি চলে, তা বলাই বাহুল্য। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বর্ণনা করতেও এই পিরামিড আকৃতির ব্যবহার আছে। যেমনখাদ্য-খাদক পিরামিডে শক্তির প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী, অথচ যত ওঠা যায়, ততই সে শক্তির জোর কমে আসে, বরং ক্ষমতার জোর বাড়তে থাকে। তেমনই চাহিদার এই পিরামিডেও চাহিদার জোর, যত উপরদিকে যাওয়া যায় তত ক্ষীণ হয়ে আসেঅথচ একইরকমভাবেক্ষমতার জোর বাড়তে থাকে। এই পিরামিডে উচ্চ শ্রেণীর প্রয়োজনের পাশে, থুড়ি নীচে দাঁড়িয়ে নিম্ন শ্রেণীর প্রয়োজনের পাওনা কেবল এতটুকুই যে তাদেরকে প্রাথমিকও বলা হয়েছে। ফলে চাহিদার প্রকারভেদকে সরলভাবে বোঝাতে ব্যবহৃত এই পিরামিড ধীরে ধীরে খাদ্য-খাদকের পিরামিডের কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। হয়ত প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবাধ গতি আরবাস্তু-পিরামিডের সাথে সাদৃশ্যই এই তত্ত্বকে এত জনপ্রিয় করে তোলে।
- “আমাদের খাবার চাইনা, ১ মাস হয়ে গেল কাজ নেই। কাজ দিন। কাজ দেবেন?”
- “আরে ওদিকে কি খাবার দিচ্ছেন! দেবেন না। কালকে মুদিখানার দোকানে গিয়ে একে একে বিক্রি করে এসেছে এইসব চাল ডাল… নষ্ট করবেন না এত এত খাবার”
- “আমরা পোকামাকড়ের মত মরব, টাকা নেই তো আমাদের কাছে, পোকামাকড়ের মত মরব আমরা।“
- “এই তো বোন, একটু টাকা জমানো ছিল বর্ষার আগে টালিটা সারাই করব… দেখো না কি করে করি, টাকাটা খরচ করতেও ভরসা পাচ্ছি না এখন! খাব না টালি সারাবো”
খবরের কাগজ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ও আশেপাশের কানাঘুষো বলছে, একদল মানুষ হঠাৎ রাজপথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে, আর তাতে ভয় পেয়েছে ‘দেশ’। ২০১৮ সালের মার্চে মহারাষ্ট্রের ৩০,০০০ চাষী রাজপথে প্রতিবাদী মিছিল করেন, তারপরেও আমরা জানতে পারিনি, এখনও ‘নিম্ন’ শ্রেণীর চাহিদা মেটেনি (মেটেনা) অনেকের। আমরা জানলাম, যখন দেখলাম ফাঁকা রাজপথে (হয়ত ফাঁকা ছিল বলেই) হেঁটে হেঁটে ‘কোরোনা’‘আমাদের রাজ্যে’ ঢুকে আসছে। চাহিদার সোপান তত্ত্বকেই আজকের প্রেক্ষিতে সাজালেদেখা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিপত্তি ও প্রীতির চাহিদা বাদে, এমন প্রায় কোন চাহিদাই নেই যা শ্রম করে সম্মানের সাথে বাঁচতে শেখা মানুষ এখন, নিজেরা, ‘উচ্চ শ্রেণীর’ মানুষদের সাহায্য ছাড়াই পূরণ করতে পারেন। বন্ধুবান্ধব, পরিবারপরিজনের সাথে একজোট থাকাই তাদের হাতের, এই মুহূর্তের একমাত্র বিকল্প।
অতঃপর প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘নিম্ন শ্রেণীর’ এতগুলি চাহিদা না মেটার পরেও কেমন করে ‘উচ্চ শ্রেণীর’ চাহিদা স্তরে পৌঁছন তারা? সত্যিই তো। যদি জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রের মতই, চাহিদার পিরামিডকেও ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান ‘সোপান’ এ পরিণত করা গিয়ে থাকে, যদি সভ্যতার পরিসরে মানুষের চাহিদাপূরণের ক্ষেত্রগুলিকে সত্যই ক্ষমতার পিরামিডে ফেলে দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের যুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, তবে দৈহিক ও নিরাপত্তার চাহিদা যার মিটছেনা, তার তো প্রাকৃতিক নির্বাচন অনুযায়ী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা? ফলস্বরূপ চিন্তাগত দিক থেকে বিলুপ্ত এই মানুষগুলো যখন পাঁচ থেকে ত্রিশ বছর পর আজ ঘরে ফিরছেন, যে রাজ্য, গ্রাম, বাড়ি, পরিবার, জমি ও অর্থনীতি থেকে তারা বেরিয়েছিলেন, হয়ত আত্মহত্যা করতে না চেয়েই বেরিয়েছিলেন, সেখানেও তাদের অস্তিত্ব আজ না থাকারই সমান। ফলে, অনিশ্চয়তার জমিতেতাদের সহজেই কোরোনা ডেকে দেওয়া যায়। উপর উপর একে ‘স্টিগমা’ বলে ছেড়ে দেওয়া গেলেও, অন্তর্বর্তী মানসিক লড়াই আরও অনেক জটিল ও পরিশ্রমসাধ্য হতে চলেছে — না-মানুষ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াই। তবে সুবিধে এইটুকুই, যে কৌমজীবনে ফিরে যাবেন বলে তারা পা বাড়িয়েছিলেন, কোরোনা ডাক সেই কৌম পরিসর থেকে আসেনি, এসেছে ক্ষমতার অন্যক্ষেত্র,অন্য পরিসর থেকে।
তাহলে এই মানুষদের চাহিদাগুলো আমরা কিভাবে দেখব? যারা ক্যামেরা নিয়ে কাজ দেখেছেন, তারা জানেন, ক্যামেরা অন করা আর ছবি তোলার মধ্যে মেলা প্রস্তুতি থাকে, যার মূল উদ্দেশ্য ক্যামেরাটিকে, লেন্সটিকে মুহূর্তটির উপযোগী করে তোলা। তারপর বেছে নিতে হয় দিক ও কোণ। সেই অনুযায়ীআবারও বদলে যায় কিছু প্রস্তুতি। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার জন্য এত প্রস্তুতি, যা পরে সুযোগ মত মুছেও দেওয়া যাবে, অথচ একজন মানুষের চোখ দিয়ে আরেকটা মানুষকে দেখার আগে, যা প্রায় চিরকালের জন্য স্মৃতিতে জমা থাকবে, তার জন্য প্রস্তুতি থাকবে না?যদি সোপান ছেড়ে এই চাহিদাগুলোকে এক সমতলে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে প্রথম সিঁড়ির চাহিদা থেকে তৃতীয় সিঁড়ির চাহিদাতে লাফ আর অবোধ্য লাগে কি? বাঁচার তাগিদে মানুষের কাছে বিকল্প হিসেবে যে চাহিদাগুলি উপস্থিত, সেগুলো একরৈখিকভাবে ন্যস্ত থাকলে একটি না পেরিয়ে অপরটিতে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু, ব্যক্তি যখন একই সমতলে থেকে যে কোন চাহিদাপূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা পায়, তখন এই পিরামিড আলগা হয়ে খুলে পড়ে, কোন চাহিদাই আর ‘নিম্ন’ বা ‘উচ্চ’ শ্রেণীর চাহিদা হয়ে থাকেনা। সুতরাং, ত্রাণ সাহায্য করতে গেলে আমরা কেউ খাবার নিয়ে গেলে, কেউ বাড়িঘর সারানোর ব্যবস্থা করতে পারি। কেউ কিছু সংখ্যক মানুষকে অন্তত যতদিন না প্যান্ডেমিকের ফাঁড়া কাটে, ছোট-বড় নানা কাজে নিয়োগ করতে পারি। যে রিকশাচালক এখনও ভাড়ার রিকশা চালাচ্ছেন, তাকে একটা রিকশা কিনে দিতে পারি, যার মিলের চাকরি গেছে কজন মিলে তাকে সবজি বিক্রির ভ্যান কিনে দিতে পারি। মানুষকে শুধু ‘নিম্ন’ শ্রেণীর প্রয়োজনে সাহায্য না করে, তার দৈহিক, নিরাপত্তার, প্রীতির, মর্যাদার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সমস্ত প্রয়োজনগুলিতে কিছু করে যদি সাহায্য করা যায়, তবে সমস্যার কিছু সমাধান হয়ে উঠতে পারে। বিন্দুগুলি একই সমতলে থাকে, তাদের একে একে জুড়ে দেওয়ার কাজও আমাদের — নাগরিকদের। বিন্দুগুলিকে একে অপরের উপরে বা নিচে যোগ করে আমরা পিরামিড বানাচ্ছি না পরস্পর যোগ করে তারামন্ডল, তা আমাদেরই হাতে।