দারিদ্রতাও এক বৈষম্য : তপোন দাশ

সমাজে মানুষ যে কতো রকম ভাবে বঞ্চিত হতে পারে তা অনেকটাই অনুভব করতে পারে সূর্য। স্কুল জীবন থেকেই সে খুব সহজে সকলের সাথে মিশতে পারে। শুধু নিজের শ্রেণীতেই নয়, স্কুলের প্রায় সমস্ত ছেলেদের সাথেই তার অবাধ মেলামেশা ছিল। মাধ্যমিকের পরে একটা নতুন স্কুলে গিয়েও মাত্র দু’বছরেই সে সকলের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আর এখন কলেজেও তাই। তার খুব ইচ্ছে ছিল কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়ার। বেশ কয়েকটা কলেজে পরীক্ষাও দিয়েছিল। কিন্তু কোথাও সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজে গণিত অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। প্রায় প্রথম দিন থেকেই কলেজের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই সে বন্ধুত্ব করে নেয়। এমনকি ইউনিয়ন রুমে ঢুকে প্রাক্তনদের সাথেও তার ভালো রকম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। পড়াশোনায় বেশ ভালোই সূর্য। তার উপর কবিতা লেখার অভ্যাস আছে। কয়েক দিনের মধ্যে সে ইউনিয়ন রুমে থাকতে থাকতে টেবিল টেনিসও শিখে নিয়েছিলো সঙ্গে দেদার আড্ডাবাজি। প্রথম বর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে প্রায় গোটা কলেজেই সে প্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এতো সকলের মধ্যে নিশ্চল রায় তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়। কারণ সেও কবিতা লিখতো। দুই বন্ধু একসঙ্গে কখনও ফাঁকা কোন ক্লাসরুমে কখনও লাইব্রেরিতে বসে নানান রকম পড়াশোনা, কবিতা পাঠ,নতুন সব পত্রিকা নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি করতো। তবে কলেজে আর কেউ সেইভাবে নিশ্চলের সাথে মিশতো না। সূর্য দেখতো প্রায় সমস্ত ছাত্রছাত্রীই নিশ্চলকে এড়িয়ে যায়। কাউকে সে নিশ্চলের কবিতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে তারাও কথা ঘুরিয়ে দিতো। অথচ কেউই কোন দিন কোন কারণ বলতো না। ধীরে ধীরে সূর্য বুঝতে পারে নিশ্চল শুধুমাত্র গরীব বলেই সকলের কাছে অবহেলিত হচ্ছে! এই সুস্থ সমাজে শিক্ষিত হতে আসা মানুষেরা কেন এইভাবে ছেলেটাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারেনা।

একটা বাটিক প্রিন্টের প্রায় সমস্ত রঙ চলে যাওয়া খদ্দরি জামা আর একটা বহু পুরনো কাপড়ের প্যান্ট। এই ছিল নিশ্চলের ইউনিফর্ম। এটা পরেই সে কলেজে আসতো। আর একটা ব্যাগ ছিল সেটাও একেবারে জীর্ণ। প্রায় চারপাঁচ কিলোমিটার সে হেঁটে আসতো। কখনও রাজমিস্ত্রীদের সাথে মজদুরি, কখনও থেমে থাকা ট্রেনের যাত্রীদের খবরের কাগজ বিক্রি বা অনুষ্ঠান বাড়িতে জোগাড়ের কাজ করে পেট চালাতে হতো নিশ্চলকে। তার উপর পড়াশোনার খরচ। তিনজন প্রাইভেট প্রফেসরের মাহিনা। দু’চারটে বাচ্চাদের পড়িয়েও অবশ্য কিছু টাকা আসতো। তবে সব খরচ সামলে মাসের শেষে আর কানাকড়িও পকেটে থাকতো না। কোন দিন কাজ না পেলে অনাহারেই থাকতে হতো তাকে। রাস্তায় টিউকলের জল খেয়ে সে কোন বাড়ির রকে বা পরিত্যক্ত কোন বাড়ির নিচে আস্থানা করে ঘুমিয়ে পড়তো। আর কোথাও সামান্য আলো পেলে সে শুরু করে দিতো কবিতা লেখা। পড়তো দিনের আলোয়।

সূর্য কোনদিন নিশ্চলকে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোন প্রশ্ন করতো না। মাঝেমধ্যেই সে ক্যান্টিনে খাবার নিতো এবং নিশ্চলকেও জোর করে খাওয়াতো। তারপর ভূপেন্দ্র এভিনিউ ধরে জগৎ পার্কের কাছে চলে আসতো। কখনও বা ওই পার্কের গা’ধরে সোজা বাগবাজার ঘাটে। অনেক কবিতা হতো সেখানে। উত্তর কলকাতার রাস্তাঘাট খুব প্রিয় সূর্যের। পুরনো সব বাড়ি। বড়ো বড়ো দালান। ঝোলা বারান্দা। নিশ্চলও তার মতো উত্তর কলকাতারই ছেলে। তাদের একটা সময় আহিরিতোলা বাইলেনে বাড়ি ছিল। বাড়িটা পারিবারিক কারণে বিক্রি করে দিতে হয়। তখন নিশ্চলের বয়স চারপাঁচ হবে। পরে বাগবাজার থেকে যে রাস্তাটা কুমোরটুলির দিকে মিশে গেছে সেখানে একটা পুরনো বাড়িতে ওরা ভাড়া যায়। নিশ্চলের বাবা একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দেশবিদেশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আসার পর হাওড়ার বেলুড়ে জিন্ডাল কোম্পানিতে ফোরম্যানের পদে স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ একটা মেশিন ঠিক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। নিশ্চলের বাবা প্রায় দু’মাস হাসপাতালে লড়াই করার পর মারা গিয়েছিলেন। নিশ্চল তার মা’য়ের মুখেই শুনেছে, তার বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে মায়ের সমস্ত গয়না এবং সঞ্চিত অর্থ শেষ হয়ে গেছিল। তারপর মাধ্যমিক পাশ করার পর নিশ্চলকে তার মা একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। প্রথম বছর মা আর তার ছোট বোন মুমুন তার সঙ্গে ওই আবাসিক স্কুলে দেখা করতে যেতো। বেশ কয়েকবার এসেছিল তারা। সেই সময় থেকেই নিশ্চল তার মা’য়ের চোখেমুখে দৈন্যতার আভাস দেখতে পেয়েছিল। মা এলে সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার আনতেন আর কিছু গল্পের বই। কিন্তু দ্বিতীয় বছর শুরু হওয়ার পর থেকে তারা আর কোন দিন নিশ্চলের সাথে দেখা করতে আসেনি। এমনকি আবাসিক স্কুলের বকেয়া টাকাপয়সাও জমা দেওয়া হয়নি বাড়ি থেকে। অগত্যা ওই স্কুলের অধ্যক্ষ তাকে উচ্চমাধ্যমিকের পর আবাসিক স্কুলের মেশ ছেড়ে দিতে বলেন। তার পর থেকেই সে একা। বাগবাজারে ফিরে সে আর পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি। ওই আবাসিক স্কুলের এক প্রফেসর প্রাণগোপাল মহারাজের সাহায্যে সে এই মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। না ঘর,না পরিবার,না পরিচয় কিছুই ছিলনা নিশ্চলের। ঝড়,বৃষ্টি,প্রচন্ড গরম, কনকনে শীতেও তাকে রাস্তাতেই কাটাতে হয়। কখনও বৃষ্টিতে কোন বাড়ির শেডের নিচে, ঠান্ডায় কোন গুমটিঘরের ভিতর তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে ছেলেটা অনার্স নিয়েছে। কবিতা লিখছে। নানান কথা প্রসঙ্গে নিশ্চলের জীবনযাত্রার কথা গুলো জানতে পেরেছিল সূর্য। নিশ্চল তার ব্যক্তিজীবনকে কবিতা করে তুলতো না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গুলো ছাড়িয়ে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজমই হয়ে উঠেছিল তার হাতিয়ার। তার কাছে জীবনের প্রতিটি উপাদানই কবিতা। সমস্ত দেখার ভিতরেই তার কবিতার খোঁজ। নাগালের বাইরে চলে যায় সে তার ভাবনার মধ্যে দিয়ে। নিজের অসচ্ছল জীবন তার কাছে চরম ব্যক্তিগত। সে কবিতায় এক অর্থহীন পৃথিবী ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকে।

সূর্য নিশ্চলকে নিয়ে লাইব্রেরিতে নানা রকম বই পড়তো। কখনও ডেভিড বম। কখনও অ্যান্তেনিও গ্রামসি। কখনও ইলিয়া গ্রিগোজিন। কখনও কার্ল মার্ক্স। শুধু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসই নয়,বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের সমাবেশ নিয়েও তাদের নিয়মিত চর্চা এবং পড়াশোনা চলতেই থাকতো। এমনকি বাংলা সাহিত্যে জ্যাঁক দেরিদা, লাকা, ফুকো, সস্যুর প্রমুখদের ভাবনাচিন্তা গুলোর প্রয়োগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিস্তর তর্কাতর্কিও হতো। একটা সময় সাহিত্যিকদের সাথে পাঠকদেরও পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা নিয়ে যোগাযোগ ঘটেছিল।আর সেই কারণেই তত্ত্ব গুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রধানত নতুন কিছু লেখার তাগিদেই এই সব বিদেশি তত্ত্ব গুলোর সংযোজন ঘটানো হয়েছিল। ফলে দ্রুত ভাষা তত্ত্বেরও বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। তাতে অবশ্য পড়ার স্বাভাবিক স্বাদ বদলে যায়। একটা অন্য রকম পরিসর তৈরি হয়। তবে সূর্য সাহিত্য বা কবিতায় পাশ্চাত্য দার্শনিক তত্ত্ব গুলোর প্রয়োজন আছে কিনা সেই বিষয়ে নানা রকম সন্দেহ প্রকাশ করে। তার মতে এর চেয়ে বৌদ্ধদর্শন পড়া ভালো। পৃথিবীর তামাম দর্শনের ছাপ নেওয়া হয়েছে বৌদ্ধ দর্শন থেকে। নিশ্চলের মনেও নানান প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল এই সব পড়তে গিয়ে। শুধুমাত্র ভৌগোলিক বিস্তারের ফলেই কি নতুন আবিষ্কার হবে! নতুন কি নিজে থেকে জন্মাতে পারে না? কোন একটা তত্ত্বের প্রয়োগ কি প্রকৃতই নতুন নাকি নতুন প্রয়োগ মাত্র! কলেজ থেকে বেড়িয়ে ডানদিকে সরু গলিটায় ঢুকেই দুখে’দার চায়ের দোকান। সূর্য আর নিশ্চল প্রায় দু’তিন ঘন্টা ওখানেও জমিয়ে আড্ডা দেয়। নানা রকম কথাবার্তার সঙ্গে কবিতাও হয় মাঝেমধ্যে। তবে নিশ্চল তত্ত্ব গুলো পড়লেও সেগুলো নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। দর্শনকে সে নিজের মতো উপলব্ধি করে। চারপাশে সমস্ত জুড়েই তো দর্শন রয়েছে। সম্ভাবনার রাস্তা গুলো তৈরি হয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতেই। নিশ্চল তার কবিতায় সম্পূর্ণ অবাস্তব গুলোই বিকল্প করে তোলে নিজস্ব বাস্তবতায়।

দারিদ্রের জন্য পৃথিবী জুড়ে নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমার বেশ কয়েক বছর ধরে এই বিষয়ে গবেষণা করে আসছেন। সূর্য বাস্তবিক জীবনে নিজের চারপাশে দেখছে গরীব মানুষদের জীবনযাত্রা। রেললাইনের ধারে, পচা পুকুর বা ভাগাড় গুলোর চারপাশে কতো অস্থায়ী বস্তি গড়ে উঠেছে। তারা কি কষ্টকর জীবন চালায়! বাড়ির পাশেই কুলিলাইনে এমনই একটা ছোট ঝোপরপট্টি আছে। তাদের বেশির ভাগ জনই লোকের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে খায় বা ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া বাসি খাবার খেয়ে দিন কাটায়। একটু বয়স হলেই বস্তির ছেলে গুলো চুরিচামারিতে জড়িয়ে যায়। নানা রকম নেশাভানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। প্রায় অকালেই মারা যায়। প্রশাসন কি এদের মানুষ ভাবে না? অথচ সকলেরই কিন্তু আঁধার কার্ড আছে! এরা যে কেন আজও গরীব তার কোন ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে। কেন স্বাধীনতার এতো গুলো বছর কেটে গেলেও এদের জন্য কিছু করা হলো না কে জানে! এদের কাছে পেটের জ্বালাই হলো আসল শিক্ষা। তাই এরা আর আলাদা করে কোন বিদ্যালয়ে যায় না। দারিদ্রের জন্য অবশ্য প্রতি বছরই নানান রকম প্রকল্পের কথা শোনা যায়। সেগুলো কখন কোথায় কিভাবে বাস্তবায়িত হয় বা আদৌও হয় কিনা কে জানে। কোন দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যতাই প্রকৃত পক্ষে দায়ী এই দারিদ্রতার জন্য। কিন্তু তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এই সমস্ত গরীব মানুষদের। এই দায় তো কেউ নেয় না। পেটের দায়ে এই সব নিম্ন বস্তির ছেলেমেয়েরা নানা রকম অপরাধ মূলক কাজেও জড়িয়ে যায়। এসব জায়গা থেকেই পাচার হয় ছোট ছোট মেয়েরা বা বিভিন্ন নেশার বস্তু। সন্তানের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য মায়েরা দেহব্যবসাও করে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝেমধ্যে নিজেদের সংগঠনের নিয়ম বজায় রাখার জন্য ওই সব বস্তিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কিছু ছবি তুলে রাখে। তবে গরীব মানুষ গুলোর দুঃসহ অবস্থা নিয়ে প্রচার, বিজ্ঞাপন হলেও তাতে তাদের ক্ষুধার সমস্যা মেটে না। সূর্য নিয়মিত দেখে পাশের সব্জি বাজারে পরিত্যক্ত কাঁচা আনাজ বা খোসাপাতি ওই সমস্ত গরীব মা-বোনেরা পরম যত্ন করে তুলে নিয়ে যায়। তার সাথে ভিক্ষে পাওয়া চাল বা খুদ মিশিয়ে শুকনো গাছের ডালপালায় জ্বাল দিয়ে খিদের খিচুড়ি তৈরি হয় পোড়া ইঁটের উনুনে।

গরীব মানুষেরা সব দিক থেকেই বঞ্চিত হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা সহজে কাজ পায়না কোথাও। সামান্য কলকারখানাও নেয় না। পরিচারিকার কাজও জোটে না। সামাজিক অনুষ্ঠান উৎসবেও তারা ব্রাত্য থেকে যায়। এদের মধ্যে যারা নির্মাণ শ্রমিক বা দিন মজুরি করে বা রিক্সা চালক তাদের জীবনযাপন মানে রোজ আনা রোজ খাওয়ার মতো। ছোট থেকে অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা কতো তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে ধরে নানা রকম অসুখ। এই সমস্ত শ্রেণির গরীব মানুষেরা নিজেরাই অন্য রকম ভাবে বেঁচে টিকে আছে পৃথিবীর সর্বত্র। ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য সেই একই রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে কাল্পনিক কবিতা লেখাও বড়ো বিলাসিতা মনে হয় সূর্যের। সে প্রতিনিয়ত নিশ্চলকে দেখে দারিদ্রতার সংজ্ঞা বদলে যেতে দেখে। যে সমস্ত পত্রিকার সঙ্গে নিশ্চল যুক্ত আছে তারাও কম অবজ্ঞা করেনি তাকে! একটা পত্রিকা চালাতে গেলে সদস্যদের আর্থিক সাহায্য করার একটা ব্যাপার আছে। সেদিক থেকে নিশ্চল একেবারেই অসহায়। ফলে তার লেখালিখিও তেমন গুরুত্ব পায় না। কবি সম্মেলন গুলোয় তাকে কবিতা পাঠের জন্য ডাকা হয়না। পত্রিকা গুলোয় বিশেষ বিশেষ সংখ্যায় তার জন্য অতিরিক্ত পাতা বরাদ্দ থাকে না। এমনকি সেই সব সংগঠন গুলো দল বেঁধে কবিতার অভিযানে গেলেও তাকে কোন দিন জানানো হয়নি। কারণ সেই সব ট্যুরে একটু বেশি অঙ্কের টাকা লাগে। এসমস্তই নিশ্চল মেনে নিয়েছে। তার একটা প্রিয় বন্ধু ছিল এক সময়। প্রিয়ব্রত। সেও কবিতার বন্ধু। প্রিয়ব্রত বিয়ে করার পর নিশ্চলের সঙ্গই ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর সে তার বউ আর ধনী বন্ধুদের নিয়ে শিলং,দার্জিলিং, কেরল,অরুণাচল প্রদেশ প্রভৃতি কতো জায়গায় ভ্রমণ করেছে। কিন্তু একবারও নিশ্চলের কথা ভাবেনি। পরে তাদের একটা বাচ্চা হওয়ার পর সেই ছেলে, বউ এবং পাড়ার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন সকলকে নিয়ে সে যে কতো ট্যুর করেছে! তাদের ঘুরে আসার অ্যালবাম গুলো দেখে নিশ্চল আনন্দ পায়। সে বুঝে গেছে বউ,বাচ্চা, আত্মীয়, ধনী বন্ধুবান্ধব এরা একটা শ্রেণির আর সে এক অন্য গ্রহের মানুষ। রক্তের সম্পর্ক আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছাড়া মানুষ অন্য কারো কথা ভাবেনা! একটা ধনী বন্ধুর খরচ বহন করা অহংকারের বিষয়। গরীব বন্ধুর জন্য সেটা সাহায্য করা বোঝাবে। সত্যি প্রিয়ব্রত বছর বছর ট্যুর করেছে, এতো বন্ধুবান্ধবদের এবং নিজের পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ একটা বারও সে নিশ্চলের কথা ভেবেও দেখেনি। অথচ একটা সময় সে’ই ছিল নিশ্চলের সব সময়ের সঙ্গী। নিশ্চল অর্থ দিয়ে না পারলেও বন্ধুর পাশে থাকার মতো সমস্ত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে চিরকাল। ওই যে গরীব হওয়া! সমাজে কোথাও নিয়ে গেলে কি পরিচয় দেবে মানুষ। না সে কোন ভালো চাকরিতে করে না কোন ব্যাবসা। পরিচয় দেওয়ার জন্য অর্থনৈতিক যোগসূত্রটা আবশ্যিক একটা দিক। যদিও এই সব নিয়ে নিশ্চল তেমন কিছু ভাবে না। সূর্যই এই সমস্ত বিষয় গুলো খুঁটিয়ে দেখে। প্রিয়ব্রত বড়ো ব্যাবসায়ী। অগাধ অর্থশালী। সে হয়তো পারলে নিশ্চলকে কোন একটা রাস্তা দেখাতে পারতো। সূর্য চেষ্টা করলেও হবে না। সেও তো নিন্ম মধ্যবিত্ত বাড়িরই ছেলে। বাবার সামান্য মাহিনায় সংসার চলে। বরং এবার সূর্যকেও নিজের পা’য়ে দাড়াতে হবে। তবে সে মনেমনে ভাবে, যদি তার কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যায় তাহলে নিশ্চলেরও একটা কোন ব্যবস্থা সে নিজে করবে। নিদেনপক্ষে একটা ঘর। সামান্য কিছু রোজগার। কবিতা লিখে তো শারীরিক খিদে মিটবে না!

ঝড়বৃষ্টিদাবদাহন সমস্ত নিয়েই রাস্তায় রাস্তায় জীবন কাটিয়ে গেল নিশ্চল। তার কোন থেমে যাওয়া নেই। ফিরে দেখা নেই। সমস্ত অতীত তার কাছে বোবা। এমনকি অদূর ভবিষ্যৎ নিয়েও তার কোন কথা নেই। তার নিরন্তর লিখে যাওয়া শূন্যকাল থেকে ক্রমশ বয়ে চলেছে। তবে একটা সময় সে সত্যি থেমে যেতে চেয়েছিল। মানসিক অবসাদ গ্রাস করেছিল তার চেতনাবোধকে। লেখালেখির জগতে নেপোটিজম খুব সূক্ষ্ম তরঙ্গে চলে। ধীরে ধীরে একজন কবি কিভাবে ডিপ্রেশনে পৌঁছে যায় সে নিজেও টের পায়না। অনবরত যোগ্য মানুষকে বঞ্চিত করে অযোগ্যদের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সমস্ত মাধ্যমেই চলে নেপোটিজম। গরীব মানুষদের খুব সহজেই যেকোনো অপবাদ দেওয়া যায়। সরাসরি মিথ্যেবাদী বানিয়ে দেওয়া যায়। আসলে দারিদ্র্যবদের কোন কথারই কোন গুরুত্ব থাকে না কোথাও। ফলে যথেচ্ছ অপমান সহ্য করতে হয় কমবেশি সমস্ত শ্রেণিরই গরীব মানুষদের। যখন সূর্য একাদশ শ্রেনীতে সায়েন্স নিয়ে পড়তে শুরু করলো তখন একজন প্রাইভেট টিউটর সকলের সামনেই বলেছিল “মধ্যবিত্তদের সায়েন্স মানায় না। কতো খরচ জানো?” কিম্বা বারবার তাকেই উনি প্রশ্ন ধরে বিব্রত করতেন! হাসির খোরাক তৈরি করতেন সেই প্রফেসর। সূর্যের সামান্য অভিজ্ঞতা রয়েছে এই বিষয়ে। তাই হয়তো সে নিশ্চলের ব্যাপারটা এতোটা বুঝতে পারে। তাকে পাড়া প্রতিবেশীদের টিপ্পনীও শুনতে হয়েছে। “কেরানির ছেলে সায়েন্স নিয়েছে, বড়ো হয়ে বিজ্ঞানী হবে ” বলে হাহাহোহো করে হেসে ছিল কিছু প্রতিবেশীও। তাই নিশ্চলকে নিয়ে কেউ উপহাস করলে কষ্টটা টের পায় সূর্য।

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দারিদ্র্য বিমোচন অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। একটি সুস্থ মানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দারিদ্রতা নিয়ে প্রত্যেক দেশেরই ভাবা উচিৎ। কারণ দারিদ্রই প্রকট করে কোন দেশের অর্থনৈতিক মান। শুধুমাত্র দারিদ্রতার কারণেই গরীব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে রোজগারের দিকে চলে যায়। আজ গরীব বলেই প্রতিপদে বঞ্চিত হতে হয় নিশ্চলকে। তাছাড়া এই দারিদ্রতার সাথেসাথে গরীবদের রুগ্ন স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির সঙ্গেও লড়াই চলে। তাদের দৈনিক রোজগার এতোটাই কম যে তারা ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করার ফুরসতই পায়না। তাই যেকোনো দেশের সরকার যদি যথাযথ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাহলেই হয়তো এই দারিদ্রতার মতো প্রপঞ্চক দূর হবে। নচেৎ এই নিশ্চলের মতো ছেলেরা চিরকাল চরম বৈষম্যতার শিকার হতেই থাকবে।

Facebook Comments

Leave a Reply