হীনতায় লীন যাপন-শাসন : সুদেষ্ণা মজুমদার

শরীরের যত্ন নাও, বুদ্ধি বা মেধার নয়। হাঁটাচলা, চুলবাঁধা, দাঁত, নখ, গোড়ালি—মানে আপাদমস্তক মোম পালিশে চকচকে করে তোলো। কম খাও। আস্তে হাঁটো। জোরে কথা বলবে না, জোরে হাসবে না। আড়াই-তিন হাজার বছর পেরিয়েও নারীর প্রতি সমাজের এই মনোভাব বদলায়নি। ফেসবুকের বাইরে যে বৃহৎ সমাজ, তার কথা বলছি।

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। আড়াই-তিন হাজার বছর। তবে, আমিই যে প্রথম এ-বিষয়টির উল্লেখ করছি মোটেও নয়। আমার আগে অনেকেই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাতে সমাজের কোনো পরিবর্তন কি হয়েছে? হলেও খুব সামান্য। বড়ো বড়ো শহরে পরিবর্তনটা নজরে এলেও খোঁজ নিলে দেখা যাবে নজরের বাইরে পড়ে থাকা নারীদের অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু শহরেও কি নারীরা, শিক্ষিত নারীরা অত্যাচারিত হয় না? এত চট করে হায়দরাবাদের প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির কথা ভুলি কী করে? নির্ভয়াকে? এই ধরনের অত্যুগ্র ঘটনার পাশাপাশি খুব নিঃশব্দে, চোরাস্রোতে অনেক ঘটনা ঘটে যায় যেগুলোর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না। একদম ঠিক বুঝেছেন– আমি নারী-জীবনের কয়েকটি প্রসঙ্গ বা বঞ্চনা নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই ভাবছেন এ আর নতুন কী! সেই পুরোনো বিষয়। সেই পুরোনো কপচানি। আর এদিকে পৃথিবীতে কত কী ঘটে যাচ্ছে, সেদিকে কোনো নারীই নজর দিতে চান না। একটু ভুল করলেন। চান যেমন, দেনও তেমন। তবে কী জানেন, বেশিরভাগ সময়ে দিতে দেওয়া হয় না। নিজের মতো করে দিতে চাইলে শুনতে হয়, এটা মেয়েদের বিষয় নয়। তোমরা বড্ড মেয়েলি! বাংলা সংবাদপত্রটা একটু খুলে দেখুন। দেখবেন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি—মানে গম্ভীর বিষয়গুলোতে লেখকরা সবাই-ই প্রায় পুরুষ। মেয়েদের ভাগে তথাকথিত নরম বা হালকা বিষয়গুলো পড়ে। বা বলা ভালো সমাজের ভিত্তিমূলক (বা, নীচুস্তরের) বিষয়, যেমন স্বাস্থ্য, শিশু, খাদ্য, বস্ত্র এবং ঘর (বাসস্থান নয়) সাজানোর হাল-হদিশ। আজ যখন পৃথিবী অন্তিম সময়ের দিন গুনছে, তখন বলা হচ্ছে, না, স্বাস্থ্যের দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। শিক্ষাটাও জরুরি। এবং পাশাপাশি অন্যান্যগুলো। আর এইবার আবার পুরুষরা ‘আরো বেশি’ নজর দেওয়া শুরু করে কী ঘটাবেন কে জানে! যাই হোক, ওই উপরোল্লিখিত গম্ভীর বিষয়গুলো কি নারীরা বোঝেন না? ঠিকই বোঝেন। অবিশ্যি বুঝেছি, এটা প্রকাশ করতে গেলেও পুরুষের কাছে মানে খাটো হয়ে যান। নিজেদের মত প্রকাশ করার চেষ্টা করলেই তাঁদের শুনতে হয়, ‘যা বোঝো না সে-নিয়ে কথা বলতে এসো না।’ এ শুধু সিনেমায় কমল মিত্রের ডায়ালগ ভাবলে ভুল করব আমরা। প্রতিটা ঘরে এই ডায়ালগ শুনতে পাওয়া যায়। এমনকী, নিজের সম্বন্ধে কিছু বলার অধিকার, ভাবার অধিকার আজ, ২০২০ সালেও নেই। একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। গত মাসের কথা। আমার এক আত্মীয়া, যাঁর বয়স বাষট্টি-তেষট্টি, কোরোনায় গৃহবন্দি, ফলে বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না। তো, অসুস্থতার কারণে ডাক্তারকে ফোন করতে চাইলে তাঁর বর (স্বামী শব্দটা আমি এড়িয়ে চলি) বলেন, ‘আমি করছি।’ এবং ফোন করে সেই ভদ্রলোক বউয়ের অসুস্থতার কথা ডাক্তারকে বলতে গিয়ে যথারীতি আমতা-আমতা করছেন। কারণ বউয়ের অসুস্থতার বিষয়টি সঠিকভাবে তাঁর জানা নেই। জানার কথাও নয়। কী হবে জেনে? ডাক্তারকে ফোন করার প্রসঙ্গ না উঠলে তিনি জানতেও পারতেন না যে তাঁর বউ অসুস্থ। ফলে, বারবার বউকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমার সমস্যাগুলো ডাক্তার জানতে চাচ্ছেন। একটু বলো তো, ওঁকে বলি।’ এক্ষেত্রে আসল সমস্যাটা কিন্তু অন্য, অসুখ নয়। কী, না, তোমার কীসে ভালো হবে তা আমিই ভালো বুঝি, তুমি কিছুই বোঝো না। খেয়াল করে দেখুন, এই একই মনোভাব সমাজের নানান স্তরে—নীচতলা থেকে ওপরতলা, সর্বত্র। রাজনীতিও একই ভাবে আক্রান্ত। পৃথিবীর সর্বত্র, প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ভাবেন জনগণের ভালোটা একমাত্র তিনিই বোঝেন। অদ্ভুত এবং কী প্রচণ্ড হাস্যকর!

এই লেখার প্রসঙ্গেই আসছে, কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র-এ নারী সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখেছেন। সবাই অল্প-বিস্তর জানেন। তবু বলা প্রয়োজন, কারণ, আজও, আড়াই হাজার বছর পরেও তা কত প্রাসঙ্গিক! উনি বলছেন, একজন ১২ বছরের ঋতুমতী মেয়েকে পাত্রস্থ করতেই হবে। হবে মানে হবেই। কারণ, তাকে সন্তান বিশেষ করে পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে হবে। আর যদি সে মেয়ের বিয়ে না দেওয়া হয়, আজও ‘হয়’, কারণ, মেয়েরা তো বিয়ে করে না, তাদের ‘বিয়ে দেওয়া হয়’, ৭-টি ঋতু অবধি যদি সে গর্ভবতী না হয়, তবে মেয়েটির বাবাকে দণ্ড দিতে হবে। এবং মেয়েটি যতদিন ঋতুমতী থাকবে, লাগাতার তাকে সন্তানের জন্ম দিয়ে যেতে হবে। একটা ঋতুও যেন বাদ না যায়। বুঝুন একবার! ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলাম, আরো কত যে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। আজও, সন্তানের জন্ম দেওয়া, স্বামী তথা শ্বশুরবাড়ির সেবা করা ছাড়া একজন নারীর আর কোনো কাজ নেই। এ-প্রসঙ্গে আরো বলি, যে-কোনো শুভ কাজ, যজ্ঞ ইত্যাদিতে নারী, শূদ্র আর কুকুর—এই তিন ধরনের প্রাণীর প্রবেশাধিকার ছিল না। এই নিয়মের তারতম্য খুব কি ঘটেছে? আর কত অবলীলায় সমাজ বলে, ‘নারী নরকের দ্বার!’ আপামর জনসাধারণ (নারী+পুরুষ) কার্য এবং স্বার্থসিদ্ধির সময় অবিশ্যি এই মনোভাব উপেক্ষা করে। তখন বলে—ও কিছু না! আবার প্রয়োজন ফুরোলে, পুনরায় বলতে ছাড়ে না। ওই যে ব্র্যাকেটের মধ্যে ‘নারী’ শব্দটা লিখলাম, লিখতে কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে লিখলাম। কারণ, অধিকাংশ নারী, পুরুষ জাগালে জাগে, ঘুমোতে বললে ঘুমোয়। নইলে অত্যাচার। মানসিক থেকে শুরু করে শারীরিক। নিঃশব্দে বা সোচ্চারে।

কত লিখব বলুন তো?

প্রকৃতির কথাই ধরুন। যা-নয়-তাই করা হয়েছে, হচ্ছে, হবেও। ভাবুন না একবার, প্রকৃতিও নারী! তার কাছে আমরা দিবারাত্র শুধু চাই আর চাই। দাও আর দাও। আমাদের অপরিসীম লোভ। সেই লোভ চরিতার্থ করার জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা। সোজাভাবে না হলে, পেশীশক্তির প্রয়োগ। অর্থাৎ ক্ষমতার আস্ফালন। শুধু ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে কত দূর যাওয়া যায়, তার পরিষ্কার ছবি একটার পর একটা আমাদের নজরে আসছে। প্রকৃতি কিন্তু রক্তমাংসের নারী নয়। তার ক্ষমতা কিন্তু অসীম। তার ওপর যাবতীয় অত্যাচারের প্রতিশোধ সে কিন্তু নিতে শুরু করেছে। আগে আমরা বুঝিনি। এখন কিন্তু সামলাবার আর কোনো উপায় দেখছি না। তাকে ঠেকাবে এমন কোনো বাপের ব্যাটা জন্মায়নি। কিন্তু রক্তমাংসের নারী? তাকে কবজা করতে কোনো অস্ত্র লাগে না। শুধু যৌনতাসংক্রান্ত সামান্য ইঙ্গিত করলেই সে যুদ্ধের নব্বই শতাংশ হেরে বসে থাকে। কারণ, শৈশব থেকেই সে শুনে আসছে, ছিঃ, এটা কোরো না, ওটা বোলো না, সেটা ভেবো না! ঠাকুর পাপ দেবে! দরজার বাইরে পা রাখলে ঠাকুর পাপ দেবে। বেশি খেলে ঠাকুর পাপ দেবে। মেয়েদের অতো খেতে নেই। অল্প খেলেই চলবে। মেয়েদের জান তো কই মাছের মতো। এই মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই। তবে যতটা হওয়া উচিত, ততটা হয়নি। সমাজে যে অসাম্য অতীতে ছিল, বর্তমানেও তা দেখতে পাই যদি একটু কষ্ট করে চেনা গণ্ডীর বাইরে অন্য পরিসরে দৃষ্টি ফেরাই।

শেষে একটা নাম উল্লেখ করি—জর্জ ফ্লয়েড। নতুন করে তাঁকে চেনাতে হবে না। কী বলছিলেন তিনি? আই কান্ট ব্রিদ। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। এ-কথাগুলো মুখ ফুটে হয়তো বলেন না পৃথিবীর অগণিত নারী; মনে মনে কি বলেন না– আমাকে একটু নিঃশ্বাস নিতে দাও?

[লেখক – সাহিত্যিক, প্রকাশক]

Facebook Comments

Leave a Reply