মূল্যবান জীবন অর্থাৎ একটি সাইকেলের ঘূর্ণমান চাকা : সুমিতা বীথি

‘অল লাইভস ম্যাটার’, আলগা অনুবাদে ‘সব জীবনই মূল্যবান’ – এই ঔপনিষদিক উচ্চারণটি এইমুহূর্তে এতো জরুরি হয়ে উঠেছে কেন? আর সত্যিই কি আমরা সবরকম জীবন নিয়ে কথা বলছি? কিছু জীবন যে চিরদিনই মূল্যবান ছিল এবং তাদের মূল্যকে অমূল্য করে তোলার জন্য আরও অনেক জীবনকে মূল্যহীন করে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে, এসব তো জানা কথা। আমরা বোধহয় কথা বলতে বসেছি ‘সব জীবন’ নিয়ে নয়, ‘মূল্যহীন’ জীবনগুলো নিয়ে, কারণ এই জীবনগুলোকেই প্রান্তিক করতে-করতে একটা মোটা-তাজা-রসালো ‘অমূল্য মূল-স্রোত’ তৈরি হয়েছে, যেটা আমরাই নানাভাবে তৈরি করেছি কিম্বা তৈরিতে মদত দিয়েছি। সব সময় এটা যে খুব বুঝেসুঝে করেছি তা নয়, বরং আমার মনে হয় কোনও এক অদৃশ্য মাদারির হাতে বাঁদর নাচই নেচে চলেছি সবাই। এই পর্যন্ত উপলব্ধিটা নতুন কিছু নয়, বিশেষ কিছুও নয়। কিন্তু এরপর যা ভাবছি সেটা একটু ভয়ধরানো বিশেষ, যে কেবল একটা মাদারি নয়, আর তার এক সেট বাঁদরই শুধু নয়, স্তরে স্তরে এই নাচ চলছে। সেলুনের একাধিক আয়নার মধ্যে দিয়ে যেমন মুখের পিছনে মুখ তার পিছনে মুখ, মুখের মিছিল লেগে যায়, তেমনি মাদারির পিছনে মাদারি আর বাঁদরের পিছনে বাঁদর, একাধিক আয়নায় তারা নাচিয়ে ও নেচেই চলেছে বলে মনে হচ্ছে। আর সব মাদারি ও বাঁদরের জুটি জানেও না যে তার পিছনের আয়নায় মাদারিতর/তম ও বাঁদরতর/তম-রা লাইন লাগিয়ে দিয়েছে। ভাবনাটা যখন এখানে পৌঁছায়, ভয় তখন শুরু হয়, মনে হয় একটা আরশি-নগরের মধ্যে আটকে গেছি আমি।
ভাবনাটা আর একটু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি, শুরুতেই যদি ধরে নিই আমি এক বাঁদর, তাহলে আমাকে নাচায় কে? যে আমাকে নাচায় সেও কি নাচে? আমাকে কি একটা মাদারি নাচায়? নাকি নানাবিধ মাদারি যারা আমার ক্ষমতার সীমারেখার বাইরে তারাই নাচায় আর আমার মতো বিভিন্ন স্তরের বাঁদরেরা চুপ করে বসে-বসে সার্কাস দেখে আর কলা খায়? নাকি তারাও পরস্পরকে নাচায় চান্স পেলে? আবার তারা যখন নাচে তখন আমি কলা খাই আর তাদের নাচ দেখি!
আবারও নিজেকে অর্থাৎ বুবাইবোসকে নাচের আসরে নামাচ্ছি, বুবাইবোস কেমন বাঁদর? প্রথমেই জানা যাচ্ছে ইহা বাঁদর+ঈ (স্ত্রিয়াম ঈপ), যেটা নাকি জন্মের সময় শরীরের বাইরের একখানা চিহ্ন দেখেই দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর এল তার নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী যদিও বর্ণ হিন্দু, আবার শহুরে পাড়ায় বসবাসের দরুন একধরণের এক্সপোজারের সুযোগ হল, মিশনারি ইস্কুল আর পরবর্তীতে অতিচর্চিত এক ইউনিভার্সিটিও ঢুকে গেল তার মধ্যে। ওদিকে বাঁদরীটির গাঁয়ের রং (জম)কালো, এবং সে প্রবল পেটুক, পাথরে কোঁদাই স্বাস্থ্য অর্থাৎ মুটকি, নাক থ্যাবড়া, গোটাগুটি অনার্য কাটিং। এরপর যোগ হয়েছে তার মধ্যমেধা, যৌনক্ষুধা, সংসারিক হাঁদা ইত্যাদি। পরতে-পরতে যেমন বাঁদরামি, তেমন প্রতিটি পরতেই মাদারিও প্রস্তুত। যদি বুবাইবোস হয় মেয়েছেলে বাঁদর, তবে মাদারি তাকে নারী বলে নাচায়, সে কতো ভালো বাঁদরী হতে পারল বা পারল না বলে ডুগডুগি বাজায়। আর আমি নাচতে-নাচতে পিছনে তাকিয়ে দেখি অনন্ত আয়নায় ছায়া পড়েছে অনন্ত বাঁদরীর, তাদের মধ্যে কারো স্কুলড্রেস বারবার হাতে কেচে হলদেটে, কার কেডস ফাটা, ব্যাগ ছেঁড়া, তাতে ভরা আগের বছরের দিদিদের থেকে হাফদামে কেনা ব্যবহৃত বই। কোনও এক মাদারি সেইসব বুবাইবোসদের নাচায়, আর নানা ঝকঝকে জামা-জুতো-ব্যাগ-বইওয়ালা বাঁদরকূল সেই নাচ দেখে তালি দেয়।
আয়নারও শেষ নেই, নাচেরও অবধি নেই, এই বুবাইবোসই অন্য কোনও আরশি-টিফিনের অবসরে সুমনা নস্করের সঙ্গে কালু জমাদারের বিয়ে দিয়ে দেয়, এবং এইসব নোংরা ও পাকা কথা বোর্ডে লেখার জন্য যথাবিহিত শাস্তিও পায়! কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞেসই করেনা প্রথমত সুমনা নস্কর কালু জমাদারকেই কেন বিয়ে করবে, বা ভাইসি ভারসা? কোন মাদারি দিয়ে গেল এই পাঠ? কোনও সর্বাধিক বিক্রীত দৈনিক পত্রিকার পাত্র-পাত্রী চাই বিভাগ? কালু জমাদারের জাত-গোত্র জানা নেই বটে, কিন্তু জমাদার যখন, তখন ও-ই হল নস্কর সুমনার সঠিক দাবীদার, বুবাইবোসের জন্য ঘোষ-মিত্র-দত্ত ইত্যাদি অ-জমাদার বর্ণের কেউ আসবে নিশ্চয়। অথচ ফর্সা-ছিপছিপে সুমনা বরাবর রানির পার্ট পেয়ে যায় ইশকুলের আরশি-নাটকে, আর মোটা-কালো বুবাইবোস চাকর সেজে ভাঁড়ামি করে, এমন কি নারী চরিত্রও জোটে না কারণ তার চাল-চলন আরেক মাদারির আয়নায় নেচে-নেচে সঠিক নারীটি হতে ব্যর্থ হয়ে গেছে।
তবে কি বুবাইবোস শুধুই বাঁদরী? মাদারি নয়? চিরদিনই নাচছে, নাচাচ্ছে না? জরা ঠ্যাহরো জানম, পিকচার অবভি বহুত বাকি হ্যাঁয়। এই শহুরে, অল্প ইংরাজি চিবুতে পারা, কিছু রোজগার করা বুবাইবোসও অন্য কোনও আয়নায় ঢুকে প’ড়ে সেখানকার অতল মফস্বলে ডোবা, ঘরের মেয়ে/বউ মার্কা, বাংলা মিডিয়াম ও খাটা-পায়খানার বাসিন্দাদের জন্য নতুন নাচের ক্লাস খোলেনি? নতুন ডুগডুগি কিনে নতুন মাদারি হয়নি? আটার রুটির বদলে পাউরুটি, ইজের ছাড়িয়ে প্যানটি, আর ন্যাকড়ার জায়গায় প্যাড ইত্যাদি নৃত্যপাঠ পড়িয়েছিল তো! মানে প্যাড ও প্যানটি দুই-ই পুষ্টিকর, সেগুলো ব্যবহার করা অন্যায় নয়, যদিও আটার রুটি আবার ফুল-সার্কেল ঘুরে অরগ্যানিক হয়ে ফিরে এসেছে শহুরে কিচেনে, কিন্তু – আমি শিক্ষিত-শহুরে-রোজগেরে হনু অতএব আমি তোমাদের থেকে বেশি জানি – এবম্বিধ মাদারিপনাটা খুব পুষ্টিকর হল কি? অথচ বুবাইবোস যে কারো খারাপ চেয়ে এসব করছিল তা তো নয়, যে ভালোকে সে ভালো বলে জেনেছে সেই নাচটাই আরও পাঁচজনকে দিয়ে তোলাবার চেষ্টা করেছিল। মাদারিরা নিজেরাও তো জানে না তাদের টিকি কোথায় বাঁধা থাকে, কার লিখে দেওয়া কোন স্ক্রিপ্টের দাঁড়ি-কমা মেনে আরশি-নাচের মুদ্রা শেখায় সে!
এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি, বুবাইবোসের ভিতরে পরতে-পরতে ঢুকে থাকা আরও নানা বাঁদর/বাঁদরী ও মাদারিকূলের সহাবস্থান নিয়ে। তারপর জীবনের গলার মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে বালি খুঁড়ে-খুঁড়ে মোটামুটি গোটাবারো মূল অক্ষ বা অ্যাক্সিস খুঁজে এনেছি যা দিয়ে নিজের অবস্থান, যাকে বলে ইন্টারসেকশনাল লোকেশন, তার বর্ণনা দেওয়া যায়। এখানে ‘বর্ণনা’ শব্দটা জরুরি, জীবনকে সংজ্ঞায়িত না করে, কেবল বর্ণনা করার চেষ্টা করছি মাত্র। এই ক’টা তথাকথিত মূলের বাইরে আরও ঢের অ-মূল আছে জানি, ভাবনার সুবিধার জন্য মূলগুলো ধরে এগোচ্ছি।
‘বুবাইবোস’ কে? মানুষ বলে লাভ নেই, বায়োলজি কিছু লক্ষণ দিয়ে মানুষ/না-মানুষ বোঝায় বটে, কিন্তু বায়লজির পরিধির বাইরে চলে গেলে কাকে বলে মানুষ তা নিয়ে বিস্তর দর-কষাকষি হয়, সেসব আমরা জানি। কাজেই ওটার মধ্যে ঢুকছি না। বায়োলজি মতে এই বুবাইবোস এবং আরও কোটি কোটি বুবাইবোসেরা হোমোস্যাপিএন্স, ওটা বলতে গিয়ে আর অক্ষ খরচ করব না। নম্বর দিয়েই গুনতি শুরু করছি যদিও এখানে নম্বর মানে ওজন নয়। এক-এ যে আছে সে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ নাও হতে পারে, অক্ষের গুরুত্বও স্থান-কাল-পাত্রভেদে বদলে যেতে পারে। এই হিসাবে শুরু যদি ধরি সেক্স দিয়ে (বুবাইবোসের পিঠে জন্মসূত্রে ফিমেল সেক্স হিসাবে ছাপ্পা মারা আছে), তাহলে দু’নম্বর হতে পারে জেন্ডার ( বুবাইবোস নারীই, কারণ প্রাথমিক ফিমেল ছাপ্পার বিরুদ্ধে খুব একটা হুঙ্কার তো ছাড়েনি), তারপর তিননম্বর হবে ছিরি/ছব্বা ( সে হুমদো ও কালো), চারে আসতে পারে বাসস্থান ( এক্ষেত্রে শহর, কিন্তু গ্লোবাল সাউথে অবস্থিত পুব দিকের কোনায় পড়ে থাকা শহর, দিল্লি-বোম্বে তো আর নয়)। এরপর পাঁচ হতে পারে লেখাপড়া (এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়েছে বটে), ছয় তবে হোক ভাষা (ইংরাজি/হিন্দি হোঁচট খেয়ে পারে, ঘষামাজা বাংলাটাও জানে), সাতে এসে যেতে পারে ক্লাস (মধ্যবিত্ত?), তারপর আট ধরতে পারি ধর্ম (হিন্দু, সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধর্মাচরণ করুক বা না করুক জন্মসূত্রে পাওয়া)। ধর্মের পর নয়ে এসে যেতে পারে কাস্ট/ বর্ণ (গায়ের রং যাই হোক বুবাইবোস বামুন না হলেও সবর্ণ বটে!), দশ হতে পারে বয়েস (খুন হলে মিডিয়া রিপোর্টে বলবে বৃদ্ধার রক্তাক্ত মৃতদেহ…), এগারোতে আসতে পারে শারীরিক/মানসিক ডিস/এবিলিটি (এইটা ধোঁয়াটে, মাথার রোগ আছে, কোমরও ভাঙা) আর ফাইনালি বারোতে নিয়ে আসতে পারি সেক্সুয়ালিটি (চরম ঘাঁটা, সব নম্বর কাটা)!
এই বারোটা অক্ষ গোল করে সাজালে সাইকেলের চাকার মতো দেখতে হয়, নিচের প্রথম ছবিতে যেমন দেখছি। বুবাইবোসকে মাঝের কালো বিন্দুতে বসানো যেতে পারে, তারপর দেখি তার দৌড় কদ্দুর যায়। দ্বিতীয় ছবিতে দেখছি সে চাকা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে মোটামুটি একটা মাকড়শার জাল টাইপের চেহারা বানিয়েছে, তা জীবন তো বিতত বীতংস বই আর কিছু নয়, আমরা ওই ফাঁদ পেতেই বসে থাকি সেই জালে কে কোথায় ধরা পড়বে এই ভেবে, আবার নিজেরাই অন্যের পাতা জালে ধরা পড়ে যাই সময়ে-সময়ে।

 

এখানে একটা কথা বলে দিতে হবে যে এই সাইকেলের চাকার চক্কর যা জাল দিয়ে বানানো ফাঁদ, একে যাই বলি না কেন, এটা সমাজের পারসেপশনের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে। মানে বুবাইবোস নিজেকে এই গ্রাফের মধ্যে প্লট করছে না, সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মের যে ভয়ানক একটা আঁতাত (আনহোলি ট্রিনিটি) আছে, তারাই আমাকে জায়গা নির্দিষ্ট করে বসিয়ে দিচ্ছে। আবার এর মধ্যে যেহেতু আমি খানিক মোচড়ও মারছি, আপত্তিও করছি, তাই ওদের কথা মানলে আমার যতটুকু ওপরে ওঠার ‘সৌভাগ্য’ হত, সেটুকুও হচ্ছে না। যেমন আমি নারী-তকমা গ্রহণ করেছি, কিন্তু আনহোলি ট্রিনিটির হিসাব অনুযায়ী নারীর কর্তব্য পালন করিনি পুরোপুরি, তাই পুরুষ না হলেও সিস-নারী হিসাবে (আর যাই হোক ট্রান্স তো নয়!) বুবাইবোসের যে অনতিউচ্চস্থান পাওয়া উচিত ছিল সেটাও জোটেনি। যেমন সেক্সুয়ালিটি, যেখানে যে পুরো গোল খেয়ে গেছে সেটার দায় অনেকের। ওই আয়নায় নানা মাদারি নানাভাবে তাকে জব্দ করার চেষ্টা করেছে, শুধু বিষমকামী নেত্তটাই বাধ্যতামূলক বলে নয় – সমকামী হলে সেই নাচটাই ভালো করে নাচো – এই কথা বলার মাদারিও তো কম নেই। এসব নিয়ম না মানলে ঘরে-বাইরে কোথাও আমার অস্তিত্বের কোনও মূল্যই থাকবে না বলে থ্রেট মারে এরা, আর মানলে কী দেয়?
এইটাই মাদারিদের মজা, ওরা ভাবখানা এমন দেখায় যেন ওদের তালে নাচলে অনেক কিছু দেবে, অনেক ভালো-ভালো গাজর-মুলো-ক্ষীর-ননী ঝোলায়, তারপর দেবার বেলায় স্রেফ শুঁটকো ছোলা আর পোকাধরা বেগুন! আবার সেই সুত্রেই মাদারি হিসাবে আমি যখন চাকরি পাই, তখনও এইসব ধোঁকা রপ্ত করেই কাজের জায়গায় আসতে হয়। এটাও মজা যে ধোঁকাগুলো আমিও দিই, বাঁদর আমিও নাচাই, তবু নিজের বেলায় আমিও যে ধোঁকা খাচ্ছি, বাঁদর হয়েই যে নাচছি অন্য কোনও আরশি-নগরে সেইটা আর মনে থাকে না। সেই অন্যজগতের ভিন্ন মাদারি আমাকে যে ধোঁকাই খাওয়াচ্ছে এইটা বুঝেও বুঝি না, গপাগপ খেতে থাকি।
অর্থাৎ আমার মধ্যেই নানা অবস্থান, নানা মূল্যমান রয়েছে, তাহলে কে কোন জীবনের মূল্যধারণের জন্য লড়ব? আমি যদি নানা লোকেশনে ছড়িয়ে থাকি, ‘আমি’ বলে যদি একটা অখণ্ড বস্তুকে না ধরা যায়, তাহলে মূল্যহীন মার্জিনও তো একটা অখণ্ড বস্তু হতে পারে না, আর অমূল্য মূলস্রোতটাও সেই নিরিখে বদলাতে-বদলাতে যায় নিশ্চয়। ভিন্ন-ভিন্ন আরশি তাই নানা অ্যাঙ্গেল থেকে জীবনকে দেখায়, সেখানে ছায়া ফেলে নানা বুবাইবোস। অনেকগুলো জীবন একসাথে বাঁচে সে, যার মধ্যে অমূল্য ও মূল্যহীন দুই-ই ঘাপটি মেরে রয়েছে, তাই এক আরশিনগরে যদি সে বাঁদরী তবে অন্য কোথাও সে-ই মাদারি। তাহলে কার জীবনের, কোন জীবনের, বা কোন-কোন জীবনের মূল্য নিয়ে আন্দোলন হবে? কে করবে? মূল্যহীন বুবাইবোস? অমূল্য বুবাইবোস?
লাইভস ম্যাটার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনও-কোনও বিশেষ মুহূর্তে জীবনকে বিশেষণে ভূষিত করতে হয়, তখন শুধু উপনিষদ পড়ালে হয় না, বুবাইবোসকে তখন মানতে হয় একটা নিদিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে একটা মাদারি আর একসেট বাঁদরের খেলার ওপরেই আলো ফেলতে হবে। যেমন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আলাদা করে বলতে হয়, যখন সাদা পুলিশের হাতে একজন কালো মানুষ শুধু কালো বলেই খুন হয়ে যান, তখন তাঁর বাকি লোকেশনগুলো মাথায় থাকে না, এক্ষেত্রে রেস বা বর্ণটাই সবথেকে বড়ো কথা হয়ে ওঠে, তাই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার।পিরিয়ড। আবার আমাদের দেশে ঘটা ঘটনার দিকে তাকাই যদি, সেই যে রেপিস্ট সন্দেহে কয়েকটি ছেলেকে ধরা হল, তারপর কোনও আইন-আদালত-বিচার ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে এনকাউন্টার করে সাফ করে দেওয়া হল। এই জীবনগুলোর মূল্য যাই হোক, পুলিশ-জীবন আগে থেকেই অমূল্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। আবার হয়ত বিচার হলে দ্যাখা যেত এরা সত্যিই একটি মেয়েকে রেপ করে পুড়িয়ে মেরেছে, সেই মেয়েটির জীবনের মূল্য যাই হোক, পুরুষ-জীবন আগে থেকেই অমূল্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত! অর্থাৎ একটাই জীবন এক-এক অবস্থানে মূল্যমান বদলাতে-বদলাতে যাচ্ছে, পুরুষ হিসাবে নারীর থেকে বেশি, ক্রিমিনাল (?) হিসাবে পুলিশের থেকে কম।
ক্যুইয়ার জীবনের কথাও একটু বলি এখানে। যে ক্যুইয়ার সে তার জেন্ডার-সেক্সুয়াল লোকেশনের কারণে আনহোলি ট্রিনিটির হাতে কম নম্বর পেয়েই যাত্রা শুরু করছে। কিন্তু তার মানে এও নয় যে তার বাদবাকি লোকেশনগুলোতে নম্বর কম আছে। কিন্তু কোনও-কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে, ওই কালো মানুষটির মতোই, একজন লেসবিয়ানকে যখন কারেক্টিভ রেপ বা অনার কিলিঙের মুখে পড়তে হয় তখন তার বাকি সব লোকেশন মুছে যায়, কোনও প্রিভিলেজ আর তাকে রক্ষা করতে পারে না। এখানে আরও একটা কথা বুঝতে হবে যে একজন মানুষের ইন্টারসেকশনাল অবস্থান তার প্রিভিলেজ ও মার্জিনালাইজেশনের সমন্বয়, শুধু যোগফল নয়, মানে অক্ষগুলোকে যোগ করে-করে গোটা মানুষকে পাওয়া যাবে এমনটা নয়। ফিমেল প্লাস নারী প্লাস সমকামী প্লাস মফস্বলবাসী প্লাস মধ্যবিত্ত প্লাস হিন্দু প্লাস এসসি এইভাবে গোটা মানুষটার অবস্থান বোঝা যায় না, কারণ এদের মধ্যে কোনও-কোনও অক্ষ বাকিগুলোকে ইনফ্লুএন্স করে এমনভাবে যে বাকিগুলো সেই নিরিখে নির্বিষ হয়ে পড়ে। অক্ষগুলোর নাচ এতোটাই ডাইনামিক, এতোটাই জটিল ও সূক্ষ্ম, কোনও মাদারির সাধ্য নেই এদের ঝুঁটি ধরে কন্ট্রোল করবে।
আনহোলি ট্রিনিটি তাই অন্য পথ নেয়, এই লোকেশনগুলো যে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত, একটা আরেকটাকে প্রভাবিত করে, এবং একটা মানুষ যে একই সঙ্গে সে অমূল্য ও মূল্যহীন হতে পারে, এই কথাটা আমাদের জানতে দিতে চায় না। আমরা নিজেদের ছোট-ছোট টুকরোয় ভাঙা-ভাঙা জীবনের মধ্যে বেঁধে রাখি, সেই জীবনটাকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করি, সেই নিরিখে ‘আত্ম’ আর ‘অপর’এর অবস্থান নির্ণয় করে অপর বলে চিহ্নিতকে মেরে লোপাট করে দিতে চাই, তার জীবনকে মূল্যহীন করে দিতে চাই। অথচ তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারব সেলুনের আয়নার মধ্যে আমার বহুমাত্রিক লোকেশনের ছায়া পড়ছে, আমার মধ্যে অপর আর অপরের মধ্যে আমি, এইভাবেই আমাদের দ্যাখা যাচ্ছে। সবটাই আমার জীবন, যা আমি দেখেও দেখতে পাই না, কারণ দেখানোর অভ্যেস করানো হয়নি, বরং ঠুলি পরিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে আমার চরে খাবার জায়গাটা অবধি অন্যের কন্ট্রোলে থাকে।
সবরকম প্রান্তিক জীবন মূল্যবান – এই বোধ আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সহজ হবার কথা। কে কার হাতে খুন হল, রেপড হল বা অন্য কোনও ভায়লেন্সের শিকার হল, আর আমরা হটাত ঘুম থেকে জেগে উঠে বলতে শুরু করলাম – না না, এইসব জীবনেরও মূল্য আছে – এমনটা হবার কথা নয়। কারণ কোন সব জীবনের কথা বলছি আমি? যাদের কথা বলছি সেই ‘ওরা’ কি ‘আমরা’ নয়? হয়ত ওই মানুষটির প্রান্তিকতা আমার মতো নয়, হতে পারে আমি সবর্ণ উনি দলিত, উনি গ্রাম্য আমি শহুরে, কিম্বা উনি ট্রান্স আমি সিস, কিন্তু আমার সিস মানে তো নারী, আমার শহর মানে তো আলো-হাওয়াহীন গর্ত, আমার মগজ মানে তো অস্থির ঘুণপোকার বাসা, আমার যৌনতা মানে তো ‘বিকৃত’। প্রতিটি প্রান্তিক জীবন মূল্যবান – এটা বুবাইবোসের কাছে কেবল দার্শনিক তত্ত্ব নয়, এই রাজনৈতিক উচ্চারন তার জীবনের মর্মস্থল থেকে উঠে আসছে, উঠে আসছে নিজস্ব বহুমাত্রিক ইন্টারসেকশনাল লোকেশনের ধারণা থেকে, যেখানে অপর বলে কেউ নেই, সবটাই আত্ম।
মাদারি তার খেলা গুটিয়ে ফেলছে, বাঁদর নিজের পথ চিনে-চিনে সাইকেল চালিয়ে এবার ঠিক চলে যাবে আরশি-নগরের গোলকধাঁধা পিছনে ফেলে রেখে। বাই বাই বুবাইবোস…

[লেখক – সুমিতা বীথি ওরফে কুখ্যাত নৌটঙ্কি বুবাইবোস (ক্যুইয়ার ফেমিনিস্ট যাপনযাত্রী-গল্পকথক-অ্যাক্টিভিস্ট]

Facebook Comments

Leave a Reply