মানসিক স্বাস্থ্য ও ভ্রমণ : সুদীপ বসু
প্রায় সবাই একমত হবেন যে ভ্রমণ বা বেড়ানোর সঙ্গে মানসিক প্রসন্নতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। যে ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ও মানসিক চাপ থেকে নিস্কৃতি পেতে বছরে একবার বেড়াতে যান, তার মানসিক স্বাস্থ্য (অন্য কোন আভ্যন্তরীণ সমস্যা না থাকলে), যিনি বেড়াতে যান না, তার তুলনায় বেশী সতেজ থাকার সম্ভাবনা। এর কারণ অবশ্যই দৈনন্দিন বাতাবরণে স্নায়বিক একঘেয়েমি থেকে মুক্তি, ভিন্ন পরিবেশে মানসিক বিশ্রাম ও প্রসন্নতা। বেড়িয়ে আসার পরে, সেই ব্যক্তি আগের পরিবেশে সতেজ মন নিয়ে ফেরাতে, দৈনন্দিন জীবন যাপন আর ক্লান্তিকর মনে হয় না।
ব্যক্তির আর্থসামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে দু-এক দিন কিংবা আরো বেশি দিনের বেড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন ধরণের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে কাজ করছে। অনেক সময় পাড়ার পুজো কমিটি, ক্লাব অথবা পাড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ঘিরে ছোটখাটো বেড়ানোর প্রবনতা গত কুড়ি বছরে লক্ষনীয় ভাবে বেড়েছে। এই ধরণের উদ্যোগে পরিবহন, যোগাযোগ, পর্যটন উপযোগী বাসস্থান এবং বেড়ানোর জন্য অন্যান্য জরুরী ব্যবস্থাপত্র আরও উন্নত হওয়ায়, বেড়াতে যাবার প্রবনতা সামাজিক জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে।
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভ্রমণ জরুরী। আরো জরুরী ছয় থেকে পনেরো বছরের শিশু-কিশোর/কিশোরীদের জন্য। ভ্রমণ তাদের মানসিক গুন বিকশিত হতে সাহায্য করে (যা সুপ্ত থাকে, বেড়াতে যাবার আগে তাদের বাবা-মায়েদেরও জানা থাকে না)। শিক্ষার (আহরণ ও ধারণ) এক বিশেষ প্রাপ্তি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, পরিবেশে নিজেকে মানানোর অভ্যাস, যা ভ্রমণের মাধ্যমে সহজে ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়।
ভিন্ন পরিস্থিতিতে দৈনন্দিন জীবনের সাময়িক পরিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে আছে বেড়াতের যাবার আকর্ষণ। সাধারণত ব্যক্তি নিজস্ব ছন্দের জীবন বৃত্তে অভ্যস্থ, সেই জীবন বৃত্তের বাইরে গিয়ে অভ্যস্থ জীবনকে দেখা; দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন (অন্য দৃষ্টি-কোন থেকে) দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন আনে। বেড়াতে গিয়ে অন্য জায়গার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনযাত্রা, পরিবেশের প্রতিকুলতা কাটিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা অভ্যস্থ জীবনযাত্রাকে এক অন্য মাত্রা দেয়। বইতে পড়া বা কারুর কাছে শোনা কোন ঘটনা, যখন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তি মানসে উপলব্ধ হয়, তখন সেই অভিজ্ঞতা তার জীবনে কোন না কোন ভাবে দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে ব্যক্তিগত জীবন যাত্রার একঘেয়েমি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। বার বার বেড়াতে যাবার মাধ্যমে ‘জীবন পরিবর্তনশীল’ এই সত্যটি উদ্ঘাটিত হয়। এর জন্য বয়স নির্বিশেষে বেড়ানো জীবনকে প্রভাবিত করার মাধ্যম। এটি শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
মানসিক প্রসন্নতা মানসিক স্বাস্থ্যের পরিপুরক কি ভাবে হয়? উত্তর আছে মানসিক প্রসন্নতার সঙ্গে বেড়ানোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারকারী তথ্যের আলোচনায়।
প্রত্যক্ষভাবে বেড়ানো বা ভ্রমণ আমাদের ভৌগলিক ও স্থানিক পরিবেশ সম্মন্ধে সচেতন করে। স্থান বিশেষে প্রাণ ও পরিবেশ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ব্যক্তিকে সাহায্য করে এটা বুঝতে যে, সেও এই প্রজাতি হিসেবে পৃথিবীতে বাসকারী অনেক প্রাণীর মধ্যে একজন। প্রাণ ধারণ করার বিশেষ গুন, অন্য অর্থে আলোচিত বিশেষ প্রজাতির প্রাণীর সমষ্টিগত ধর্ম হলো পরিবেশের পরিবর্তনীয় নিয়মকে নিজের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার আলোয়, বর্তমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, আরোও একটা পরিমার্জিত ধারণা গঠন করা; যে ধারণা ঐ বিশেষ পরিবেশে বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিয়মে অভ্যস্থ হতে শেখায় এবং একই সঙ্গে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায় (স্বাভাবিক মৃত্যু এখানে আলোচ্য নয়)। জীবনযাত্রার এক প্রজন্মের পরিবেশ সংক্রান্ত ধারণা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়; ঐ বিশেষ পরিবেশের প্রতিকূলতা ও অনুকূলতা অনুযায়ী বর্জন বা ধারণ করতে সাহায্য করে।
বেড়ানোর সময় প্রকৃতির বিশালতা, আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সংবেদন, স্নায়ুতন্ত্রকে আবিষ্ট করে রাখে। পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, নদী, সমুদ্রে যারা ঘুরে বেড়ান, তারা এব্যাপারে একমত। নির্দিষ্ট সীমায়িত জীবন যাপনের ছন্দ, ব্যাক্তি বিশেষের স্নায়ুতন্ত্রকে এক ঘেয়েমির কাঠামোয় বেঁধে ফেলে; দু-চার দিন বা কয়েক সপ্তাহ বেড়ানো এক ঘেয়ে জীবনের ছন্দ থেকে ভিন্ন ছন্দযুক্ত জীবনের স্বাদ নেওয়ার মাধ্যমে, বন্ধন মুক্ত স্নায়বিক প্রসন্নতা আনতে বিশেষ ভাবে কার্যকরী। জীবন যতই সুখের হোক না কেন একই ছন্দযুক্ত জীবন যাপনের অভ্যাসের প্রতি মানুষ সহজে নিঃস্পৃহ হয়ে ওঠে। একমাত্র অতিমাত্রায় বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যাক্তি (বৌদ্ধিক), অথবা সাময়িক ভাবে মানসিক অসুস্থ (ডিপ্রেশন, স্কিজফ্রেনিয়া … বিকারগ্রস্থ জাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন) মানুষের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বক্তব্যটি প্রযোজ্য নয়।
ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ তার পরিবেশ সম্মন্ধে সচেতন হয়। সে তার জীবন যাপনের ধারাকে উপরে আলোচিত ধর্ম ও গুন অনুযায়ী প্রতিস্থাপিত করে বা করার চেষ্টা করে। এই মানসিক প্রক্রিয়া যখন সম্পুর্ণ বা আংশিকভাবে প্রতিস্থাপিত হয় তখন মানুষটি ঐ বিশেষ স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে মানসিক ভাবে স্থিতিশীল হয়। সম্পুর্ণ বা আংশিক ভাবে মানসিক প্রশান্তি লাভের দিকে এগোয়। তার কাছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও জৈবিক জীবনযাত্রা এক বিশেষ জ্ঞান বা কুশলতা হিসেবে প্রকাশ পায়। নিজের এবং তাকে ঘিরে যে সমাজ জীবন ও তার আপাত অবস্থান আরো পরিশীলিত ও পরিপুষ্ট হয়। প্রতিবার নিজেকে প্রকৃতির মাঝে রেখে, আপাত পরিবর্তন যোগ্য মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়াবার সুযোগ পায়। জীবনের ক্ষুদ্রতার থেকে মুক্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অন্য অর্থে, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বিশাল ভুবনের পরিধিতে নিজের অকিঞ্চিৎ অবস্থান অনুভব করে।
প্রকৃতির মাঝে কয়েকবার নিজেকে নিয়ে গেলে, পরোক্ষ ভাবে আরো কিছু মানসিক গুন বিকশিত হবার সম্ভাবনা বাড়ে। দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের ঘেরটোপ থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য আত্মীয়দের সঙ্গে রোজকার স্থান-কাল-পাত্রের চাহিদা ভেদে আদান-প্রদান যুক্ত মানবিক সম্পর্ক সাময়িক ভাবে পরিবর্তিত বা বিচ্ছিন্ন হয়। বেড়ানোর সময় এবং বেড়ানোর জায়গায় অন্যান্য সামাজিক ও মানবিক চাহিদার রকম ফেরে সম্পর্কের রেখাগুলো (কখন নিজের সঙ্গে পরিচিত বা অপরিচিত অন্যের, সে যে জায়গায় বেড়াতে যায় সেখানের মানুষের সঙ্গে কিম্বা ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে যাকে পায় তার সঙ্গে) অন্য ভাবে, অন্য রূপে, খুব কাছ থেকে উপলব্ধ হবার সুযোগ ঘটে। ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হবার সুযোগ প্রতিবার আসে ভ্রমণকালে। এই সময় নিজের সুখ-সুবিধার থেকেও, নতুন সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করার তাগিত অনুভুত হয়। অন্যকে সুখী করার প্রবৃত্তি জন্মায়। বেড়ানোর মাধ্যমে অজান্তে তা অভ্যাস করার সুযোগও ঘটে। এই মানসিক গুণটির উন্মেষ একবার হলে, ঐ ব্যক্তি যখন তার ছোট্টো চৌহদ্দির মধ্যে ফিরে আসে, তখন সে নিজের অজান্তে হয় এক অন্য মানুষ। এই ব্যক্তিকে ঘিরে যে মানুষরা তারাও, তার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা পালটাতে বাধ্য হয়। সাধারণ ভাবে এরা বন্ধুবৎসল, ধৈর্যশীল ও আরো অন্যান্য বিশেষ গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হতে আরম্ভ করে।
বেড়ানোর মাধ্যমে গুনী মানুষ হবার সুযোগ থাকলেও, একথা বলা বাহুল্য হবে না যে কিছু ক্ষেত্রে কিছু মানুষের ব্যক্তিত্বের পুনর্গঠন নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে উপরোক্ত আলোচনায় আরোপিত মানবিক গুণগুলোর বিকাশ না হবার সুযোগ থাকে। অর্থাৎ, মানুষটি বেড়ানোর মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব পুনর্গঠন করবে কি করবে না – তা সেই মানুষটির শৈশব অভিজ্ঞতা, বোধ, বিচার, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। বেড়ানো মানুষকে স্থিতিশীল, প্রসন্ন মানবিক গুনের অধিকারী করার সুযোগ করে দেয় মাত্র, মানুষটি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে কি না, তা সেই ব্যক্তির মনন-নির্ভর।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে বেড়ানোর বিশেষ সম্পর্ক সম্মন্ধে দ্বিমত হবার সম্ভাবনা কম। এই উপলব্ধির প্রাসঙ্গিতা বজায় রেখে, প্রমান সাপেক্ষে, এ কথা আশা করি বলা যায় যে, আজকাল যে সব ব্যক্তি মানসিক উদ্বেগজনিত কারণে অসুস্থ (ভারী মানসিক অসুখ ও শারীরিক অসুখের শুরু এই উদ্বেগ থেকে), তাদের চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে বেড়ানোর প্রস্তাব (নিদান) দেওয়া যাবে কিনা, তা মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ লব্ধ ফলাফল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও পাড়ার পারিবারিক ডাক্তার বাবুরা পরামর্শ দিতেন “হাওয়া পাল্টানোর বা বদলের জন্য পশ্চিমে বেড়াতে যাবার”। ষাট-সত্তর দশকের বাংলা চলচিত্র এবং উপন্যাসে এর আভাস আছে।
বেড়ানোর সঙ্গে মানসিক প্রসন্নতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে, তাকে আলাদা ভাবে না দেখে, সমস্ত জীবনের এক বিশেষ অংশ, এই ভাবে দেখলে ভালো হয়। তা না হলে, বর্তমান সামাজিক মুল্যবোধের অবমূল্যায়ণ ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ, বেড়ানোর মত জৈব-প্রাকৃতিক ঘটনা বিকৃত রুপে আমাদের সামনে আসবে।