পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের ফিরে আসার পর ভবিষ্যত? ভাবি কি আমরা কখনো? – সৌম্যদীপ চ্যাটার্জি
কাটুয়া থেকে কামদুনি কিংবা সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা উন্নাও বা হায়দ্রাবাদ বা ধরুন নির্ভয়া — সাধারণ মানুষ জেনে গেছে নারীদেহের অন্তিম পরিণতি। ছিঁড়ে, খুবলে-পচে-পুড়িয়ে, দেওয়া নারীমাংসের ধর্ষণ এবং তার অবধারিত মৃত্যু! কিন্তু এর বাইরেও প্রতিদিন কত হাজার হাজার কন্যা শিশুর দেহ ‘সাজিয়ে-গুছিয়ে’ তুলে দেওয়া হয় অর্থের বিনিময়ে বৈধ ধর্ষণের জন্য! তার খবর? তার সংখ্যাতত্ত্ব? এন.আর.সি (NRC), পেঁয়াজ-আলুর মূল্যবৃদ্ধি, ‘করোনা’ ভাইরাসের কবলে পড়া মানুষের সংখ্যা এবং তাতে প্রতিদিন কত মানুষের মৃত্যু হল, বা দেশজুড়ে অর্থনীতির বেহাল দশার খবর পড়া শেষ করে কতটুকু আর সময় আছে কন্যা শিশুপাচার নিয়ে আলোচনা করার ?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৯-এ তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে দেশজুড়ে শিশু পাচারের এক বিভীষিকাময় সংখ্যাতত্ত্ব তুলে ধরেছে। ২০১৭ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এন.সি.আর.বি (NCRB) জানাচ্ছে , মোটামুটিভাবে প্রতি বছর ভারতজুড়ে শিশু পাচারের সংখ্যাটা এক লক্ষ কুড়ি হাজারের কাছাকাছি। সারাদেশের নিরিখে প্রতি ছয়জন শিশুর একজন পশ্চিমবঙ্গের। এন.সি.আর.বি-এর খোলা পাতায় শতাংশের হিসাবে এই হার ১৬.৫।
পাড়ায় প্রায় প্রতিদিনই দেখতে পাওয়া মেয়েটি হঠাৎই একদিন উধাও হয়ে যায়, পুলিশের খাতায় ‘মিসিং ডাইরির’ আরও একটি সংখ্যা বাড়ে। মা-বাবা, পরিজনের হা হুতাশ, যন্ত্রণা, দলা পাকানো কান্নাও একদিন থেমে যায় সময়ের পলিস্তরে। আসলে পাড়া বা প্রতিবেশী অথবা নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হয়ত বা লুকিয়ে ছিল ওই কুৎসিত মানসিকতার ‘আড় কাঠি’ — জাস্ট কিছু নগদ টাকার বিনিময়ে পরিচিত শিশুটিকে তিন বা চার হাত ঘুরে ঠাঁই করে দিয়েছে মাংস-পিণ্ডের নরকে। হতে পারে সেটা শহর কলকাতার সোনাগাছি বা দেশের রাজধানীর জি.বি রোড অথবা দেশের ভিতরে বা বাইরের অন্য কোনো যৌনপল্লিতে। কিইবা এসে যায় তাতে! ২০১৭-তে এমন করেই তো প্রায় ২০,০০০ শিশুপাচারের একটি অংশের জায়গা হয়েছে, কলকাতা-হায়দ্রাবাদ-দিল্লি-এর কোনো বেশ্যালয়তে। সমীক্ষা বলছে, গ্রাম বা মফস্বল অঞ্চলের অশিক্ষিত বা কিছুটা অর্ধশিক্ষিত পরিবার, এই ‘আড়-কাঠি’-দের সফট টার্গেট। টোপ হিসাবে দেওয়া হয় কখনও চাকরি, শহরের ঝাঁ চকচকে বিলাশ-বহুল জীবনের হাতছানি আর কিছু না থাকলে নিপাট প্রেমের অভিনয় করে সুখী সংসার পাতানোর চমৎকার স্বপ্ন। সংলাপ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধিকর্তা, পিনাকী রঞ্জন সিনহার কথায়, “অপরিচিত মানুষজনের সংখ্যা এই অপরাধে খুব কম। বেশিরভাগই চেনা-পরিচিত গণ্ডির মধ্যে। কারুর পাড়ার কাকু, কারুর খুড়তুতো দাদা, তো কারুর নিজের বাবা…এমন অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, নিজের বাবাও টাকার জন্য নিজের মেয়েকে বেচে দিয়েছে অন্য কারুর হাতে। কোন-কোন ক্ষেত্রে নিজের মা-ও বেচে দেয় নিজের মেয়েকে…জানেন কেন? মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে।”
তবুও, ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশের মাঝে সূর্যের দেখা পাওয়ার মতই ঘটনা ঘটে যখন আরও একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যায়। এন.সি.আর.বি-এর পরিসংখ্যান বলছে, হারানো শিশু ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সবার প্রথমে। শেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী (২০১৭) ৩,০৫৫টি শিশুকে ফিরিয়ে আনা গেছে যা ১৪.৭ শতাংশ সারা ভারতবর্ষের নিরিখে। যদিও বা এন.সি.আর.বি থেকে প্রাপ্ত তথ্য হিসাবে ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ঠিক ঝাড়খণ্ডের পরেই পাচার হয়ে যাওয়া শিশুর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ( পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ডেড কেসের সংখ্যা ৩৫৭ এবং ঝাড়খণ্ডের ক্ষেত্রে ৩৭৩। সারাদেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ২,৮৫৭)।
তবে পরিসংখ্যানই সব ক্ষেত্রে শেষ কথা নয়। বিশেষ করে, পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের ফিরে আসার পর তাদের জীবন! বইয়ের পাতায় বসে থাকা শব্দগুলি কি কখন বাস্তবে রূপায়িত হয়? একজন শিশু পাচার হয়ে গেলে, তাকে প্রথমে রেসকিউ করা হয়, তারপর হোমে রেখে চলে রিহ্যাবিলিটেশন এর কাজ, মানে, তার ভালোলাগার জিনিসগুলি শেখান হয়, নানান রকম ট্রেনিং এর মাধ্যমে তাকে স্বনির্ভর করার প্রক্রিয়া চলে। যাতে সমাজে ফিরে সে সঠিক ভাবে রোজগার করতে পারে। তারপরের প্রক্রিয়া হল, রিইন্টিগ্রেশন, মানে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া, আর রইল বাকি পড়ে, রিস্টোরেশন, মানে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েটি পাচার হয়ে যাওয়ার আগে সমাজের যেখানে ছিল, সেখানে ফিরে যাওয়া। কিন্তু, শেষের প্রক্রিয়াটি খাতায় কলমে থাকলেও, সত্যিই কি পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে ঘরে ফেরার পরে মেনে নিতে পারছে সমাজ? নাকি আবার হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েগুলি অন্ধ-গলির ছোট্ট কুঠুরিতে? যদিও এই বিষয়ে সেরকম কোনো পরিসংখ্যান নেই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের কোনও তরফ থেকেই। কিছু বছর আগেও ‘মুক্তির-আলো’ নামে একটি প্রকল্পের সূচনা হয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কিন্তু তার মাধ্যমে কতজন যৌন কর্মী মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারছে বা ফিরে এলেও কতজন স্থায়ী ভাবে কাজ করতে পারছে, সেই পরিসংখ্যানও নেই। তারা কি আদৌ ফিরে আসতে পারছে ‘মেইনস্ট্রিম সোসাইটি’ বা বলতে গেলে সমাজের মূলস্রোতে? আমরা যারা তাদেরই কারুর প্রতিবশী, ভাই বা বোন অথবা মা বা বাবা, মেনে নিতে পারছি কি তাদের ফিরে আসার কাহিনী? নাকি তারা হারিয়ে যাচ্ছে আবার অন্ধ গলির কুঠুরিতে, যেখানে ‘দিন’ শুরু হয় সূর্য ডুবে যাওয়ার পর? প্রশ্নগুলো খুব সহজেই করা যায় কিন্তু উত্তরগুলো তো অজানাই থেকে যায়।
‘করোনা’ ভাইরাসের অতিমারি একদিন ঠিক কেটে যাবে, বিজ্ঞানীদের সফল প্রচেষ্টায় হয়ত খুব শীঘ্রই আমরা ভ্যাক্সিন বা এই রোগ থেকে বাঁচবার জন্য সঠিক ওষুধের ব্যবহারও শুরু করতে পারব কিন্তু সমাজের মধ্যে গেঁথে যাওয়া অসুখ, শিশু পাচার যে কবে আমরা নির্মূল করতে পারব, তা কোনো তাবড় বিজ্ঞানীও বলতে পারবেন না, যতদিন না সমাজ সচেতন হচ্ছে, সচেতন হচ্ছে আমাদের চার পাশের মানুষজন।
[লেখক – Development Communication পেশাজীবী। বর্তমানে Childline India Foundation-এ কর্মরত।]