মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
২ আকাশের নীল গাঙে :
জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম আমার জামাইবাবুর কাছে, আমি তখনও হাফ প্যান্ট। জামাইবাবু ঘোর কম্যুনিস্ট, দীর্ঘদেহী, তামাটে রঙ, শ্রমিক আন্দোলনে মিছিলের মুখ। আমাকে বলেছিলেন- মার্ক্স-লেনিন নয়, জীবনানন্দ পড়ো। তখন আমি ক্লাস সেভেন। পড়লাম রূপসী বাংলার কবিতা—‘আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি’। তো, খেলা সাঙ্গ হলে আমিও বসে রইলাম ঘাসের জাজিমে, দেখলাম আকাশ আঁধার হলে কিভাবে ফুটে ওঠে একটা দুটো অনেকগুলো তারা। কিশোর বয়সে সেইদিনই বুঝি কবিতা আর আকাশের তারারা আমাকে একসাথে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আমি যখন সদ্যজাত শিশু, প্রায় তখন থেকেই আমার দৃষ্টি ছিল আকাশে। জামশেদপুরে দাদুর বাড়িতে ধাইমার-হাতে-প্রসূত সেই শিশুকে প্রতিদিন তেল মাখিয়ে, উঠোনে হেমন্তের নরম রোদে একটা পরিত্যক্ত ক্যারম বোর্ডের ওপরে শুইয়ে রেখে সংসার সামলাতো আমার মা ও দিদিমা। আকাশের বিস্তৃত নীলিমায় ভাসমান মেঘের কিউপিড, আর অনেক নীচে সিংভুমের লাল মাটির নিকোনো উঠোনে ক্যারম বোর্ডের ওপর আমি। সেই থেকে নীলাকাশ আমার চোখে লেগে গেল। কত মেঘের শব্দরূপ ও ধাতুরূপ। সেই থেকে আমি– ‘ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ, ঐ ওপরে, ঐ ওপরে’ (র্যাঁবো / অনু : বুদ্ধদেব বসু)।
তারপরে আরও কত ‘কোদালে মেঘের মউজ’ উঠলো, আর আকাশের নীল গাঙে হাবুডুবু খেল কত তারা ! –‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে, আকাশের নীল গাঙে হাবুডুবু খায় তারা বুদ্বুদ’। জীবনে তার পরে কত মেঘের সংসারের ভেতর দিয়ে কত রকম বিমানে উড়ে গিয়েছি আমি। নীচু মেঘের মধ্যে দিয়ে কখনো ফকার, সেসনা, কিং এয়ার, বীচক্র্যাফট্ বোনাঞ্জা। কখনো মেঘের অনেক ওপর দিয়ে বিশালাকায় জেট, এয়ারবাস, বোয়িং। মেঘও কত রকমের ; ল্যামিনেটেড, রেখায়িত, বিচ্ছুরিত আলোর মেঘ। কখনও তারা পেঁজা তুলো, ক্ষীরসমুদ্র, উড়ন্ত সিফন। কালো পাথরের বিশাল চট্টান আর ভারী দূর্গের মতো বজ্রগর্ভ, ঝলকানো মেঘ। যেন তারা রিলকের কবিতায় ডুইনো দুর্গের দেবদূত পর্যায়ের শ্রেণীবদ্ধ শ্রোতারা। -এসব কথা লিখেছি আমার ‘নীলাকাশ ও অলৌকিক ট্রেক’ বইয়েও।
বালক বয়সে উত্তর কোলকাতার দমদমে যে ছোট্ট লাল দোতলা বাড়িটায় আমরা থাকতাম— এক কাঠারও কম, মাত্র চোদ্দছটাক জমির ওপর সেই দোতলা বাড়ি— তার এক চিলতে ছাদ থেকেই আমার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল মহাবিশ্বের সাথে। আমি জানতাম উত্তরপূর্ব দিকে আছে ঈশান কোণ, তারপর অগ্নি, নৈঋত, বায়ু। ওই ঈশান কোন থেকে ঝড় আসতো, বাজ পড়তো নারকেল গাছের মাথায়। আকাশের সেই ঈশান কোণে ঘনিয়ে ওঠা মেঘের মধ্যে একবার খাঁড়া হাতে অবিকল এক কালীমূর্তি, আমাকে পিসি দেখিয়েছিল। একটু পরে, আমার বিস্মিত চোখের সামনেই মিলিয়ে গিয়েছিল সেই মূর্তি। সেই ছোট্ট বয়সে ক্রাউন সাইজের একটা রঙীন ছবির বই আমার খুব প্রিয় ছিল। তার নাম ‘ছবিতে পৃথিবী’। পাতাজোড়া কত রঙের সেইসব ছবি। মহাকাশ, ধুমকেতু, পৃথিবী আর সৌরমন্ডলের জন্মকাহিনী। কিভাবে সৃষ্টি হোল প্রথম প্রাণ, এককোষী জীব, অ্যামিবা, সমুদ্র-প্ল্যাঙ্কটন, উদ্ভিদ, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, পশু। সেসব ছবি আজও চোখে রয়ে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ, নাকি প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, কে এঁকেছিলেন মনে নেই। সেটা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথা। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে নেট-দুনিয়া জুড়ে এত তথ্য, এত হাই রিজোলিউশান ছবি ও ভিডিও, তবু বাল্যে পড়া সেই চিত্রিত বইটার স্মৃতি আজও অম্লান থেকে গেছে।
সেইথেকে কতশত কাজে, কত বৃথা কাজেও, ব্যস্ততায়, জীবনের অনেকটা কেটে গেছে। আজ পৃথিবীজোড়া ভয়ংকর পরিবেশ-বিপদে, অতিমারীতে, ব্যতিব্যস্ত ও বিহ্বল হয়ে মনে হচ্ছে এই বিশ্বপ্রকৃতির কতকিছুই আজও জানা হয়ে ওঠেনি। মনে পড়ছে আন্দ্রেই তারকোভস্কি পরিচালিত ‘নস্টালজিয়া’ (১৯৮৩) ছবিটার কথা, যেখানে বলছে-
“ বরং একবার প্রকৃতির দিকে তাকাও, তাহলেই বুঝবে জীবন কত সহজ হতে পারে।
আমরা ভুল পথে বাঁক নিয়ে ফেলেছি, আবার ফিরে যাওয়া যাক আগে যেখানে ছিলাম।
জীবনের মূল ভিত্তিতেই ফিরে যেতে হবে, স্বচ্ছ জলকে দূষিত না ক’রে।
আজ যদি পথের কোনও পাগল এসে আপনাকে জিগ্যেস করে– ‘যাব্বাবা, এ আবার কেমন পৃথিবী ?’ -নিশ্চয়ই নিজের ওপর লজ্জা হবে আপনার।”
*
সিকিমের পাহাড়ি পথের পাশে পাশে কত এলাচের প্ল্যান্টেশান ; কত লতাপাতা ওষধি, কত অজানা অর্কিডের ফুল। কালো পাথরের সিঁড়ির গায়ে গায়ে সবুজ মস। যে পাখিটা এখনি উড়ে গেল, সেটা নীল ম্যাগপাই। দিনশেষে আঁধার হয়ে আসছে। ক্রমশঃ বাড়ছে হাওয়ার বেগ আর কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে বাড়িঘর, আকাশ, মনাস্টেরি, প্ল্যান্টেশান। আমাদের কাছেই উঠেছে কলকাতা থেকে আসা চারজন ছেলেমেয়ে। ব্যাকপ্যাক, ক্যামেরা, টেলিলেন্স, ফেডেড জিন্স। ব্যাগে হয়তো হুইস্কি, বিয়ার কিংবা রামের বোতল আছে। হয়তো চকোলেটস, বারমুডা, মাউথ অর্গান। হয়তো আছে কবিতার বইও। একজনের গলায় বাইনোকুলার। বার্ড-ওয়াচার বুঝি ? অথবা হয়তো স্কাই-ওয়াচার। রাতের আকাশ পরিস্কার হলে, কুয়াশা সরে গেলে, ওরা ঠিক স্কাইম্যাপ আর কম্পাস দেখে আকাশ খুঁড়ে বের করবে ক্যাসিওপিয়া, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, অরিয়ন নেবুলা, সপ্তর্ষি মন্ডল। ওরা কি কখনও উল্কাবৃষ্টি দেখেছে ? অরিয়নিড, কিংবা লিওনিড মিটিওর শাওয়ার ? কিন্তু এখন তো শুক্লপক্ষ। শুক্লপক্ষে লোকে আসে জ্যোৎস্নায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে, আর গান গাইতে- ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। তারা কেউ নক্ষত্রের খোঁজ করে না। বিশেষতঃ বাঙালি কবিরা। তারা বরং ভালোবাসে পত্রমোচী বন, পলাশ ও মহুল জল, সারান্ডার জঙ্গল, সমুদ্র ফসফরাস, স্নোলাইন। কেউ ভালোবাসে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, পিন্ডারি গ্লেসিয়ার, কুনজুম পাস, অথবা দায়ারা বুগিয়াল ট্রেক। কতশত ট্রাভেল ও ট্যুর অপারেটর্স রয়েছেন, কতভাবে চারধাম যাত্রা। কত প্যাকেজ, গাইড, কোলাহল। পয়সা ফেললে কাঁধে করে সামিট করিয়ে দেওয়ার শেরপাও পাওয়া যাবে। কিন্তু আজও ঊর্ধাকাশে চোখ তুলে চেয়ে দেখে না কেউ, মহাকাশ নিয়ে আমজনতা এখনও এমনই পক্ষপাতহীন, চৈতন্যহীন। বাঙালি কবি, নর্তকী, জাদুকর, বিধায়ক, ক্রিকেটার, সাংবাদিক, কেরানি— হয়তো সকলেই প্রিয়জন বিয়োগের পরে, অথবা কখনো একা নিরালায়, রাতের আকাশে নক্ষত্রলোকে খুঁজে দেখেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনও পরমাত্মীয় বিদেহীকে। কত নির্জন মুহূর্তে, কতবার। ‘সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও’— আশৈশব এই গানই তো আমরা শুনে এসেছি। তবে এবার আস্তে আস্তে দিন পাল্টাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের নক্ষত্র-চেতনা নিয়ে পিএইচডি হয়ে গেছে অনেক। প্রফেসর নোট দিয়েছেন, সাজিয়েগুজিয়ে। আমরা বাঙালী কবিরা আকাশে চোখ না রাখলেও, এমনকি কালপুরুষ বা সপ্তর্ষীমন্ডলকে না চিনলেও, কবিতায় কার্পণ্য রাখিনি। সেখানে ইতস্ততঃ ঢুকে পড়েছে সুপারনোভা, ব্ল্যাকহোল, অ্যান্ড্রোমিডা, অতি বেগুনি।
পাঠক প্রণম্য, আমাদের দোষ নেবেন না। আমরা কবিরা প্রতিদিনের জাঁতাকলে পড়ে গিয়ে কতকিছুই জেনে উঠতে পারিনি। বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের পড়াশোনা ছিল নিতান্তই পেশাভিত্তিক। অথবা নগণ্য, কান্ডজ্ঞানহীন। আমরা অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করেছি কফিহাউসে, বামপন্থায়, মিছিলে, বাউলগানে, মঙ্গলকাব্যে, পুরাণকথায়, কবিসভায়। প্রাত্যহিকতার ক্লেশে, যৌনতায়, অপ্রেমে। আমরা মূলতঃ বেদনার সন্তান। শ্রমজীবী, ক্ষুধার্ত, কিংবা অন্তরে অ্যানার্কিস্ট। আমরা কে কিভাবে বেঁচে আছি, শুধু সেকথাই জানাতে চেয়েছি কবিতায়– আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। ভেবেছিলাম, এই গোটা একটা পৃথিবীই আমাদের জানার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের ভুল হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম- কবিতা যুদ্ধজয় করতে পারে, নিয়ে আসতে পারে বিপ্লব। আমরা ভুল ভেবেছিলাম। সুদূর নক্ষত্রলোকের কোথায় কি হচ্ছে, তা নিয়ে মর্ত্যবাসী আমাদের মাথাব্যাথার কোনও কারণ নেই, ভেবেছিলাম। আমাদের ভুল হয়েছিল। ভেবেছিলাম, আমরাই শহর শাসন করি মধ্যরাতে। ভেবেছিলাম, আমাদের হাতেই আছে ভুবনের ভার। ভুল হয়েছিল। আমরা ক্রমশঃ বুঝতে পারছি যে, কিছুই আমাদের হাতে নেই। সবকিছুই আবার নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমরা কারা, কেন, কোথায়, কিভাবে, কোন উদ্দেশ্যে, কতদিন—এসবই এবার গোড়া থেকে ভেবে বুঝে দেখার সময়ে হয়েছে। পৃথিবীর আজ সমূহ বিপদ। এবং আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু পৃথিবী নিজেই কি সামগ্রিকভাবে একটা জীবন্ত অস্তিত্ব নয়? সে কি পারবে না নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে ? আমাদের বুঝতে হবে এইসবই। আমরা কি সত্যিই একা, নাকি এক অজানা সম্পর্কজালে সকলেই জড়িয়ে আছি সমগ্র ব্রহ্মান্ড ও বিশ্বপ্রকৃতির সাথে।
সবাই বলবে- ‘ওদের বোঝাতে হবে। ওদের বলতে হবে ভেবে দেখুন’। আসলে ভাবতে হবে নিজেকে। সবচেয়ে আগে, নি:শব্দে। হতে পারে অনন্ত কাল। সমস্ত অর্জিত জ্ঞান তামাদি হয়ে গেছে, তা দিয়ে আর কিছুই আয়ত্তে আসবে না। প্যারাডাইম বদলে গেছে। বিপ্লব ঠোঙায় ভরা বাদামভাজা নয়। যেখানে সেখানে খেয়ে ছড়িয়ে কুড়িয়ে পাওয়া যায় না। বিপ্লবের কোনও নির্দিষ্ট রঙ নেই। আগামী পৃথিবীতে সশস্ত্র বিপ্লব কোথাও কখনও জয়ী হবে না। এবং কথাটা আর revolution নয়, কথাটা এখন provolution, যেমন বলেছিলেন ডঃ ডি-বোনো। এবার নিজের চিন্তাধারাকেই provoke করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে নিজের গন্ডির বাইরে, সঙ্ঘারামের বাইরে, আর যা যা কিছুর বাইরে যাওয়া যায়। এমনকি এই বিশ্বেরও বাইরে। কীভাবে চলছে এই বিশ্বপ্রকৃতির কিমাকার ডায়নামো। কী তাকে চালায়, চালাচ্ছে, এত দূর্বোধ্য ভাবে। সেই বিজ্ঞানকে জানতে হবে, যা কিছু systems dynamics সম্পর্কিত। কবি মানেই সত্যদ্রষ্টা নয়। সবাই কবি নয়। কবিতা যদি অস্ত্র হয়, তবে কবিতা দিয়ে আর বড় কিছুই করা যাবে না। কারণ এটা রণাঙ্গন নয়। ওগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গী, যা দিয়ে শুধু সময় ও শক্তির অপচয় হয়। এখন প্রয়োজন নতুন ভাবনা, নতুন ভাবে বুঝতে চাওয়া– কীভাবে চলছে এই পৃথিবী, কে তাকে এমন করে, এমন বিড়ম্বিত করে চালায়। ব্রহ্মজ্ঞান নয়, আমাদের চাই বিশ্বজ্ঞান। মহাবিশ্ব।
*
আমি যখন বড়ো হয়ে উঠছি, স্কুল ছেড়ে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে, তখন আমি প্রথম চমকে উঠেছিলাম আলভিন টফ্লারের লেখা ‘ফিউচার শক্স’ বইটা পড়ে। ক্রমে কর্মজীবনে টাটাস্টীলে যোগ দিলে কম্পিউটার আর জ্যোতির্বিজ্ঞান আমায় আকৃষ্ট করে। আমার বুকর্যাকে একে একে আসেন ফ্রিৎজফ কাপরা, রজার পেনরোজ, কার্ল সাগান, স্টিফেন হকিং। আসেন ইউরোপীয় চিত্রকর ও ফরাসি কবিরা। আসে পিগমি, বান্টু, মাসাই, মাওরি আর ইঙ্কাদের জীবনকাহিনী। আসে বর্ষাবন, প্রেইরী, তুন্দ্রা আর মেরুপ্রদেশের ভূগোলের কথা। ঘুরে বেড়াই কবিতার ক্যাম্পে ক্যাম্পে, পাহাড়ে জঙ্গলে হাইওয়ে-ধাবায়। আমি টেলিস্কোপে চোখ রাখি রাতের আকাশে। ক্যাসিওপিয়া, অ্যান্ড্রোমিডা, অরিয়ন নেবুলা, আর মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। কেনা হয় নিজের জন্য টেলিস্কোপ। ট্রাইপডের ওপরে ৭০ মিমি ব্যাসের নিউটনিয়ান রিফ্লেকটর। সঙ্গে কয়েকটা বার্লো লেন্স, স্কাইম্যাপ আর একটা বই, দিল্লী থেকে ডাকযোগে। প্যাকেট খুলে আমি নিজেই তাকে অ্যাসেম্বল করেছিলাম [নীচে ছবি]।
দেখলাম, টেলিস্কোপের বাইরের গায়ে সমান্তরালভাবে একটা আলাদা ‘ভিউ ফাইন্ডার’ বা ‘ফাইন্ডারস্কোপ’ টিউব লাগানো থাকে, যেটাতে চোখ রেখে আকাশের যে তারাটিকে টেলিস্কোপে খুঁটিয়ে দেখতে চাই তাকে আগে মোটামুটিভাবে দৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসতে হয়, টেলিস্কোপকে প্রয়োজনমত হাত দিয়ে ঘুরিয়ে। এবার মূল টেলিস্কোপের ‘আই পিস’-এ চোখ রাখলে তাকে ফোকাসে এনে অনেক বিবর্ধিত করে দেখা যায়। এর জন্যে ব্যবহার করা যায় বিভিন্ন বিবর্ধনশক্তির বার্লো লেন্সগুলো। কিন্তু খুব সন্তর্পণে স্পর্শ করতে হয় তাকে। একচুল নাড়া লাগলে মহাকাশে তার দৃষ্টি সরে যেতে পারে কয়েক লক্ষ মাইল।
এই রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপে মিরর বা আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হয় বলে, খুব স্পষ্ট ও উজ্জ্বল ছবি দেখা যায়, কিন্তু রিফ্র্যাক্টর টেলিস্কোপে লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখা ছবি কিছুটা অস্পষ্ট, খুব শার্প নয়। রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপের আরও সুবিধে হোল যে এর দৈর্ঘ্য কম, এবং একে ট্রাইপডের ওপরে নিজের উচ্চতার সুবিধেমত বসানো যায়। তবে এটাই ‘ডবসোনিয়ান-মাউন্ট’ রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপ হলে ট্রাইপডে বসানো সম্ভব হত না, খুব নীচু বলে তাকে বসাতে হোত চোখের উচ্চতায়– কোনও উঁচু জায়গায় বা একটা টেবিলের ওপরে। [নীচে ছবি]
নিজের রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপে প্রথম রাতে যেদিন স্যাটার্নের রিংগুলো দেখি, বিহ্বল হয়ে গেছিলাম– অমন একটা জিনিষ আকাশে !? সেটা বোধ হয় ১৯৯৬-৯৭ সাল, আমি তখন জামশেদপুরে সুবর্ণরেখা ফ্ল্যাটে থাকি। মনে পড়ছে, ঐ সময় ‘হেল বপ’ নামের ধূমকেতুটাও সৌর মন্ডলের কাছে এসে পড়েছিল। আমি সবে তার গতিবিধির খবর পেতে শুরু করেছি। সে সময় তো এত ইন্টারনেট ছিলো না। মনে আছে, দিল্লীতে গিয়ে সেবার ‘তাজ প্যালেস’ হোটেলে উঠেছি। সেখানে সন্ধ্যেবেলা ছোট লাউঞ্জ বার-এ আমাদের জন্যে রোজ একটা করে কমপ্লিমেন্টারি ড্রিঙ্ক বরাদ্দ থাকতো। যেকোনও ককটেল, জাস্ট একটা, তাই নিয়েই অনেকটা সময় কাটাতাম। পাঁচতারা হোটেলে পয়সা দিয়ে মদ কেনার ক্ষমতা ছিলো না। তো, সেখানে টাইম ম্যাগাজিনের একটা কপি পড়ে ছিলো। বসে বসে পাতা উল্টে হঠাৎ সেই ধূমকেতুর ফ্লাইট-পাথের পুরো ডিটেল্স পেয়ে সে কি উত্তেজনা ! এসব কথা আমি সম্প্রতি লিখেছি আমার ‘নীলাকাশ ও অলৌকিক ট্রেক’ বইতেও। জামশেদপুরে ফিরে কয়েক মাস পরে, সেই মতো একদিন সন্ধেবেলা পশ্চিম আকাশে চোখ পড়তেই দেখি তাকে– সেই দীর্ঘ উজ্জ্বল লেজওয়ালা ‘হেল বপ’! আমি তখন নির্বাক। অনেককে ডেকে চিনিয়েছি। এখন তো আমার ল্যাপটপেই পুরো একটা প্ল্যানেটোরিয়াম রয়েছে। [ নীচে ছবিতে শনির বলয়, এবং ‘হেল-বপ’ ধুমকেতু ]
সেরকমই মনে আছে, ২০০৩ সালে যখন কল্পনা চাওলা গিয়েছেন ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশানে (ISS), তখন আমি তার ফ্লাইট পাথের ডাটা যোগাড় করেছি। এবং খুব ভোরে উঠে আমার বাড়ির পাশেই জুবিলী পার্কের মাথার ওপর দিয়ে সেই স্পেস স্টেশনের চলে যাওয়াও দেখে ফেলেছি একদিন। [ নীচে ছবিতে : পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র ]
তারপর মিশন শেষ করে ওদের সাতজনকে নিয়ে স্পেস শাট্ল্ ‘কলম্বিয়া’ যেদিন ফিরে আসছে পৃথিবীতে, ওদের মহাকাশযান বায়ুমন্ডলে ঢোকার পরেই প্রবল উত্তাপে বিস্ফোরণে টুকরো হয়ে মাঝআকাশে জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল। জামশেদপুরে তখন অনেক রাত। আমার বিহ্বল চোখের সামনেই ঘটে গিয়েছে সেই দুর্ঘটনা, টিভিতে লাইভ দেখেছিলাম সেই দৃশ্য। আজও ভুলিনি।
…আমার প্রিয় নীহারিকার নাম ’অ্যান্ড্রোমিডা’। গ্রীক পুরাণে সিফিয়াস আর ক্যাসিওপিয়ার কন্যা সে। তাকে মান্য করে চলে সকল পুরুষ। তিনি ইথিওপিয়ার রাজকুমারি, এবং পার্সিয়াসের স্ত্রীও। এঁরা সবাই এখন নক্ষত্রলোকে। রাতের আকাশে আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথও আমার খুব প্রিয়। -দা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, কিন্তু তাদের কোলকাতার আকাশে দেখা যায়না। প্রথম দেখেছিলাম, অন্ধকার রাতে জাজপুর-রোড স্টেশানে, ট্রেন থেকে নেমে। তার পরে আরও কয়েকবার। একবার কুমাউন-হিমালয়ের বিনসর থেকে। তবে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের আকাশে আমরা ছায়াপথকে যেমনটা দেখি, তার চেয়েও অনেক সুন্দরভাবে, কেন্দ্রিয় অংশের পুরোটা নিয়ে, দেখা যায় দক্ষিণ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দক্ষিণ গোলার্ধের দেশের আকাশে [নীচের ছবিতে]। কেন উত্তর গোলার্ধের আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাই না, তার কারণ পরে কখনও আলোচনা করবো।
*
ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির তরুণ মেম্বারদের আমার ভালো লেগেছিল। একদল মেধাবী বিজ্ঞানী। সেই ক্লাবের বন্ধুদের দেখেছি, একে অন্যকে চিঠির শেষলাইনে লিখেছে– ‘আরও আঁধার নেমে আসুক পৃথিবীতে’। সেভাবেই তাদের উচ্ছ্বাস। অর্থাৎ, সেলিব্রেশান অফ ডার্কনেস। সেই ক্লাবে ওরা সবাই চায় রাতের আকাশ আরও নির্মেঘ, দূষণহীন, স্বচ্ছ, কৃষ্ণকায় হোক। কবিদের প্রিয় চাঁদ ও জ্যোৎস্না, উভয়েই সেখানে একদম ভিলেন। তাই ভিলেন চাঁদ অস্ত যাক, নগর ভরে থাক মিশমিশে কালচে নীল অন্ধকারে। রাত্রি জুড়ে প্রকৃত আঁধার নামুক, হে ইশ্বর !
কখনও তাদের ম্যারেজ পার্টি, বার্থডে পার্টি বা, ফেয়ারওয়েল পার্টি নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। তাদের কাছেই আমি প্রথম শুনেছিলাম ‘স্টার পার্টি’-র কথা। নির্মেঘ আকাশ ও কৃষ্ণপক্ষ হচ্ছে আদর্শ। বেঙ্গালুরু শহর থেকে একটা এস’ইউ’ভি গাড়িতে করে টেলিস্কোপ, যন্ত্রপাতি, স্লিপিং ব্যাগ ও খাবারদাবার নিয়ে তারা একদল বন্ধু পাড়ি দিত শনিবার বিকেলে, একশো মাইল দূরের কোনও গ্রামীণ স্কুলবাড়ির উদ্দেশে। সারারাত ছবি তোলা, নোটস নেওয়া, দারুণ উত্তেজনা। কত নক্ষত্রমন্ডলী, নিহারিকা, ডাবল স্টার, নেবুলা, পালসার। আগে থেকে তৈরী করা থাকতো দ্রষ্টব্যর লিস্ট। হেমন্তরাতে স্কুলের মাঠের গভীর অন্ধকারে তাদের টর্চ, ট্রাইপড, এস’ইউ’ভি। কখনও মাঝরাতে আকাশ থেকে ইতস্ততঃ তারা খসে পড়তো। আকাশে তখন পরবর্তী লক্ষ্য হয়তো NGC 1952 বা, ‘ক্র্যাব নেবুলা’ ; ফ্লাস্কে গরম কফি, ফয়েলে মোড়া স্যান্ডুইচ, অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি, স্টার পার্টি। -আমার কখনও সৌভাগ্য হয়নি সেইরকম পার্টিতে যাওয়ার।
কলকাতা থেকে রাতের আকাশে প্রায় কিছুই দেখা যায়না। শহরের ধুলোবালি, জলীয় বাস্প আর আলোকদূষণে নষ্ট হয়ে গেছে তার স্বচ্ছতা। আকাশ যত বেশি স্বচ্ছ হবে, তত বেশি দৃষ্টিগোচর হতে পারে গভীর মহাকাশের নক্ষত্র ও নীহারিকারা, যাদের বলা হয় DSO, অর্থাৎ Deep Sky Objects.
ধুমকেতু-বিশারদ ফরাসি মহাকাশ-বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার এই রকম ১১০-টা DSO-র লিস্ট বানিয়েছিলেন, যাদের তাঁর নামেই পরিচয় দেওয়া হয়। যেমন অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা-কে বলা হয় Messier-31 অথবা, M 31.
আমার সমুদ্রপৃষ্ঠাগুলো-বইয়ের একটি কবিতায় আছে :
“রাতের বাস্পজল আলোড়ন
ওইসব ছাইচাপা মেসিয়ার নক্ষত্র আকাশের।”
মেসিয়ার যখন টেলিস্কোপ নিয়ে সারা আকাশে ধুমকেতু খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সে সময়ে ধ্যাবড়া, ঘোলাটে, অস্পষ্ট ১১০-টা জিনিস তিনি দেখতে পান, যা ধুমকেতু নয়। এগুলোকে তাই ফালতু মনে করে তাদের একটা তালিকা তৈরী করে রেখেছিলেন, যাকে পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং বলে সনাক্ত করেন। কারণ, মেসিয়ারের তালিকার এরা অনেকেই নক্ষত্র, নীহারিকা, নেবুলা, আর নানা রকমের গ্যালাক্সি, যাদের পরবর্তীকালে আরও বড় তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার নাম NGC (New General Catalogue), যাতে আছে কয়েক লক্ষ নক্ষত্র আর নীহারিকার তালিকা। যেমন, M-1 হচ্ছে বৃষরাশিতে অবস্থিত ক্র্যাব নেবুলা বা, NGC 1952, যা আসলে একটা সুপারনোভার বিপুল বিস্ফোরণের পরে ধ্বংসাবশেষ, খুবই পপুলার তার ছবি।
নক্ষত্রপুঞ্জ বা স্টার ক্লাস্টার আছে দুরকমের। ছড়ানো বা, ওপেন ক্লাস্টার (যেমন ধনুরাশিতে আছে, প্রায় ১২০ টা তারা নিয়ে গঠিত M23/NGC 6494)। আর আছে গোলাকার এক দলা, বা গ্লোবিউলার ক্লাস্টার (যেমন হারকিউলিস মন্ডলিতে আছে M13/NGC 6205)।
আছে ডাবল স্টারও, যাদের দেখে একটাই তারা মনে হয়, কিন্তু খুব বিবর্ধিত করে দেখলে বোঝা যায় যে, আসলে দুটো। আর আছে নানা আকারের নীহারিকা বা, গ্যালাক্সি। যেমন আমাদের ছায়াপথ বা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এছাড়াও আছে অনেক নেবুলা, যাদের মধ্যে থাকে কয়েক কোটি নক্ষত্র ছাড়াও গ্যাস ও মহাজাগতিক কণার বিশাল ভান্ডার, যে কারণে টেলিস্কোপে এদের কিছুটা ঝাপসা বা কুয়াশাচ্ছন্ন অঞ্চল মনে হয়। যেমন অ্যান্ড্রোমিডা নেবুলা (M31 / NGC 224), অরিয়ন নেবুলা (M42 / NGC 1976) ইত্যাদি, যেখানে জন্ম হচ্ছে শিশু তারাদের। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির (M24 star cloud) প্রান্তিক অঞ্চলেও জন্ম নিচ্ছে নতুন নক্ষত্ররা।
নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যকে মাপা হয় তার ম্যাগ্নিচিউড (Mag) দিয়ে। যে নক্ষত্র যত উজ্জ্বল, তার ম্যাগ-নম্বর তত কম। সূর্যের উজ্জ্বলতা -26.7, পূর্ণিমা চাঁদের -12 এবং তার চেয়ে অনেক কম উজ্জ্বল (+4) হোল অরিওন নীহারিকা। অর্থাৎ, কোনও গ্রহ, উপগ্রহ, বা নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার মান শূন্যেরও নীচে যত কম (নেগেটিভ) হবে, রাত্রিবেলা তত তাকে সহজেই দেখা যাবে খালি চোখে।
রাতের আকাশের স্বচ্ছতাকে মাপা হয় তার বর্টল নম্বর (Bortle no. 1 to 9) দিয়ে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে কলকাতা শহরতলির মাঘমাসের মেঘমুক্ত আকাশকে বর্টল-৮, প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে বর্টল-৫, আর হিমালয়ান ফুটহিলের রাতে বর্টল-১ বলা যায়। আকাশ খুব স্বচ্ছ (১-২) হলে, আমরা খালি চোখে ম্যাগ ৬ অব্দি তারাদের দেখতে পাই। তবে টেলিস্কোপ দিয়ে তো দেখা যেতে পারে প্রায় সবাইকেই।
নীচের ছবিটা তুলেছেন Jeremy Stanley ; পেয়েছি Bangalore Astronomical Societyর সৌজন্যে। ছবিতে দু’রকমের আকাশ (স্বচ্ছ আর অস্বচ্ছ) দেখান হয়েছে।
*
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় গানে লিখেছিলেন গ্রহ তারা রবি আর সুদূর নীহারিকার কথা। ভ্যান গখ এঁকেছেন স্টারি নাইটস-এর ছবি। এডভেঞ্চার-প্রিয় বাঙালী আজও শুধু শালজঙ্গলে আর ঝাউবনে। মহাকাশে তার আজও কোনও উৎসাহ নেই।
মহাকাশে আগ্রহ না থাকলে আমার লেখা হোত না ‘দা অরিজিন অফ দা মিল্কি ওয়ে’ গদ্যটা। ইটালিয়ান চিত্রকর ‘টিন্টোরেট্টো’-র আঁকা সেই বিখ্যাত পৌরাণিক ছবিটার কথা আছে যেখানে। মহাকাশের দিকে তাকিয়েছেন অনেক কবি, রবীন্দ্রনাথ তো বটেই। পরবর্তীকালেও অনেকের কবিতায় মহাকাশ-সূর্য-গ্রহ-চাঁদ এসবের উল্লেখ আছে, তবে সেটা প্রধানতঃ দৃশ্যজগতের মধ্যেই সীমিত থেকেছে, কবিতায় কোনও নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান তৈরী হয়নি। জীবনানন্দে এসে মহাকাশের কিছুটা অন্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিকে ওঁর ধুসর পান্ডুলিপির বোধ- কবিতায় যেখানে ‘নক্ষত্রের দোষ’ লেখেন, সেখানে ওটা জ্যোতিষশাস্ত্র বা ‘অ্যাস্ট্রোলজি’ বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু পরে মহাপৃথিবী বইয়ের কবিতায় এসে জীবনের নীল মত্ততাকে উপলব্ধি ক’রে এক অদ্ভুত আনন্দে বিষাদে তিনি আড়ষ্ট ও অভিভূত। আকাশের বিরামহীন ডানার বিশালতার সম্মুখীন তিনি। কবিতার নাম- ‘হাওয়ার রাত’।
‘যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে
কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে যেন—
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য ?
জীবনে গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য ?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য ?
আড়ষ্ট—অভিভূত হয়ে গেছি আমি,
কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন ;
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল”।
ওপরের এই বিশ্বখ্যাত ছবিটার নাম ‘Earthrise’ ! চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে যেমন পৃথিবীকে উদিত হতে দেখা যায়– বিরাট মাপের এক উজ্জ্বল নীলাভ গোলক। সেই জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে চাঁদের মাটি। হাওয়া বয় না, গাছের পাতা নড়ে না, জলে তরঙ্গ ওঠে না, কোকিল ডাকে না ; শুধুই গা-ছমছমে জ্যোছনা। ছবিটা প্রথম তোলা হয়েছিল চাঁদকে প্রদক্ষিণরত Apollo-8 মহাকাশযান থেকে, ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে। মানুষকে অনেক কিছু ভাবাতে– রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য। মানুষের হিংসা, লোভ, ঘৃণা, প্রেম। যে চাঁদকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষের এত গান, কবিদের এত রোম্যান্টিকতা। একদিকে সেই শুকনো, পাথুরে, ঝলসানো খাঁখাঁ নৈঃশব্দ্য, আর অন্যদিকে মহাকাশের ঘোর অন্ধকারে ভাসমান এক নীল উজ্জ্বল অপূর্ব গোলক, যার নাম পৃথিবী, যেখানে আমরা বাস করি, যার সম্পদের অধিকার নিয়ে আমাদের এত যুদ্ধ, যাকে আমরা বেহুঁশের মতো ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছি। বিশ্ব মাতৃদিবসে NASA এই ছবি পোস্ট করে লিখেছে- এই পৃথিবী আমাদের মা। যথার্থই লিখেছে। এই বিশ্বপ্রকৃতিই আমাদের সকল রূপ ও চেতনার জন্ম দিয়েছে, লালন পালন করেছে। আমরা যা কিছু পেয়েছি, সবই নি:শর্তে পেয়েছি। যা প্রাপ্য নয়, তাকেও বলপূর্বক অধিকার করেছি। একদিন মৃত্যুর পরে তারই মধ্যে আমরা রূপান্তরিত হয়ে মিশে যাবো ; আমরা যারা শংখচিল, মেরু ভালুক, ইলিশের ঝাঁক, জেলিফিশ, ছত্রাক, প্রজাপতি, মাছরাঙা, ফ্লেমিংগো, পাহাড়ি অর্কিড, বাওবাব, বটবৃক্ষ, শিল্পী, প্রতিবন্ধী, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজন।
*
একটা বড় শহরকে জানতে হলে আগে জেনে নিতে হয় তার অবস্থান ও আয়তন, কিভাবে তার গোড়াপত্তন হয়েছিল, কোথায় তার প্রাণকেন্দ্র, কোন অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোথায় কীভাবে থাকেন নাগরিকেরা, কোন অঞ্চল আছে কত দূরত্বে, কীভাবে হয় যোগাযোগ, কোথায় যায় তার বর্জ্য পদার্থ, কীভাবে চলে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা। –অনেকটা সেভাবেই, মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও জানতে হয় তার সৃষ্টিরহস্যের কথা, তার আকার ও আয়তন। তার নিকট, দূর ও বহুদূরের অঞ্চলগুলোর বৈশিষ্ট্য। এবং তার অজানা অচেনা রহস্যময় বিষয়গুলো। কোথায় থাকতে পারে মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশ, কতদূর সেসব অঞ্চল, আছে কি আর কোনও উন্নততর সভ্যতা, প্রাণজীবন ? কীভাবে যোগাযোগ করা যেতে পারে, কীভাবে অতিক্রম করা যেতে পারে বিপুল দূরত্ব, যা আমাদের একজীবনে কখনও সম্ভবই নয় ?
দেখা যাক, মাত্র দশটা বাক্যে ব্রহ্মান্ডের একটা আন্দাজ দেওয়া যায় কিনা। তারপরে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের ভাষায় নয়, সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ ভাষায়। তবে ছবির সাহায্য নিয়ে, এবং যতটা সম্ভব প্রাঞ্জল করে বলা হবে সেইসব কথা, যা সাধারণ মানুষকে জানানো হয়নি আগে।
দশটা বাক্যে ব্রহ্মান্ডের স্বরূপ :
১। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড কি একই রকম আয়তনে স্থির হয়ে আছে, যার কোনও বিনাশ নেই ?—এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা আজ নির্ণয় করেছেন যে, ব্রহ্মান্ড ক্রমশঃ স্ফীত হতে হতে একসময় হয়তো আবার দ্রুত সংকুচিত হতে থাকবে, এবং একটি অদৃশ্যপ্রায় বিন্দুতে পরিণত হয়ে, বিপুল বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে, পুনরায় সৃষ্টি করবে এক নতুন ব্রহ্মান্ড। –ফ্রম ‘বিগ ব্যাং’ টু ‘বিগ ক্রাঞ্চ’। অবিরাম সেই ভাঙাগড়া, কয়েক হাজার কোটি বছর পর পর।
২। আজ থেকে প্রায় ১৩৭৭ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল আজকের ব্রহ্মান্ড, যা ক্রমে আয়তনে স্ফীত হয়ে চলেছে। এখনও তার সংকোচন বা, ক্রাঞ্চ শুরু হয়নি।
৩। সূর্য নামক একটা মাঝারী আয়তনের নক্ষত্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে আটটি প্রধান গ্রহ এবং কয়েক কোটি গ্রহাণু, ধুমকেতু, উপগ্রহ ; এই নিয়েই আমাদের সৌরমন্ডল, আমরা যার অধিবাসী।
৪। সব নক্ষত্রেরই জন্ম ও মৃত্যু আছে। আয়নিত ধুলিকণা ও নানা গ্যাসের বিপুল ভান্ডার বা, নেবুলা (Nebula) থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়, বৃদ্ধি হয়, এবং ক্রমশঃ লাল রঙের বিশাল ‘রেড জায়ান্ট’ হয়ে উঠলে তার জীবন শেষ হয় বিশাল ‘সুপারনোভা’ বিস্ফোরণে, যা ক্রমে পরিণত হতে পারে কৃষ্ণ গহ্বরে অথবা, একটি ঠান্ডা অতি ক্ষুদ্র ‘নিউট্রন’ স্টার হয়ে সে উজ্জ্বলতা হারায়, আর ছড়াতে থাকে নানা বিকিরণ।
৫। এই ব্রহ্মান্ডে আলোর গতিই (প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার) সবচেয়ে বেশি, তার চেয়ে বেশি গতি সম্ভব নয়। এবং বস্তু জগতে মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাই শীতলতম, তার চেয়ে নীচে সম্ভব নয়।
৬। গণনার সুবিধের জন্য সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বকে– যা প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার (১৪,৯৫,৯৭,৮৭১ কিমি)— বলা হয় এক ‘সূ-পৃ দূরত্ব’ অথবা, 1-AU (Astronomical Unit), যা মহাবিশ্বে দূরত্বের একক।
এছাড়া, আলোর গতিতে ছুটে গেলে একবছর সময়ে (পৃথিবীর ৩৬৫ দিনে) যতটা দূরত্ব অতিক্রম করা যায়, তাকে ১-আলোকবর্ষ বলা হয়। এই দূরত্বের পরিমাপ হচ্ছে, নয় লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার আশি কোটি কিলোমিটার (94,60,80,00,00,000 Kms)। অর্থাৎ, এক আলোকবর্ষ দূরত্ব, যার মানে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে 63,241.5 বার অতিক্রম করা।
এর চেয়েও বড় দূরত্বের মাপ হচ্ছে ‘পার্সেক’ (Parsec)। ১-পার্সেক মানে, ৩.২৬ আলোকবর্ষ বা ৩১ লক্ষ কোটি কিলোমিটার বা, ৩১ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার।
৭। মহাবিশ্বে সর্বত্রই বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও তড়িৎ আয়নিত কণা উপস্থিত রয়েছে ; একদম ফাঁকা জায়গা বা এম্পটি স্পেস কোথাও নেই।
৮। অনেক নক্ষত্র মিলে তৈরী হয় নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সি। আমরা যে ছায়াপথ বা ‘মিল্কি ওয়ে’ নামক গ্যালাক্সির অধিবাসী, সেখানে আছে আমাদের সূর্যের মতই প্রায় চল্লিশহাজার কোটি নক্ষত্র এবং তাদের মধ্যে অনেক নক্ষত্রকেই ঘিরে আছে তাদের নিজ নিজ গ্রহ-উপগ্রহর মন্ডলী।
৯। চল্লিশ হাজার কোটি নক্ষত্র নিয়ে গঠিত যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, তার মতো প্রায় দেড় লক্ষ গ্যালাক্সি নিয়ে যে সুপার ক্লাস্টার তার নাম ‘লানিয়াকিয়া’ সংগঠন (Laniakea Supercluster)। এরকম আরও অনেক আছে। আনুমানিক দু’লক্ষ কোটি বিশাল গ্যালাক্সি আছে ব্রহ্মান্ডে, অন্তত ব্রহ্মান্ডের যতটুকু (পৃথিবী থেকে সবদিকে ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব অব্দি) এপর্যন্ত পরিমাপ করা গেছে। তার বাইরেও আছে অনেক।
১০। ব্রহ্মান্ডের যতটুকু দৃশ্য, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী অদৃশ্য রয়ে গেছে আমাদের কাছে, যার মধ্যে আছে কোটি কোটি কৃষ্ণ গহ্বর বা, ব্ল্যাক হোল। এছাড়াও রয়েছে অনেক অদৃশ্য পদার্থ ও শক্তি (ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি), যাদের উপস্থিতি আন্দাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
ওপরের ছবিতে বাঁদিক থেকে সূর্যের পরে বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহ। তারপরে আছে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। সূর্য থেকে যতদূরে যাওয়া যায় ততই শীতলতা বাড়তে থাকে, যেমন শনি, ও তার পরবর্তী গ্রহরা রয়েছে সৌরমন্ডলের হিমশীতল অঞ্চল জুড়ে। আর যারা সূর্যের খুব কাছে রয়েছে, যেমন বুধ বা শুক্র গ্রহ, তাদের তাপমাত্রা এত তীব্র যে, প্রাণজীবন সেখানে সম্ভব নয়।
এইসব বিচার করলে দেখা যাবে, আমাদের পৃথিবী রয়েছে সূর্যের উত্তাপ থেকে সবচেয়ে সুবিধেজনক দূরত্বে, বেশি কাছে নয়, বেশি দূরেও নয়। তাই জলকে পাওয়া যায় পেয় ও তরল অবস্থায়, সম্ভব হয় প্রাণজীবনের উৎপত্তি ও বিকাশ। পৃথিবী যেমন সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন, দূরের অন্য গ্রহদের ক্ষেত্রে তাদের দূরত্বের কারণেই সময় লাগে অনেক বেশি। তাই তাদের বছরগুলো পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘ।
গ্রহদের নিজের দিনকে বলা হয় ‘সোলার দিন’ বা, Sols ; মঙ্গল গ্রহের একদিন (সোল) পৃথিবীর দিনের চেয়ে প্রায় ৩৯ মিনিট দীর্ঘ। সেই হিসেবে মঙ্গলের এক বছর পূর্ণ হয় ৬৬৮ সোলার দিনে, যা পৃথিবীর হিসেবে ৬৮৭ দিন। বৃহস্পতি গ্রহের এক দিন হয় পৃথিবীর হিসেবে মাত্র ১০ ঘন্টায়। তার একটা কারণ, নিজের অক্ষে তার ঘূর্ণনবেগ (ঘন্টায় ২৮,০০০ মাইল) পৃথিবীর (ঘন্টায় ১০০০ মাইল) চেয়ে অনেক বেশি। বৃহস্পতির একবছর পূর্ণ হয় পৃথিবীর হিসেবে প্রায় ১২ বছরে [নীচের ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে]।
সৌরমন্ডলে, প্রথম চারটে গ্রহের পরেই রয়েছে ‘প্রধান গ্রহাণু বলয়’ (Main Asteroid Belt), যেখানে আছে ছোটবড় কয়েক কোটি গ্রহাণু, তবে সেখানে ধুমকেতুরা থাকে না। এই বেল্টের পরে যে আরও চারটি গ্রহ আছে, তারা পৃথিবীর চেয়েও আকারে অনেক বিশাল, এবং তারা সকলেই প্রধানতঃ গ্যাসীয় অবস্থায় রয়েছে বলে তাদের ‘গ্যাস জায়ান্ট’ বলা হয়, সেখানে মানুষের অবতরণের কোনও উপায়ই নেই। এরা হচ্ছে যথাক্রমে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। বরং এদের উপগ্রহরা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, সংখ্যাতেও তারা অনেক। বৃহস্পতির নিজস্ব কক্ষপথেও চলাচল করছে প্রায় দশ লক্ষ গ্রহাণু, দূরত্ব বজায় রেখে, যাদের ‘ট্রজান’ (Trojans and Greeks) বলা হয়। [নীচে ছবিতে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষের মাঝে সেই ‘প্রধান গ্রহাণু বলয়’ এবং বৃহস্পতির কক্ষপথে ট্রজান্স।]
সৌরমন্ডলে এখন এই আটটিই গ্রহ, বাকীরা ছোট বড় অসংখ্য গ্রহাণু, যাদের মধ্যে প্লুটোও রয়েছে, যাকে আর গ্রহ বলা হয় না। এই নেপচুনের পরে, সৌরমন্ডলের শেষ প্রান্তে, সূর্য থেকে ৩০ সূ-পৃ দূরত্বে (30 AU), রয়েছে কোটি কোটি গ্রহাণু নিয়ে গঠিত ‘কাইপার বেল্ট’ (Kuiper Belt)। [নীচের ছবিতে]
সৌরজগতে ১০০-২০০ বছর পরপর যেসব ধুমকেতু (Periodic Comets) আমাদের দেখা দিয়ে যায়, যেমন ৭৬-বছর অন্তরে আসা হ্যালির ধুমকেতু, তাদের উৎপত্তি এই কাইপার বেল্টে। এই কাইপার বেল্ট চওড়ায় প্রায় ২০ সূ-পৃ (20 AU), অর্থাৎ প্রায় ৩০০ কোটি কিলোমিটার। প্লুটো আসলে এই কাইপার বেল্টেরই বাসিন্দা একটি ছোট গ্রহ, বা মাইনর প্ল্যানেট। প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা দিতে গেলে তারই সমকক্ষ তো আরও রয়েছে এই কাইপার বেল্টেই, তাদের নাম—হাউমিয়া, মাকেমাকে, এরিস, এবং আরও অনেক। সুতরাং সৌরমন্ডলে আকার ও আয়তনের বিচারে এখন আটজনই মাত্র গ্রহের মর্যাদা পেয়েছে। এই কাইপার বেল্টের প্রায় পরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সৌরমন্ডলের সীমানা, সূর্য থেকে ৭৫০ কোটি কিলোমিটার (50 AU) দূরে।
*
সেই কোন কিশোর বয়সে চর্যাপদে পড়েছিলাম —
“ভব নই গহন গম্ভীর বেগে বাঁহি
দু অন্তে চিখিল মাঝে ন থাহি”।
মহাকাশ যেন তেমনই এক পারাপারহীন অসীম নদী। যতই আলোর বেগে ছুটে যাওয়া যাক, কোথাও তার আর থই পাওয়া যায় না। আকাশের ওই অসীম নীল গাঙে কোটি কোটি তারা, তাদের আছে কোটি কোটি গ্রহ। তবে আমাদের সব-হতে-আপন এই সৌরজগতে একটা নবম গ্রহ কি সত্যিই আছে কাছাকাছি ? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সত্যিই সে আছে এবং সে নাকি পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়, লুকিয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে না। সেকথায় আসা যাবে আগামী পর্বে।
[ক্রমশঃ]
Posted in: July 2020 - Serial, PROSE