ধর্ম : পিতৃতন্ত্র বনাম নারী – সংযুক্তা পাল

ভারত বা ভারতের বাইরে ‘ধর্ম’ নামক ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান যে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর অধীন তা বহুভাবে প্রমাণিত। পিতৃতন্ত্রের ঈশ্বর তাই ইভকেই সমাজের উপযুক্ত মনে করেছেন, বিপ্লবী লিলিথকে তাই নির্বাসনের জন্য ছেড়ে রেখেছেন, বেশ্যার তকমা এঁটে দিয়েছেন গায়ে। মিল্টনের ইভ আদমের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে
“আমার প্রণেতা ও ব্যবস্থাপক, তুমি যা আদেশ করো প্রশ্নহীন আমি মান্য করি;এ-ই বিধাতার বিধি; বিধাতা তোমার বিধি, তুমিই আমার;এর বেশি কিছু না জানাই নারীর সবচেয়ে সুখকর জ্ঞান ও গুন।”(উদ্ধৃত ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্)
ইসলামি শাস্ত্রে নারী তাই ‘ফিৎনা’ যার কাম এলোমেলো বা বিপর্যস্ত করে দিতে পারে গোটা সমাজ,তাই তাকে শৃঙ্খলে বা অবরুদ্ধ করে রাখতে হবে অবরোধে এমনই নির্দেশ বিধি।
‘ফাতিমা মেরনিসসির(১৯৭৫,৩৪)মতে নারীপুরুষ সম্পর্কে ইসলামি সমাজে রয়েছে দুটি তত্ত্ব, একটি স্পষ্ট, আরেকটি অন্তর্নিহিত: স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ সক্রিয়, আক্রমণাত্মক; নারী অক্রিয়,মর্ষকামী; অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি হল নারীর কাম অসীম। অন্তর্নিহিত তত্ত্ব টির চূড়ান্ত রূপ মেলে গাজ্জালীর ইহয়া উলুস আল-দিন বা ধর্মতত্ত্বের পুনরুজ্জীবন -এ। তাঁর মতে সভ্যতা নিরন্তর সংগ্রাম করে চলছে নারীর সর্বগ্রাসী সর্বনাশী শক্তির সাথে;তাই পুরুষ যাতে অবিচলিত ভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্য দরকার নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা।… নারীপুরুষ সম্পর্কে ইসলামি স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ; পুরুষের প্রবনতা জয়লাভ ও আধিপত্য করা; নারীর প্রবনতা পরাভূত, অধীনস্থ হওয়া। ইসলামি মৌলবাদীর মধ্যে এ-দুটি বিশ্বাসই কাজ করে;সে নারীকে যেমন ভয় পায়, নারীর মুখোমুখি যেমন অসহায় বোধ করে,তেমনই তাকে অবরুদ্ধ, পর্যুদস্ত করে রাখতে চায়। শুধু ইসলামি মৌলবাদী নয়,সব মৌলবাদীর স্বপ্নই এক: নারীকে পর্যুদস্ত করা। হিন্দু মৌলবাদী নারীকে মনুসংহিতানুসারে আবদ্ধ ও দগ্ধ করতে চায়; খ্রিস্টান মৌলবাদী নারীর ওপর চাপাতে চায় মানুষের সমস্ত পাপের ভার।'(হুমায়ুন আজাদ/’নারী’)
হাদিস এ আছে “স্বামী যদি সঙ্গম চায় এবং স্ত্রী যদি না চায় তার ফলে কামার্ত স্বামী যদি সারারাত জেগে কাটায় তবে ফেরেশতাদের অভিশাপ ঐ নারীর মাথার ওপর সারারাত ধরে বর্ষিত হতে থাকে।”
এইভাবে পুরুষের স্বেচ্ছাচারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মনুসংহিতার একাধিক শ্লোক যা মেয়েদের জীবনকে অদ্ভুত কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
“তিরিশ বছরের পুরুষ বারো বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে, চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছর বয়সের কন্যাকে বিয়ে করবে,নইলে ধর্ম নষ্ট হয়”
এখন প্রশ্ন হলো কোন ধর্ম? উত্তর তবে সহধর্ম, অর্থাৎ সেই হলো সহধর্মিনী-সহধর্ম পালন করে যে,নিজ ধর্ম নয়। কিংবা সহধর্ম পালনকেই তার সমগ্র জীবনের নিজ ধর্ম বলে চালানো হয়।মনু আরো বলেছেন—

“বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থহগ্নি পরিক্রিয়া।।”
(বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন,পতিসেবা হচ্ছে গুরুগৃহবাস এবং গৃহকর্মই প্রভাত ও সন্ধ্যায় হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।)
এ প্রসঙ্গে মহাভারতের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক- ঋষি কুনির কন্যা সুভরূ সারাজীবন ধর্ম পালন করেও স্বর্গে যেতে পারবেনা কারণ সে কুমারী, বিয়ের দ্বারা তার দেহ পবিত্র হয়নি।অতএব এক ঋষির সঙ্গে একরাত্রি কাটানোর ব্যবস্থা করে তাকে স্বর্গে যাবার ছাড়পত্র দেওয়া হয়।এই স্বর্গলাভ যদি মোক্ষকে ধরে নিই তবে তার সঙ্গে দেহ ভোগ বা সম্ভোগের কি সম্পর্ক হতে পারে! সুতরাং ধর্মের অজুহাতে এ আসলে পিতৃতান্ত্রিকতার ষড়যন্ত্র-নারীকে ভোগ্যা হিসেবে দেখার মানসিকতা বা এক অর্থে লৈঙ্গিক রাজনীতি।

‘নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে, নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়।’ (মনুসংহিতা)
এ যেন এক প্রভুর কাছ থেকে অন্য প্রভুর কাছে ধর্মীয় বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে নারীর হস্তান্তর।
পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী আদি শক্তি বা আদ্যা শক্তি একজন নারী, তাহলে নারীত্বকে দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে তার জন্য আলাদা নীতি বা বিধান কেন? অর্থাৎ ভিক্টোরীয় রীতির অনুসরণে মৌখিকভাবে ‘দেবী’, ‘মূল প্রাণ শক্তি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে আসলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার অজুহাতে তাকে একদিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা অন্যদিকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং দাসত্বের মধ্যে গৃহবন্দী করে রাখা। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বর্ণিত নারীর দুই রূপ উর্বশী ও কল্যাণী(লিলিথ ও ইভের ন্যায় বলা যেতে পারে)।এই (উর্বশী) জাতীয় নারীকে পুরুষ গ্রহণ করে না, আবার এই (কল্যাণী) জাতীয় নারীকে গৃহে বন্দী করে রাখে।
আদি শক্তি-মহামায়া, অথচ বিশ্ব সৃষ্টি ব্রহ্মা কর্তৃক, পালনকর্তা বিষ্ণু, সংহারকর্তা শিব, এঁদের সম্মিলিত
শক্তিতেই উৎপন্ন মহামায়া অর্থাৎ নারী শক্তি; এক্ষেত্রে নারী আসলে পুরুষ কর্তৃক সৃষ্ট বা নির্মিত, তা সে ‘পাঁজরের হাড়’ বা ‘জ্যোতি ‘ যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন।’বিধাতা’ শব্দটির সঙ্গে ‘পুরুষ’ শব্দটিই যুক্ত করা হয়।
হিন্দু শাস্ত্রে পুত্রের জন্য বাতিল করে দেয়া হয়েছে নারীর সতীত্বের ধারণা; স্বামী যদি পুত্র জন্ম দিতে না পারে তবে পুত্র উৎপাদনের জন্যে বিধান রয়েছে পুত্রবীর্যবান পুরুষ নিয়োগের। পুরুষতন্ত্রের প্রয়োজনে ধর্মকে শিখন্ডী দাঁড় করানো হয় নারীর সামনে তা প্রমাণিত।ধর্মপ্রথা অনুযায়ী নারীর সতীত্বের ধারণায় এক পুরুষের ভোগ্যা হওয়ার যে অনিবার্য পরিণতি পিতৃতন্ত্র রক্ষার জন্য , পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে সেখানে বহু পুরুষ সঙ্গমেও নারীকে তখন অসতী হিসেবে দেখা হচ্ছে না (মহাভারতের একাধিক উদাহরণ প্রযোজ্য)অর্থাৎ এক্ষেত্রে আধুনিকতার প্রেক্ষিতে মানসিক শুচিতার দিকে লক্ষ্য রেখে শারীরিক শুচিতার মিথকে ভাঙা হচ্ছে বলা যেতে পারে; তেমনই নারীর সতীত্বের সংজ্ঞা যে প্রয়োজন অনুসারে পিতৃতন্ত্রই তৈরি করে দেয় তাহলে বলা বাহুল্য।
গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও নারীর সতীত্ব অদ্ভুতভাবে পিতৃতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদাহরণ-মহাভারতের কুন্তী চরিত্র, যে বিবাহপূর্বে নিজের ইচ্ছের কারণে গর্ভধারণ করলে তাকে সন্তান বর্জন করতে হয়।সূর্যদেব কর্তৃক বরপ্রদত্ত সে সন্তান অবৈধ কেননা তা অবিবাহিত নারীর সন্তান।যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই বিধান দেয় সেই সমাজই বিবাহপরবর্তী জীবনে পান্ডুর অপারগতায় পান্ডুর স্ত্রী কুন্তীকে বংশ রক্ষার্থে পরপুরুষ কর্তৃক সন্তান জন্মদানের অনুমতি দেয়, কোথাও তারা অবৈধ সন্তান আখ্যা পায় না।এও পুরুষতন্ত্রের এক কারসাজি যেখানে নারীর গর্ভ এমনকি গর্ভধারণের অধিকার তাও তার নিজের বা নিজের জন্যে নয়, সেখানেও পুরুষের মালিকানা বর্তায়। ‘সতীত্ব’ একটি concept বা বিমূর্ত ধারণা, যাকে নারীর সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয়। পুরুষ এর সঙ্গে ‘সতী’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়না।’সৎ’ বা ‘সত’ থেকে যদি ‘সতী’ এসে থাকে তবে একজন সৎ পুরুষ বলতে তার চরিত্রের অনেক গুনাগুনই বোঝায়,দেহজ বা কামজ বিষয়টিই শুধু নয়, তেমনই নারীর ক্ষেত্রে সতী নারী বলতে যে নির্দিষ্ট বিষয়ে তাকে বেঁধে ফেলা হয় তা খুবই মর্মান্তিক।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী প্রথাগত সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই সতীদাহের ব্যবস্থা। মৃত পুরুষের সঙ্গে জীবন্ত নারী পোড়ানোর এক ভয়ানক পাশবিক উল্লাস–কি অদ্ভুত আয়রনি।মনু পতির মৃত্যুর পর নারীর ব্রহ্মচর্য্য পালনের কথা বলেছেন।সহগমন ছাড়াও ব্রহ্মচর্য্য পালনের নির্দেশকেই কাজে লাগিয়েছিলেন রামমোহন সতীদাহ রদ্ কে শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করার ক্ষেত্রে। পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ে আছে—’পরাশর নিরূপিত ধর্ম কলিযুগের ধর্ম।’ ধর্মশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্রকর্তার মধ্যে থেকে পরাশর বিধবাদের জন্য যে তিন নীতি বরাদ্দ করেছেন সেখানে পুনর্বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায় (বিবাহ, ব্রহ্মচর্য, সহগমন-পরাশরভাষ্য)যা বিদ্যাসাগর ‘বিধবা বিবাহ’ কে শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করার ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন।
বেগম রোকেয়া বলেছেন ‘নারীকে শিক্ষা দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন।… পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে সম্বন্ধ,সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ।… রামচন্দ্র “স্বামিত্বের” ষোলো আনা পরিচয় দিয়াছেন!!আর সীতা?কেবল প্রভু রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া দেখাইয়াছেন যে তাঁহারও ইচ্ছা প্রকাশের শক্তি আছে।’
রামায়ণ হিন্দুদের একটি জনপ্রিয় ধর্মীয় পুরাণগ্রন্থ, যেখানে সীতা মডেলেও পিতৃতন্ত্র নারীর ধারণা তৈরি করে দেয় যা মর্ষকামিতার চূড়ান্ত উদাহরণ।

নারীবাদনেত্রী স্ট্যান্টন আক্রমণ করেন বাইবেলি নারীর ভূমিকা ও ভাবমূর্তিকে;—”বাইবেলকে আমরা দীর্ঘকাল ধরে অন্ধ ভক্তির বস্তু করে তুলেছি। এখন এটি অন্যান্য বইয়ের মতো পড়ার সময় এসে গেছে, নিতে হবে এর ভালো শিক্ষা বাদ দিতে হবে খারাপটা’
তিনি দেখান যে সম্পূর্ন বাইবেল দাঁড়িয়ে আছে নারীর পাপের ধারণায় ভিত্তি ক’রে। তিনি বলেন ‘সাপটি,ফলগাছটি এবং নারী টিকে সরিয়ে নাও;তারপর আর থাকে না কোনো পতন, কোনো ক্রুদ্ধ বিচারক, কোনো নরক, কোনো চিরশাস্তি;–সুতরাং দরকার পড়ে না কোনো ত্রাতার। এভাবে খ’সে পড়ে সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের তলদেশ।এ কারনেই সমস্ত বাইবেলি গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পন্ডিতেরা কখনো নারীর অবস্থানটি ছুঁয়ে দেখেন না’
স্ট্যান্টন এর বক্তব্যের শেষাংশের রেশ টেনেই বেগম রোকেয়ার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা যায়। তিনি এক জায়গায় বলছেন “এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।মুনিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।যাহা-হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কিনা,তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমনী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে পরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিত নহে।আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।…”
তিনি আরো বলছেন—’ “দাসী” শব্দে অনেক শ্রীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, “স্বামী”শব্দের অর্থ কি? দানকর্তাকে “দাতা” বলিলে যেমন গ্রহণকর্তাকে “গ্রহীতা” বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে “স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর” বলিলে অপরকে “দাসী” না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন’
অতএব নারী-পুরুষের প্রথাগত সম্পর্ক তাঁর কাছে কোনো পবিত্র বা মহৎ কিছু নয়,তা শক্তির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতিতে বলপ্রয়োগের দ্বারা নারী পরাজিত, সুতরাং উভয় সম্পর্কে যথেষ্ট বৈষম্য বর্তমান। সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্র বাদের যে বিরোধ বা সংগ্রাম তেমনি এও এক শ্রেণি-সংগ্রাম।তবে পুরাকালে সভ্যতা ও সমাজবন্ধন যখন ছিল না,তখন নারী মুক্ত, স্বায়ত্তশাসিত ছিল। পরিবারতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নারীও আবদ্ধ হয়। পুরুষ শক্তিশালী তাই নারীকে পরাভূত ও দাসত্বের মাধ্যমে অধীনস্থ করে রাখে।

বঙ্কিমচন্দ্র এক জায়গায় বলছেন—’স্ত্রীলোকের প্রথম ধর্ম্ম পাতিব্রত্য।…নবীনাগণ পতিব্রতা বটে, কিন্তু যত লোকনিন্দা ভয়ে,তত ধর্ম্মভয়ে নহে।…ধর্ম্মে যে নবীনাগণ প্রাচীনাদিগের অপেক্ষা নিকৃষ্ট, তাহার একটি বিশেষ কারণ অস্ম্পূর্ণ শিক্ষা। লেখাপড়া বা অন্য প্রকারের শিক্ষা তাহারা যাহা কিঞ্চিৎপ্রাপ্ত হয়েন, তাহাতেই বুঝিতে পারেন যে, প্রাচীন ধর্ম্মের শাসন অমূলক।’
পুরুষ ও নারীর ধর্ম্ম আলাদা করা অর্থাৎ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির চরম শর্তরূপে তা কাজ করে।ধর্ম্মের একটি অখন্ড সামগ্রিক ব্যাখ্যা হওয়াই বাঞ্ছনীয়, সেখানে প্রাচীন-নবীন হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো যুক্তি দেখিনা উপরন্তু লেখাপড়া বা শিক্ষা লাভ যা যুক্তিবাদ গ্রহণে সহায়ক তাকে বঙ্কিমের মত মানুষ অস্ম্পূর্ণ শিক্ষা বলছেন শুধুমাত্র নারীসত্তাকে পাতিব্রত্যের অন্ধঘেরাটোপে বেঁধে রাখবেন বলে। পিতৃতন্ত্রের এ হেন নিয়ন্ত্রণ সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
বোভেয়ারের “The second sex”এ সেন্ট পলের যে উক্তি পাওয়া যায় “For the man is not of the woman but the woman of the man.Neither was the man created for the woman but the woman for the man.”
“For the husband is the head of the wife even as Christ is the head of the church therefore as the church is subject into Christ so let the wives be to the wives be to their own husband’s in everything
সেন্ট আম্ব্রোজের উক্তি “Adam was led to sin by Eve and not Eve by Adam, It is just right that woman accept as lord and master him whom she led to sin”
সেন্ট থমাসের উক্তি “Man is above woman as Christ is above man.It is unchangeable that woman is destined to live under man’s influence and has no authority from her lord.”
ভারতীয় পুরাণে পরাশর কর্তৃক সত্যবতীকে ধর্ষণের উপাখ্যান বিখ্যাত, দেবরাজ ইন্দ্র মানেই এক চূড়ান্ত নারী লোলুপতা,গ্রীক পুরাণেও পাওয়া যায় ধর্ষণ,যাতে প্রধান ধর্ষণকারী দেবরাজ জিউস। দাফনে অ্যাপোলোর কামক্ষুধা থেকে বাঁচার জন্যে রূপান্তরিত হয়েছিল লরেলতরুতে।নারীদের পরিনতি আত্মগোপন নয়তো আত্মহনন।ব্রাউনমিলার তাই হয়তো বলেছেন- ‘শুরুতে পুরুষ ছিলো প্রাকৃতিক লুন্ঠনকারী আর নারী ছিলো প্রাকৃতিক শিকার।’

আধুনিক নারীবাদীরা ধর্ষণের তত্ত্বকে প্রথম প্রতিস্থাপিত করেন এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁরা দাবি করেন ধর্ষণ কে কিছু ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের বিকৃত কাজ বলে একদিকে রাখা যাবে না, ব্যাপারটিকে বুঝতে হবে লৈঙ্গিক সম্পর্ক ও রাজনীতি, সন্ত্রাস এবং অপরাধের ভাষায়।কেইট মিলেট ই প্রথম ‘বলপ্রয়োগ’ নামে ধর্ষণ বিষয়টি আলোচনা করেন ; দেখান যে পিতৃতন্ত্রে নারীর ওপর পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলগুলোর একটি ধর্ষণ।
১৯৭৫ এ বেরোয় সুজান ব্রাউনমিলারের ধর্ষণ সম্পর্কিত বই ‘আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে: পুরুষ, নারী ও ধর্ষণ।’ তিনি তাঁর বইয়ে ধর্ষণের যে সামগ্রিক রূপরেখা অঙ্কন করেছেন তার মূল প্রতিপাদ্য হল ধর্ষণ আসলে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদান, একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও পরবর্তীকালে আরো বহু বই ও নিবন্ধে এই সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে।
সুতরাং ধর্ষণের মূল কারণ হিসেবে সামাজিক ব্যাধি বা আধুনিক শিল্পনির্ভর জীবনের সামাজিক জটিলতা নয়, মহাভারতে দ্রৌপদীর প্রতি জয়দ্রথের আচরণ,এইরকম একাধিক পৌরাণিক অনুষঙ্গ প্রমাণ করে ধর্ষণকারী পুরুষের মধ্যে মূল্যবোধহীনতা বা পুরুষের আধিপত্যবাদ কখনোবা নারীবিদ্বেষও ধর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সমগ্র মহাভারত , রামায়ণ এছাড়াও একাধিক পুরাণ ঘাঁটলে নারীর যে অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়-যেমন দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী, বস্ত্রহরণ, শকুন্তলা উপেক্ষা, অর্জুনের একাধিক বিবাহ, সীতার সতীত্ব পরীক্ষা,পাতাল প্রবেশ ইত্যাদি দারুন শোচনীয়।
এমনকি নারীর নিজস্ব অনুমতি ছাড়াই তাকে অন্যপুরুষ সংসর্গে বাধ্য করা, যা ঘটেছিল অম্বিকা, অম্বালিকার ক্ষেত্রে;যে পুরুষ কে দেখে কেউ ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছেন (অম্বিকা), কেউবা ভয়ে পান্ডুবর্ণ হয়ে যাচ্ছেন (অম্বালিকা)-কারণ প্রজনন, বংশরক্ষা,অথচ ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই মাতৃত্ব কতটা গৌরবের একজন নারীর পক্ষে? মাতৃত্ব যে আদৌ মেয়েদের পরম গৌরবের একথা তাদের বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে পুরুষ তন্ত্র।মা হওয়াটা কোথাও শুধু মাত্র ‘কাজ’, কোথাওবা মেয়েদের প্রাপ্ত ক্ষমতার ব্যবহার মাত্র। সেখানে কষ্ট ছাড়া যে আনন্দের মধ্যে দিয়ে সাফল্য খুঁজতে চাওয়া হয় তা একাধারে যেমন একজন মায়ের,একজন বাবারও, শুধুমাত্র অকাতরে নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা,স্বীয় জীবনের উন্নতি বা লক্ষ্য সাধনের পথ বন্ধ করে একাধিকবার গর্ভবতী হওয়াটা মেয়েরা যাতে সহজেই মেনে নেয় সে উদ্দেশ্যেই এহেন শিক্ষা। অথচ ঋতুমতীত্ব যা মাতৃত্ব বা সৃষ্টির মূল উৎস, স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া তার সঙ্গেও পবিত্র, অপবিত্রতার ধারণা কুসংস্কার রূপে চলে আসছে বহু বছর। এমনকি বিবাহিতা নারীদের চিহ্ন সম্পর্কিত নানান তর্ক বিতর্ক, প্রতিবাদ, বিরোধ এবং তার দরুণ সেই চিহ্নগুলি (যেমন-সিদুঁর, শাঁখা-পলা,লোহা ইত্যাদি)লোপ পেতে বসেছে। কিন্তু সংস্কৃতির নাম দিয়ে যা চালানো হয় তাহলে পুরুষের অঙ্গে ওঠে না কেন? বিবাহিত পুরুষের নির্দিষ্ট চিহ্নায়ণ প্রয়োজন পড়ে না কেন? কারণ একটাই- অধীনতার সম্পর্ক-একজন অধিকারী অপরজন অধিকৃত। সোস্যাল সাইটেই সেদিন একটা জোক্স চোখে পড়ে গেল। শাঁখা-পলা-লোহা ইত্যাদি যদি পুরুষের মঙ্গল কামনায় হয় তবে বিয়ের আগে তাদের মঙ্গল কামনায় ওগুলি কারা পরে কিংবা কেউ না পরলে তাদের মঙ্গল কিভাবে হয়?এর থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় বিষয়টির অসাড়তা।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এর মত প্রভাবশালী ঋষিকে বিদুষী গার্গী ভাব-যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন।গার্গী ছিলেন আধুনিকতামনস্ক শিক্ষিতা নারী,বিশেষ করে অবিবাহিতা পেশাজীবী নারীদের পথিকৃৎ, যাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ মহাঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন ‘স্তব্ধ হও’। এভাবেই যুগে যুগে বিদুষী নারীদেরও স্তব্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের পান্ডিত্য সহ্য করেনি পুরুষতান্ত্রিক ঔদ্ধত্য।
এমনকি দেবতারা ছদ্মবেশে নারীকে সম্ভোগ করলে অভিশাপগ্রস্ত হয় নির্দোষ নারীরাই; একাধিক উদাহরণ এক্ষেত্রে দেওয়া যেতে পারে। অহল্যা গৌতম ঋষির স্ত্রী, দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক ধর্ষিতা হওয়ার পর তিনি গৌতম কর্তৃক অভিশপ্ত হন। পুরাণে বর্ণিত ঘটনা অনুযায়ী সোম বা চন্দ্র কর্তৃক তারা অবরুদ্ধ হলে বৃহস্পতি তাকে মুক্ত করতে সমর্থ হননি অথচ ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় সোম তারাকে মুক্তি দিলে সন্তানসম্ভবা তারাকে বৃহস্পতি গ্রহণ করতে অরাজি হয়। নারীকে অযোগ্য, শারীরিক ভাবে হীন প্রতিপন্ন করে পুরুষ তার প্রভু হবে,দেহের ওপর কর্তৃত্ব করবে অথচ প্রয়োজনে রক্ষা করতে অসমর্থ হলে তার শাস্তি বা দায় বর্তাবে সম্পূর্ণ নারীর ওপর।অপর পুরুষ কর্তৃক লাঞ্ছনার দায়টাও যেন ঐ নারীরই ।
তুলসী শঙ্খচূড় এর স্ত্রী,নারায়ণ শঙ্খচূড় এর বেশে এসে তুলসীর সতীত্ব হরণ করেন সম্ভোগের দ্বারা, তাতে শঙ্খচূড় মারা যান। সতীত্ব যেহেতু একটি বিমূর্ত ধারণা তাই তার সঙ্গে মৃত্যুর কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতে পারে না। সুতরাং কোনো পুরুষকে হত্যার জন্য তার স্ত্রীর সতীত্ব হরণের বিষয়টিও পুরুষের লিপ্সা চরিতার্থের অন্য একটি উপায় বৈ কিছু নয়; আসলে আশীর্বাদ, অভিশাপ বা তজ্জনিত গল্পের রূপকে স্ত্রীদের সতী হবার বাধ্যতামূলক নির্দেশ শুধু নয়,সেই সঙ্গে স্বামীর আয়ুজনিত ভীতি সঞ্চার করে স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ বিবাহিতা স্ত্রীরা যুগে যুগে এই গল্প শুনবে এবং নিজেদের সঙ্গে হওয়া অন্যায় , বঞ্চনা সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে নিষ্প্রাণ সতীত্ব রক্ষার চেষ্টা করে যাবে,এই সব গল্পের মূল উদ্দেশ্যই তাই। তাছাড়া যে সময়ে দাঁড়িয়ে লেখা হচ্ছে পৌরাণিক গ্রন্থগুলি তৎকালীন সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পাওয়া যায়।তাই পৌরাণিক যুগ থেকে বঙ্কিম যুগে এসেও ভিক্টোরিয় আদর্শ বাহিত সতীত্ব মাথাচারা দিয়ে উঠেছিল, এমনকি এখনও কোনো মেয়ে ধর্ষিতা হলে অদ্ভুত শুচিবায়ুতা লক্ষ্যনীয়। সামাজিক অপরাধের মাপকাঠিতে না বিচার করে আমাদের সমাজে সেখানে আগে তার বাড়ি ফেরার সময়, পোশাক,সে কোথা থেকে ফিরছে , সঙ্গে কে কে ছিলো-পুরুষ না মহিলা বন্ধু ইত্যাদি অমূলক বিষয়ের হদিশ বেশি করে নেওয়া হয়, অর্থাৎ ধর্ষণকারী অপেক্ষা ধর্ষিতার চরিত্র বিচার সেক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়।তাই বোধহয় বঙ্কিম যুগে ইন্দিরাকে দিয়ে বঙ্কিম বলালেন—
“যে বুদ্ধি কেবল কালেজের পরীক্ষা দিলেই সীমাপ্রান্তে পৌঁছে,ওকালতীতে দশটাকা আনিতে পারিলেই বিশ্ব-বিজয়িনী প্রতিভা বলিয়া স্বীকৃত হয়,তাহার অভাবই রাজদ্বারে সম্মানিত,সে বুদ্ধির ভিতর পতিভক্তিতত্ত্ব প্রবেশ করান যাইতে পারে না।যাহারা বলে বিধবার বিবাহ দাও,ধেড়ে মেয়ে নহিলে বিবাহ দিও না, মেয়েকে পুরুষের মত নানাশাস্ত্রে পন্ডিত কর,তাহারা পতিভক্তিতত্ত্ব বুঝিবে কি?”
যেখানে দুজন একই প্রজাতির জীব প্রজন্ম বৃদ্ধির মাধ্যমে মানব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার কারণে একত্রে বসবাস করে বিবাহ নামক একটি সামাজিক শর্ত, চুক্তি বা আইনের মাধ্যমে সেখানে একজনের অপরজনের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার উদ্রেক হতে পারে কিন্তু গুরু বা ঈশ্বর জ্ঞানে ভক্তি কেন উদ্গত হবে,সেওতো একজন সীমাবদ্ধ মানুষ। পড়াশোনা এবং বাহ্য বা বৃহত্তর জীবনের সংসর্গইতো বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে সাহায্য করে, সেখানে যে কোনো রূপ কুসংস্কার বাসা বাঁধে না।
হিন্দুপুরাণে নারীর প্রধান ‘অষ্টগুণ’ চিহ্নিত ছিল,এই গুণ আরোপিত হয়েছিল অবশ্যই পুরুষকর্তৃক।

“কার্যেষু দাসী,করণেষু মন্ত্রী,
ভোজেষু মাতা,শয়নেষু রম্ভা,
রূপেষু লক্ষী,ক্ষমায়েষু ধরিত্রী,
সৎকর্মে নারী,কুলধর্মে পত্নী।।”

বলা বাহুল্য একজন মানুষ কখনোই সব বিষয়ে সমান পারদর্শী হতে পারে না, সেক্ষেত্রে নারীকেও সব বিষয়ে perfect হবার ক্ষমতা স্বয়ং প্রকৃতি বা ঈশ্বর যাই বলিনা কেন তিনিই কি দিয়েছেন? অথচ বাস্তবতার দিকে না তাকিয়েই এইরকম বৈশিষ্ট্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মেরি অ্যাস্টোন, তাঁর ‘some reflection upon marriage’ এ বলেছেন-“If all men are born free,how is it that all woman are born slaves?”
আসলে ত্যাগ ,সরলতা, ঔদার্য,ক্ষমা ইত্যাদি গুণের মোড়কে নারীকে অবদমিত করে রাখার চিরন্তন প্রয়াস।
সমগ্র মনুসংহিতায় স্ত্রী জাতিকে গৃহকর্মে নিযুক্ত থেকে কুকর্ম এড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।গৃহকার্যে ব্যস্ত না থাকলেই নারীর মাথায় কু-চিন্তা অবশ্যম্ভাবী,অথচ সেই কারণে তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল কোনো কাজ তো দূরে থাক; শিক্ষালাভ-অধ্যয়ন সব কিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।মনু তৈরি করেছেন নারীর জন্য একাধিক বৈষম্যমূলক আইন। তাদের বশবর্তী করার জন্য পার্থিব সুখ-ভোগে ভুলিয়ে রাখার ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ পরিবারতন্ত্রকে যেন বিনাবাক্যে ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’এর মত সারাজীবন নিজেদের পিঠে নারী হাস্যবদনে বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতক,যার নাম কুনাল জাতক তার মুখ নিঃসৃত বানী-

“সদা রক্তমাংস প্রিয়, কঠোর হৃদয়,/পঞ্চায়ুধ,ক্রুরমতি সিংহ দুরাশয়,/অতিলোভী,নিত্য প্রতিহিংসা পরায়ণ,/বধি অন্যে করে নিজ উদর পূরণ,/স্ত্রীজাতি তেমনি সর্বপাপের আবাস,/চরিত্রে তাহাদের কভু করোনা বিশ্বাস।”

এছাড়াও নারীকে ব্যভিচারিণী হিসেবে দেখেছেন তিনি-
“পাইলে নিভৃত স্হান, পাইলে অবসর/হেন নারী নাই এই পৃথিবী ভিতর।/না করিবে পাপ যেই ,না পেলে অপরে।/পঙ্গুর সহিত রত হয় ব্যভিচারে।/সত্য বটে ভাবে লোকে সুখদা রমনী/কিন্তু সর্ব নারী হয় পরপুরুষ গামিনী।/দমিতে নারীর মন নিগ্রহের বলে/শক্তি কাহারো নাই এ মহীমন্ডলে।/প্রিয়ঙ্করী তবু এরা বিশ্বাস অযোগ্যা,/বেশ্যা;তীর্থবৎ এরা সর্বজনভোগ্যা।”

বৌদ্ধরূপী শাস্তা ৬৫নম্বর জাতক অনাভিরতি জাতককে স্ত্রীজাতির চরিত্র সম্পর্কে যা বলেন সেই সংক্রান্ত গাঁথাটি হল এইরকম-
“নদী,রাজপথ,পানের আগার/
উৎসব,সভাস্থল আর,/এই পঞ্চস্থানে অবাধে সকলে/ভুঞ্জে সম অধিকার।/তেমতি রমনী ভোগ্যা সকলের,/কুপথে তাহার মন,/চরিত্রস্খলন দেখিলে তাহার/
রোষে না পন্ডিত জন।”
এইরূপ আরও একাধিক উদাহরণ রয়েছে জাতকের কাহিনীগুলিতে।
মনু যেখানে বলেছেন-
‘নাস্তি স্ত্রীণাম পৃথগ্ যজ্ঞো ন ব্রতমনাপ্যুপোষথম্ /পতিম্ শুশ্রুষতে যেন তেন স্বর্গে মহীয়তে।’
“প্রয়োজন নেই পৃথক কোনো যজ্ঞ কিংবা উপাসথের,পতি সেবায় স্বর্গ লাভ হবে স্ত্রীদের।”
অঙ্গুত্তর নিকায়(থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটকের সুত্রপিটক অংশের পাঁচটি নিকায়ের মধ্যে চতুর্থ-৩খন্ডে সমাপ্ত।) বুদ্ধ বলেন আটটি গুণের দ্বারা মেয়েরা গুনবতী হয় যা স্বর্গলাভের অন্যতম সোপান।যেমন-পরিবারে কাজকর্ম সুসংহত ভাবে সম্পাদন, কর্মচারীদের সাথে সুন্দর ব্যবহার, স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, স্বামীর অর্জিত সম্পত্তি যথাযথভাবে রক্ষা,ধর্মের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন,শীলসম্পন্ন,দয়ালু এবং প্রজ্ঞাবান।
(থেরবাদ-বৌদ্ধধর্মের আদিরূপ সম্প্রদায়/প্রাচীনপন্থী।
ত্রিপিটক-বৌদ্ধধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম।বুদ্ধের দর্শন ও উপদেশের সংকলন।তিনটি পিটক অর্থে ত্রিপিটক।বিনয়পিটক,সূত্রপিটক,
অভিধর্মপিটক।)
ভিক্ষুণী তথা নারীদের সংঘে প্রবেশ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভ নিয়ে বুদ্ধের সময় থেকেই মতানৈক্য ছিল। এক্ষেত্রেও নারীদের সামাজিক বিপ্লব ও ধর্মীয় বিপ্লব সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ভিক্ষুনীদের জন্য প্রবর্তিত কঠোর নিয়মাবলীও পরবর্তী সময়ে নারীদের অনুৎসাহ সৃষ্টি করে।
এমনকি সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং প্রচলিত প্রেমের মডেল (রাধা-কৃষ্ণের প্রেম) পুরুষ-নারীর যে প্রেমকে দেখানো হয়, সেখানে পুরুষ ঈশ্বর, নারী ভক্ত।এই ধর্মীয় প্রেমতত্ত্ব বা দর্শনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিবেদনের কথা বলা যায়, কিন্তু এই আত্মসমর্পণের ধারণা কেন বিপরীতমুখী নয়? ভক্ত-ভগবানের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীকে ঈশ্বর, পুরুষকে ভক্ত হিসেবে দেখানো হয়না কারণ পুরুষতন্ত্র তা মেনে নেবে না। অপরপক্ষে পৌরাণিক আখ্যান বিল্বমঙ্গল এ বারবণিতার প্রেমে আত্মমগ্ন,প্রায় সম্পূর্ণ হতচৈতন্য একজন পুরুষের শেষে এসে এই উপলব্ধি ঘটে বা ঐ নারী কর্তৃক ঘটানো হয় যে মানবীর প্রতি প্রেম তুচ্ছ; প্রেমের জন্য যে সাধনা, ত্যাগ বা কৃচ্ছ্রসাধন তা ভগবৎ প্রেমে ব্যায় করলে মোক্ষ লাভ অবশ্যম্ভাবী। ঈশ্বরই একমাত্র সেই প্রেমের আধার …তার মত একজন সামান্য বারবণিতা সেই দুর্লভ প্রেমের যোগ্য নয়।অতএব জীবাত্মা-পরমাত্মা তত্ত্ব এক্ষেত্রে খাটেনি, নারীর জন্য পুরুষের অভিসার-প্রাচীন কিংবা আধুনিক সকলের চোখেই অকল্পনীয় কিংবা ব্যাঙ্গাত্মক বা হাস্যকর হয়তোবা।এ প্রসঙ্গে বোধ করি নিটশের বক্তব্যটুকু উদ্ধৃত করা প্রয়োজন যেখানে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার (ব্যতিক্রমী মানসিকতার নিশ্চয় কেউ কেউ আছেন) প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
‘পুরুষ ও নারীর কাছে একই শব্দ প্রেম বোঝায় দু-জিনিস। নারী প্রেম বলতে যা বোঝে ,তা খুবই স্পষ্ট:তার শুধু ভক্তি নয়,তা প্রত্যাশাহীন নিঃশর্ত সম্পূর্ণ দেহমন সমর্পণ। তার প্রেমের শর্তহীনতার বৈশিষ্ট্য তার প্রেমকে পরিনত করে একধরনের ধর্মবিশ্বাসে; এবং এই তার একমাত্র বিশ্বাস। পুরুষ যখন ভালোবাসে কোনো নারীকে,তখন সে নারীর কাছে চায় প্রেম;… যদি কোনো পুরুষ বোধ করে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের বাসনা, তাহলে , আমার কথা হচ্ছে,সে পুরুষ নয়।’
‘সেক্স ‘ এবং’জেন্ডার’ শব্দদুটির মধ্যে স্বভাবতই কিছু পার্থক্য আছে।’সেক্স’ অর্থে জৈবিক লিঙ্গ, জেন্ডার অর্থে পরবর্তী সাংস্কৃতিক লিঙ্গ। পুরুষকে পুরুষালী আর নারীকে মেয়েলি হতে হবে এটাই ঠিক করে জেন্ডার যা পুরোপুরি সমাজকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। পুরুষ আর নারীর ঘরানাকে পৃথক করার ভাবনার সঙ্গে জৈবিক লিঙ্গ (sex)এর কোনো সম্পর্ক সেভাবে নেই। ঋতুস্রাব বা মাতৃত্ব এগুলি মেয়েদের ক্ষেত্রে পুরুষের গোঁফ-দাড়ি বেরোনো, অন্ডোকোষের বিকাশের মত স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা। সুতরাং ধর্ম বিষয়টাও পিতৃতন্ত্রের বর্ম যাকে পরে বা সামনে রেখে নারীর ভাগ্য বা অবস্থান নির্ধারণের ক্ষমতা পায় পুরুষ। নবনীতা দেবসেন এক সাক্ষাৎকারে বলছেন—
“নারীবাদের কথা ভাবতে হবে সাধারণ জীবনযাত্রার মানুষকে নিয়ে।স্বীয় কর্মের মাধ্যমে নারীকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজের ব্যক্তিত্ব। এখানে জেন্ডার এত জরুরি বিষয় নয়। কিন্তু যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি, সেখানে জেন্ডার রুলস খুবই স্পষ্ট।”
১৩. “যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যস্তে রমস্তে যত্র দপবতা”—
(নারী যে সমাজে পূজা পান দেবতাগণ সেথায় বিরাজ করেন।)
নারীর অধিকার রক্ষা কিংবা পুরুষ-নারীর সমতা বিধানের জন্য তাকে পুজো করার প্রয়োজন পড়ে না। নারী কখনোই দেবী হতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ এর ‘দৃষ্টিকোণ’ গল্পে ঠিক যেমনটা কুমু বলেছিল-‘না আমার দেবী
হইয়া কাজ নাই।’ আপামর নারীসমাজকে প্রশ্ন করলে মনে হয় এ উত্তরই পাওয়া যাবে…সে রক্তমাংসের মানুষ, মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক সমস্ত প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধে, অধিকার এবং পুরুষের সমানুভূতি এটাই তার আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রাথমিক সহায়ক হবে বলে মনে হয়।

[লেখক – কবি, গল্পকার, গীতিকার। পেশায় শিক্ষিকা]

Facebook Comments

Leave a Reply