ভোর : ঋতুপর্ণা

পর্ব-এক

ক্লাসে পড়াতে পড়াতে সুমেধার চোখ চলে গেল একজোড়া শান্ত, গভীর চোখের দিকে। আপাতদৃষ্টিতে একমনে সে পড়া শুনছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সুমেধার অভিজ্ঞ দৃষ্টি বলছে, সে আদৌ ক্লাসের মধ্যে নেই, তার মন অনেকদূরে কোথাও বসতি স্থাপন করেছে। কেমন যেন এক বিষণ্ণ দৃষ্টি তার।

ইতিহাসের প্রোফেসর হয়ে একজন ছাত্রের এরকম আচরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করা সুমেধার সাজে না। বরং ক্লাসে মন দিয়ে পড়া না শোনার জন্য কড়া ধমক দেওয়া উচিত তার। কিন্তু সুমেধা আবার মানুষের মন নিয়ে ভাবতে বেশ ভালোবাসে। কত মানুষ পৃথিবীতে, কতরকম মনের কারবার চলে সারা বিশ্বে। একেকটা মনের একেকরকম গঠন, একেকরকম চলার রাস্তা, একেকরকম জটিলতা! সুমেধা ভালোবেসে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করলেও, এই ‘মন’ও ওর প্রিয় বিষয়। যদিও সেটা নিয়ে পড়াশোনা করার আর সময় নেই ওর। ইশ! ওর নিজেও তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কী ভাবছে সব ছাত্ররা, কে জানে? যাক গে, এখন পড়ানো যাক, পরে সেই মেয়েটাকে নিয়ে ভাববে।

ক্লাস শেষের ঘন্টা ঢং ঢং করে বাজতে ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা করে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার আগেই সুমেধা সেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল,

“এই যে শোনো তুমি আমার সাথে কমনরুমে দেখা করবে এখন এসে।”

মেয়েটা খুব ভীত চোখে আলতো করে ঘাড় নাড়ল।

মিনিট দশেক বাদেই সে এল সুমেধার কাছে। সুমেধা জিজ্ঞাসা করল,

-“কী নাম তোমার?”

-“রাধিকা সোরেন।” খুব ক্ষীণস্বরে ভেসে এল নামটা।

-“তুমি নিশ্চয়ই এখানকার নও। কোথা থেকে এসেছ তুমি?”

-“উত্তর দিনাজপুর।” সেই ক্ষীণ গলা।

-“এখানে থাকো কোথায়?”

-“একটা হোস্টেলে।”

-“ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে?”

-“হ্যাঁ, ম্যাডাম।”

-“তাহলে যখন পড়াই, অন্যমনস্ক থাকো কেন?”

রাধিকা চুপ করে রইল। সুমেধা এবার একটু নরম স্বরে বলে উঠল,

-“রাধিকা নামটা বেশ সুন্দর। তা, রাধিকা, তোমার যদি কোনোরকম অসুবিধা হয় কোনো জায়গায়, আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। ইনফ্যাক্ট, আমার বাড়িতে এসেও পড়তে পারো আমার কাছে৷ ভয় নেই, কোনো টিউশন চার্জ নেব না। আমার বাড়ি দমদম স্টেশনের কাছেই। এই যে আমার ঠিকানা।”

রাধিকার হাতে একটা প্যাডে লেখা কাগজ দিল সুমেধা। রাধিকা চুপচাপ কাগজটা হাতে নিয়ে চলে গেল। সুমেধার মনে হল, রাধিকা যাবে না ওর বাড়িতে। পড়া নয়, মেয়েটার অন্য কোনো সমস্যা আছে৷ সেটাকেই জানতে হবে।

পরের দিন সুমেধার ডে-অফ ছিল। বাড়ির নানা কাজ আর কিছু লেখালেখির কাজ করতে করতে সুমেধা রাধিকার কথা ভুলেই গেল। তারপরের দিন কলেজে গিয়ে ফার্স্ট ইয়ার অনার্সের ক্লাস করানোর সময় হঠাৎ মনে পড়ল। কিন্তু সেদিন রাধিকা ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। হয়তো ক্লাস বাঙ্ক করে কোথাও আড্ডা দিচ্ছে ভেবে ওর কথা আবার ভুলে গেল।

তারপর, পরপর তিনদিন রাধিকা অনুপস্থিত থাকায় সুমেধার কেমন যেন সন্দেহ হল। সে ক্লাসে তার কথা জিজ্ঞাসা করাতে একটা হাসির স্রোত খেলে গেল সবার মুখে। রাধিকারই পাশে বসে তিথি নামের মেয়েটা বলে উঠল,

-“না, ম্যাম, সাঁওতালটা ক’দিন ধরেই আসছে না। হয়তো, শরীর-টরীর খারাপ হয়েছে।”

-“সাঁওতাল! ওর নাম রাধিকা না?”

-হ্যাঁ, ম্যাম। রাধিকাই নাম ওর। সাঁওতালদের মধ্যেও যে এরকম নাম হয়, জানা ছিল না আগে। আপনি জানতেন না ম্যাম, যে ও সাঁওতাল?”

সুমেধা হাল্কা হেসে বলল,

-“জানি বৈকি। তবে সাঁওতালদের মধ্যে রাধিকা নাম যে হয় না, এটা আবার আমার জানা ছিল না। আর না হওয়ার কারণও জানি না।”

সুমেধার এই হাল্কা কথাতে যে তীব্র বিদ্রূপ আছে, সেটা বুঝতে পেরে ক্লাসের সবার মুখেই হাসি বন্ধ হয়ে গেল। ও পড়াতে শুরু করল।

পর্ব-দুই

এক সপ্তাহ বাদে রাধিকা ক্লাসে এল। সুমেধা দেখল, সে যেন আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। সুমেধা এবার ওর বিষণ্ণতার কারণ কিছুটা যেন আন্দাজ করতে পারছে। আজ আবার ক্লাস শেষে দেখা করতে বলল ওকে। কমনরুমে যেতে যেতে সুমেধা শুনতে পেল,

“তোরাই তো সুবিধা পাবি রে। সরকার তো তোদের প্রচুর সুযোগ দিয়ে দিয়েছে। আমরাই তো আজ সংখ্যালঘু। খুব ভালো রেজাল্ট না হলে আমাদের কোথাও কোনো চান্স নেই। আবার দেখ, তুই পড়াশোনা না করেও ম্যামের প্রিয় ছাত্রী হয়ে গেলি। ম্যাম তোকে আলাদা করে ডাকছে, তোকে নিশ্চয়ই বাড়িতে পড়াবে আলাদা করে। তবে রাধিকা, টাকা-পয়সা আছে তো আবার তোর কাছে? না কি, তোর পরিবারে তুই-ই প্রথম পড়াশোনা করলি? তোর বাড়ির লোক নিশ্চয়ই ইঁদুর খেয়ে দিন কাটায়। ইশ! কষ্ট লাগছে রে। চান্সটা না মিস হয়ে যায়। আসলে, ম্যামকে মোটা পয়সার ডোনেশন দিতে হতে পারে। নইলে ম্যাম আর কেন শুধু শুধু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে বল? তবে যাই বলিস, আজকালকার দিনে কোনো আদিবাসী হয়ে জন্মালেই ভালো হত।”

সুমেধা বুঝল, ওরা সবাই রাধিকাকে ব্যঙ্গ করছে। করুক, কিন্তু ও রাধিকার পাশে দাঁড়িয়ে ওর ভয়, লজ্জা কাটাবে। নিজেও তো একসময় এসব পেরিয়ে এসেছে, তাই ও জানে যে এসব আঘাতে কতটা রক্তক্ষরণ হয় ভেতরে।

-“কী ব্যাপার? এতদিন অনুপস্থিত ছিলে কেন? কতটা পড়ায় পিছিয়ে গেছ তুমি জানো? ক্লাসের বন্ধুদের কাছে জেনে নিও কী কী পড়িয়েছি। এবার যাও।

রাধিকা মাথা নেড়ে কমনরুম ছেড়ে চুপচাপ বেরিয়ে যেতেই ওর অপমানে কুঁকড়ে যাওয়া মুখটার কথা ভাবতে লাগল সুমেধা।

পরদিন সকালে ডোরবেল বেজে উঠতেই সুমেধা অবাক হল। সাধারণত ওকে না জানিয়ে সকালে কেউ আসে না। রীনামাসি দরজা খুলতেই রাধিকার ভীরু ভীরু মুখখানা দেখতে পেল সে। ড্রয়িংরুমে তাকে বসতে বলে ও ভেতরে গিয়ে রীনামাসিকে জলখাবার দিতে বলল। ফিরে এসে দেখে রাধিকা ওড়নার খুটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, দৃষ্টিও সেখানেই। সুমেধা বলে উঠল,

-“কী ব্যাপার? হঠাৎ এলে যে? বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হয় নি তো?”

-না, ম্যাডাম। আসলে একটু দরকার ছিল আপনার সঙ্গে।”

-“তুমি ফ্রি হয়ে বোসো রাধিকা। এবার বলো কী দরকার? ক্লাসে কী কী পড়িয়েছি, সেসব দেখেছ?”

-“না, ম্যাডাম। ওই জন্যই আসছি।”

-“আমি তো কোনো নোটস দিই না রাধিকা। নোটস তুমি ক্লাস থেকেই নিও। তোমার কোথায় অসুবিধে হচ্ছে সেটা খুলে বলো। আমি বুঝিয়ে দেব।”

-“নোটস নেই আমার কাছে ম্যাডাম।”

-“মানে? কী কী পড়ানো হয়েছে, সেটা জানো তো?”

এবার রাধিকা শুধু না বাচক মাথা নেড়ে চুপ করে রইল।

-“ও, সেটাও জিজ্ঞাসা করো নি? আচ্ছা, রাধিকা, তোমার কি ক্লাসে কারোর সাথে কথা বলতে অসুবিধে হয়?” একটু যেন রুষ্টস্বরে বলে উঠল সুমেধা।

এবার রাধিকা বলল,

-“না ম্যাডাম, আমি ওদের কাছে পড়া জানতে চাইছিলাম, কিন্তু কেউ জানাতে চায় না আমাকে।”

-“কেন?”

খুব ক্ষীণস্বরে উত্তর এল,

-“আমি সাঁওতাল তাই।”

সুমেধা একটু অবাক হল এবার। সে বলে উঠল,

-“মানে? সাঁওতাল তো কী হয়েছে?”

-“ওরা বলে, আমার পড়াশুনা না করলেও চলবে। সরকার এমনিই আমাকে চাকরি দিয়ে দিবে।”

সুমেধা স্তম্ভিত হয়ে গেল! এখনও? এখনও এই একই জিনিস চলছে! আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও একইভাবে ওকে হেনস্থা হতে হয়েছিল। আজও সেই জিনিস! শুধু ধরণটাই আলাদা। ও দেহাতি আর দলিত বলে ওকে পড়তেই দেওয়া হচ্ছিল না, আর আজ সরকারের কিছু সুবিধা পেতে পারে বলে রাধিকাকেও পড়তে দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে পড়াশোনা, শিক্ষা এসবের কোনো মূল্য নেই? জাত-ধর্ম-অর্থনৈতিক অবস্থান-ভাষা এসবই তাহলে শিক্ষিত হওয়ার মাপকাঠি?

কিন্তু না, সুমেধাকে যে লড়াই করে এখানে আসতে হয়েছে, যে লড়াইয়ে ওর পাশে তখন কেউ ছিল না। আজ রাধিকার ক্ষেত্রে সেটা ও হতে দেবে না। ওর পাশে দাঁড়াবে সুমেধা। সে বলে উঠল,

-“চিন্তা কোরো না রাধিকা। আমি তোমাকে সাহায্য করব। না, ভয় নেই, কোনো কিছুর বিনিময়ে এ সাহায্য করব না। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে যেভাবে সাহায্য করে, ঠিক সেভাবেই পড়াব। আর, ওসব কথায় একদম কান দেবে না। নিজের পড়ায় মন দাও।”

এই বলে সুমেধা কিছু বই নিয়ে এসে বসল।

পর্ব-তিন

সকালবেলা সবে রাধিকা একমুঠো মুড়ি মুখে পুরতে যাবে, অমনি কোথা থেকে রাধিকার রুমমেট থার্ড ইয়ারের রুমেলা এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিল,

-“তুই এখন আরাম করে বসে খাচ্ছিস? ওদিকে আমরা কেউ বাথরুমে যেতে পারছি না!”

রাধিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-“কেন? বাথরুমে আবার কী হল?”

-“ন্যাকা! নিজে নোংরা করে এসে বলছে বাথরুমে কী হল?”

রাধিকা বুঝে গেল ওকে অত্যাচারের আবার কোনো নতুন পন্থা বের করেছে। একটা দিনও শান্তি দেয় না এরা কেউ। যত পরিষ্কারই থাকুক ও, ওকে দিয়ে নোংরা কাজ করাবেই ওরা। খাওয়া ফেলে রাধিকা ছুটল বাথরুম পরিষ্কার করতে। নইলে হয়তো আরও বাজে কিছু ঘটাবে।

কমোডটা নোংরা করে রেখেছে নিজেরাই। সকালবেলাও পরিষ্কার দেখে গেল। গা ঘিন ঘিন করে এসব দেখলে। কিন্তু ও সাঁওতাল বলে যেন, ওকেই পরিষ্কার করাবে।

বাথরুম পরিষ্কার করে, চান করে কলেজে গেল। সেখানেও তো বিদ্রুপের অন্ত নেই। ওখানেও সবাই প্রমাণ করতে চায়, ও সাঁওতাল হয়ে জন্মেছে, তাই ওর ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা নেই। একটা না একটা চাকরি হবেই। কী অদ্ভুত জীবন চলছে এখন রাধিকার। সব ছেড়েছুঁড়ে বাড়িই চলে যাবে বরং, পড়াশোনা করে কাজ নেই। দিন কে দিন অপমান বেড়েই চলেছে। একমাত্র সুমেধা ম্যাডাম আছেন, যাঁর সঙ্গে রাধিকা মন খুলে মিশতে পারে।

আজ রাতে আবার রাধিকা জেগে মেঝেতে বসে আছে। ওরা কিছুতেই ঘুমোতে দিল না। সে আজ হোস্টেলের পাহারাদার৷ সাঁওতালরা নাকি রাত জেগে নাচ-গান করে। তাই ওকেও জেগে থাকতে হবে। তবু নাচ-গান তো করতে হবে না, তাই নাকি যথেষ্ট। আজ আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারবে না সে সারারাত। করলেই নতুন কোনো শাস্তি। ওকে পাহারার জন্য সেই ঘরেই রুমেলা ও আরও দুজন মেয়ে মিলে সিনেমা দেখছে। ওরা বলে ফার্স্ট ইয়ারে তো এটুকু রিগিং হবেই। কিন্তু রাধিকা জানে, সে সাঁওতাল বলেই এত অপমান!

পর্ব-চার

দেখতে দেখতে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষার দিন চলে এল। ইতোমধ্যে সুমেধার কাছে অনেক সহজ হয়েছে রাধিকা। পড়াশোনাতেও মন দিয়েছে মেয়েটা। ওর কাছে সুমেধা শুনেছে, ছোট থেকেই কলকাতায় পড়াশোনা করার স্বপ্নকে, নিজে শিক্ষকতা করার স্বপ্নকে বুকের মধ্যে লালন করেছে রাধিকা।

রাধিকারা দুই ভাই-বোন। ভাই ছোট। ওর বাবা, একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। মা গৃহবধূ। যদিও মা বাড়িতে ঠিক বসে থাকেন না। বেতের কাজ করেন, বাড়িতে সব্জি বাগান করেন। ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। রাধিকা উচ্চমাধ্যমিকে রীতিমতো লেটার পেয়ে কলকাতার এই কলেজে চান্স পেয়েছে। ইতিহাস ওর প্রিয় বিষয়, তাই ইতিহাসেই অনার্স নিয়েছে। কস্মিনকালেও ওদের বাড়ির কেউ ইঁদুর খায় নি।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে এসেছিল। কলকাতায় এসে ওর স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে। হোস্টেলে দিনের পর দিন রিগিং, ও সাঁওতাল বলে ওকে নিয়ে মজা করা, খাওয়ার সময় বিরক্ত করা, রাতে ঘুমোতে না দেওয়া এমনকী পড়তে বসলেও বারবার নানা ছুতোয় বাধা দেওয়া-এসব নৈমিত্তিক জীবন হয়ে উঠেছিল ওর।

আবার, কলেজে কোনোভাবেই কেউ সাহায্য কর‍ত না, প্রত্যেকটা ক্লাসেই বন্ধুরা বিদ্রুপ করে। দিনে দিনে ও ভেঙে পড়ছিল। তবু বাড়িতে কিছু জানাচ্ছিল না। ভেবেছিল চলে যাবে সব ছেড়ে। এমন সময় ম্যাডামকে পাশে পেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল ও।

এতসব গল্প, পড়ার মধ্যে দিয়ে কখন যে সুমেধাও নিজের সব কথা অকপটে বলে ফেলেছিল একদিন।

“আমি বাঙালি না। বিহারের একটা গ্রামের মেয়ে। তার থেকেও বড় ব্যাপার, আমি দলিত জাতির মেয়ে, আমার বাবা ছিল মেথর। বুঝতেই পারছ, আমাকে কতটা স্ট্রাগল করতে হয়েছে! মা মারা গেছিল ছোটতেই। সংসারে শুধু আমি আর বাবা। বাবা চেয়েছিল আমাকে পড়াতে। তাই যেভাবেই হোক, কলকাতায় চলে এসেছিল। থাকতাম একটা বস্তিতে। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি আমি। স্কলারশিপ পেয়েছিলাম বলে কলেজের পড়া শেষ করতে পেরেছিলাম। আর আজ চাকরি করছি। যদিও বাবা আর নেই এখন। আমি একা৷ কিন্তু সবচাইতে বড় কথা হল, এই পড়াশোনার পেছনে শুধু আমার মেধা বা জেদ নেই, এরজন্য আমাকে আত্মসম্মানও খোওয়াতে হয়েছে।”

রাধিকা অবাক হয়ে গিয়েছিল সুমেধার কথা শুনে।

সুমেধার যেন বাঁধ ভেঙে গেছে। রাধিকাকে সবই বলবে আজ।

“বি.এ. ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই গোটা ক্লাস একসাথে রব তুলল আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। মেথর জাতির মেয়ে আর পড়তে পারবে না। এদের মধ্যে কেউ কেউ কলেজে ইউনিয়নও করত। আমি আমাদের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে বসতে বলে বলতে লাগলেন,

-‘ক্লাসে সবাই যা বলছে, আমি একা কী করে প্রতিবাদ করব তার?’

-‘এ কী বলছেন স্যার? সারাবছর আমি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম, এখন পরীক্ষা দিতে পারব না? আমি তো কারও টাকায় পড়ছি না বা বিনা পয়সাতেও পড়ছি না!’

-‘সবই বুঝলাম। কিন্তু…..’

-‘কিছু করুন স্যার! এ তো অন্যায়!’

-‘ঠিক আছে। এর একটা সমাধান হতে পারে। যদি তুমি রাজি হও তবেই বলব। কিন্তু এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না।’

-‘বলুন স্যার… কত টাকা লাগবে? আমি যেভাবেই হোক জোগাড় করে এনে দেব।’

-‘টাকা লাগবে না। কিন্তু একটা ঝুঁকির কাজ আছে৷ পারবে করতে?’

-‘হ্যাঁ স্যার। সব পারব।’

-‘আমার বংশধর দরকার। পারবে এনে দিতে?’

আমি চমকে উঠেছিলাম সেদিন। ভাবতেও পারি নি একজন সম্মাননীয় প্রফেসর এভাবে কিছু বলতে পারেন? আমি রাগে-ক্ষোভে থরথরপ করে কাঁপছিলাম তখন। কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না। অথচ উনি একমনে বলে যাচ্ছিলেন,

-‘আমার একমাত্র ছেলে পাগল। ভেবেছিলাম বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে দিলাম। ঠিক তো হলই না, উল্টে ছেলের বৌ পালিয়ে গেল। এখন আমার এমন একজনকে দরকার, যে অন্তত পাগল ছেলের সঙ্গে থেকেই এনে দিতে পারবে বংশধর। আমি কাউকে খুঁজে পেলাম না৷ তুমি আমার জন্যে এটুকু করে দাও, বদলে পরীক্ষায় বসার গ্যারান্টি আমার। আবার কিছু টাকাও দেব। চিন্তা কোরো না।’

-‘স্যার! আপনি আমার দুর্বল অবস্থার এতবড় সুযোগ নিতে চাইছেন? আমি তো কোনো অনুদান চাই নি! আমার যোগ্য সম্মান চেয়েছি। স্কলারশিপে পড়াশোনা করেও পরীক্ষায় বসতে না পারছি না। এ তো চূড়ান্ত অপমান! আর আপনি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন! আমি প্রিন্সিপালের কাছে যাব।’

-‘ সে যেতে পারো। কিন্তু উনিও কিছু করতে পারবেন না এই ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। এর একটাই সমাধান আছে, ভেবে দেখো… কাল জানিয়ে দিও আমাকে।’

আমি কোনোরকমে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম স্যারের ঘর থেকে। কিন্তু অবশেষে রাজিও হয়েছিলাম পড়াশোনা করে এর উত্তর দেওয়ার জন্য।”

সুমেধা থামতেই রাধিকা বলে উঠল,

-“আপনি শেষ পর্যন্ত একটা পাগলের সঙ্গে….?”

-“না। সেরকম কিছু হয় নি। সরোগেট মাদার বোঝো?”

রাধিকা সায় দিতেই সুমেধা বলল,

-“আমি ছিলাম সরোগেট মাদার। পরীক্ষার পর একবছর গ্যাপ দিয়ে বাচ্চাটার জন্ম দিয়ে এম.এ.তে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে বাচ্চাটার জন্ম দিয়েই আমি ওদের হাতে দিয়ে দিই, আর ফিরে আসি পড়াশোনায়। কখনও ঘুরেও তাকাই নি।”

-“এখন বাচ্চাটা কোথায় ম্যাডাম?”

সুমেধা হেসে বলল,

-” সে আর নেই। খবর পেয়েছিলাম, ওর পাগল বাবাই একদিন ওকে মেরে ফেলে। স্যারের বংশের ওখানেই ইতি। কিছুদিন পর এই কলেজেই চাকরি পাই আমি। ওই স্যার তখন রিটায়ার্ড করার মুখে। আমার সাথে লজ্জায় কখনও কথা বলেন নি।”

সুমেধা আরও বলে,

“তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তুমিও আমার মতো বঞ্চনার শিকার। কারণ তোমার চোখের দৃষ্টিই সেটা বলে দিয়েছিল। একদিন আমিও ওইভাবেই জগৎটাকে দেখতাম। তবু আমি লড়েছিলাম। কিন্তু তুমি হেরে যাচ্ছিলে। আমি সেটা হতে দিতে পারতাম না।”

রাধিকা আপ্লুত হয়ে ওঠে।

পরীক্ষার ঠিক দু’দিন আগে রাধিকা আসবে বলেও আসে না। এমনকী ফোনেও খবর দেয় না। সারা সকাল বসে বসে অবশেষে সুমেধা নিজেই ফোন করে। ফোন ধরে এক অচেনা পুরুষের গলা ভেসে ওঠে,

-“হ্যালো, কে বলছেন?”

-“আমি রাধিকার প্রফেসর বলছি। ও কোথায়?”

-“ম্যাডাম, আমি দমদম থানার ইনচার্জ বলছি। রাধিকা এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে।”

সুমেধা হতবাক! রাতারাতি কী হয়ে গেল?

-“কেন? কী হল ওর? কোথায় ভর্তি ও?”

-“পিজিতে ভর্তি। স্যুইসাইড কেস ম্যাডাম।”

সুমেধা এক মুহূর্ত দেরি না করে কোনোরকমে চেঞ্জ করে দ্রুত বেরিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশে।

পর্ব-পাঁচ

আজ দু’দিন বাদে রাধিকার জ্ঞান ফিরল৷ কীটনাশক খেয়েছিল অনেকটা। এ যাত্রা খুব জোর বেঁচেছে বেচারী। সুমেধা সবই শুনেছে হোস্টেল সুপারের কাছে। সুমেধা ঘরে ঢুকতেই রাধিকা সুমেধাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠল,

-“আর সহ্য করতে পারি নি ম্যাডাম। সাঁওতাল মেয়েরা কেমন দেখতে হয়, এইটা জানার জন্য ওরা আমার জামাকাপড় খুলে দেয়। আমাকে দিয়ে জোর করে একটা ইঁদুর কাটিয়ে সেটা রান্না করে আমাকে খেতে বাধ্য করায় ম্যাডাম! আমি আর পারলাম না ম্যাডাম, হেরে গেলাম ম্যাডাম! সাঁওতাল মেয়েরা কলকাতায় পড়তে পারবে না ম্যাডাম! আর কেউ পড়বে না। আমি কাউকে পড়তে বলব না। এত নোংরা এই ভদ্র মানুষগুলো?”

সুমেধা রাধিকার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,

“ভুল করছিস। সবাই মোটেই বাজে না। তোর ওই হোস্টেল সুপার নিজে সাক্ষী হয়ে ওই মেয়েগুলোর বিরুদ্ধে কেস ঠুকেছেন। উনি কি নোংরা? না অভদ্র?

আর এই ধরণের কিছু ভালো মানুষের কথা ভেবেই তোকে লড়তে হবে রাধিকা! জীবন এক ঝটকায় শেষ করলেই কি নোংরামানুষী ঠিক হবে? না, তোকে এগিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে! ওই দেখ দরজার বাইরে। তোকে দেখার জন্য তোর পুরো ক্লাস এসেছে। ওরা বুঝেছে জানিস, যে তুইও একটা সাধারণ মানুষ, ওদেরই মতো। একই রঙের রক্ত শরীরে। শুধু তুই নামে সাঁওতাল আর ওরা জেনারেল কাস্ট। ওরা সব ক্ষমা চাইতে এসেছে তোর কাছে। তাছাড়া, মা-বাবা-ভাই আছে যে তোর? ওদের কী হবে? তুই শেষ হয়ে যাওয়া মানে তো ওরাও শেষ হওয়া, ওদের সম্মান রাখবি না? ওরাও তো অপেক্ষা করে আছে তোর মাধ্যমে সমাজে মাথা উঁচু করার জন্য। তুই এগিয়ে যাবি, আমরা সবাই তোর পাশে আছি।”

রাধিকার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ছে। সব রাত্রির পরেই নতুন ভোর আসে।

Facebook Comments

1 thought on “ভোর : ঋতুপর্ণা Leave a comment

  1. খুব ভালো লাগলো, রিনি। শেষটায় চোখে জল চলে এসেছিল।

Leave a Reply