না-আধুনিকতা : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
জেব্রাদাগটি মেনেই পথ চলতে হয়।পারাপারের সেটাই নিয়ম। ভুল হল বোধহয়। জেব্রার সফেদ শরীরে তো কালচে তুলিদাগ থাকে। কিন্তু এ যে একশো আশি ডিগ্রি ভিন্নতা! কালো শিরদাঁড়াময় শক্তপোক্ত শরীরে সাদা মানুষের বোঝা বওয়ার অগুনতি প্রলেপ। দু-হাজার বিশেও কি তার অন্যথা হয়? শ্বাসরুদ্ধ ফ্লয়েডের অটপসি রিপোর্টটি ঘনঘন মাথা নাড়ছে, হল্লা বলছে—‘উহুঁ,অন্তত—আমেরিকাতে নয়’। হে সুমহান তত্ত্ব-প্রবক্তাগণ—হে হেবারমাস-হে ফুকো-হে ফুকিয়ামা—এ কেমন আধুনিকতা? এই আধুনিকতা কি পোস্ট-মিডিয়াভ্যাল>মোর মিডিয়াভ্যাল, উন্নততর মধ্যযুগীয় নয়? এ কেমন সংবিত্তি? স্বাধীনতা কি কেবলই সৌধমাত্র আজ?
অর্থাৎ, এ নিবন্ধের বিষয়বস্তু হল এক অতি সামান্য ধারণামাত্র যে—আধুনিকতারও দ্বিত্ব-দোগলাপন-টানাপোড়েন রয়েছে। অতএব, তার দ্বিধা-দ্বব্দ্ব-দ্বৈবিধ্যও নিশ্চয়ই থাকবে এবং আ-বিশ্ব পরীক্ষাগা্রগুলোয় সেগুলো ছানবিনের আওতাভুক্ত হবে। দুনিয়া জুড়ে তাবড়–তাবড় সব তাত্ত্বিকেরা এই একরত্তি কিন্তু অগাধ সম্ভাবনাসম্পন্ন কয়েনেজটি নিয়ে এখন (তর্ক)-মল্লযুদ্ধরত। ‘আধুনিকতা’-র বিরুদ্ধে কথাবাত্রা চালাচ্ছেন কেউ, কারো বোধবুদ্ধিতে ধরা পড়েছে ‘আধুনিকতার অনেকত্ব’ ওর্ফে ‘মাল্টিপল মর্ডানিটিজ’। কেউ হয়তো আধুনিকতার ইন্তকাল হেঁকে লিখে রেখেছেন—আধুনিকতা তো হদ্দ পুরোনো! এসময় ‘উত্তর-আধুনিকতা’-র! পক্ষান্তরে, হেবারমাসীয় “আনফিনিশড প্রোজেক্ট অব মর্ডানিটি’-র হাল-হকিকতে আধুনিকতা এখনো, বহাল তবিয়তে, স্পন্দমান—একটি প্রকল্প। সুতরাং,বিভেদ-বিভাজনের এমন এক সুস্পষ্ট ফাটলে পা রেখেই প্রবেশ করব ‘অ-না-ধুনিকতা’-র অন্দরমহলে ।
বাড়ছে বুদ্ধিবৃত্তি। কমছে যুক্তিগ্রাহ্যতা। মার্টিন লুথার কিং-য়ের গতশতকীয় প্রশ্ন ভাসছে হাওয়ায়—‘হোয়ার ডু উই গো ফ্রম হিয়ার’। ফ্র্যাঙ্কলি—‘বিয়িং হিউম্যান’-য়ে অ্যাত্তো গরমিল-গাঁজাখুরি, যে ‘মর্ডানিটি’র ‘সবরকমের বিভেদ-বিভাজন-বিদ্বেষব্যবস্থা ও তার বিষাক্ততার দাখিলা তো দূর, শুধু লিস্টি টাঙ্গাতেই ২৫০০ শব্দের স্পেস-লিমিট ফুড়ুৎ হয়ে যাবে।। তাই, ফুলেফুলে ঢলে পড়া মধুবায়ের মতোন বিষয়গুলোর বুড়ি ছুঁয়ে যাবো কেবল—শুধু এতটুকু আশা—নেমে আসে যদি কোনো অনুভববেদ্য ছায়ার ঔজ্জ্বল্য…যুবতি ফুলের গর্ভসঞ্চারে টেস্ট-টিউব শিশুর সফল সূচনা হয় যেমন প্রজাপতির প্রযত্নে…
সাদা আর কালো-কে পাশাপাশি রাখলেই কি ওরা ক্যাচাল বাঁধায়? অথচ দুখের পাশে সুখকে টাঙ্গিয়ে রাখতে দরকার কেবলমাত্র একটি খুদে হাইফেন। ‘আদি’-কে ওভাবেই অনন্ত উপহার দেওয়া যেতে পা্রে; আধা সেন্টিমিটার লম্বা বেঁটে-খাটো চেহারার মধ্যস্থতা, ব্যস—হাইফেন-যুক্তির অ্যাডেসিভে সহাবস্থানে রাজি সবকটি মেড ফর ইচ আদার জুড়ি: সাদা-কালো, পাপ-পুণ্য, উচ্চ-নীচ, ছোটো-বড়ো, বিবর্ণ-রঙ্গিন, কেন্দ্র-পরিধি, ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার, অগ্র-পশ্চাৎ, ইত্যাদি-প্রভৃতি হাজির সবাই, সব-বাই: মোনালিসার গহীন হাসি থেকে শেয়ালের রংঢং-ধুর্তামি, মুচকি মুখ-ব্যাদান। তখন—বক্রী সরলরেখায় ঘেরা মনে হয় কি তাবৎ বৃত্তভূমি?
৬০-৭০ বছর আগে ‘আধুনিক’ কথার অর্থ ছিল ইতিবাচকতা, প্রযুক্তিবিদ্যার প্রগতি ও কারিগরি উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক-বৌদ্ধিক বিকাশ। আর তারই পাশাপাশি ‘দ্বি-বিশ্ব’ সামাজিকতা-পরিণামদর্শিতার যৌথতা কিংবা প্রত্যয়বদ্ধ দূরদর্শিতা—যে অনুষঙ্গে আরো বরফাকীর্ণ হয়ে ওঠেনি ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধ”। আর একবিংশের দ্বিতীয় দশকে আমরা যেন কেমন প্রাচীনপন্থী কু-সংস্কারাচ্ছন্নতা, ধর্মীয় বা নানাধরণের গোঁড়ামি-সংকীর্ণতার চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ছি, অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ হাঁটছি। হাল এমন যে “মধ্যযুগীয়” অভিধাটি শব্দটি এখন স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা যেতেই পারে আমাদের ক্ষেত্রে। আধুনিকতাকে অনুভব করার জন্য তো সবচেয়ে সহজ পন্থা হল অতীতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ১) সামাজিক উন্নয়ন এবং ২) অর্থনৈতিক প্রগতির—মূল্যায়ন, তুলনাত্মক বিশ্লেষণ। প্রথম মানুষের সমস্যা ছিল শিরদাঁড়া সোজা রেখে আগামীর মোকাবিলা। পক্ষান্তরে,বিজ্ঞানের অকল্পনীয়-অভাবনীয় উদ্ভাবনী শক্তির দৌলতে উনিশ-বিশ-একুশের পৃথিবী যেন বস্তুবিশ্বের অবাধ প্রদর্শন-স্থল হয়ে উঠল। আর এই অভিনবত্বের সঙ্গে নিজেদের মানানসই করে তুলতেই নানাবিধ আইন-রীতিনীতি-ডু’জ অ্যান্ড ডোন্ট’সের সুচারু ও সফল প্রয়োগের মাধ্যমে সুসংস্কৃত-নিয়মানুবর্তী-শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছি আমরা। (১৯৪৫ উত্তরকালে!) মানবিকতার সুসংহতির কল্যাণে কোনো বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি। চাঁদের এই পিঠটা আমরা খুব ভালোভাবেই চিনি। আর এই করোনা-বাজারে তো রোজই চন্দ্র-কলার হ্রাস-বৃদ্ধিটি নজরে পড়ছে। সবাই বলে চাঁদের উল্টোপিঠটা নাকি দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। কিন্তু চাঁদ তো কয়েক লক্ষ মাইলের ব্যাপার! আমাদের ‘অন্য-মন’কেই কি আমরা কখনো দেখেছি, জেনেছি, চিনেছি? কেন এখনো তার অমুচ্য অমাবস্যায় একধামা ‘মানবিকতার’ কলঙ্কহীন জ্যোৎস্না বেচে আসতে পারছি না? অথচ—আমরা একুশশতকীয়, আমরা অত্যাধুনিক! কি অনায়াস আতিশয্যে আমরা যুদ্ধ কিনছি, যুদ্ধে বাঁচছি। কেন এতো অস্ত্র-বিক্রি? কেন এই অস্ত্র-আণবিকতা? সাপ্লায়ার প্রথম বিশ্ব। খরিদ্দার—‘গরিব’ এশিয়া-আফ্রিকার একশো ষাট-বাষট্টিটা দেশ, যারা—‘অল দ্যাট ইজ সলিড মেল্টস ইন্টু এয়ার’ বইয়ের লেখক মার্শাল বেরম্যানের ভাষায়—চোখে ঠুলি বাঁধা (গান্ধারীপ্রতিম)অনুরাগে ‘প্রগতি’র পরাকাষ্ঠা ইওরোপ-আমেরিকার প্রশ্নহীন অনুসরণকামী। ‘ডিস-আর্মামেন্ট’ চলছে আর তারই লাগোয়া (তৃতীয় বিশ্বেই প্রধানত) অ-বাধ “রি-আর্মামেন্ট’; কেন এই প্রস্তরযুগীয় দোগলাপন-দ্বিচারিতা ?
আদতে, মাস্ক পরে আছি দুনিয়াসুদ্ধ সবাই! এমন এক এক মাস্ক, যা আমাদের দৃষ্টিশক্তি, বোধবুদ্ধিকেই ঢেকে ফেলেছে। আমরা গ্রস্ত, গ্রহণ-গ্রন্থিত। প্রতিনিয়তই—এই মুখোশ, থুড়ি, মাক্স খুলে ফেলতে চাই। কিন্তু পরে থাকতে হয় যে। অতিমারী থেকে বাঁচার নাকি সেটাই সহজতম নুশকা। তাই,পনেরো শতক থেকে চালু হয়েছিল কোয়ারান্টাইন বা সঙ্গরোধ; অর্থাৎ, দুজন মানুষের স্বাভাবিক আদান-প্রদান, যোগাযোগ, দেওয়া-নেওয়ার মাঝখানে বসানো হল “সামাজিক” দেওয়াল-আড়াল-নিষেধাজ্ঞা। উপলক্ষ্য প্লেগ। কিন্তু ‘কোয়ারান্টাইন’-ব্যবস্থা যে ঢের ঢের পুরোনো। অনাধুনিকতার প্রথম লগ্ন থেকেই পৃথিবী তো দুটি গোলার্ধে বিভক্ত। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের কোথাও উচ্চবিত্তের ছায়া মাড়াতে পারত না গরিব, নিম্নবিত্ত। আর ভারী মজার ব্যাপার হল খ্রিস্টীয় আঠেরো-উনিশ থেকে সভ্যতার ওই জাতীয় আর্থ-সামাজিক ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হল খুল্লমখুল্লা রাজনৈতিকতা। অর্থাৎ, আধুনিকতার ফুল সার্কল, একটি নিটোল যুক্তি-তর্ক-গপ্পো বৃত্ত। প্রতিস্পর্ধী হয়ে হাজির দ্বিতীয় বিশ্ব। আর তার একপাশে—তেঁতুল-সুজনের মতোন অপচ্ছায়া হয়ে হাজির দড়ির খাটিয়ায় আধশোয়া “জী-হুজুর” তৃতীয়-বিশ্ব, যারা—বেরম্যান বলছেন—সেইসব সুযোগসুবিধাগুলো (অর্থাৎ,আধুনিক যন্ত্রসভ্যতাসৃষ্ট এয়ারকণ্ডিশন-টিভি-এরোপ্লেন-কম্প্যুটার প্রভৃতি)আত্মস্থ করেত আগ্রহী। (কিছুদিন আগে সোভিয়েত মানুষেরাও নাকি ওগুলোই চেয়েছিল)। অর্থ হয়,আধুনিকতা ওর্ফে জ্ঞান-বিজ্ঞান-নীতি-যুক্তি-আইন-সুচেতনার সবই ভূমিষ্ঠ হল প্রথম বিশ্বে। বাকিরা কপিক্যাট। টেকনোলজিকাল লিবারেশন পছন্দের ব্যাপার নিশ্চিতই; কিন্তু মানবিক-সামাজিক ‘স্বাধীনতা’-র বিষয়টি কি অছুৎ-ই থেকে যাবে? রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে এইসব “ব্ল্যাকস্”-রা কি “পরিযায়ী’ শ্রেণিভুক্ত ? এইসব এক-তৃতীয়াংশের জন্য ভারতে স্বাস্থ্যবীমা নেই, খাদ্য নেই, অধিকার নেই—এই নেই-য়ের সীমানা নেই। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত (এরিক ফ্রম বলেছেন—“রোবোটিক”) ধনব্যবস্থায় কেলেকুলোদের ‘সামাজিক’ স্বাধী্নতা-সাম্য নেই। শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, মার্কিনি বিপ্লব, বলশেভিক-চীনা বিপ্লব: ইক্যুয়ালিটি—ইন দি আই অব দি ল’? ছোঃ! the “separate but equal” doctrine. নামে একটা আইন ছিল, আমেরিকায়—কালো চামড়ার (অ)মানুষদের জন্য, এই সেদিনও, (সেপারেট বাট ইক্যুয়াল/পৃথক কিন্তু একীভূত,সমান!!! সে বস্তুটো কী? ‘সোনার পাথর বাটি’? পরবর্তী Civil Rights Act of 1964-এর মাধ্যমে সেই এমপ্লয়মেন্ট সংক্রান্ত বৈষ্যমের বিলোপ ঘটানো হয়। মার্টিন লুথার কিং-য়ের প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল জর্জ ফ্লয়েডের ওপর চাপানো শাদামনিষ স্বরূপ দুহাজার বিষে-র বার্ডেন-বোঝায়! এখন তার গালভরা নাম = সিম্বলিক রেসিজম বা প্রতীকী বর্ণবাদ। মর্ডানিটি অব টেকনোলজি থেকে মর্ডানিটি অব লিবারেশন-য়ে উত্তরণ ঘটবে কবে? হে ডারউইনিয়ান শাখামৃগ—২৩১ বছর অতিক্রান্ত ফরাসি বিপ্লবের হাঃ—সাম্য তবুও এখনো ভোরে দেখা মিষ্টি ‘স্বপ্ন’ !
‘দি এম্পায়ার রাইটস ব্যাক”। ইয়েস—দে মাস্ট—বাট উইথ আউট ভেঞ্জিয়ান্স! দীপেশ চক্রবর্তীর ‘মনোরথের ঠিকানা’-য় মার্শাল বেরম্যান-এর ‘all that is solid melts into air’ বইয়ের উল্লেখ রয়েছে।একই বইয়ের উল্লেখ করেছেন সঞ্জয় শেঠ, ডি কুমার প্রমুখ আরো অনেক তাত্ত্বিক। ভারী জবরদস্ত কয়টি কথা বলেছেন বেরম্যান। প্রশ্ন তুলেছেন যে আধুনিকতার ধাক্কায় সবধরনেরই নিরেট বস্তুপুঞ্জ তো ঝলসে-দগ্ধে-উড়ে-পুড়ে বায়ু-লীন হয়ে চলেছে, (অল দ্যাট ইজ সলিড মেল্টস ইন্টু এয়ার), সুতরাং, ’communism too might be a fleeting moment rather than a culmination and a resting place। ‘মহা আহ্লাদে, বেরম্যান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আধুনিকতা হল এক আ-বিশ্ব প্রয়োগ-প্রয়াস। কিন্তু প্রয়োগের মাত্রাটি সর্বত্র সমান নয়। প্রায় ২০০ বছর আগে, ইওরোপ-আমেরিকায় আধুনিকতার জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। ভূ-বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলগুলো, এই এখন, গর্ভযন্ত্রণা কাটিয়ে উঠে আধুনিকতা প্রসব করছে। উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। Berman লিখেছেন—19th century Russia as an archetype of the emerging nineteenth-century Third world’। অর্থাৎ, আজকের তৃতীয় বিশ্বের ডিট্টোকপি ছিল ঊনবিংশের রাশিয়া। সেক্ষেত্রে তো স্ট্যালিনিস্ট/লেনিনিস্ট সোভিয়েত সাম্যবাদও আধুনিক সভ্যতারই অঙ্গসম্ভূত। অর্থনীতিবিদ ইম্যানুয়েল ওয়ালারস্টেইন আর তাঁর সহগামীরা যদিও মনে করেন যে ধনবাদের উত্থান কেবল ইওরোপেই ঘটেনি, বরং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন এলাকার কাঠামোগত আন্তঃসংযোগের মাধ্যমেই ঘটেছে। একধাপ এগিয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ল্যারি রে লিখেছেন যে আধুনিকতার জন্য সংগ্রামের নতুন ভূখণ্ড খুলে দিয়েছে পোস্ট-কম্যুনিজম। দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন ল্যারি। ১) কম্যুনিজম ছিল আধুনিকতার এপিটোম বা চূড়ান্ত নিদর্শন। ২)কম্যুনিজমের বিপদ হলে তা আধুনিকতার পক্ষেও সম্ভাব্য বিপদের কারণ হতে পারে। ল্যারি-র উদ্ধৃতিটির সূত্রে তো একটা প্রশ্ন জাগে—তাহলে তো কম্যুনিজমের মৃত্যু-র অর্থ হয়—আধুনিকতারও পরিসমাপ্তি—যেহেতু এ দুয়ের মধ্যে “ঐচ্ছিক নৈকট্য’ ছিল।কিন্তু এ প্রসঙ্গ বারান্তরে,যদিও পোস্টমর্ডান দুনিয়া, তার বিশ্বায়ন, তার আধুনিকতা নিয়ে গাদা-গুচ্ছের প্রশ্ন তুলেছেন ল্যাঙ্কাস্টার য়ুনিভার্সিটির ল্যারি রে। দুচ্ছাই, সাম্য-স্বাধীনতা তো মঙ্গল-গ্রহের মোঙ্গল-কাব্য এখন; হে আধুনিকতা, ন্যুনতম ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের’ অস্তিত্বও যে মাল্লা-ললিত-নীরব-মেহুল, আপাতত !
“আনফিনিশড প্রোজেক্ট অব মর্ডানিটি’-তে হেবারমাস বলছেন আধুনিকতা হল ‘আত্মিক উন্নতির সিঁড়ি’। আর সেই সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপ, নিজ নিজ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী, দখল করে রয়েছে (আ-বিশ্ব) বিভিন্ন সমাজ, সমাজ-ব্যবস্থা।এটুক পড়েই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছা হয় যে মানবিক প্রগতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে নিশ্চিতই রয়েছে এয়ুগের মার্কিন সমাজ! সেক্ষেত্রে—বহুজাতি-বহুবর্ণ-গোত্র অধ্যুষিত এসময়ের আমেরিকা তবে সেই ল্যাডারের কতো নম্বরে থিতু? অত্যাধুনিক হিসাবে সর্বোচ্চ স্তরে কি? প্রি-মর্ডান সোসাইটি কি তবে নিন্দনীয়? ধনবাদের উৎপত্তি-স্থল অত্যাধুনিক লন্ডন–আমেরিকায় কেন জাতিবাদ, নিন্দনীয় ছুত-অছুত ! সেই বিচারে দলিতবাদের ভারত-ভূমির স্থান কি (করনাসদৃশ) আমেরিকার অব্যবহিত পরেই? টিভিতে প্রিমিয়ার লিগের প্রতিটি ম্যাচের আগে (হাঁটুমুড়ে) ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ অনুশীলিত হচ্ছে! অর্থাৎ, আধুনিকতম ধনবাদী বিশ্বে কী অদ্ভুত অনাসৃষ্টি! আমেরিকায় কালো মানুষ পদদলিত হচ্ছে, লন্ডনে সামূহিক প্রতিবাদ চলছে। কলম্বাসের মূর্তি ধ্বসে পড়ছে; (উইকিপিডিয়ায় তার বিশাল লিস্টি ঠুসে দেওয়া হয়েছে) কিন্তু ক্রীতদাসত্বের লাঞ্ছনা থেকে, হে হেবারমাস, মর্ডানিটি’-র “আনফিনিশড প্রোজেক্ট-য়ে মানসিক-বাস্তবিক-ব্যবহারিক মুক্তি ঘটেছে কি? অক্সফোর্ড বলছে ভাইরাস ল্যাবে তৈরি করা যায় না। ম্যারিকান সংবাদ জানাচ্ছে উহান-এর ল্যাব থেকেই নাকি করোনা বিশ্বব্যাপী বিস্তার পেয়েছে! হায়,আধুনিকতা ! এই দুই মন্তব্যের অন্তত একটি তো অন্তত, ‘মধ্যযুগীয়’ নিশ্চিত।
আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল আধুনিকতা কি তবে একগুচ্ছ অর্থনৈতিক-সাংগঠনিক-ভোগবাদী আয়োজন? সামাজিক বিশ্বাস-আচারবিচারের ভুমিকাটি তবে কী বা কীরকম? আধুনিকতায় সামাজিক র্যাডিক্যালিটি কোথায়? আর যাই হোক মানুষ, প্রথমত এবং প্রথামত, একটি ‘সমাজবদ্ধ’ অস্তিত্ব! রুশো-ভলতেয়ার-কান্ট-অ্যাডাম স্মিথ-গোর্কী-টলস্টয়-লক-হবসের বিশাল বিশাল টোমগুলো কি বিলুপ্ত? হে আধুনিকতা—কই আর সেই প্রজ্ঞাপারমিত বুদ্ধিদৃপ্ত র্যাডিক্যাল ব্যাক-আপ? ফুটবলের গত বিশ্বকাপে জাতিবিদ্বেষের অছিলায় জার্মান টিমে থেকেও মাঠে নামার সুযোগ পায়নি মেসুত অজিল আর গুণ্ডোগান। জার্মানি হার গিয়া! তো কেয়া? আসরে হাজির ছিলেন স্বমহিমায় ট্রাম্প-পুটিন এবং জাতিবাদের বিশ্ববিশ্রুত পুজারী, সুন্দরী কোলিন্দা গ্রেবার! জার্মানিতে জাতিবাদ ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে! জার্মানি তো ইওরোপেই। এবং প্রথম বিশ্বে! তবে কেন ‘মর্ডানিটি’ এ্মন বেহাল?
আগেই বলেছি: এই বিভেদ-বিভাজনের জগতটি ভারী সুবিশাল। সুবিস্তৃত। ২৫০০-য় ধরা যাবে না। বিষয়টি প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়ের আর্থ-সামাজিকতার জীবন-জিজ্ঞাসা নয়! হিটলারের সময়েও সাধারণ মানুষের চাহিদা-আকাঙ্খাকে এমন জাতিবাদের পোশাক পরানো হয়েছিল। মোদ্দাকথা হল গোধুলি-আকাশ দেখা গো-প্রজাতির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে! কিন্তু, ইতি তো কোথাও টানতেই হয়। তাই-
১৮৩১। আমেরিকান বর্ণবৈষম্য-গণতন্ত্র নিয়ে আলেক্সিস ডি টকভিল লিখলেন যে তিনটি জাতির বসবাস আমেরিকায়। সহজেই চিহ্নিত করা যায় এতোই সুস্পষ্ট। কিন্তু দুস্তর এক বাধাবিপত্তি খাড়া করা হয়েছে। নাহ! ১৮৩১-এর নিজস্ব ভাষাতেই শুনি বরং… ‘Almost insurmountable barriers had been raised between them by education and by law, as well as by their origin and outward characteristics;…in contemplating the cause of the present embarrassments or of the future dangers of the United States… I need scarcely add that this calamity is slavery…We are almost inclined to look upon him as a being intermediate between man and the brutes…. The moderns ,then…have three prejudices to contend, against the prejudice of the master, the prejudice of the race and the prejudice of color.’(source-wikipedia) আমি জানিনা টকভিল কথিত ‘মর্ডান’ মহান-মানবসন্তানেরা এসব বাক্য আদৌ চেখে দেখেন কিনা!
আবার লিখি এই উচ্চারণ ১৮৩১-এর! ২০২০-রও বুক কাঁপিয়ে দেয়। এই তো এনলাইটমেন্ট! এই তো আলোকপ্রাপ্তি ! টিভিমুখী জনতা দেখছে হাঁটু গেঁড়ে বসা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’! বাক্যহীন, নীরব, অতি-আনুষ্ঠানিক। হায় আধুনিকতা, তুমি হারিয়ে ফেলেছ তোমার ঠাকুর্দার বাটি-বাতি-উত্তরাধিকার!
২০০৮। আমেরিকাতে ঘটেছিল সত্যিকারের সাদা-কালো বিপ্লব।লিখেছিলাম—
কালো মানুষের হোয়াইট হাউস
রাতভোরের দ্যূত ক্রীড়ায় গতানুগতিক আলোর কাছে
হারতে হারতে হারতে
ধনাঢ্য আঁধার একে একে গড়িয়ে দিতে লাগল
তার লুকানো হিরেগুলো— কৃষ্ণগহ্বরে
ক্রমে দৃশ্য যেন তারার জেব্রাপথ
সপ্তর্ষিমণ্ডলের আলোর ধ্রুবতা অথবা
ছায়াপথের পাহারায় কালপুরুষের নীরব কুকুর,মিশকালো
বনেদি নৈঃশব্দ্য বায়ুশূন্য ঘর থেকে কখন একলাফে
হঠাৎ-ই টর্নাডো,যেভাবে
পুড়েঝুড়ে কৃষ্ণকায় গ্রীষ্মের ঔরসে রজনীগন্ধার নিবিড় শুক্লতা
তার বৃষ্টিসুবাস— মুখচুন বিষন্ন দুপুরের সুস্মিত হাওয়াবদল
যেন সুখের উৎসব, মৌসুমি কাশফুল
ঠিক যেমন কালোরংয়ের মাটিতে সহজেই ফুটে ওঠে ধবল তুলোফুল কিংবা
সাদামাঠা খুশির অধিক যখন জন্মসূত্রেই কালো যে বিষাদ,তার ছায়া
যেন সার সার কালচে অক্ষর থেকে স্বয়ম্ভু স্ফটিক সাদা আলো
নিবিড়পাঠ শেষে—- মনের জোৎস্নাডুরেগুলো লেপা
এক আলকাতরা রং মসৃণ হাইওয়ে, উইণ্ডস্ক্রিনে
পথভ্রান্ত চোখের সামনে
তখন বিরতি সংকেতহীন সুগম দূরত্বের তুমুল সায়োনারা
জল—-যে কোনো চোখের ,কি রং দেবো তাকে—- সাদা না কালো ?
(কবিসম্মেলন-২০০৯)
Posted in: ARTICLE, July 2020 - Cover Story