উনবিংশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ এবং জীবিকা-সাংবাদিকতা : পৃথ্বী সেনগুপ্ত

উনবিংশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ এবং জীবিকা-সাংবাদিকতা

অন্তিম পর্ব 

১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরের মিশনারীরা ‘ফ্রেঞ্চ অব ইণ্ডিয়া’ নামে একটি ইংরেজী মাসিকপত্র প্রকাশ করেন ৷ এখান থেকেই ১৮১৮ সালের এপ্রিলে একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ প্রকাশিত হয় জন মার্শম্যানের সম্পাদনায় ৷ তার মাসখানেকের মধ্যেই ২৩শে মে মার্শম্যানের সম্পাদনায় আরও একটি বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয় ৷ এই সংবাদপত্রটির সম্পাদনায় মার্শম্যান ছাড়াও নিযুক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন বহু নামকরা পণ্ডিত মহাশয়েরা ৷ এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তৎকালীন বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে যে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ রয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চলা সংবাদপত্রটিতে প্রকাশিত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষের চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত মতামতের মধ্য দিয়ে ৷
সংবাদপত্রের প্রতি সাধারণের এই উৎসাহই কলকাতার বিদগ্ধ সমাজের কাছে সংবাদপত্র প্রকাশের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে স্বাভাবিকভাবেই ৷ রামমোহন রায়েরও দৃষ্টি যে এড়ায়নি তার প্রমাণ, তিনি ১৮২১ থেকে ১৮২২ সালের মধ্যে কয়েকমাসের ব্যবধানে প্রকাশ করলেন তিনটি সংবাদপত্র ৷ প্রথমটি দ্বিভাষিক ইংরেজীতে ‘ব্রাহ্মিক্যাল ম্যাগাজীন’ এবং বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’ (সেপ্টেম্বর, ১৮২১) ৷ ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৮২১-এ বাংলায় বেরোল ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ৷ তৃতীয়টি পার্শিয়ান ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১২ই এপ্রিল, ১৮২২) ৷
কিন্তু এই দশকেই বাংলার সংবাদপত্র ইতিহাসে এমন একটি আদর্শ সংবাদপত্র আত্মপ্রকাশ করল যার নাম ‘ক্যালকাট জার্ণাল’ (১৮১৮), সম্পাদনায় জেমস্ সিল্ক বাকিংহাম ৷ এর প্রকাশ যদিও বাংলার সনাতনপন্হী সমাজজীবনে তার কতখানি প্রভাব ফেলেছিল সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারে ৷ কিন্তু একথা সত্যি যে জেমস সিল্ক বাকিংহাম এর ‘ক্যালকাটা জার্ণাল’ বাংলার সংবাদপত্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের আমূল পরিবর্তন ঘটায় ৷ এই ইংরেজী কাগজ সপ্তাহে দু’দিন করে, পরে দৈনিক হিসেবে, সম্পাদকীয় ও সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনে যে নিরপেক্ষতা থাকা প্রয়োজন, তার অন্যতম উদাহরণস্বরুপ তার ভূমিকা পালন করেছিল ৷ শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা নয়, গঠনমূলক সমালোচনা, ইংরেজ সরকারের দুর্নীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতে পিছুপা হননি তিনি ৷ যার মাসুল অবশ্য তাঁকে দিতে হয়েছিলো ৷ রাজরোষে তাঁর ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলো ১৮২৩ সালের ১৫ই এপ্রিলের মধ্যে ৷ বাকিংহাম ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আর্মটকে সংবাদপত্রটি প্রকাশের দায়িত্ব দিয়ে যান ৷ কিন্তু ভীত সন্ত্রস্হ ইংরেজ কোম্পানী আর্মটকেও ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয় ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৮২৩ ৷ ফলস্বরুপ ১০ই নভেম্বর ১৮২৩-এ ‘ক্যালকাটা জার্ণাল’-র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় চিরতরের জন্য ৷
সংবাদপত্রটি বন্ধ হলেও তার ভূমিকা যে রামমোহনকে অনুপ্রাণিত করেছিল তার উদাহরণ ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ ৷ যেখানে তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে মান্যতা দিয়ে যাঁরা বাংলা ভাষা জানতেন না তাদেরকেও, ধর্ম ও সমাজ এর নামে নানা অবিচার আর অনাচার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা থেকে মুক্ত করে, পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিক্ষার ভাল দিকগুলির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ৷ যেহেতু ফারসী তখনও সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিল সেইজন্য ইংরেজ শাসক ও সমাজের কাছে এদেশের প্রকৃত অবস্হা সম্পর্কে তিনি অবহিত করতে চেয়েছিলেন ৷ এই চাওয়ার মধ্যেই ছিল ইংরেজ বণিকের অন্যায় আচরণের ছবি ৷ যার ফলে গভর্ণর জেনারেল পরিষদের অন্যতম সদস্য উইলিয়াম বাটারওয়ার্থ বেইলী, তাঁর রিপোর্টে ‘মিরাৎ-উল-আখবর’-এ প্রকাশিত আপত্তিকর অংশ উদ্ধৃত করার সঙ্গে-সঙ্গে অন্যান্য সংবাদপত্র থেকেও যা সংগৃহীত হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করেই ‘অ্যাডাম রেগুলেশান’ তৈরী করেন ৷ ১৮২৩ সালে তা বিলেতের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয় এবং সুপ্রীম কোর্টে রেজিস্ট্রিকৃত হয় ৷
কিন্তু সংবাপত্রের এই দমননীতি আইনে পরিণত হওয়ার আগে, চন্দ্রকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরচন্দ্র ঘোষ ও গৌরীচরণ বন্দোপাধ্যায় এর দমননীতির বিরুদ্ধে এক আবেদন জানিয়েছিলেন ৷ কিন্তু তা আদালতে গ্রাহ্য না হওয়ায় রামমোহন রায় প্রতিবাদে তাঁর সংবাদপত্র ‘মিরাৎ-উল-আখবর’-এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন এবং ইংল্যাণ্ডের রাজদরবারে আবেদন করেন এই দমননীতি রদ করার জন্য ৷ কিন্তু তাও গৃহীত না হওয়ায় বেদনাহত হয়েও আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ করতে চাইলেন না ৷
১টা সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হলেও রামমোহনের সাংবাদিকতার জগত বন্ধ হয়নি ৷ ‘সংবাদ কৌমুদী’-র প্রকাশ ও উদ্দেশ্য রামমোহন চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রগতিবাদী ও ধর্মসংস্কারের প্রবল তাড়নায়-যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সতীদাহ প্রথা রদ করা ৷ যদিও প্রকাশক হিসেবে ঐ পত্রিকাটি ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ও তাঁরাচাদ দত্ত-র নাম ছিল ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রামমোহন ছিলেন মূল পৃষ্ঠপোষক ৷ প্রথম তেরোটি সংখ্যা প্রকাশের পর ভবানীচরণ ‘সংবাদ কৌমুদী’ ত্যাগ করেন ৷ এবং রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’-র বিরুদ্ধতা করার জন্য ‘ধর্মসভা’ স্হাপন ও কৌমুদীর বিরুদ্ধতা করার জন্য ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন, যার লক্ষ্য ছিল মূলতঃ প্রাচীনপন্হী ভাবধারার পৃষ্ঠপোষকতা ৷ ফলে দুই পরস্পরবিরোধী পত্র-পত্রিকার মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্ম সমাজ সংস্কার নিয়ে বিতর্কের আবহ তৈরী হয়েছিল অবধারিতভাবে ৷
তার সঙ্গে যোগ দিল ডিরোজিও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ তরুণ তুর্কীদের দল ৷ যার অন্যতম সদস্যরা হলো কাশীপ্রসাদ ঘোষ (১৮০৯-১৮৭৩), রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-১৮৫৮), দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (১৮১৪-১৮৭৮), তারাঁচাদ চক্রবর্তী (১৮০৪-১৮৫৫), রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৪), প্যারীচাঁদ মিত্র ও কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী ৷ এরা সবাই ছিলেন হিন্দু স্কুলের ছাত্র ৷ যাঁদের মন পাশ্চাত্য সভ্যতা –সংস্কৃতি, ১৮৩০-এর ফ্রান্সের বিপ্লবের সাফল্যের আবেগে ছিল উল্লসিত ৷ পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ যাদের ধ্যান ও জ্ঞান ৷ এই উগ্রপ্রগতিবাদী মানসিকতা ভারতের সনাতন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সমাজের সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে কলকাতার বাঙালী সমাজে আলোড়ন তুলল ৷ সেই প্রতিবাদ, শৃঙ্খলাহীন অশালীন আচরণ, গো- মাংস ভক্ষণ, অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান প্রভৃতি তাদেরকেই বাঙালী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলল ৷ রামমোহন এগিয়ে এলেন সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে আপনার মত ব্যক্ত করে এই সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য ৷ বের করলেন ‘ব্রাহ্মণ সেবধী’ নামে একটি দ্বিভাষিক পত্রিকা ৷ যেখানে ক্রীশ্চান ধর্মের আগ্রাসী নীতি, ধর্মান্তকরণের অপচেষ্টা, বৃটিশ নীতির কঠোর সমালোচনা প্রকাশ, বিদেশী শাসক ও বণিককূলকে শঙ্কিত করে তুলল ৷ সেই সময় সংবাদপত্র দমন আইন চালু করেও বাংলার সংবাদপত্র প্রকাশের প্রাবল্য প্রতিরোধ করতে পারেনি তার প্রমাণ রয়েছে লর্ড বেন্টিঙ্কের গড়া সংবাদপত্রের তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট (১৮২৮) ৷ যদিও অনেক সংবাদপত্রের আয়ু ছিল স্বল্পকালীন ৷ ছাপাখানা ও মুদ্রণযন্ত্রের অপ্রতুলতায় বাংলার ছোট শহর থেকে প্রকাশিত হতে লাগল হাতে লেখা সংবাদপত্র ৷ সংখ্যা সীমিত হলেও সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় তাদের সাহিত্য ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিফলনের প্রবল প্রয়াসের সূচনা শুরু হয় ৷ এতে একদিকে বাংলাভাষা ও সাংবাদিকতার, সংবাদপত্রের মান-এর উন্নতি হতে শুরু করে ৷ আসলে বাংলা তথা ভারতের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ১৮১৮ থেকে ১৮৩০ সাল হল শৈশবকাল, প্রস্তুতিপর্ব তৎকালীন ইংরেজী শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের, যাঁরা রামমোহনের সান্নিধ্যে এসেছেন ৷ কাছ থেকে দেখেছেন সংবাদপত্রের ভূমিকা, সমাজবদলের ক্ষেত্রে কতখানি সক্রিয় হতে পারে ৷ এটা যেমন একটি দিক, অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায়, করণিকপদে পোস্ট অফিসে ও অন্যান্য সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নানা পদে নির্দিষ্ট ও নিশ্চিন্ত বেতনের চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনায় ইংরেজী শিক্ষার আগ্রহ ও আবহ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা ও বাংলার বড় বড় শহরতলীতে ৷ পরিণতিতে জন্ম দিল এমন এক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যাদের জীবিকা বুদ্ধি নির্ভর আর নিশ্চিন্ত জীবনধারণহেতু বিত্ত নির্ভর হয়ে উঠল- যারা পরিগণিত হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে ৷ স্বাভাবিকভাবেই, এরাই যখন আর্থিক নিরাপত্তার অভাবহীন জীবন-এর অবসরে শিক্ষা-লব্ধ জ্ঞান, বিজ্ঞানসঞ্জাত চিন্তা ভাবনার প্রকাশের তাড়নায় তৎকালীন সমাজব্যবস্হায় হাতের কাছে সহজ অথচ সবল মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রকে পেল তখন তা বেছে নিতে দ্বিধা করলো না ৷ করেনি তার আরও একটি অন্যতম কারণ, ভারতবর্ষে তখনও আর কোনো গণমাধ্যমের উদ্ভব হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি ৷ অথচ পাশ্চাত্য দর্শনের, সাহিত্যের, বিজ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এর দরজা উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে ৷ তরুণ মননে তার প্রভাব, তার চিন্তা-ভাবনা সঞ্জাত নানা প্রশ্ন প্রবলভাবে মথিত করতে শুরু করেছে ৷ ব্যক্ত করার মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রকেই তাই বেছে নিয়েছে ৷ ফলস্বরুপ তরুণ প্রজন্ম তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণী-সমাজ কলমকে একদিকে পেশা করল জীবিকার জন্য, অন্যদিকে নেশায় বুঁদ হলো আত্মিক উপলব্ধির সন্ধানে সমাজের জন্য, সামাজিক বিকাশের জন্য ৷
সেই সমাজ, যে জাতিভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক ও কর্মভিত্তিক শ্রেণী বিভাজনে প্রতিনিয়ত একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে ৷ লড়াই-র ক্ষেত্রভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছে সংবাদপত্রের পাতাকে ৷ হাতিয়ার করেছে নিজস্ব মতাদর্শগত উপলব্ধির নিবিড় অনুশীলনের প্রকাশ ও প্রচার ৷ সেখানে সংবাদপত্রের অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য ৷ সেইসঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমাজ এমন একটি সমাজের জন্ম দিল, যেখানে তৎকালীন সমস্ত বর্ণভিত্তিক বা কর্মভিত্তিক শ্রেণী সমাজকে আত্মস্হ করে ফেলল ৷ শুধু আত্মস্হ করা নয়, বর্ণ ও কর্মভিত্তিক সমাজের পারস্পরিক সংঘাত বাংলার সামাজিক কাঠামোকে মেরুকরুণ করে রেখেছিল, বিভেদের প্রাচীর তৈরী করে রেখেছিল, বৈষম্য ও অবহেলা আর অনাদরের আবহে যা বহুধা বিভক্ত হয়ে উঠেছিল, তা সংবাদপত্রের অঙ্গনে সব ধুয়ে মুছে এক হতে শুরু করল ৷ যদিও সংবাদপত্রের এই পরিধির বাইরে থাকা সমাজে এই বিভাজিত শ্রেণী সমাজের পরস্পর বিরোধী দ্বন্দ যে অব্যাহত ছিল তার উদাহরণও সংবাদপত্রের পাতাতেই রয়েছে ৷
মধ্যবিত্ত নামক এক নব্য শ্রেণীর উদ্ভবের শুরুটা যদি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব হয়, তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ তিনটি পর্বে সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের ধারক ও বাহকের ৷ স্বাভাবিকভাবেই সেই বিকাশের স্বরুপকে জানতে গেলে, চিনতে গেলে সমকালীন সংবাদপত্রেষ মধ্যে নিহিত বিকাশের ধাঁরাকে খুজতে হবে ৷ এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখনীয় যে তৎকালীন বিদেশী শাসনের আর শোষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা, তাই সংবাদপত্রের প্রকাশ ও বিকাশও ছিল মূলতঃ কলকাতাকেন্দ্রিক ৷ ফলে বাংলার প্রাণকেন্দ্রকে ঘিরে বির্বতিত সামাজিক শ্রেণী কাঠামোয়, কলকাতাতেই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ আবর্তিত হয়েছিল সেটি ঐতিহাসিক সত্য ৷ তার অন্যতম উদাহরণ তৎকালীন বাংলা সংবাদপত্রের বহুল প্রকাশ ও প্রচার সংখ্যা ৷ এই প্রসঙ্গে স্যার হেনরী কটন-র ভারতের সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য (‘নিউ ইণ্ডিয়া’,) উল্লেখের দাবী রাখে, “The public opinion of India is moulded in the metropolis, and takes its tone almost entirely from the educated community which centres in the chief towned”. (Page 26) “They look to their educated countrymen for guidance. Calcutta is now more to Bengal then Paris is to France.” (Page 26) “The educated classes are the voice brain of the country. The educated followers of Islam, although they are comperatively few in needer, are aricuasted by the zeal and vigeer and austerity which have always charecterisd the religious history of their race.” (Page 27) “The Babus of engal have done even more. They now rule public opinion from Peshwar to Chittagong.” (Page 28) তাঁর এই উল্লিখিত মন্তব্যের মধ্যে একটি মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে যেখানে তিনি বলছেন, “The educated followers Islam, although they are comperatively few in numbers”. শুধুমাত্র সংখ্যায় অল্প বললেও ঠিক বলা হয় না ৷


এ আলোচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বহুলভাবে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, সবকটি সংবাদপত্রই পরিচালিত হত মূলত হিন্দু সম্পাদক দ্বারাই ৷ অথচ একই সাথে একথাও সত্যি যে, হিন্দু ছাড়াও মুসলমান এবং অন্যান্য শ্রেণীর মানুষজন বহুল পরিমাণে সেইসময় শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনে নয়, উপস্হিত ছিল সমাজের সর্বস্তরে, যাদের প্রভাবও ছিল অত্যন্ত বেশী ৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসতে পারে, মধ্যবিত্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিশেষ করেই মুসলিম সম্পাদক কি সেই সময়ে সাংবাদিকতার কার্যক্ষেত্রে একেবারেই ছিল না? না কি থাকলেও তাদের সক্রিয় কর্মপরিধির জগত এতটাই কম ছিল যে তা পরবর্তী আমাদের সাংবাদিকতা বা ইতিহাস-সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্ত করার মত নয়? না কি অবজ্ঞাসুলভ মানসিতায় ইতিহাসের পাতায় তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে?

তথ্যসূত্র:
১) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (খণ্ড ১) ৷ বিনয় ঘোষ ৷ প্যাপিরাস ৷ ১৯৬৪৷ কলকাতা ৷
২) উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র (১৮৪৭-১৯০৫) ৷ প্রথম খণ্ড ৷ মুনতাসীর মামুন ৷ বাংলা একাডেমী : ঢাকা ৷ ফ্রেবুয়ারী, ১৯৭১ ৷
৩) তারাপদ পাল ৷ ভারতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস (১৭৮০-১৯৪৭) ৷ সাহিত্য সদন ৷ কলকাতা ৷ ১৯৭১ ৷
৪) কলিকাতা দর্পণ (প্রথম খণ্ড) ৷ রাধারমণ মিত্র ৷ সুবর্ণরেখা ৷ কলকাতা ৷ ১৯৮০ ৷
৫) বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা ৷ বিনয় ঘোষ ৷ বুক ক্লাব ৷ কলকাতা ৷ ২০০২ ৷
৬) ভারতের ইতিহাসকথা ৷ তৃতীয় খণ্ডঃআধুনিক যুগ ৷ ডক্টর কিরণচন্দ্র চৌধুরী ৷ মর্ডাণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড ৷ কলকাতা ৷ আগস্ট, ১৯৭৪ ৷
৭) A HISTORY OF THE CALCUTTA PRESS The Beginnings. P. THANKAPPAN NAIR. FIRMA KLM PRIVATE LTD. Calcutta.1987.
৮) THE HISTORY OF BENGAL (1757-1905). Ed. NARENDRA KRISHNA SINHA. UNIVERSITY OF CALCUTTA. CALCUTTA. 1996.
৯) Romance of Indian Journalism. JITENDRA NATH BASU. CALCUTTA UNIVERSITY. CALCUTTA. October’1979.
১০) THE RISE OF CIVILIZATION IN INDIA AND PAKISTAN. BRIDGET and RAYMOND ALLCHIN. CAMBRIDGE UNIVESITY PRESS. New Delhi. 2011. ISBN 978-81-85618-72-2.

(সমাপ্ত)

[লেখক – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত। স্বাধীন লেখক-গবেষক-কলামনিস্ট, গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ইউটিউবার৷]

Facebook Comments

Leave a Reply