বোবা বালকঃ প্রসঙ্গ লোরকা – মানবেন্দ্র সাহা

গভীর রাতে একদিন যাকে ঝড় ভেবে উঠে আসি পৃথিবীর ছাদে, তা নাকি ছিলো আমার স্নায়ুজনিত বিশৃঙ্খলা। যারা একে আমার অসুখ বলে চালিয়ে এসেছে এতদিন, আমি আর তাদের ছায়াও মারায় না। এখনও গভীর রাত্রি। আমার জানালার থেকে কয়েক হাজার ফুট নিচে ওদের পৃথিবী। এসময় পৃথিবীতে ছায়া পড়ে না মানুষের। সুতরাং এখনই ঘুরে আসা যায়। দেখে আসা যায় আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী যারা, তারা এখনও ঘুমের মধ্যে মুঠো বন্ধ রাখে কিনা। এখনও একলব্যের কাটা আঙুল থেকে নির্গত রক্তস্রোত ধুয়ে দিতে পারে কিনা মহাভারতের কালিমা। এখনও কর্ণের নিথর দেহের পাশে কোনো শব্দহীনা নদী কথা বলতে পারে কিনা। এখনই সময়, এখনই তো সময়। এখন ছায়া পড়ে না পৃথিবীতে।

একবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ এরপর বোধহয় ইউটার্ন নিচ্ছে। আসলে ফিরতে তো হয়ই। আসলে ফেরাটাও এক টান। অভিকর্ষ টানের মতই নির্মম। কিন্তু তাই বলে সেই গুহার অন্ধকারে, কিন্তু তাই বলে সেই নৃশংস বর্ণবাদী চক্রব্যুহের মধ্যে আবার! এ কোন অগ্রগতি। এ ইউটার্ন নয় তো কী? সরকারি চাকরি প্রার্থীর শরীরে বর্ণভিত্তিক ছাপ মেরে দেয় রাষ্ট্র। তাতে সহানুভূতির চেয়ে আহ্লাদিতই হই বেশি। স্বাধীনতার সত্তর বছর পড়েও সংরক্ষণের সুবিধা নেবে, তাহলে তো এইটুকুন সহ্য করতেই হবে বাছা। বন্ধ্যা সিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে বর্ণভিত্তিক ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটের বিজ্ঞাপন। কায়স্থ ম্যাট্রিমোনি, ব্রাহ্মণ ম্যাট্রিমোনি। এ বাবা! শূদ্র ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট কোথায়! বাবা সাহেব অনেক আগেই বুঝেছিলেন সমস্যাটা। ব্রাহ্মণরা তো আর কোনদিন ওদের জীন দেবে না শূদ্রদের। ব্রাহ্মণদের জীন, কায়স্থদের জীন এগুলো খুব দামী বস্তু। পশ্চিম থেকে ইমপোর্ট করা। তা তো আর ঐ অসভ্যদের দেওয়া যায়না। সুতরাং সংরক্ষিত হোক। সুতরাং নো শূদ্র ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট। ভাগ্যিস বাবা সাহেব আম্বেদকর একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে গেছিলেন। যাই হোক এ মহাভারতীয় প্যানপ্যানে গল্প থাক। বরং একটা ঝকঝকে বিদেশি গল্প হোক।

আমেরিকান সেনসাস ব্যুরোর ওয়েবসাইটে ‘রেস’ কথার পরিস্কার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও রেস শব্দের কোনো বিজ্ঞানসম্মত স্বীকৃতি নেই, তবু আভিধানিক ভাবে যা অর্থ দাঁড়ায় তা হলো কোনো ব্যক্তিবিশেষকে যে নিজস্ব শারীরিক গঠন, আকার, রঙ, মাতৃভাষা, জন্মপরিচয় ইত্যাদির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা জাতির অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাই সে ব্যক্তির রেস। কিন্তু প্রকৃতি বড় খামখেয়ালি। সে তার খেয়ালে কখনো কখনো ভাঙা দেওয়ালেও একদল ফার্ণের পাশে একটা ফুটফুটে জবা ফুল ফুটিয়ে তোলে। অথবা কখনো কাকের বাসায় সুভাষিণী কোকিলা। কখনো শ্যাম অঙ্গে রাধাভাব তো আবার কখনো রাই অঙ্গে কানু। এ বড় বিচিত্র খেয়াল প্রকৃতির। কিন্তু কেন? বৈচিত্র্য আনার জন্য? সৃষ্টিকর্তা তাঁর একঘেয়েমি কাটানোর জন্য এসব করেন? তাহলে তো ভালো। কিন্ত যে বিচিত্র তার কী লাভ এ বৈচিত্র‍্যে? সে কীভাবে কাটাবে নিজভূমে পরবাসী হয়ে সারাটা জীবন? সে তবে কোন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে? তবে কী হবে তার ‘রেস’? তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে বাকিদের মত করে কাছে টেনে নেবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ভারতে নেই, মহাভারতে নেই, পৃথিবীর কোথাও নেই। কোনোদিনই ছিলোনা। হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন এর উত্তর ঠিক খুঁজে পাবে।

ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। বরাবরের মতই তিনি সবখানে থেকেও যেন কোথাও নেই। সবার সঙ্গে থেকেও যেন ভীষণ একা, ভীষণ আলাদা সবার থেকে। তিনি তো এই নিউইয়র্ক শহরের কেউ নন। তবে কি তিনি কৃষ্ণাঙ্গী কেউ, কিন্তু তিনি তো শুভ্রাঙ্গী। তবে কি তিনি জিপসি? নাকি ঠিকানা হারিয়ে ফেলা নিতান্ত বেমানান দলছুট একজন হিস্পানিক। নাকি তরঙ্গবিভোর এই পৃথিবীতে ভাসতে ভাসতে তীরে লাগা একটা দাঁড়হীন নৌকো।

ডর্মেটরির ভিতর একদল আবাসিকের মধ্যে থেকেও যেন আলাদা লোরকা। তিনি স্পষ্টত দেখছেন নিউইয়র্ক শহরের ঝকঝকে স্থাপত্যের নিচে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে অন্ধকারের ভিতর লুকিয়ে রয়েছে দারিদ্র্য, বর্ণবাদী নৈশব্দ আর নির্মম একাকিত্ব। সেই একাকিত্বকেই, সেই বর্ণবাদকেই তিনি তার বিখ্যাত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সেল্ফ পোট্রের্টএ দেখিয়েছেন। তাছাড়া এই সময়েই তার বিখ্যাত কাজ ‘পোয়েট ইন নিউইয়র্ক’। আর এই দুটি কাজেই ভয়ঙ্কর ভাবে তার কাছে ধরা দেয় সুররিয়েলিজম, যা পরবর্তীতে তার সিগনেচার হয়ে যায়। কিন্তু কোত্থেকে এলো লোরকার জীবনে এই উদাসীন ভাব, এই পরাবাস্তবতার ডানায় ভর করে আদিগন্ত উড়ে চলার তিব্র আকাঙ্খা! সীমাহীন আকাশে নিঃসঙ্গ পালকের মত হাওয়ার খেয়ালে ভেসে চলা! আসলে তার শৈশব সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তাতে স্পষ্ট যে তিনি ছোটবেলা থেকেই আনমনা। আন্দেলুসিয়ার সেই অবিখ্যাত ছোট্ট গ্রাম থেকে তাকে মাত্র সাত আট বছর বয়সে দূরে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রথম তার বাবা মার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। এই প্রথম নিজের চেনা পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কোনো জায়গায় যাওয়া। এই ঘটনাই হয়তো ছোট্ট লোরকার চেতনাকে আহত করে। পড়তে ভালো লাগতো না তার। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে ক্লাসের মধ্যে বসে শিক্ষকদের নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ক্যারিকেচার করতে শুরু করে। মনের সঙ্গে ধীরেধীরে তার শরীরও ভাঙতে থাকে একসময়। সকলের কাছ থেকে ধীরেধীরে সে আলাদা হতে থাকে, আলাদা অন্যরকম। যেন বহিরাগত কেউ। হোস্টেলের বাকি আবাসিকরা যখন মাঠে ফুটবল খেলায় মত্ত থাকতো, ছোট্ট লোরকা তখন সবার থেকে আলাদা, একাকী কোনো নির্জন জায়গায় বসে অনুভব করতো অদূরে কোনো এক জিপসি বস্তি থেকে ভেসে আসা সেরেনাদের সুর। ভীষণ একাত্মবোধ আসে তার সেই মায়াময় সুরের সঙ্গে। যেন অনেকদিনের চেনা। যেন সেও জিপসিদেরই একজন। এদের কেউ না, এদের কেউ না। উদাসীন লোরকা কখনো যেন সেই বোবা বালক। যে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে একটি জলকণার দিকে। সে তার শব্দ খোঁজে জলকণার মধ্যে। তার নিজস্ব শব্দ। সে তার নিজস্ব শব্দ খুঁজে চলে একফোঁটা জলের ভিতর। সেই জলকণায় সে তার নিজস্ব নৈশব্দ মিশিয়ে একটা সুন্দর আঙটি বানাতে চায়। একটা নির্মল নিস্তব্ধ আঙটি যা তাকে কখনো একা একা তার নৈশব্দের কথা বলবে? কিন্তু কাকে বলবে? কে শুনবে? কেউ কি শুনবে তার সে নৈশব্দের কথা। লোরকা জানে না। তাই এসব কথা বলার জন্য লোরকা বেছে নেয় নতুন এক ভাষা। জাদুবস্তবতার ভাষা। যে ভাষায় সবকিছুই বলা হয় অথচ কিছুই যেন বলা হয় না। সময়ের যে নির্মম গতিময়তা তাকে সে কীভাবে অস্বীকার করে! একে তো অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং এভাবেই লোরকা হোস্টেলের শব্দময় নৈশব্দে সারারাত জেগে থাকে সে। কখনো আন্দেলুসিয়ায় কখনো নিউইয়র্কে। আর সারারাত জেগে জেগে সে স্পষ্ট দেখতে পায় এ শহর ঘুমায় না। এ শহরে কেউ ঘুমায় না। শুধু দূরে বহুদূরে কবরস্থানের পাশে একটি মৃতদেহ বিগত তিনবছর ধরে শুধু কেঁদে চলেছে। শুধুই কেঁদে চলেছে। আর একজন স্থুলকায়া নারী যে ছিলো চাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী, সে সারারাত শহরের মল মুত্র উদ্বমনের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে, শুধু হেঁটেই চলে। হেঁটে চলে সেই শবদেহের পাশ দিয়ে, হেঁটে চলে সেই বোবা বালকের পাশ দিয়ে, হেঁটে চলে একলব্যের কাটা আঙুলের পাশ দিয়ে, হেঁটে চলে কর্ণের মুণ্ডহীন ধরের পাশ দিয়ে। আর সে বোবা বালক একা একা শব্দ খুঁজে চলে একফোঁটা জলের ভিতর। একবিন্দু পৃথিবীর ভিতর। তার নিজস্ব শব্দ।

Facebook Comments

Leave a Reply