জাতিরাষ্ট্রের ‘অপর’ জাতি : ইশরাত তানিয়া
আমিত্ব সকলের মধ্যেই আছে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা মানুষের সহজাত প্রবণতা। উপযোগী জল-হাওয়ায় আমিত্বের পুঁতে রাখা বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়। চারা ক্রমাগত বেড়ে ওঠে। সময় প্রবাহে শেকড় গভীর থেকে আরো গভীরে প্রোথিত, ডালপালা আরো বিস্তৃত। আমিত্ব তখন বিশাল মহীরুহে পরিণত।
এই একক আমিত্বের আচ্ছাদনে সৃষ্টি হয় সামষ্টিক প্রভুত্ববোধ। প্রভুত্ববোধ শান্তি আর সমতার বিনাশক। ক্রোধ, লোভ, অহংকার, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভয়ের মতো নেতিবাচক অনুভবের জন্মদাতা। প্রভুত্ববোধ মোহসঞ্চারক। তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অস্ত্র আর পেশি শক্তির জোরে সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী জাতি প্রভুত্ব কায়েম করে অনগ্রসর জাতি-জনগোষ্ঠীর ওপর। এই প্রভুত্ববোধ অক্ষুণ্ণ রাখতেই সম্ভাব্য সব রকম বৈষম্যের সৃষ্টি। দুর্বলের ওপর ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, লৈঙ্গিক, ধর্মীয়, ভাষাগত, যৌনঅভ্যাসগত প্রত্যক্ষ পরোক্ষ বিদ্বেষ-বিভাজন আরোপিত হয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগত স্তরবিন্যাস সাম্যের কথা বলে না। রাষ্ট্র নাগরিকদের সমতার কথা বলে না। উন্নত জাতি অনুন্নত জাতিগোষ্ঠীকে নির্যাতন নিপীড়নে আরো দুর্বল করে সীমাহীন প্রভুত্ববোধের দানবীয় আকাঙ্ক্ষা মেটায়। একক আমিত্বের সঙ্কট থেকেই উদ্ভুত ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে মানব সভ্যতা। বিভেদ-বৈষম্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অত্যাচার, অনাচারে বিধ্বস্ত হয় মানবতা।
ক্রীতদাসী ক্রীতদাস
সুখবর! সুখবর! সুখবর!
গারো আদিবাসী গৃহকর্মী!
বুকিং দিলেই ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারী!
সুখবরটা যে কী এ নিয়ে সংশয় জাগায় বিজ্ঞাপনের ভাষা। এটা পণ্যের নাকি মানুষের বিজ্ঞাপন? দু’বার পড়লে বোঝা যায় এটা আদিবাসী মানুষের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে দেয়া ছবি দেখে বোঝা যায় লিঙ্গ পরিচয়ে সেই গৃহকর্মী নারী। বুকিং কনফার্ম করলেই যাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে ‘ডেলিভারী’ দেয়া হবে। বিজ্ঞাপন দেখে দেখে পণ্য প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে কেউ কেউ অভ্যাসবশত হয়তো বুকিং দিয়েই ফেলেছে। এখন রেডিমেড ডেলিভারী পাবার অপেক্ষায়। বিজ্ঞাপনের এই ছবি ভাইরাল হয় না। বিজ্ঞাপনের এমন ভাষা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে না। এমন কি বিস্মিতও না। ইন্টারসাবজেক্টিভিটি’র এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থেকে যায় এই আদিবাসী নারী। আদিবাসীদের মধ্যে সে ‘নারী’, নারীদের মধ্যে সে ‘আদিবাসী’। দুদিক থেকেই সে ব্রাত্য। নারীবৈষম্য আর বর্ণবৈষম্যের শিকার। বাতিল মানুষের দলে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বর্ণবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে- “Racism, also called racialism, the belief that humans may be divided into separate and exclusive biological entities called ‘races’; that there is a causal link between inherited physical traits and traits of personality, intellect, morality, and other cultural and behavioral features; and that some races are innately superior to others. The term is also applied to political, economic, or legal institutions and systems that engage in or perpetuate discrimination on the basis of race or otherwise reinforce racial inequalities in wealth and income, education, health care, civil rights, and other areas.”
বর্ণবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে ভাগ করা এবং কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু বা নিচু, যোগ্য বা অযোগ্য। ফলে উঁচু গোষ্ঠী নিচুর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। কোনো আচরণ যদি সেই জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে বর্ণবাদ বলে। বর্ণবাদ ঘৃণ্য হলেও রাষ্ট্র ও সামাজের চলমান বর্ণবাদী আচরণে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৈষম্যগুলো ক্রমশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। কারণ বহুমুখী বৈষম্যচর্চা করে সহজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রভুত্বের আপাত সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হওয়া যায়। এই আত্মঘোষিত প্রভুত্বের অনুভূতি থেকে এক জাতি অন্য জাতির চেয়ে নিজেকে উৎকৃষ্ট ভাবতে শুরু করে। অপর জাতির ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলতঃ জাতিরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও জাতিগত ‘বৈচিত্র্য’ এক সময় ‘বৈষম্য’ হয়ে যায়। এক জাতি ‘অপর’ জাতিসত্তাকে পণ্যে পরিণত করে।
ক্ষুদ্র জাতির মানুষের ব্যাপারে যদি অধিপতির দৃষ্টিভঙ্গি বহুরৈখিক এবং জটিল। “ভিন্ন জাতির মানুষদের ব্যাপারে অধিপতি বাঙালি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি আমরা টের পাই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে আদিবাসীর চিত্রায়ণ দেখলে। তথ্যগত ভ্রান্তি, গৎ বাঁধা, সময়হীন পরিবেশন বলে দেয় অধিপতি তার ‘অপর’ এর ব্যাপারে কতটা অসংবেদনশীল। প্রায়ই জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় হিসেবে ধরা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষ আর তাদের লড়াই সংগ্রামকে। সে কারণে আজ অবধি সকল শাসনকালেই তাদেরকে সামরিক বাহিনী দিয়ে শাসনের কথা ভাবা হয়েছে।”
মনে পড়ে যায় দু’শ বছর আগের আফ্রিকান-আমেরিকান কুনতা কিনতের কথা। নগ্ন, শেকলে বাঁধা, নিলামে তোলা কুনতা কিনতে দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যায়। গোরা ব্যবসায়ীদের হাতে সে সময় পন্যদ্রব্য, গবাদিপশুপাখির মতো বিক্রি হতো কালো মানুষ। দীর্ঘ সময়ের ফেরে দাসত্বের ইতিহাস বদলে যায়। আর বদলে যায় বৈষম্যের ধরণ। কুনতা কিনতে আর গারো আদিবাসী কোথাও গিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে আর এক অমোঘ সত্য মনে করিয়ে দেয়। সেটা হলো ঔপনিবেশিক উত্থান-পতন পেরিয়ে বহুসংস্কৃতিবাদ ও জাতিগত ভিন্নতাকে পুঁজি করে মানুষ এখনও বর্ণবাদী। মানুষের দখলদার মনোভাব এতটুকু বদলায়নি। দাসপ্রথা অবলুপ্ত অথচ এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ বিক্রয়যোগ্য পণ্য। ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জাত-পাত, গায়ের রঙ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন কালে মানুষ সহাবস্থানে থেকেছে। ধীরে ধীরে সভ্যতার স্মারক চিহ্ন যত গাঢ় হয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির উৎকৃষ্টতাকে অনুকরণ করে অপর জাতিসত্তাকে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক অবমাননাকর নাম দেয়া হয়েছে। যাকে বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
“ঐদিন সেনাবাহিনী এবং বসতিস্থাপনকারীরা মন্দিরটি ঘিরে ফেলে। আমাকে বন্দী করা আমার হাত পা বেধে দেয়া হয়। আমার নাকের মধ্য দিয়ে জল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ওরা আমাকে বুট জুতো দিয়ে আঘাত করে এবং আমার পা কেটে দেয়। মন্দিরে ঢুকে ওরা সব মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। আমি মেয়েদের চিৎকার শুনতে পাই- হয়তো ওদের ধর্ষণ করা হয়েছিল কিন্তু আমি নিজের চোখে তা দেখিনি। কিছুদিন পর একটি মেয়ের সাথে আমার দেখাও হয়, কিন্তু একজন ভিক্ষু হিসেবে আমার কিছু বাধানিষেধ আছে তাই আমি তাকে কি ঘটেছে তা জিজ্ঞেস করতে পারিনি… সেনাবাহিনী মন্দির অপবিত্র করে। তারা জুতো পড়ে মন্দিরে প্রবেশ করে এবং মন্দিরের অর্ঘ্য ছুঁড়ে ফেলে।” মন্দিরে গরু ছাগল হত্যা করা হয়। বৌদ্ধরা যেহেতু প্রাণী হত্যা করে না তাই এ ঘটনার পর ওই মন্দিরে আর উপাসনা সম্ভব হয় না। ১৯৮৫ সালের পাবলাখালির এই দমন আক্রমণ গণহত্যায় মানবাধিকার চড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত, ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকুচিত। প্রান্তিকতার শেষ পর্যায়ে ঠেলে দিলে হয়তো নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্টির ওপর এমন পাশবিক হামলা চালানো যায়। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক দখলদারিত্ব কোন পর্যায়ের হলে সেসব মানুষের মনে হয়- জীবন তাদের নয়?
প্রতিনিয়ত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত গারো, চাকমা, মারমা, সাঁওতালসহ ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী। পাহাড়ের হত্যা ধর্ষণ গুম-খুন হামলা লুটপাটের সব খবর বাঙালির পত্রিকায় ঠাঁই পায় না। যতটুকুই বা আসে আসংগতি আর পক্ষপাতে ভরা। রাজনৈতিক আগুন জ্বলে। বোঝা যায় উদ্দেশ্যমূলক হলেও আগুন স্বভাবগুনে ঘরবাড়ি স্থাপনা সবই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় আর বিদেশী দূতাবাস ঘটনার নিন্দা জানায়। সীমাহীন নিপীড়নের শিকার প্রান্তজনের স্বর মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় ধ্বনিত হয় না। মিডিয়া ব্ল্যাক আউট। কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়, রমেল চাকমা খুন হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। ভূমি মালিকানা নেই। সরকারি চাকরিবিধি থেকে সংরক্ষিত কোটা বিলোপ। ভূমি দখলের জন্য সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগে রাষ্ট্রের প্রহরায়। পরিকল্পিতভাবে গুলি ছোটে। বিপরীতে তীর-ধনুক। অসম লড়াইয়ে মরে যায় শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি আর জীবিতরা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। স্তব্ধ-বধির হয়ে যায়। “অভিজ্ঞতা বলে, নিপীড়ন এতটা শক্তিশালী, এতটাই বহু অনুষঙ্গে বিস্তৃত যে প্রান্তজনের নীরবতাও ইতিহাস পাঠকের তদন্তের বিষয় হতে পারে।”
জাতিরাষ্ট্রের এই নির্মম দখলদারিত্ব কোনো সীমাবিভেদ মানে না। বৈষম্য কোনো স্থান, কাল পাত্র বিবেচনা করে না। তাই পাহাড়ে নয় কালাপানি পেরিয়ে ওই অতিদূর উন্নতবিশ্বের সমতলে সাদার হাঁটুর তলে থাকে কালোর গলা। তখন মনে পড়ে যায় নূরলদীনের কথা। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষকনেতা ছিল নূরলদীন। যেন কালাপানির ওপার থেকে আসা গোরাদের চিনতে পেরেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের এই প্রান্তজন বলেছিল-
“একদিন সওদাগরি করিতে করিতে তোমরা করিলেন বড়
এক সওদাগরি।
একদিন অবাক হয়া দেখিলোম কোন তালে কখন হামাক
গুষ্টি সমেত নিছেন খরিদ করি।
আর দেখিলোম, এই দেখিলোম, হামার গলায় দিয়া দড়ি,
একে সৃষ্টি হন আল্লার, হামার সিনায় তোমরা চড়াও হয়া
চড়ি বসি আছেন চমৎকার।”
নূরলদীন অনুভব করেছিলো তার গলায় দড়ি বেঁধে সিনার ওপর চড়ে বসে আছে সাদা ব্রিটিশ বেনিয়া। সেই চেপে বসা আর ফুরায় না। তাই আজ প্রায় একশ বছর পরও মানুষ দেখতে পায় জর্জ ফ্লয়েড কীভাবে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
মেল্টিং পট থেকে স্যালাড বোওল
সেদিন মিনেপোলিসের রাস্তায় একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির গলায় হাঁটু চেপে ধরেছে। পুলিশ সদস্য ডেরেক শভিনের এক হাত নিজের পকেটে ঢোকানো। বেশ একটা নাটকীয় পরিস্থিতি। দ্রুতই যা নারকীয় পুলিশি হত্যাকাণ্ডে পরিণত হবে। পথচারীরা মোবাইল ফোনে এই ঘটনা রেকর্ড করে। ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেলে বিশ্ববাসী দ্যাখে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি পুলিশ অফিসারকে বলছে- ‘আপনার হাঁটু আমার গলায়। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ এই কাতরতা পুলিশ অফিসারের কানে যায় না। নিস্তেজপ্রায় ব্যক্তিকে তখনও পুলিশ অফিসাররা ব্যঙ্গ করছে। ভিডিও হচ্ছে জেনেও বেপরোয়া। কারণ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ জানে সে সুরক্ষিত, আইন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে মরনাপন্ন কালো মানুষের সাথে পৃথিবীর সব মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে আসে। যখন হাসপাতালে সে, ততক্ষণে শ্বাস নেয়ার দরকার ফুরিয়ে গেছে। মৃতের নাম জর্জ ফ্লয়েড।
এই ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকা। ‘আই কা’ন্ট ব্রিদ’, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘জাস্টিস ফর জর্জ’ শ্লোগানে শ্লোগানে পোস্টারে প্ল্যাকার্ডে রাজপথ গর্জে ওঠে। প্রতিবাদী মার্কিন জনতা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লক ডাউন ও কারফিউ উপেক্ষা করে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ক্রমেই বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন সহিংস দাঙ্গায় পরিণত হয়। গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের একাধিক ঘটনা ঘটে। ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় ১,৬০০ সেনা পাঠায় পেন্টাগন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আন্দোলন ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতি রায় এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানান। এক সাক্ষাৎকারে বলেন- “আমি বলবো যে এই আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে প্রথমে অনুধাবন করা এর উৎপত্তি কোথায়। তার সাথে জানতে হবে দাসপ্রথার ইতিহাস, বর্ণবাদ এবং নাগরিক অধিকারের আন্দোলন সম্পর্কে এবং এদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিস্তারিত ইতিহাস। উত্তর আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকানরা বিভিন্ন সূক্ষ্ম ও স্থুল ধরনের বর্বরতা, বেআইনি কারারুদ্ধকরণ এবং বঞ্চনার শিকার হয়, এবং তা প্রতিষ্ঠিত ‘গণতন্ত্রের’ সীমারেখার মধ্যে থেকেই… দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থা ও আইনের গন্ডির মধ্যে থেকেই; কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকানদেরকে বিকল্প উপায়ে, হিংস্রতার সাথে দমিয়ে এবং বন্দি করে রাখা যায়- সেটার একটি সমন্বিত প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে।”
কালোদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্য ও সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে এই বৈষম্য চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সাক্ষী হয়ে আছে ২৫ মে ২০২০। যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত গঠনকে এক সময় ‘মেল্টিং পট’ বলা হতো। মেল্টিং পটে যেমন নানারকম ধাতু গলিয়ে সংকর ধাতু গড়া হয় তেমনি বিভিন্ন জাতির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সংযুক্তি ঘটেছে মার্কিং মুলুকে। এখন সেই ধাতু গলানো আর মিশ্রণের পাত্র এখন ‘স্যালাড বোওল’। একই বাটিতে নানান আকৃতি, স্বাদ, গন্ধের সবজীসমাহার। রূপকার্থে জাতিগত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্য বজায় রেখে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতর সহাবস্থান। সাদা আমেরিকান, কালো আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্প্যানিক এবং লাতিন আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকান এবং স্থানীয় (নেটিভ) অ্যামেরিকানের মিশেলে গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
চামড়ার বিভিন্ন রঙ আর এথনিক গ্রুপের (গোত্র নয় জাতিগত গোষ্ঠী অর্থে) মিশেল ঘটলেও ‘সাদা’র নিজেকে উৎকৃষ্টতম মানার প্রবণতা প্রবল। এই বহুসংস্কৃতিবাদ ও জাতিগত ভিন্নতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে নানামাত্রিক বর্ণবৈষম্য। অশ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা তাই ‘হোয়াইট প্রবণ’ শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কৃতির মধ্যে জীবনধারণ করতে বাধ্য। কৃষ্ণাঙ্গরা শারিরীক, মানসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়ন আর শোষনের শিকার। এমনকি করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কৃষাঙ্গরা।
সমঅধিকারের সাংবিধানিক অস্বীকৃতি, দ্বিতীয় শ্রেণী নাগরিকত্বের আইনি সমর্থন আর অভিবাসন বিরোধী নীতি বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছে। জাতিবিদ্বেষকে শক্তিশালী করেছে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের চোখে আফ্রিকান, এশিয়ান, হিসপ্যানিক ও লাতিন আমেরিকানরা এখনো খাঁটি আমেরিকান হয়ে উঠতে পারেনি। বর্ণবাদের শেকড় রাজনৈতিক আর মনস্তাত্ত্বিকভাবে হোয়াইট আমেরিকানদের এতটাই গভীরে নিহিত। তবু এক বিপরীত চিত্র দেখা যায়। মার্কিন আকাশ জুড়ে যখন বর্ণবাদের ছাই উড়ছে, খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নেয়ার জন্য মানুষ পথে নেমেছে। কালোদের সাথে সাদারাও। হোয়াইট প্রিভিলেজডদের আত্মা কি তবে বৈশ্বিক মহামারিতে কেঁপে উঠেছে? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
তোমার হাঁটু সরাও
সমঅধিকার আদায়ের লড়াই অব্যাহত সারা বিশ্ব জুড়ে। তাই জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকারীর কঠিন শাস্তির দাবিতে গলা মিলিয়েছে বিশ্বের মানুষ। কাউকে গলায় হাঁটু দিয়ে চেপে রাখা যাবে না, এমন নির্দেশ জারি করেছে প্রশাসন। বাস্কেটবল তারকা স্টিফেন জ্যাকসনের কাঁধের ওপর বসে ৬ বছরের জর্জ-কন্যা গিগি। ছোট্ট মেয়ে বলছে- ‘আমার বাবা পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছে’। ভারতীয় উপমহাদেশে দুঃশাসনের অভিযোগে ব্রিটিশ জনগণ রবার্ট ক্লাইভের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার আন্দোলনে নেমেছে। এখনই সময় বিভিন্ন সংস্কৃতি ও গোষ্ঠীর প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সচেতন হবার। চলমান প্রতিবাদকে সমর্থন জানিয়ে আদিবাসী নিপীড়ক, দাসব্যবসায়ী এবং বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেয়ার।
‘এই যুদ্ধে মরো যদি, কোনো দুঃখ নাই,/ হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।’ কৃষক বিদ্রোহের নেতা নূরলদীনের চেতনায় সময়প্রবাহ পেরিয়ে জীবন এভাবেই আজো উদ্ভাসিত হয়। তাই এমন বিশ্বাস করা অমূলক নয় যেদিন পিছিয়ে পড়া প্রান্তবাসীরা সমাজের মূল স্রোতের সাথে মিশে যাবে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, মানুষ একদিন সভ্যও হবে। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতি অনুভব করবে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র আমিত্ব আর প্রভুত্ববোধকে অতিক্রম বা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যাবে। জীবনের বিশাল শোভাযাত্রার মিছিলে একদিন উচ্চারিত হবে- ‘উই ক্যান ব্রিদ’।
তথ্যঋণ:
সাঈদ ফেরদৌস, ‘বাদপড়াদের ফিরে দেখাঃ ইতিহাসরচনায় প্রান্তজনের খোজ’, প্রবল ও প্রান্তিক ১, সিরিজ সম্পাদকঃ রেহনুমা আহমেদ (পৃ. ১৯)
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, ‘জীবন আমাদের নয়’, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও মানবাধিকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (ঢাকা: ডানা প্রিন্টার্স, ২০০১), পৃ. ২৯-৪৪ ও ৪৫-৫৫।
সাঈদ ফেরদৌস, ‘আক্রান্ত মানুষ আর জীবন জয়ের গল্প’, বিষের নিশান: রাজনৈতিক সহিংসতা আর অবিনাশী চৈতন্যের গাথা: বাংলাদেশ ১৯৮৯-২০০৫ (ঢাকা: কাউন্টার ফটো, ২০০৭)।
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য ‘নূরলদীনের সারাজীবন’।
[লেখক – বিশিষ্ট গদ্যকার।]
Posted in: ARTICLE, July 2020 - Cover Story