কবিতা নিয়ে : ইন্দ্রনীল ঘোষ

তৃতীয় পর্ব

লু — অতিচেতনার কবিতা-স্টেশন

আলোচনা — লু / বারীন ঘোষাল

Cover of lu - a collection of poems by Barin Ghosal
বারীন ঘোষালের লু কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ

“পনেরো বছর আগেকার লেখা একটা কবিতার সময়ে স্মৃতিকে ফেরাবো কী করে? সেই অনুভূতি আর তো ফিরবে না। ওই সময়ে আমি শব্দ থেকে অক্ষর, এমনকি ধ্বনি খুলে নিয়ে, শব্দকে নিঃশব্দ করার খেলা খেলছিলাম নবতরঙ্গ উদযাপনের খেলায়। নিঃশব্দ কেমন চেনা লাগে দেখতে, পুরনোকে অচেনা, স্বরবর্ণ খোলা নাউন কেমন গাউন লাগে, নুলো পিকাস কেমন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে রঙের দিকে, মাথায় গাছ গজায় পাখিদের ভালোবাসা-লেস-নেস কে জায়গা দিতে, এমনকি খাবার চিবুনোর শব্দকেও মিস করি না – সমস্ত পার্সোনাল সাউন্ড বার ক’রে সাজাতে চাই একটা কবিতা মণিপদ্মের গায়ে – মজার খেলাঐ সময়টা ফিরে পেলে হয়তো পরিষ্কার বলা যেত কিছু। এখন তোরাও যদি কোন বাজনা টের পাস তোদের অন্দরে তাহলে সেটুকুই বাকি আছে, সেটা তো আমি আর জানতে পারবো না। আর তখনই বেশির ভাগ পাঠক মিস করেছিল খেলাটা। লেখার খেলা তারা ঠিক ধরতে পারে না।”

[‘লু’ কাব্যগ্রন্থের ‘কানচোই’ কবিতাটি পুনরালোচনা প্রসঙ্গে বারীন ঘোষাল। নবেন্দু বিকাশ রায় ও আমার নেওয়া এক সাক্ষাতকারে।] [১]

কোনও কবি বা লেখকের কাজ পড়ার জন্য আমরা সচরাচর র‍্যান্ডামলি তাঁর একটা বই বেছে নিই। পড়ি। এবং সেখান থেকে পাওয়া ধারণাকেই ওই লেখকের লেখনী সম্পর্কে আমাদের ধারণা ক’রে তুলি। যদি তা ভালো লাগে তবে আমরা আবার তাঁর আরেকটা বই র‍্যান্ডামলি তুলে নিই, খারাপ লাগলে হয়ত বা থেমে যাই। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ’ সময়-ক্রম নিরপেক্ষ – ফলে লেখকের কাজের বিভিন্ন পর্যায়গুলোর ক্রমানুযায়ী বিকাশ এতে ধরা পড়ে না। সবচেয়ে সমস্যা হয় সেই সব লেখকের কাজ ধরতে যাঁরা তাঁদের লেখক-জীবনের অধিকাংশটাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন – থেমে থাকেননি একই জায়গায়। বারীন ঘোষালের কাজের মূল্যায়নেও এই সমস্যা দেখি পাঠকের মধ্যে। অনেকেই তাঁর ‘মায়াবী সীমূম’, ‘হাসিশ তরণী’ বা পরবর্তীর ‘কবিতা চালিশা’ ইত্যাদি বইয়ের একটি বা দুটিতেই আটকে থাকেন – বারীনের বাকি কাজের সাথে ওই বই-পাঠের মুগ্ধ অভিজ্ঞতাকে মেলাতে না পেরে হয়ত বা অবাক হন, রিজেক্ট করেন। কেউ বা সেটুকুও না প’ড়ে এদিক ওদিকের পত্রিকায় কশ্চিৎ কদাচিৎ বারীন ঘোষালের লেখা প’ড়ে আর বাকিটা অন্যের শুনে একটা সম্যক ধারণা তৈরি ক’রে নেন তাঁর আপামর লেখালিখি সম্পর্কে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী লেখকের জীবনে পাঠকের এই ধৈর্যহীনতা এক সমস্যা বৈকি!

কৌরব পরীক্ষা সাহিত্য সিরিজের বই ‘মায়াবী সিমূম’-এর পর প্রকাশিত হয় সৎকার – বারীনের তৃতীয় বই। এই বইয়েই প্রথম অতিচেতনার ভাবনা আসে। তা জারিত হয় পরবর্তী কবিতার বই ‘হাসিস তরণী’-তেও। এই জারণপর্ব অনবরত কবির মধ্যে চলছিল সে’ পর্যায়ে – অতিচেতনা ও এক অন্য কবিতা পথ (যার নাম পরবর্তীতে হবে ‘নতুন-কবিতা’)। এই দুই ভাবনা, সে সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা, ওয়ার্কশপ তাড়িত করতে থাকে তাঁকে। শুরু হয় এক জার্নি – আয়নশব্দ, মুখস্থ ডালিম, লু… ‘আয়নশব্দ’ যদি বেস-ক্যাম্প হয়, তবে ‘লু’ এই আরোহণ-পথের চূড়া। সম্ভবত সে কারণেই পুনর্প্রকাশের সময় এই তিনটে বইকে একত্র করা হয় –‘পুব আর ফুরোয় না’ নামে।

লু। এক উষ্ণ ঝড়-প্রবাহ। যা জনশূন্য ক’রে দেয় রাস্তাঘাট। মানুষ দূর থেকে দ্যাখে তার পরিচিত শহর, মাঠ-ঘাট, পথ সমস্ত স্বাভাবিক কীভাবে অস্বাভাবিক অপরিচিত হয়ে উঠছে – সে ভয় পায় নতুনের এই আঁচকে। ঠিক এই এফেক্টই হয়ত চেয়েছিলেন কবি বারীন ঘোষাল তাঁর ট্রিলজির অন্তিম পর্বে। বইয়ের পাতা উলটে পাঠককে থামতে হবে, রিজেক্ট করতে হবে হয় নিজের পরিচিত পাঠাভ্যাসকে নয়ত এই বইকে। কোনও সুললিত রিলিফ ‘লু’ পাঠককে প্রায় দেয়ই না। কিন্তু যেকোন ঝড়েরই তো একটা কেন্দ্র থাকে। কোন শক্তি-কেন্দ্র থেকে তৈরি হয় এই প্রচণ্ড দাবদাহ? বারীন বলছেন, “আমার তো মনে হয় শুধু ম্যাটার নয়, যা ম্যাটার করে তাই বস্তু। যেমন আমি নিজে বা আমার গুণ। বস্তু ভাঙা ও গড়ায় উদ্ভূত শক্তি লু লাগায় শব্দে, কবিতায়।” [২]

অতিচেতনার আলোচনায় বারবার এসেছে এই ‘বস্তু’ প্রসঙ্গ। গোড়াতেই বারীন বলছেন, “বস্তু ও বাস্তবতার সম্পর্ক নিয়ে ভাবা উচিত। মানুষ নিজেও বস্তু। সে কিছু আলাদা নয়। মানুষ বস্তুপ্রাণ লক্ষ করে না, তাই নিজেকে সরিয়ে রাখে প্রাণী বলে।”[৩] অর্থাৎ বিজ্ঞানের দেওয়া বস্তু ও প্রাণের পার্থক্য সরিয়ে সামগ্রিক একটা পরিসর চাইছেন লেখক। যেখানে বস্তু-প্রাণ একইভাবে ক্রিয়াশীল। ‘মানুষ বস্তুপ্রাণ লক্ষ্য করে না’ এই উক্তির মধ্যে দিয়ে বারীন সম্ভবত আপামর মানুষের কোনো বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন অধুনা সভ্য সমাজের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন অধিকাংশ মানুষের কথা। প্রাণ ও বস্তুর পার্থক্য জানার অনেক আগে থেকেই মানুষ, বস্তুর সাথে নিজেকে সমন্বিত ভাবতে পেরেছিল। নদী, আলো, জল, মাটি প্রভৃতির সৃষ্টি, বৃদ্ধি, বিস্তার ও বিনাশ লক্ষ্য করেছিল সে, নিজেকে মিলিয়েছিল। যার এক বড় প্রমাণ পৌত্তলিক ধর্মগুলিতে মানুষ বা অন্য প্রাণী-সুলভ গঠনের দেব-মূর্তিরা, আমাদের প্রাচীন মিথ ও রূপকথাগুলি।

চেতনার সম্প্রসারণ বা Expansion of conscious এর কথা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে দীর্ঘকাল আগেই বলা হয়েছিল ব্রহ্ম ও সত্যের উপলব্ধির জন্য, মায়াজগতকে চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের জন্য। বারীন অনুপ্রাণিত ছিলেন কিছুটা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ এবং তার চেয়েও অনেক বেশি মহাযান বৌদ্ধ মতের জেন স্কুলিং দ্বারা। তিনি নিজেও তাঁর প্রবন্ধে বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়গুলোর উল্লেখ করেছেন। যেমন, “চীনারা বুঝেছিলেন যে, প্রকৃতির ভাষা বুঝে ওঠা মানুষের পক্ষে সম্ভব। শুধু পথ্য আর সম্পদের উৎস বর্ণনাই নয়, এ ভাষায় আছে বিশ্বসংসারকে একীকরণের ও বিভাজনের নিয়মাবলী, অংক ও অংকের উদ্দেশ্য। চীনারা এবং কিঞ্চিদংশে ভারতীয়রাও প্রাণ-চক্র ঘটনা ও জ্ঞান থেকে নীতি আর মূল্য আবিষ্কার করেছিলেন। কালে কালে মূল্য ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় গল্পগাছা আর তাকে ছাড়িয়ে যায় পরিপ্রেক্ষিতহীন নীতি ও মূল্য। এই বোধগুলি সামাজিক প্রগতির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশ মানুষ নিজেকে প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়ানো দেখতে পায়। যেন মানুষ নিজে প্রকৃতির অংশ নয়, সে নিজে দ্বিতীয় প্রকৃতি, নীতিগুলো বই থেকে এসেছে যা মানুষেরই বলা উপদেশ। এভাবে জমা হয়ে যায় বহু বহু সাংস্কৃতিক সংকেতগুলি (symbols) যা মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে দোভাষী দালালের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।”[৪] জেন স্কুলিং-ও ভাষা সম্পর্কে প্রায় কাছাকাছি মতই পোষণ করে। ভাষাকে তার জীর্ণতার কারণে সীমিত মনে করা হয় ভাব প্রকাশের জন্য। আবার কেউ কেউ জেন বৌদ্ধ-মতকে এক নতুন ভাষা-ব্যবস্থায় উত্তরণের কথাও বলেন। “One is the traditional claim that Zen is at odds with language and Zen enlightenment is an experience of a linguistically pure state; the other is the relatively newer claim that language has played a pivotal role in the development of Zen tradition and Zen enlightenment is nothing more than a mastery of a particular monastic language game. These two seemingly contradictory claims about the role of language in Zen Buddhism as either a search for a non-linguistic state or a mastery of a specific linguistic system do not have to be mutually exclusive as they seem to be at first glance. Within Zen literature and the school’s historical development, one finds the unmistakable coexistence of contradictory claims about language and written texts. For example, even though Zen Buddhism has declared from the very inception of the school that Zen enlightenment is characterized by a separation from language, each time such a claim was made, Zen neutralized its position on language with counterbalancing statements which discharge language from the accusation of being an obstacle to enlightenment.” [৫] এটা স্বাভাবিক। কোনো এক ভাষা-ব্যবস্থা ভাঙার পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই সময়ক্রমে আরেক ভাষা-ব্যবস্থা গ’ড়ে ওঠে। যদি তা না হয়, তবে নতুন এই পরিসরে কোনো কম্যুনিকেশনও হয় না। বা অন্যভাবে বলা চলে, কোনো সমষ্টিগত বোঝাপড়া বা পদ্ধতি গ’ড়ে ওঠে না। যা এবং যতটুকু এক কম্যুনিকেশন তৈরি করে, প্রাথমিকভাবে তাই তো ভাষা। প্রচলিত ভাষা-ব্যবস্থার রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক পলেস্তারা অনেক পরের কথা।

অতিচেতনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে, লু-তে বারীন সেই প্রচলিত ভাষা-ব্যবস্থাকে ভাঙলেন। আমরা দেখব, নতুন কোনো ভাষা তৈরি হলো কি-না, পাঠকের মাথায় নিজের মতো ক’রে কোনো কম্যুনিকেশন হলো কি-না। কিছু উদাহরণ দেখা যাক।

 

পোষাকীন্তুশব্‌দ

ভাবো ভোর     কোন শব্দ নেই    ক্তিগত
শব্দবিরোধী তরঙ্গদের আজ ছেড়ে দেয়া হয়েছে হাজত থেকে
আজ decibel নামিয়ে বউ শব্দের বৌকে নামিয়ে
enter নির্বাণ
পর্দায় শুধু চোখের রঙ ও আলপনার বদল pattern
লাফিয়ে তার মৃতদে ভে যাচ্ছে

নিঃস্বন্‌     নিসন্‌     নিস্ব     ব্যাং     গুম
চোওত্‌ সাদা নর্কসুন্দর     গর্ভে    waoবান
খাবান্নিশা

ক্ষেতে ক্ষেতে পেট ভ’রে উঠছে আলোখার
এমনভাবে হাসলো যেন বৃষ্টি দেখেছে
তারপর ভেজা লোকের মতোও হাসলো
torso calligraphy

The intersecting jemming Ruby
becoming বানান্নেশা
ভয়কে সাহস দিচ্ছে
টিকটিক ঠিকঠিক সূর্যের কোনো শব্দ নেই
অথবা আমরা শুনতে পাইনা ভোরকে ভোরাও
শুনতে চাইনা প্রাণীদের খাবার সঙ্গীতগুলো


কানচোই

পিকাস ও রঙে ভরা পলাশটন
আকাশথম
মেমোজিকা
জলজলরে চোখ personal sound-এ নজর রেখেছে
Rain tree & brain tree লাটিম

আস্তে পাখি

আমার হোন গাছের সন্তান
আয়ুদায়ী বায়ুদায়ি     ট্যোওওওঅঅঅঅংংংগ
বেলাটিন সাজে green windmills

আকাশ বলা নিজত্ব আওয়াজ
প্রজাপতির হোয়তি থেকে রুয়ামের সবুজ বাতাসজড়কল

ওওওওঙ্‌ঙ্‌ঙ্‌ঙ্‌ মণিপদ্‌মে হুউউউম্‌ম্‌ম্‌ম্‌

পাখিদের কোন ভালবাসাহীন সৌন্দ
মানুষের মায়াময় পরশ খাবার চিবুনো থেকে
পরম্‌ পরম্‌ শব্দ উঠছে

কানচোই কান চাই

ফিরন্ত পাখিদের শ্রমপরী আমরাওঅবাকে



প্রাথমিকভাবে এই লেখাগুলিকে ধ্বনি-কবিতা বা Sound Poetry ভেবে বসেছিলাম এবং একটু বিমর্ষও হয়েছিলাম, কারণ, ‘ক্তিগত’ বা ‘চোওত্‌ সাদা নর্কসুন্দর’ এই গঠনগুলোর মধ্যে ধ্বনির সেই জিমন্যাস্টিকটি, স্বাভাবিক ওঠা-নামার সঙ্গীত পাইনি আমি। ধ্বনিদের আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বদলে এ যেন ছিল বাইরের ইঞ্জিনীয়ারিং।

বেশ কিছু বছর পরে, লেখকের স্বরচিত কবিতা নিয়ে আলোচনা প’ড়ে, তাঁর সাথে কথা ব’লে, ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে বুঝতে পারি – আমি ভুল করেছিলাম। লেখাগুলি আদপেও Sound Poetry নয়। sound poetry তে শব্দের অর্থ নয় আওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ, অন্য দিকে বারীন এই কবিতাগুলোতে চেয়েছিলেন “ভাষার, সংস্কারের ডিমিথ।”[৬] এবং এ’ কথা অনস্বীকার্য যে মিথ না থাকলে ডিমিথ হয় না। আগে মিথ যে আছে, তা মেনে নিয়ে তবেই ডিমিথের পথে চলা যায়। যদি কোনো শব্দ (বা ধ্বনি-সমন্বয়) কোনো কিছুকেই প্রতীকায়িত না করে তবে তাকে ডিমিথও করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ধ্বনিকবিতায় কিন্তু তার ব্যবহার একদমই সম্ভব এবং কাঙ্ক্ষিত। এই ধরণের শব্দের কয়েকটা উদাহরণ – দ্রীঘাংচু, হাট্টিমাটিমটিম, হজবরল… শব্দগুলো পূর্ব-পরিচিত ব’লে যদি প্রতীকায়নের কথা মনে আসে, এরকম আরও অনেক শব্দ বানানো যায় – আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই গোত্রটিকে দেখানো।

লক্ষ্য করি, ১৯৯১ সালে কবি রঞ্জন মৈত্রকে লেখা এক চিঠিতে নিজের ‘সৎকার’ কবিতাটি নিয়ে বলতে গিয়ে, “হেমন ত্বং বলে লিঙ্গ বেঁচে যায়” এই লাইন প্রসঙ্গে বারীন বলছেন “হেমন্ত ঋতুর কথা প্রথম থেকেই। সেই ঝরে পড়ার তান্ত্রিক পুজোকে তাচ্ছিল্য করছি অনবরত। মনে নেই তি ত্বাং তাম শব্দরূপ? মনে নেই? লিঙ্গ বেঁচে যায় ভুলজন্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার তৃপ্তিতে।”[৭] এটা পড়ার পর ওই ধ্বনিকবিতার বিষয়টা মাথায় রেখে বারীন ঘোষালকে এক ইন্টারভিউয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আলোচনায় হে+মন+ত্বং অথবা লিং+গ বা শেষ শব্দের অন্তস্থ-অ এর মধ্যে দিয়ে যে ধ্বনি ওঠাপড়া তা নিয়ে তার অনুভূতি নিয়ে” কিছু বলেননি কেন?[৮] উত্তরে বারীন বলেন, “‘হেমন তম্‌ তাং এ সময়’ … হেমন্তকে প্রথমেই ভেঙে দেয়া হয়েছে। শব্দকে না। ঋতুকে। এটাই ডিমিথ করা। ভাষার, সংস্কারের ডিমিথ। হে+মন ভাবনায় কবিতাটির প্যাশন, স্পিরিট ও ফোর্স ধরে না। শুরুতে হেমন্তকে ভেঙে বলেছি ‘হেমন তম্‌’ …, আর তোদের উল্লিখিত লাইনে আছে ত্বং। যা ছিল ‘তুমি’ শব্দের সংস্কৃত ধাতুরূপের ধ্বনিসরণ, তাই হয়ে দাঁড়ালো ‘ত্বং’ শব্দে বিরক্তির আভাস।”[৯]

বারীনের উল্লেখিত কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই বোঝা যায় এই কবিতাগুলো মুখ্যত ধ্বনি অনুরণনের ক্ষেত্র নয়। ভাষাকে, সংস্কারকে ডিমিথ করবার কাজটির মধ্যে দিয়েই নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে বারীনের ‘অতিচেতনার কবিতা’। যা প্রসঙ্গে আরেক জায়গায় লেখক বলছেন, “এসব কথা সাধারণ লোকের জন্য নয়। তাঁরা দেখছেন বিশেষ একটি ঘটনা, দৃশ্য বা শুনছেন একটা সংলাপ একই সাথে, সময়ে, ভাবে, এই দেখাটা একটা অস্বচ্ছ দেয়াল থেকে আলোর ফিরে আসা, যেন প্রতিফলিত। ভিশনপ্রাপ্ত মানুষ কিন্তু অস্বচ্ছ দেয়ালকে স্বচ্ছ মনে করেন এবং আরো দূর উৎস থেকে ভেসে আসা বস্তুর কার্যকরণ ঐ ঘটনা ভেদ করে দেখতে পান। তাঁর কল্পনার আর প্রতিসরণের কোনো সীমা নেই। অতিচেতনা তাঁকে বস্তুর সবটা একেবারে দেখায়।” [১০]

লু-এর কবিতাগুলি সম্পর্কে তাহলে আমরা দুটো বিষয় এখনও অবদি লক্ষ্য করলাম।

১. শব্দ কেবলমাত্র ধ্বনি অনুরণনের কারণে ব্যবহৃত হয়নি। ধ্বনি-গুঞ্জন শোনানো তার উদ্দেশ্য নয়, বরং তার উদ্দেশ্য ভাষা ও সংস্কারের ডিমিথের মাধ্যমে অতিচেতনা-লব্ধ এক বড় প্রেক্ষাপট তুলে ধরা।

২. এই ডিমিথের প্রক্রিয়াটি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেছে শব্দের শরীর দিয়ে। শারীরিক এই যোগ-বিয়োগের ফলে শব্দ/ব্যবহার পরিচিত ভাষা-ব্যবস্থার মধ্যে টিঁকে থাকতে পারেনি আর।

তবে কম্যুনিকেশন? কবিতায় কম্যুনিকেশনের বিষয় নিয়ে আমরা অনেকেই হয়ত একমত হবো যে, এ’ কোনো কংক্রিট কম্যুনিকেশন নয়, কবি ঠিক যা বললেন পাঠক তাই বুঝলেন এরকমটা হয় না, বা হওয়ার প্রয়োজনও নেই। বরং কবি তাঁর কবিতা গঠনের মধ্যে দিয়ে ভাবের বিভিন্ন সম্ভাবনা ছড়িয়ে রাখেন, যার কয়েকটি হয়ত অনুভব করেন কোনো কোনো পাঠক – যে যার নিজের মতো ক’রে।   

লু-এর অনেক কবিতাই এই জায়গাটির অভাবে, ‘দুর্বোধ্য’ (বা বলা ভালো কম্যুনিকেশন-হীন) হয়ে পড়ে পাঠকের কাছে। শব্দ ও তার ব্যবহার অপরিচিত, কিন্তু তা কোনো ধ্বনি অনুরণন বা ননসেন্সের জন্য নয়, বরং তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ডিমিথের খেলা। এবার কবিতা-লিপিতে ডিমিথ হয়ে যাওয়া সেই শব্দ-চিহ্নগুলিকে দেখে ডিমিথের পথটা খুঁজে পাওয়া যাবে কী ক’রে? লেখক ঠিক যেভাবে ভেবেছিলেন তাকে ট্র্যাক ব্যাক করা বাদে এর আর কোনো উপায় হয়ত নেই। পাঠকের স্বাধীনভাবে কোনো বোঝাপড়ার জায়গা সীমিত হয়ে আসে এক্ষেত্রে। বারীন-কৃত নিজের কবিতাগুলির ব্যাখ্যা দেখলে ধরা যায়, কত সুচিন্তিত ভাবে কার্য-কারণ সম্পর্ক ভেবে তিনি ব্যবহার করতেন শব্দগুলোকে। কিন্তু গোটাটাই তাঁর ব্যক্তিগত বোঝাপড়া – অর্থাৎ এমন এক কোডিং যা ডিকোড করার চাবি কেবলমাত্র লেখকেরই হাতে। যেমন ঠিক একটু আগেই এক উদ্ধৃতিতে দেখছি তিনি ‘সৎকার’ কবিতা প্রসঙ্গে বলছেন – “যা ছিল ‘তুমি’ শব্দের সংস্কৃত ধাতুরূপের ধ্বনিসরণ, তাই হয়ে দাঁড়ালো ‘ত্বং’ শব্দে বিরক্তির আভাস।”[১১] এবার সমস্যা হলো, এই ত্বং যে হিন্দির ত্বং = বিরক্তি, এই সিদ্ধান্তে উপনীত না হলে? এটা কীভাবে ধ’রে নেওয়া যায় পাঠক তাই ভাববেন যা লেখক ভেবেছিলেন? কারোর মাথায় টং শব্দের প্রসঙ্গ আসতে পারে বা ত্বক + টং (বেজে ওঠা ত্বক)… আরও অনেক কিছুই। বারীনের বিশ্বাস ছিল কবিতা, “শব্দ থেকে শব্দে সম্পর্ক থাকলে এক উত্তরণের পথে এগোয়।” [১২] কিন্তু এই ‘সম্পর্ক’-এর কোনো সার্বজনীন বোঝাপড়া হয় না। লেখক একটি মাত্র সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত দিতে থাকলে ক্রমেই পাঠ দুরূহ হয়ে পড়ে পাঠকের কাছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এক ইন্টারভিউয়ে যখন বারীনকে তাঁর কানচোই কবিতাটার আলোচনা করতে বলি, তিনি প্রায় একই উত্তর দেন, “পনেরো বছর আগেকার লেখা একটা কবিতার সময়ে স্মৃতিকে ফেরাবো কী করে? সেই অনুভূতি আর তো ফিরবে না।”[১৩] প্রশ্ন জাগে, তবে কি কবিতাগুলোর অন্তর্দর্শন কেবলমাত্র কবির চেয়ার থেকেই হয়? কবির অনুভূতি না জানলে সেই কবিতার আলোচনা পাঠক হিসাবে কি সম্ভব না?

ওপরের ‘পোষাকীন্তুশব্‌দ’ কবিতাটার দিকে তাকাই। প্রথম লাইনের শব্দহীন পরিসরের পরেই বলা হচ্ছে, শব্দবিরোধী তরঙ্গদের কথা। অর্থাৎ ব্যক্তিগত > ক্তিগত এই পরিবর্তনের কারণটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বা পরবর্তীতে এক সচল পরিসরের মধ্যে দিয়ে শব্দের অনবরত বদলে যাওয়ার কারণও। মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে, এই দৃশ্য “তার মৃতদে ভে যাচ্ছে” হলো হয়ত বা এক পার্সপেক্টিভ বোঝানোর জন্য, ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ দৃশ্যটা তুলে ধরার জন্য। আবার আগের লাইনটা পড়লে, এই লাইনের গোড়ায় থাকা লাফিয়ে শব্দটা পড়লে আরেক সম্ভাবনাও মাথায় আসে – 

পর্দায় শুধু চোখের রঙ ও আলপনার বদল pattern

লাফিয়ে তার মৃতদে ভেঙে যাচ্ছে

আর ওই ভাঙা টুকরোগুলো হারিয়ে লাইন হয়ে পড়ে… “পর্দায় শুধু চোখের রঙ ও আলপনার বদল pattern /লাফিয়ে তার মৃতদে ভে যাচ্ছে”

বারীন ঠিকই বলেছিলেন, এ’ এক লেখার খেলা।[১৪] চিরাচরিত পাঠাভ্যাস নিয়ে এর সামনে দাঁড়ালে, এক দুর্বোধ্য দেওয়াল মনে হবে। খেলার মেজাজ নিয়ে এলে টের পাওয়া যায় এর অনন্ত খোলা মাঠ। এমনকি সব সময় ডিমিথ হলো কি-না বা কীভাবে তা লেখক বর্ণিত পদ্ধতিতে না বুঝলেও চলে, তা বাদেও অনুসন্ধিৎসু পাঠক খুঁজে পাবেন এর খেলার আনন্দ, সম্ভাবনা সাফল করার আনন্দ।

এ’ তো নিশ্চিত যে, সনাতন পাঠাভ্যাসকে ধাক্কা দিতেই চেয়েছিলেন বারীন তাঁর এই বইয়ে। তাই তো “ক্ষেতে ক্ষেতে পেট ভ’রে উঠছে আলোখার/ এমনভাবে হাসলো যেন বৃষ্টি দেখেছে/ তারপর ভেজা লোকের মতোও হাসলো” কবিতায় এই অপূর্ব মায়াময়তা তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই তা মুছতে ছুটে আসেন “torso calligraphy” নিয়ে।  

আগেই বলেছি, অতিচেতনার যে ভাবনা শুরু হয় ‘সৎকার’ কাব্যগ্রন্থ থেকে, তা এক চূড়ায় এসে পৌঁছোয় ‘লু’-তে। প্রায় এক দশকের এই জার্নিতে ক্রমশ গ’ড়ে ওঠে বারীনের শব্দ, ব্যবহার, বস্তু ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে বোঝাপড়া। শুরুর সবটাই যে এক থাকে তা নয়। এ’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক নিজে পরে একবার বলেছিলেন, “কোন বিষয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তার শোধন, বৃদ্ধি ও পরিবর্তন হতে থাকে অনবরত, কারণ তা জীবন্ত।”[১৫] ‘লু’ সেদিক থেকে খুবই উল্লেখযোগ্য এক বই। অতিচেতনার শিখরে দাঁড়িয়ে বারীনের পার্সপেক্টিভের সাক্ষ্য হয়ে থাকে সে।


শব্দের প্ল্যান


শব্দের প্ল্যানে নিবিড় তা দিচ্ছি
তাহলে এই শব্দের ছানাগুলো সাদা প্রোটিন নাকি

গার্জেনদেরও আছে অনেক শব্দছানা এবং শিক্ষক
অভিধানের দিনে সেই পাতারই মৌসুমী গেট
স্ফুলিঙ্গ থেকে লিঙ্গকে মুছে ভাবতে বসা পেরেন্ট টিচার মিটিং,

ফু কে দিল
    বাতাস আনল
        কাঁপন পরিযায়ী
বয়স বড় জটিল হয়ে অফিস থেকে ফিরল

পাখিপায়ের অনেক রোদ গাছ ডিঙিয়ে এই তা দেখছে
অপেক্ষা করছে ভাবনাগুলো ভাঙার
ওয়াড়হীন গাছে লেপের সাদা গুঁড়ো শীতে
কাঁপনাফল মনকষা ভালো লাগানোর স্প্রিংগীত

মাথায় মাথার প্ল্যান বউকেও বলিনি
যে কাঁপতে হবে
শব্দের ভেতরেই শব্দের প্ল্যানগুলো ছিল
কাউকে বলিনি

তথ্যসূত্র:

[১] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৬০

[২] কবিতার লু / অতিচেতনার কথা / পৃষ্ঠা ৫০

[৩]অতিচেতনা / অতিচেতনার কথা / পৃষ্ঠা ১৯

[৪] অতিচেতনা / অতিচেতনার কথা / পৃষ্ঠা ২১

[৫] Zen and Zen Philosophy of Language: A Soteriological Approach / Jin Y. Park

[৬] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৫৯

[৭] নতুন কবিতা (প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা – ক্রোড়পত্র: বারীন ঘোষাল) / পৃষ্ঠা ৪২৬

[৮] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৫৭

[৯] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৫৯

[১০] কবিতার লু / অতিচেতনার কথা / পৃষ্ঠা ৫০

[১১] নতুন কবিতা (প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা – ক্রোড়পত্র: বারীন ঘোষাল) / পৃষ্ঠা ৪২৬

[১২] ছাপাখানার গলি / জুলাই, ২০০৬ / পৃষ্ঠা ৪৮

[১৩] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৬০

[১৪] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৬০

[১৫] একটা ফুলদানী রাখার সাহস / ‘বারীনডাঙা’ (নতুন কবিতা প্রকাশনী)/ পৃষ্ঠা ২৫৮

[লেখাটি ভিন্নমুখ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত]

Facebook Comments

Leave a Reply