আমাদের সমাজ জীবনে বর্ণবৈষম্য : গার্গী চক্রবর্তী

বর্ণবৈষম্য কথাটার মধ্যে জড়িত রয়েছে আফ্রিকা ও আমেরিকার সমাজে সাদা চামড়ার মানুষদের কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি দুর্ব্যবহার, অত্যাচার ও উৎপীড়ন। সম্প্রতি আমেরিকায় সেই ধরণের হিংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে সবাই পরিচিত। সেদেশে কালো চামড়ার মানুষেরা বহু অংকে দরিদ্র এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা অর্থবহুল insurance থেকে স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত। করোনা ভাইরাসে এদেরই বেশি মৃত্যু হচ্ছে বিনা চিকিৎসায়।
আমাদের দেশে শুধু যে বর্ণবৈষম্য রয়েছে তা নয়। নানা ধরণের বৈষম্য—অর্থনৈতিক বৈষম্য তো আছেই, তার সঙ্গে জাতপাত ধর্ম লিঙ্গ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই গভীর বৈষম্য, যার ইতিহাস যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের হার বাড়লেও মনের অন্দরে ঐ সব বৈষম্য দানা বেঁধে রয়েছে। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আজ আমদের সমাজ জীবনেও কী প্রবল বর্ণবৈষম্য রয়েছে তারই কিছু দৃষ্টান্ত দেবো। কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে না গিয়ে শুধুমাত্র মানুষের এই মানসিকতা তুলে ধরাই এই রম্যরচনার উদ্দেশ্য। তাই নিবন্ধ বা প্রবন্ধ আখ্যা না দিয়ে রম্যরচনার নিদর্শন বললাম।
জন্মসূত্রে কালো হয়ে জন্মালে, একটা হীনমন্যতা সহজ ভাবেই তৈরি হয়। “মা ফরসা, বাপ ফরসা, মাইয়া এত কালো হইল কেন?” এই ধরণের মন্তব্য যথেষ্ট শোনা যেত এখনও যায়। কালো মেয়েদের বিয়ে দেওয়া নাকি মুস্কিল! দেখতে সে যেমনই হোক গায়ের রঙ ফর্সা হলে সুন্দরী হয়ে গেল! মজার ব্যাপার!
এই যে কালো রঙের চামড়ার প্রতি একটা অচ্ছুত ভাব, তার উৎপত্তি কোথায়? এটা কি ব্রিটিশ শাসনের ফলশ্রুতি? তাদের বিরুদ্ধে যতই লড়াই করেছে, কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতি একটা আকর্ষণ। বাড়িতে মেমসাহেব বউ এলে সবার বেশ খুশি খুশি ভাব। কিন্তু বৌ-এর কালো রঙ হলেই মন খারাপ, সে যত সুন্দর ও লাবণ্যময়ী হোক না কেন? আফ্রিকা বা আমেরিকার কালো মেয়েকে ক’টা ছেলে বিয়ে করে?
এই প্রসঙ্গে আমার চাকরী জীবনের অভিজ্ঞতা বলি। আমাদের কলেজে বেশ কিছু বিদেশী মেয়েরা পড়তো — শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি। আর ছিল আফ্রিকান ছাত্রী। Ethiopia ও Nigeria থেকে এসেছিল। লক্ষ্য করতাম ওদের সঙ্গে কেউ মিশতো না। ওরা নিজেদের মত একত্রে থাকতো। আমার বড়ই খারাপ লাগতো। দিল্লীতে আফ্রিকার ছেলে মেয়েরা লেখা পড়ার সূত্রে বা কর্মসূত্রে আছে, তাদের বাড়ী ভাড়া পেতে বড়ই অসুবিধা হয়। ওদের criminal-এর মত দেখা হয়।
অথচ আমাদের দেশে Nelson Mandela যখন এসেছিলেন তাঁকে কী বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। মিটিং-এ প্রস্তাব পাশও করা হতো। কিন্তু কোথায় যেন কালো মানুষদের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব প্রকট ভাবে প্রকাশ পায়। অনেককে তাদের ‘হাফ্‌সি’ বলতে শোনা যায়। এই দ্বিচারিতা চরিত্রগত।
বিয়ের পাত্র পাত্রী কলমে গৌরবর্ণের প্রতি সবার ঝোঁক। তাছাড়া জাতপাত ইত্যাদি তো রয়েছেই। ভিন্নধর্মের ব্যাপারে যত কম বলা যায়, ততই ভাল। সে তো আরেক অধ্যায়।
অথচ দেশের ইতিহাসের যাদের জ্ঞান নেই, যারা Social formation সম্পর্কে অবগত নন, তারা জানেন না কেন আমাদের দেশে নানা বর্ণের মানুষ আছে। কোন Ethiopia থেকে গুজরাতের পথে ব্যাপারী এসেছে। কত কত দেশ থেকে আনাগোনা। সেই সংমিশ্রণে কারোর রঙ কালো, শ্যামবর্ণ, কারোর গৌরবর্ণ। কিন্তু ফর্সা হবার জন্য আজকাল হাজার হাজার বিউটি পার্লার খুলেছে। ত্বকের চর্চা এক অন্য জিনিষ। এর জন্য সুস্থ খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু Fair and Lovely Cream মেখে এবং ছেলেদের জন্যও ঐ ধরণের cream-এর বিজ্ঞাপন টেলিভিশনের পর্দায় দেখে দেখে মানুষের এমন মগজ ধোলাই হয়ে চলেছে, যে লজ্জা করে। এই হীনমন্যতা কেন? এর বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানীরা কিংবা মনের ডাক্তাররা করতে হয়তো পারবেন। একমাত্র NDTV এই বিজ্ঞাপনকে বয়কট করবার সৎসাহস দেখিয়েছে। বাড়ীতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পয়সা নেই, কিন্তু Fair and Lovely Skin cream কেনা হচ্ছে! কী বিসদৃশ চিত্র!

[লেখিকা – অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, মৈত্রেয়ী কলেজ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় সহ: সভানেত্রী, এন এফ আই ডব্লিউ]

Facebook Comments

Leave a Reply