হিমঝুরি : ফাল্গুনী ফাগুন ঘোষ
১
উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত গঞ্জে টলটলে কচি নদীর পারে লীনা-দীপুর আনন্দের সংসার। স্বস্তিরও তা। দীপুর সোহাগে আকাশলীনা কখনো ‘লী’ কখনো ‘লীনা’। আর লীনার ডাকে দীপাংশু কখনো দীপ। আদরের গভীরতায় মাঝে মধ্যে দীপু। গাছ- গাছালিঘেরা দুকামরার সবুজ দ্বীপে এদের সংসার। স্বামী- স্ত্রীর মনের টান, ভালোবাসা সবুজের মতোই তাজা এখানে। নেই কোনো আগুপিছুর টান। অতীতকে এরা ভুলিয়ে রেখেছে। ভবিষ্যতকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। বর্তমানের মধ্যে আছে এক পুতুল পুতুল রাজকন্যা। দীপু-লীনার একমাত্র সন্তান। কাজের মধ্যে প্রাধান্য পায় শিলিগুড়ি শহরে কলেজে পাঠরতা একুশের কন্যাকে ঘিরে দম্পতির স্বপ্নজাল বোনা। লীনার দ্বিতীয় স্বপ্ন–
“আমাদের মেয়ের একটা টুকটুকে রাজপুত্রের মতো বর হবে দেখো লী…”
দীপের কাঁধে আদুরে বেড়ালের মত মুখ ঘষে লীনা। বিয়ের বছর তেইশ-চব্বিশ পার করেও এদের প্রেম ভোরের শিশির ভেজা টাটকা ফুলের সুবাস মাখা।
“হুঁ আমাদের মতো পালিয়ে আসতে যেন না হয়! “ ম্লান হাসিতে চোখ চকচক করে ওঠে লীনার ।
“আমি কিন্তু এভাবে নির্বাসিত হতে চাইনি লীনা! চেয়েছিলাম তুমি সবার কাছে স্বীকৃত হও!”
খুব গভীর চোখে দীপকে পড়ে নেয় লী। ঠিক এই মুহূর্তগুলোতে কতকটা মন এলোমেলো হয় আকাশলীনার। বাবা-মায়ের জন্যই এত কষ্ট হয়তবা। নাড়ীর টান যে। সেই কোন ভরন্ত যুবতীবেলায় দীপের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা প্রেম তার। ধীরে ধীরে জীবনে জীবন গেঁথে নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প। সব বাধা ছিঁড়ে দূরে অনেক দূরে সরে এসে নিজস্ব ঘেরাটোপে একরত্তি সংসার পাতা।
মাঝে মাঝে এইরকম হেমন্তের ঝিমধরা বিকেলে লীনা কোথা থেকে যেন ন্যাতানো আঁচলের মা মা গন্ধ পায়। বাবা মা’র অবাধ্য সন্তান হওয়ার কোনও আফশোস তার নেই। ভাই-বোনেরা তাদের মনের মতো স্বপ্ন পূরণ করেছে। নিজের জীবনে সে নিশ্চিন্ত। স্বামীর যত্ন, পরিচর্যা, সাবধানতা লীনাকে বন্ধুর মতো ঘিরে রাখে। কিন্তু লী আজও বুঝে উঠতে পারেনি, দীপ তাকে কতটা বুঝেছে! দীপ মনেপ্রাণে চায় কাছের কংক্রিটের জঙ্গলে তার সুখের নীড় বাঁধতে। নদীর ঠিক ওপারেই শহররেখার সূচনা। সাজানো ছকে বাঁধা জন্ম মৃত্যুর জীবন প্রতিনিয়ত ধূলোয় গড়াগড়ি যায় সে শহরে।
লীনা একবার অনেকদিন আগে দেখেছিলো। কংক্রিটের জঙ্গলে টাটকা মৃতদেহের অভিমান ইলেকট্রিক চুল্লীতে পুড়ে যেতে। কী তীব্র দহন ! এক বিকৃতির শেষে পড়ে থাকা চিরন্তন ছাই। না, লীনা এভাবে লীনা পুড়তে চায় না। চায় না তার অস্থি, মজ্জা, দেহতন্তু কালো বিকৃত ধোঁয়ার রূপ নিক। ভাবলে শিউরে ওঠে। তার চেয়ে ফুলের মতো ভেসে থাকবে তার দেহ। জলের আলতো স্পর্শ ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে ভেসে থাকবে। তার বাড়ির পাশের ছোটো নদীতেই তাকে যেন ভাসিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে ভাসানো হবে সে ঘাটে থাকবে সুউচ্চ এক সাদা ফুলের গাছ। সারারাতের ক্লান্তি ছুঁয়ে ভোরের আধবোলা আলোয় ঝরে পড়াই সে সাদার জীবন। হয়তো, সে ফুলের নাম হবে হিমঝুরি। যৌবনের ভারে ফুটে থাকা থোকা থোকা সাদা ফুল তার বুকে, মুখে, মাথায় ঝরে পড়বে। হিমঝুরির মধুগন্ধ আকাশলীনার মৃতদেহের পূতিগন্ধ ঢেকে দেবে। লীনার এই প্রথম স্বপ্নের কথা দীপ বারবার হেসে উড়িয়ে দেয়।
২
দীপাংশু হিসেবী, সংসারী যাকে বলি আমরা। গোছানো। লীনাকে ভালোবেসেছে বলে সব বাধা সরিয়ে তাকে নিজের জীবনে এনেছে। সে জানে এবং মানে ভালোবাসলে বেঁধে রাখতে হয়। বুকে আগলে রাখতে হয়। আধুনিক বিলাসিতায়, আরামে স্ত্রীকে জড়িয়ে থাকতে চায় সে। চায় মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ। শুধু লীনার ঐ বেমক্কা আবদার। সেই নাকি তার স্বপ্ন! মৃত্যু নিয়ে রোমান্স যতই সবুজ, সতেজ হোক না কেন, দীপ নিতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে তার।
কিন্তু দীপের অগোচরে অনেক কিছু ঘটে যায় লীনার সংসারে। আজকাল মাঝে মধ্যেই লীনার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। দীপাংশুর এসব জানার কথা নয়! কয়েক মুহুর্তের জন্য হয় এটা! কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশে ঘনিয়ে ওঠে। দিকচক্রবালের সবুজ তখন ধূসর। ধূসর ধোঁয়ায় ঘেরা মাঠ, ঘাট, প্রান্তর, নদী। ঈশ্বরের অসীম কৃপা, দীপুর অনুপস্থিতিতেই এখনও ঘটেছে। নাহলে মুহুর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে পান্ডুর হয়ে ওঠা তার আদরের লী’র মুখ দেখে দীপ চুপ করে বসে থাকত না! নিশ্চয়ই তাকে কংক্রিটের জঙ্গলে হাসপাতালের খাঁচায় বন্দী করে দিত! ভাবলেই কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে লীনার!
শুধু একদিনই দীপু পাশে ছিল। সেদিন ঘোর রাত্রি। লীনার ঘুম চোখে ধূসর ধোঁয়ারা সেদিন রাত্রের কালিমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো। যদি ঘুম ভেঙে যায় স্বামীর, ভয়ে ঘাম সপসপে বিছানায় চাদরের সাথে কুঁকড়ে থেকেছিলো সে।
৩
যে ঘাটের পাড়ে লীনা-দীপুর ছবির মতো নীড়, তার থেকে নদীর উজানে কিছুদূর বাইলে আরেক পারঘাটা। এ ঘাট আরো জনমানবহীন। লোকে বলে এ হলো পাগলাঘাটা। লোকটা মাঝবয়সী। দিন-রাত, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা মানামানি নেই। প্রতিদিন সকাল সন্ধেয় নিয়ম করে ঘাটের পাড়ে এসে বসা চাই তার। পরিচ্ছন্ন পায়জামা পাঞ্জাবি পরা লোকটাকে দেখে কিন্তু মনেই হয় না , তবে লোকে বলে সে নাকি পাগল। সে তাকায়, বিড়বিড় করে। জলের ছলছলে স্রোতের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করার অভ্যাস মানুষটার।
কেউ কেউ সাহস করে জিজ্ঞেসও করে, “নদী ঘাটে কেন রোজ যাও বলতো?”
অবাক বিস্ময়ে দুচোখ তুলে তাকায় ক্ষ্যাপাটে মানুষটা। উস্কোখুস্কো মাথার চুলে খসখস করে আঙুল চালাতে চালাতে থমকে যায় প্রশ্ন শুনে,
“সারাদিন পর ঘরে ফিরব না! ঘরে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করে করে সারা হয়ে গেল যে!”
এরপর খুব বিরক্ত হয়ে দ্রুতগতিতে নদী পাড়ের ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। উবু হয়ে বসে। একরাশ সাদা ফুল বিছিয়ে আপন মনে হাসে। জলে ছুঁড়ে দেয় ফুল। রোজনামচা ফুরিয়ে এলে গুনগুনিয়ে ওঠে, “তোমায় নতুন করে পাব বলে…… “
৪
সেদিনও হেমন্ত বিকেল।
ন্যাতা ন্যাতা মা মা গন্ধের ঝাপটা এসে লাগল লীনার চোখে। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল।
ঐ তো নদী। নদী পাড়ের ফুরফুরে হাওয়ায় ধপধপে সাদা বিছানায় লীনা আরাম করে শুয়ে আছে। তার কপালে বাতাস এসে চুমু খাচ্ছে। পলকা গা শিরশিরে একটা আদরের ছোঁয়া। ঝুরঝুরে একরাশ হলুদ রেণু ঝরে পড়ছে চোখের পাতায়, গালে । লম্বা লম্বা সাদা ফুলের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে সে। এক শ্বেতশুভ্র আবেশ ঘিরে আছে তাকে। সে আবেশ গাঢ় সাদা স্রোতের অবয়ব নিচ্ছে ধীরে ধীরে। কি সুগন্ধ! ভুরভুরে গন্ধের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে আকাশলীনার সাদা বিছানা। অবয়ব আরও এগিয়ে আসছে তার দিকে । মুখের কাছে নুয়ে পড়ছে যেন। আবছা এই মুখের রেখা কি পরিচিত তার! এই সাদা কি তার প্রিয় হিমঝুরি! যার সুউচ্চ ডালপালা হাত হয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে থোকা থোকা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। আহ; পরম নিশ্চিন্তে ঘুম আসছে লীনার।
একটু আগের ভয় খাওয়া থমকে যাওয়া মন একটু জিরিয়ে এসেছে।
কিন্তু দীপু অত দূরে দাঁড়িয়ে কেন! তার আদরের দীপের মুখটা যে তার কাছে আবছা হয়ে আসছে।
৫
পাগলাঘাটায় আজ বেশ কয়েকটি লোকের সমাগম। লীনার মৃতদেহ ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে তার স্বামী ও কন্যা। কোনও রজনীগন্ধার মালায় লীনাকে ঢেকে দেয়নি তার দীপ। বরং সে খুঁজছে সেই সাদা থোকা থোকা ফুল। সে শুনেছে পাগলাঘাটায় এক খ্যাপাটে মানুষ নাকি রাশি রাশি সাদা ফুল জলে ভাসিয়ে দেয়। যদি সে সাদার মধ্যে থাকে দু চারটে হিমঝুরি, এই অনবুঝ আশা তাকে ছুটিয়ে এনেছে পাগলাঘাটায়। তার বড় আদরের লী’র স্বপ্ন ছিল যে! তাইতো মনে আশা যদি পেয়ে যায় সে ফুল! হোকনা পাগল! মানুষের বিপদে কি পাগলের মন গলবে না! তাইতো এই চাতকের অপেক্ষা!
এমন সময় রব উঠল , ‘আসছে আসছে ! ঐ পাগল আসছে!’
হুমড়ি খেয়ে একরকম লোকটার গায়ে পড়ে দীপ— “কয়েকটা সাদা ফুল দেবেন? হিমঝুরি আছে আপনার কাছে?”
থমকে দাঁড়ায় লোকটা। ঘোলাটে চোখে একটু তাকায়। ফুলভর্তি হাতটা পিছিয়ে নেয় বুকের কাছে!
কান্নায় কেঁপে ওঠে দীপের ঠোঁট, “দিন না দু চারটে হিমঝুরি! ঐ যে আমার স্ত্রী শুয়ে আছে! বড় সখ ওর হিমঝুরি ফুলের গন্ধ মেখে নদীতে ভেসে যাওয়ার। ও বলত, ওর নাকি তাতেই বড় সুখ! সেই সুখেই বোধহয় সুখের মরণ আমার লী’কে আমার থেকে চুরি করে ……”
দীপাংশুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দৌড়ে যায় লোকটা। লীনা’র মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবির সুউচ্চ অবয়ব। বারবার লীনার মুখ দেখে…… চারদিকে এলোপাথাড়ি দৃষ্টি ছুঁড়ে আবার লীনার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে…… আবার দেখে…… আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে………কষ্টে মুখ ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে……
‘পাগলের পাগলামি’ , ‘দ্যাখ দ্যাখ পাগলামি করছে’ এরকম মৃদু গুঞ্জন তুলে পাতলা হতে থাকে ভিড় । শোকাতুর স্বামী স্ত্রীর শবদেহের পাশে বিস্বাদের জীবন নাড়াঘাঁটা করতে থাকে।
আর ঐ পাগলটা, জোরে শ্বাস নেয়। হাতের মুঠি আলগা হয় তার। ঝরঝর করে লীনার মুখে, বুকে ঝরে পড়ে হিমশীতল হিমঝুরি… ঝরতেই থাকে … ঝরতেই থাকে হিম হিম শীতলতা…… শীতলতাকে চুঁইয়ে ভালোবাসা……
পঁচিশ বছর আগের বাগদত্তার স্বপ্নে মুখাগ্নি দেয় এক পাগল ।