সম্পাদকীয়

হুজুক আমাদের অনেকের প্রিয় বিষয়। একটা কিছু হলেই মেতে যাওয়া। ভেতরে ঢুকতে হয় না। তলিয়ে ভাবতে হয় না। সৃষ্টিশীল কিছু করতে গেলে একটা কমিটমেন্ট থাকতে হয়। তার অনেক হ্যাপা। তার চেয়ে বরং ফ্রি থাকা ভাল। ভাল এই কারণেই সব বিষয়ে বলা যায়, মন্তব্য করা যায়। দায় নিতে হয় না। অবস্থানটা নিরাপদ। এটা একটা ট্রেন্ড। বিপরীতে আর একটা ট্রেন্ড আছে। যাই ঘটুক একটা যুক্তিযুক্ত অবস্থান নেওয়া। এটার পেছনে একটা কমিটমেন্ট আছে। উদ্দেশ্য বিধেয় সবই আছে। কৌশল আছে, রাজনীতিও আছে। যেমন ধরা যাক আমেরিকার সাম্প্রতিক এক ঘটনা। পুলিশ দু’পায়ের সাঁড়াশি চাপে মেরে ফেলল একজন নাগরিককে যিনি একজন কালো মানুষ। আর এই অমানবিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানেই গড়ে উঠল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন। কালো মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে গেল অজস্র সাদা মানুষ। শুধু তাই নয় অন্যান্য সাদা চামড়ার দেশেও প্রতিবাদ আন্দোলনটা ছড়াল। এদের কেউ কখনও ঘুণাক্ষরেও বললেন না ‘হোয়াইট লাইভস ম্যাটার’। চূড়ান্ত অমানবিকতার বিরুদ্ধে ছিল সাদা কালো নির্বিশেষে তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ। আর সেটা নেমে এসেছে শাসকের নির্মম আস্কারায় অসহিষ্ণুতায়। তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ।

কেউ কেউ আছেন আকাশের দিকে তাকাতে পারেন না। তারা সাথে সাথেই আওয়াজ তুললেন ‘হিন্দু লাইভস ম্যাটার’। দেখাদেখি হয়তো কেউ হয়তো বলবেন ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’। তারও দেখাদেখি চলবে খ্রিষ্টান লাইভস, শিখ লাইভস বা আরও ম্যাক্রো লেভেলে ব্রাহ্মণ লাইভস, দলিত লাইভস অ্যান্ড সো অন – অর্থাৎ বিভাজনের এক পাহাড় গড়ে মানবিকতার প্রশ্নটা ফালা ফালা করে জলে ভাসিয়ে দেয়া যায়, অমানবিকতার জমজমাট চাষ করা যায়, বিত্ত দখলের জন্য যে কোন ডলার মাপের দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠা যায়। মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তো আর জল চলে না!

‘অপরজন’য়ের আপত্তি বা কমিটমেন্ট ঠিক এই যায়গাটাতেই। ধম্মো বা লিঙ্গ বা বর্ণ বা জাতের নামে কোন বজ্জাতি ‘অপরজন’ বরদাস্ত করে না। ‘অপরজন’ স্পষ্ট উচ্চারণে তার সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে মানবিকতার পক্ষে কুণ্ঠাহীনভাবে দাঁড়ায়। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়। শোষণের মধ্যে যে অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, বৈষম্য লুকিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। অপরকে সচেতন করে, বেঁধে বেঁধে দাঁড়াবার বার্তা দেয়। সারা দুনিয়ায় শোষিতরা যারা শাসকের চোখে ‘অপর’, যাদের মধ্যে রয়েছে সব জাত-ধর্ম-বর্ণের মানুষ, যাদের সত্ত্বায় জন্ম বা কর্মসূত্রে কোন ভেদাভেদ নেই, বৈচিত্র্য আছে, যারা সৃষ্ট ঘৃণা, ভেদাভেদ ও অসহিষ্ণুতার শিকার – ‘অপরজন’ সেই ‘অপরদের’ পক্ষে দাঁড়ায়। সবাইকে এক পংক্তিতে দাঁড় করাবার দায়বদ্ধতার স্বাভাবিক পরিণতিতে এই সংখ্যার থিম হয়ে যায় ‘আদার লাইভস ম্যাটার’।

ক’দিন আগে এদেশের মাটিতে যে ঘরছাড়ারা কাজ হারিয়ে, আশ্রয় হারিয়ে ‘ঘরমুখো’ হতে গিয়ে অশেষ দুর্গতির শিকার হয়েছে। তাদের পাশেও আপনাদের সঙ্গে ‘অপরজন’ দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গতি নিয়ে। আর এখন ‘আদার লাইভস’য়ের পক্ষে। সাদামাটা কথা এটাই ‘অপরজন’য়ের কমিটমেন্ট।

‘অপরজন’ পরিবারের সবাই তিনি পাঠক হোন বা লেখক, শুভানুধ্যায়ী অথবা সমালোচক সকলেই আমাদের সাথে যোগ দেবেন – লাঞ্ছিত মানবতার পক্ষে দাঁড়াবেন – যে মানবতা প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে লাঞ্ছিত, দমিত, অপমানিত হয়ে চলেছে আপনার আমার বাড়ির আশে পাশে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। রুখে দাঁড়াবার এটাই সময়। আসুন এবার দাঁড়াই।

অপরজন

জুলাই, ২০২০

Facebook Comments

Posted in: EDITORIAL, July 2020

Tagged as: ,

Leave a Reply