দেবাশিস মজুমদার-এর কবিতা
ব্ল্যাক বিউটি ও কালুয়া
আমাদের ব্ল্যাক বিউটি পড়াতেন যে অধ্যাপক
তাঁর কথার যাদুতে মুগ্ধ হয়ে
যৌবনের স্বপ্ন কালো ঘোড়ার মতন দৌড়ত।
প্রতি রবিবার বাড়ির
নর্দমা টানতে টানতে
ওড়িয়া ভাষায় গান গাইত কালুয়া মেথর
সাদা চাউমিনের সাথে সাদা দুধের ব্রেকফাস্ট
খেতে খেতে সেই গান শুনতে শুনতে
বাথরুমে গেলে নিজের অজান্তেই
বাথরুম-সঙে ঢুকে পড়ত সেই সুর।
সাদা দুধ বাজে লাগত বলে
মুখ বেঁকালে মা নির্দ্বিধায় মিশিয়ে দিত
চকলেট ফ্লেভারের কালচে বোনভিটা ।
সেদিন কখনও মনে হয়নি
ব্ল্যাক বিউটি পড়ানো অধ্যাপক আর কালুয়া মেথরের
গায়ের রং-এর কথা।
বা জীবনের নানা ছন্দের সাথে জড়িয়ে থাকা
সাদা কালোর কথা।
যেদিন জ্যাঠতুতো দাদার বিয়ের পর
বউদির সব ব্যবহার খারাপ
হয়ে গিয়েছিল জ্যেঠিমার কাছে
আর তার একটাই কারণ ধরা পড়েছিল
জ্যেঠিমার উত্তরে …
—”ইস তাকান যায় না, তো কথা কমু কি?”
—”ইস কি কালা, যেন টেলিফোনের
রঙ।”
সেদিন বুঝলাম — সত্যি কালো একটা ব্রাত্য রঙ।
তাই ঠাকুমা বোধহয় বাড়ির কাউকে কালো পরতে দিত না।
অথচ প্রতি সোমবার ঘটা করে জল ঢালতে
যেতেন কালো শিবের মাথায়।
পরে আবিষ্কার করেছিলাম
ঠাকুমা আর জ্যেঠিমার বিয়ের ছবিটাই তো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট।
আয়ারল্যান্ডে থাকার সময়ও
সাদা অধ্যাপক সাবধান করেছিলেন — “ব্ল্যাকিসদের সাবধান।”
অথচ ‘গেইতি’ থিয়েটারে যে মিশকালো নাইজেরিয়ান যুবক আমাকে
নামমাত্র দামে মোজার্টের ‘দ্য ম্যাজিক ফুট’ অপেরার টিকিট দিয়ে
সাদাদের ‘হাউসফুল’, ‘নো টিকিট’ শব্দদুটির
প্রত্যুত্তর দিয়েছিল
তখন বুঝেছিলাম, বর্ণবিদ্বেষ কি আর কাকে বলে?
সবাই বলে সাদা শান্তির রঙ
সারা পৃথিবীর লোক মৃত্যুর পর
সাদাতেই শেষ আশ্রয় খোঁজে
কিন্তু কালো কফিতে বা কালো
চকলেটে ফূর্তি খোঁজে যে
সাদা সাহেবের দেশ
কিংবা আমাদের এখানে
কালীপুজোর দিনে শ্মশান কালীর
কাছে গিয়ে বা
শিবরাত্রিতে কালো শিবের উপাসনা করে
বিপদের মুখে ছাই দিয়ে
আরাধনা করতে যেত
আমার সেই জ্যেঠিমা আর ঠাকুমারা
নির্দ্বিধায়
তাই তো আজ প্রশ্ন জাগে —
কালো ঠাকুরের পাশে কালো মানুষকে
বসাতে যে মন সায় দেয় না
সে মনের আঁধার যে
সারা পৃথিবীর কাছে দুধসাদা স্পষ্ট হয়ে যায়
একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবির মতন।
প্রতিবাদ সহজবোধ্য নয়
খাবার পেল না বলে যে কুকুরটা খেঁচিয়ে দিল
সেও বোঝাল খাবার পাওয়া উচিত ছিল।
নিজের নিজের অধিকারের দাবিতে
যারা পথে হাঁটল
তারাও বোঝাল —
তারা চলমানতাকে মেনে নিতে পারল না।
যে মানুষটা নিজের আদর্শের মিনারে যাবে না বলে
সরে গেল বা অবসর নিল
সেও বোঝাল —
সেও আসলে মানতে পারল না।
যে মানুষটা বর্তমানে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারল না বলে
নিজেকে শেষ করল
সেও কিন্তু বোঝাল না মানার কথা।
আর যারা দল বেঁধে গাড়ি ভাড়া করে
লোক জুটিয়ে মাঠ ভরাল ঘাট ঘোরাল
অচল করার বুলি আউড়ে স্লোগান দিল
তারাও তো আসলি প্রতিবাদের
প্রতিবাদী রূপ দেখাল,
আবার তারাই যখন ক্ষমতার অলিন্দে এসে
অন্যের না পাওয়াকে বুড়ো আঙুল দেখাল
তারাও তখন বোঝাল
প্রতিবাদের প্রকৃত রাস্তা সোজা নয়।
আর যারা মানুষের মনের মধ্যে জমে থাকা
চিরকালের না পাওয়া সত্তাকে উস্কে দিয়ে,
তাদেরকে সামনে এগিয়ে দিয়ে
মৃত্যুর স্বাদ পাওয়াল
আর নিজেদের বুদ্ধিকে সেই হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে
লাভের গুড়ের স্বাদকে
প্রতিবাদী স্বাদে বদলাল তারাই
আগামীর ইতিহাসের পাতায়
স্থায়ী প্রতিবাদী হল।
ওরাই তো ইতিহাসকে আধুনিক করে বোঝাল —
প্রতিবাদ করা সবার যেমন উচিত,
তেমনি বোঝাটা নয় —
কারণ
প্রতিবাদ সহজবোধ্য নয়।
Posted in: July 2020 - Cover Story, POETRY