জাহাজডুবির একমাত্র জীবিত নাবিক : দীপ শেখর চক্রবর্তী
আচমকা নিজের ভেতরে এতসমস্ত ছিদ্র খুঁজে পেলে অত্যন্ত বিভ্রান্ত লাগে। কোথায়, কখন-সে সম্পর্কে চেতনা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে এক অসীম নিঃসঙ্গতার কালো জলে যেন ভেসে আছি। প্রবল গরমের রাতগুলোতে বিছানায় জোর করে ধরে রাখা শরীর একটি ব্যর্থ সম্পর্কের মতো। নিজের ভেতরে একটা ঘরের মুগ্ধতা খুঁজে যে আলো নিভিয়ে দেবো সে উপায় নেই। আলো আরও স্পষ্ট করে যাচাই করে নিতে চায়, দেখতে চায় শরীরের ভেতরে এতসমস্ত ছিদ্র কবে থেকে?
সেসমস্ত বাড়ির কথা খুব মনে আসে যেখানে আর কোনদিন যাওয়া হবেনা। কিছু মানুষ স্মৃতির নিঃসঙ্গ দুপুরবেলা একটা ভাঙা চেয়ারের ওপর বসে থাকে, মনে আসে তাদের সঙ্গে একদা কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। আবেগের সঙ্গে আবেগ, মনের সঙ্গে মন, শরীরের সঙ্গে শরীরের ঘনিষ্ঠতা। বৃষ্টির পরে পুরনো পাড়ার মুগ্ধতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। মনে হয়, আমি এমন এক নাবিক যে জাহাজডুবির পর অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেছি। সহনাবিকদের প্রেত আমার সন্ধের উপকূলে আকাশ-বাতাস জুড়ে এক আশ্চর্য গান গায়। এই গন্ধ, এই গান মিলেমিশে এক আশ্চর্য অনুভবের জন্ম দেয়। জীবন যত বেশি আমার এই হাতের মুঠো থেকে পড়ে যাচ্ছে ততবেশি কেন সুন্দর হয়ে উঠছে এই পৃথিবী?
জাহাজডুবির পর যে নাবিক একমাত্র বেঁচে গিয়েছে তার হৃৎপিণ্ড দিয়ে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের বেহালা। অথচ যে বাজায়, যে শোনে তারা এর কিছুই জানে না। জীবন তাই এতটা মধুর।
যখন যেখানে হাঁটি, মনে হয় একা একা কথা বলে যাচ্ছি। আসলে হেঁটে যাওয়া তো তাই-অবিরাম স্বগত সংলাপ। অথচ কোন শব্দ নেই কারণ নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে বহুদূর দেখা যেতে পারে। একটি বিন্দুর মতো নিস্তব্ধতা-একটি সরলরেখার মতো তার স্বগত সংলাপ। একটি বিন্দুর মধ্যে এই সমস্ত শরীরটাকে আমি সমাহিত করতে চাই। একটি বিন্দুর ভেতর দিয়ে যতটা জীবন দেখা যায় মাঝে মাঝে সমস্ত জীবন খুলেও তার কিছুমাত্র দেখা যায়না।
কাজিপাড়ার সেই পুরনো বাজারের ভেতরে এখন আর মোরগ লড়াই হয়না নিশ্চিত। বাবার হাত ধরে মসজিদের সামনে বড় জমিটায় মোরগের পায়ে বাঁধা ধারালো অস্ত্রটা চোখে মকরত মণির মতো করে জ্বলতো। সমুদ্রে সেবার গিয়ে দূরের এক উপকূলে বসে দেখেছি জলের ভেতর সেই মকরত মণির খেলা। সমুদ্র কি এক বিরাট লড়াইয়ের মোরগ? যেখানেই যাই, যা দেখি, মনে হয় তার পেছনে এক গভীর অর্থ আছে। মনে হয়, কেউ দৃশ্যের ভেতরে ভেতরে রেখে গেছেন কিছু সংযোগসূত্র। তার অস্তিত্ব বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বদলে যায়। একদিন মনে হত ভালোবাসা, একদিন মনে হত মৃত্যু। আজ বুঝি আসলে আমার জন্যই আমি এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে বিছিয়ে রেখেছি এই পথ। অবশেষে রুপোলী মেঘে ঢাকা এক অরণ্যের নির্জনতার ভেতর দেখা হয়ে যাবে নিজের সঙ্গে নিজেরই।
তারপর? একই শরীরে মিশে যাওয়া? বৃষ্টির পর দূর মসজিদ থেকে জলে ভেজা অক্ষর নিয়ে বুকের ভেতর কাঁপন লাগায় এক সুর। বামুনমুড়োর রাস্তার ভেতর থেকে এগিয়ে যাই সেই বাঁধানো রহস্যময় পুকুরের দিকে। একদিন ঘুম ভেঙে ভেজা জামাকাপড়ে এই পুকুর থেকে উঠে এসেছিলাম। সমস্ত শরীর জুড়ে কচুরিপানার গন্ধ, বিক্ষিপ্ত শামুক, মাছেদের কয়েকটা কামড়ের দাগ। এমন শরীর নিয়েই একদিন দাঁড়িয়েছিলাম মেয়েদের ইশকুলের পেছনের গলিতে যেখান থেকে সুস্পষ্ট দেখা যেতে পারে ভালোবাসার সবুজ জানলাটা।
অথচ কেউ এসে দাঁড়ায়নি সেখানে। কেউ সেই ইশকুল থেকে বেরিয়ে এসে আমার কচুরিপানা মাখা এই ভেজা শরীরের ঘ্রাণ নেয়নি। আমার এই চিরপলাতক অস্তিত্বের ভেতর কেউ মাথা ঢুকিয়ে দেয়নি। কারও কানের কাছে ঝুলে থাকা একটা চুল আমি পাকিয়ে নিতে পারিনি এই মাছে খাওয়া আঙুল দিয়ে। কাউকে নিয়ে আমি শুয়ে পড়তে পারিনি গমক্ষেতের উষ্ণতার ভেতরে। শুধুমাত্র দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়েছি একটি মেয়েদের ইশকুলের সামনে। আমি তার দেওয়ালের গায়ে একটা শাদা খড়ি দিয়ে বারবার লিখে যাচ্ছি নিজের নাম সহস্রবার।
যেন নিজের নামের বানান ভুল করেছি বলে শিক্ষক শাস্তি দিয়েছেন আমাকে।
আমাদের এই সামান্য পাড়ার ভেতর সবথেকে আশ্চর্য হল সুপুরিগাছে ঘেরা মাঠটি, সেটি পূর্বে কবরস্থান ছিল। এই কথা সকলেই জানে এমন মাঠেই জন্ম নিতে পারে কিংবদন্তী খেলোয়ার যে মাঝমাঠ থেকে জালে বল জড়িয়ে দিতে পারে। অথচ আমি নাবিক, তাই এই মাঠে প্রবেশের অধিকার কখনই পাইনি। এক পা ঘাসে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবর থেকে মৃতেরা উঠে এসে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে মাঠের বাইরে। জীবন এমনই। কিংবদন্তী খেলোয়াড়টির জন্য সর্বদা মাঠের শিওরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে নাম ভুলে যাওয়া ফুল হাতে মেয়েটি।
কি আশ্চর্য এই মেয়েটির মুখ ঠিক আমার মায়ের মতো-কি আশ্চর্য এই মেয়েটির মুখ ঠিক আমার বোনের মতো-কি আশ্চর্য এই মেয়েটির মুখ ঠিক আমার দিদিমণির মতো।
রাতের বেলা এই মেয়েটিও ছাদে বসে একা একা ছিঁড়ে ফেলে ফুলের পাপড়িগুলো এবং সমস্ত ছড়িয়ে দেয়। আমি দেখি, আমার ভয় লাগে কারণ আমি নিশ্চিত জেনেছি এই কথা- যে মানুষ কখনও কোন কথাই সঠিক সময়ে বলতে পারেনি কাউকে সেই গভীর রাত্রে ছাদে উঠে আসে, একা বসে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে নেয়। সেই ফুলের পাপড়ি ধরবো বলে কতরাত আমি ছুটে বেরিয়েছি পথে পথে।
ভয় ছিল আমাকে হয়ত ধরে ফেলবে সেই অদৃশ্য পাহারাদার, যাকে কেউ নিয়োগ করেনি এখানে। শুধু মাঝে মাঝে বাঁশি হাতে ঘুরে সে জাগিয়ে রাখে। জাগিয়ে রাখে কি আসলে? নাকি ঘুম পাড়ায়? আমার মনে হয় সে আমাকে ধরে ফেলে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের কাছে। আমাকে ডুবিয়ে দেবে সে,কারণ এতদিনে আমিও জেনে গেছি-যার হারিয়ে যাওয়ার খবর একবার প্রচারিত হয়ে যায় তার হারিয়ে যাওয়াই ভালো।
সে ফিরে এলে সকলেই অস্বস্তিতে থাকে।
অথচ এই আমার ভেসে থাকার আশ্চর্য ক্ষমতা, এক টুকরো শুকনো কাঠের মতো। যা দিয়ে কোনোপ্রকার বাদ্যযন্ত্র হয়না। যা দিয়ে প্রহারও সম্ভব নয়। শুধু এক খন্ড শুকনো কাঠের মতো এই জীবন। চির-নির্বাসিতের মতো করে আমি পাক খাই আমার এই পাড়া জুড়ে। আরও কিছুটা হয়ত দূর-পুরনো স্মৃতির পাড়া। কিছু কিছু ক্ষতস্থান যা আজীবন শুকিয়ে যাবেনা। সামান্যও অহংকার তাকে ঘিরে-মলমের ব্যবহার করিনি কখনও।
বৃষ্টির পর পাঁচিলের শ্যাওলার ধার দিয়ে ক্রমাগত হেঁটে চলেছে আমার স্বগত সংলাপ। জীবনের সমস্ত মুগ্ধতার ভেতর থেকে তার কথা শুনি। যাকে আমি খুঁজে চলেছি রাতের পর দিন-পথে,পথে-বিন্দু থেকে বিসর্গে।
আজীবন নির্বাসিত আমি, একটি সামান্যও বাড়ির বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো, চলে যাবো। সেই ঘরের ভেতরে রয়েছে আমার সামাজিকচিহ্নসমূহ।
সে ঘরের ভেতরে কোথাও আমার দুটি কাটাহাত, এতদিনে ইঁদুরে খেয়েছে।