সাক্ষাৎ ভালোবাসা! – বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

শত-শত হাজার ওয়াটের হ্যালোজেন আলোয় তখন ঝলসে যাচ্ছিল গোটা মঞ্চ, যেমন অজস্র জ্যোতিষ্ক-মধ্যে আটক উলঙ্গ পৃথিবী। ছায়ার লেশমাত্র ছিল না কোথাও, কোনোখানে- মধ্যিখানে, মেঝেতে শুয়ে ছিল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে- অবিকল আদিম নর ও নারী। সটান-শায়িত, নির্বিকার এবং দৃষ্টি উর্দ্ধগামী। চতুর্দিকে আলোর সমারোহে তাদের নগ্ন দেহ উলঙ্গতর হয়ে উঠেছিল, রন্ধ্র-রন্ধ্র উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল ক্ষেত্রব্যাপী; তবু বৃন্ত নিস্তেজ, লিঙ্গ ঢালু– মঞ্চময় এক অকাম অস্তিত্ব।

মুহূর্ত চঞ্চল হয়; মৃদু হয়ে আসে আলো। যুদ্ধবিমানের গম্ভীর শব্দে নেপথ্য গমগম করে উঠলে ছেলেটির মুখ থেকে বেরনো সবুজ রশ্মি সরলরেখায় মঞ্চের ছাদ ছুঁয়ে ফেলে, যে ছাদময় তখন নীল আলো ফ্লুওরোসেন্ট আভায় ক্রমাগত আন্তর্জাল বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত, দর্শকের চোখে যেমন প্রাণের প্রোটোজোয়ার কসমো-দর্শন। উৎপল-নীল ঐ সবুজ ঋজুরেখা আপন দেহমধ্যে ধারণ ক’রে পুনরায় সবুজে মেয়েটির মুখে স্থানান্তরিত করতে থাকে দ্বিতীয় সরলরেখায়। ইতিমধ্যে দুই সবুজের যৌথ নীল উত্তাল হয়ে ওঠে, বিমানের বোঁ-বোঁ শব্দ তীব্রতর হয়, বৃন্ত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, লিঙ্গ উন্নত হয়;- দু’জনের শরীর জমি ছেড়ে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে, ক্রমশঃ দূরবর্তী হয়ে মঞ্চময় উড়ে বেড়ায় দিক-বিদিক;- ঋজুরেখ সবুজদ্বয়ের সে এক উদ্দাম লেজার-নৃত্য! তবু এত আলোকচাঞ্চল্যের মাঝেও দুই দেহ যেন দুই প্রেত, ভারশূন্য তন্দ্রায় একে অপরকে কেন্দ্র ক’রে ভেসে বেড়ায় কামুক গতিতে। সে এক আদিম সম্ভোগমুখী ব্যাকুল অনুধাবন!- দর্শকেন্দ্রিয়ে যা আলোড়িত ক’রে তোলে ঈক্ষণ-কামনার তরঙ্গ-জোয়ার। অতঃপর কোনো এক আকস্মিক মুহূর্তে শব্দের মন্দ্র স্তব্ধ হয় খানিক অবকাশে; এক প্রকা-আ-আ-ণ্ড বিস্ফোরণ!- যাকে মতান্তরে মহাবিস্ফোরণ-ও বলা চলে, দুই দেহের সংঘাত ঘটায় ছাদের অদূরবর্তী উচ্চতায়। সমগ্র নীল ও সবুজ অতর্কিতে অন্তর্হিত হয় মুহূর্ত-চমকে; মঞ্চময় ধুন্ধুমার আলো দপ্‌ করে জ্বলে উঠে চোখ ঝলসে দিয়ে স্থানু হয় এক নীরব অন্ধকার পলকে যাকে অতিক্রম ক’রে একটি নলাকৃতি ক্ষীণ সাদা আলো বরাবর দুই দেহকে আষ্টেপৃষ্ঠে প্রচণ্ড তীব্রে পাক খেতে খেতে নেমে আসতে দেখা যায় সেতারের ঝংকার-ধ্বনির নেপথ্যে; অবশেষে ক্লান্ত এক চুম্বন স্পর্শ করে দর্শকের চোখ; যবনিকা-পতন।

নিকষ কালো একটা প্যাঁচা মাথা টপকে চাঁদের দিকে উড়ে যেতেই তার ডানায় বাতাস কেটে যাওয়ার শব্দে চমক লাগে অভিমন্যুর। সেই কখন থেকে অদিতির জন্য অপেক্ষা করছে সে;- এতক্ষণ একনাগাড়ে দু-হাতে হাঁটু আগলে ব’সে থাকায় তার পিঠ থেকে কোমর অব্দি জমাট বেঁধে এসেছিল, ন’ড়েচ’ড়ে বসতেই কট্‌কট্‌ ক’রে কশেরুকা ফাটে। প্যাঁচাটার গাঢ় ছায়া ক্রমশঃ ছোট হ’তে হ’তে চাঁদের গায়ে মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তখানেকের মধ্যে প্রকৃতি যে ধ্যান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল, তার অস্থি-মড়মড় শব্দে তা যেন পুনর্বার বিচলিত হয়ে পড়ে এবং অলৌকিক প্রতিবর্তে অভিমন্যু সিদ্ধান্তে আসে- এইখানে, প্রকৃতির এই স্থানাঙ্কে বুঝি-বা সময়ের কোন প্রবাহ নেই, যা বর্তমান তা কেবল ঘটনার তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশমাত্র; যাকে সময়ের নদী ব’লে ভ্রম হয় অনুক্ষণ, তা আসলে ঘটনার বিচ্ছিন্ন স্রোত ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়।
আজকাল তার এই এক নতুন- কথায় কথায় কার্য-কারণ-সিদ্ধান্ত; সায়েন্টিফিক মাইন্ডের নিরন্তর অনুশীলন।

অভি প্রাইভেট টিউটর; কয়েকবছর হ’ল ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান পড়ায় সে, মাঝেমধ্যে গল্প লেখে আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঠিক কি করা উচিত তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ বিষয়ে তার যুক্তিনির্মাণ থেকে সিদ্ধান্ত সবটাই বড় ব্যাকডেটেড্‌, অর্থাৎ অর্থকরী লক্ষ্যের দিকেই যে সিদ্ধান্ত-নিষ্পত্তির ঝোঁক – তার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা নয়, আরও নানা ফ্যাক্টর, নানা দ্বন্দ্ব – নানানরকম আবেগ সেখানে জড়ো হয়, আর তাই চারপাশের মার্কেট ইকনমির একমুখী প্রবাহের তোড়ে তাকে দেখে কারোও মনে হতেই পারে যেন-বা দিশাহীন কোন স্রোত যা অচিরেই ঘূর্ণির কবলে শৃঙ্খলিত হবে। প্রাথমিকভাবে যদিও সে একজন লেখক হয়েই উঠতে চায়, কিন্তু লেখা আর বেঁচে থাকা – এই ক্রিয়াদুটোকে পৃথকভাবে দেখতে গিয়েই তার যাবতীয় লেখকবোধ ও জীবনবোধ বিপন্ন হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে, নিজের পরিপার্শ্বে, এই ক্রিয়াদ্বয়ের মধ্যে যে লেনদেন – যে সম্পর্ক, তা যেন সহজে বোধগম্য হ’তে চায় না; অথবা, বোধগম্য হলেও সে মেনে নিতে পারে না। এই দোটানায় মাঝখান থেকে পিএইচডি করার ইচ্ছেটা কখন যে মনের গভীরে চাপা পড়ে যায় তা সে খেয়ালই করে উঠতে পারেনা, উল্টে জমাট বাঁধে অ্যাকাডেমিয়া নিয়ে তীব্র বিরোধ, যা বড্ড বায়াস্‌ড এবং যেকোনো তর্কেই যা হয়ে উঠতে পারে অন্ধ-মতানৈক্য। এমনকি কয়েকমাস যাবৎ নতুন কিছু লিখে ওঠাও তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। লিখতে বসলে পরে কেবলই মনে হয় প্রস্তুতিতে বুঝি কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে;- যদিবা লেখে, সেই লেখা এগোতে না এগোতেই হারিয়ে ফেলে দিশা;- কিভাবে একটা গল্প নির্মাণ করা যায়, এখনকার সময়ে-সমাজে আদৌ কোনো গল্প নির্মাণ করা সম্ভব কিনা – এইসব জটিল-কুটিল প্রশ্নে মন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলত সে প্রচুর বইপত্র পড়তে থাকে, দেশ-বিদেশের লেখকদের লেখা পড়ে শেখার চেষ্টা করে দ্য আর্ট অফ ফিক্‌শন, তবু নিজে কিছুই লিখে উঠতে পারে না। কি নিয়ে লিখবে সে, তার গল্পের বিষয় ঠিক কি হ’তে পারে;- মাঝেমধ্যে এমনও মনে হয়, নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একের পর এক আপনজনের বিচ্ছেদ বুঝি তার সমস্ত ইচ্ছেশক্তিকে অবশ করে দিয়েছে, পরাজিত করে বন্দি করে রেখেছে কোনো গোপন কারাগারে;- ঠিক তখনই মায়ের মুখ ভেসে ওঠে – চুল কাঁচাপাকা, মুখে স্পষ্ট বলিরেখা। বাবা প্রায় বলতেন – “তুমি থেমে থাকলেও সময় থেমে থাকে না…”

আজ অদিতির আসতে বড্ড দেরী হয়। পূর্ণিমার রাতে অলীক আকাঙ্ক্ষার মত গোলাকৃতি চাঁদের নিচে খোলা মাঠে অভিমন্যু অপেক্ষা করে – পাঁচ মিনিট… দশ মিনিট… পনের মিনিট… সামনেই কয়েক হাত দূরে তিরতির করে বয়ে চলে একটি ক্ষীণতোয়া নদী- অভি নাম দেয় শিঞ্জিনী, তার স্রোতের শব্দ ভাবনাকে নিষ্কলুষ করে ঝরিয়ে দেওয়ার এক অপার্থিব প্রচেষ্টামাত্র। বেশ কিছুটা দূরে জঙ্গলের গা বেয়ে যে উঁচু-উঁচু টিলাগুলোকে দেখতে পাওয়া যায়, তারা দৃষ্টিকে হারিয়ে যেতে দেয় না, আটকে রাখে চাঁদের সর পড়ে যাওয়া তাদের নীরব শরীরে। এমন নিস্তব্ধতায় ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে চুপ করে ব’সে অতীত-স্মৃতি-ভবিষ্যৎ ভাবনায় অভি বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলে…
দিনদুয়েক আগে অদিতির সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়েছে, যদিও দিনদুয়েক আর ঘন্টাকয়েকের পার্থক্য বড়ই ক্ষীণ মনে হয় আজকাল। যত দিন যায়, সময় ঘিঞ্জি হয়ে ওঠে; দায়িত্ব আসে, প্ল্যানিং আসে… বিগত কয়েকমাসের প্রতিটা দিনের মতোই অদিতি সেদিনও চাকরি নিয়ে অভিকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছিল, খুব স্পষ্ট করে বোঝাতে চাইছিল একটা স্থায়ী চাকরি না পেলে তার বাবা তাদের সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নেবেন না; আর অভি তখন উদাসীন মনে তাকিয়েছিল কালো পাহাড়গুলোর দিকে। সে লেখালেখি নিয়েই থাকতে চায়; দশটা-পাঁচটার চাকরি করার মানসিকতা সে কোনোকালেই তৈরি করে উঠতে পারেনি। একটা ফ্রিল্যান্স জবের সন্ধান যদিবা পেয়েছে, অদিতির কথার চাপে তাকে খবরটা জানিয়েই উঠতে পারেনি সেদিন। অদিতি তার চুপ করে থাকা আর সহ্য করতে না পেরে মারাত্মক ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, “তোর যা মনে চায় তুই তাই কর, শুধু আমায় মুক্তি দে।” অভি তারপর থেকে আর একটাও কথা বলেনি; অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে কি-জানি কি-এক চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েছিল। আজকাল সে বড় তাড়াতাড়ি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে; এক বিষণ্ণ অভাব জেঁকে বসে থেকে-থেকেই;- যদিও সে জানে এসবই ছিল, আছে, থাকবেও; এমনকি যা-যা ছিল না, যা-যা নেই বা যা-যা হবে না কোনদিনও, সবটাই। তবু কখন না জানি, কোন মায়াবলে এক হা-ঘরে অভাব জেঁকে বসে থেকে-থেকে…

অদিতি আসে আরোও কিছুক্ষণ বাদে। অভি ঘাড় ঘোরাতেই দেখে, অদিতি পাশে ব’সে –
‘আজ এত দেরী?’ –
‘একটা অ্যাসাইনমেন্ট ডিউ আছে, কালকের মধ্যে সাবমিট করতে হবে; ওটা নিয়েই একটু ব্যস্ত আছি’ –
‘আচ্ছা’ –
‘কিছু ভাবলি সেদিনকার কথাগুলোর ব্যাপারে?’ –
‘ভাববার কি আছে; সেদিনই তো বললাম কোর্স-টা কমপ্লিট কর। তারপর দু’জনে মিলে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নেওয়া যাবে।’
‘হুম্‌ম্‌…’

কোনোরকম কথার অনুপস্থিতিতে কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও একটা দমচাপা নিস্তব্ধতা আঁকড়ে ধরে দু’জন মানুষকে; তবু আজ অদিতির চুপ ক’রে থাকতে ইচ্ছে করে না, কৌতুহলী স্বরে সে প্রশ্ন করে – ‘নতুন কিছু লিখলি?’ –
‘নাহ্‌; একটা গল্পের প্লট মাথায় এসেছে, কিন্তু লিখে উঠতে পারছি না। গল্পটা কিছুতেই দাঁড় করানো যাচ্ছে না। সেটা মেইবি আমার প্রিপারেশনেই কোথাও ফল্ট আছে ব’লে…’ –
কথাটা শুনেই অদিতি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে, যেন ঠিক এই উত্তরটাই পাবে ব’লে সে নিশ্চিত ছিল;- বেশ জোর গলাতেই চেঁচিয়ে সে বলে – ‘তুই আর কতদিন, কতদিন এই ভেবে নিজের ইন্সটিংক্টকে আটকে রাখবি বলতে পারিস! সেই কবে থেকে শুনে আসছি এই কথাগুলো; তুই একবারও ভালো করে ভেবে দেখেছিস বেসিক্যালি তুই কি চাস? তোর প্রায়োরিটিগুলো ঠিক কি…’- ‘একবারও’, ‘বেসিক্যালি’, ‘প্রায়োরিটি’ শব্দগুলোর ওপর অত্যধিক স্ট্রেস্‌ দেয় সে-
খারাপ লাগে অদিতির। যতই হোক সে যে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিল কথাগুলো বলার সময় তা সে বুঝতে পারে এবং অভির কথা ভেবে তার কষ্ট হয়। অভি ছেলেটা দিন-দিন ভীষণ ইম্পেনেট্রিব্‌ল হয়ে উঠছে। অদিতি আগের মতন ক’রে তাকে আর ছুঁতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, ‘কতকাল হ’ল আমরা হারিয়ে গেছি বল, সবকিছু কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে…’–
কথাটা ছাল-ছাড়ানো বেতের মতোই সপাং করে লাগে অভির কানে। সে তক্ষুনি অদিতিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কই? না-তো!’ তার কথায় একটা ম্লান হাসি খেলে যায় অদিতির মুখে। অভি কতদিন যে এভাবে দেখেনি অদিতিকে! কি অপূর্ব-সুন্দর মুখ তার, যেন-বা স্নিগ্ধ শ্যামলিমা; নিবিড়-ঘন চোখে সে এক মায়া-বিষাদের খেলা;- এমন দৃশ্যে হায়, আলোকিত চাঁদও যেন করুণার বশে ঝরে পড়ে অদিতির ঠোঁটে; বহুদিন পর অভির আজ ফের তাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে, তার ওষ্ঠের কম্পনে ধুয়ে নিতে ইচ্ছে করে সমস্ত দুঃখ-একাকীত্ব। অদিতিও তাকে বাধা দেয় না আর;–
ঠোঁটে ঠোঁট মিশে যায়, শরীরে কাঁপুনি আসে অযাচিত আর রুপালী থালার চাঁদ কেবল উদাসীন তাকিয়ে থাকে।
শরীরেরা ম’রে গেছে, কবেকার কে জানে। কোনো সাড় নেই আর, কোনো ছোঁয়া নেই। জন্ম-জন্মান্তর হাতরে মেলে বহুব্যবহৃত সঙ্গম-স্মৃতি; বিন্দু-বিন্দু নিঃসৃত হয় ইরোটিক ভাবকল্প। বাস্তব, সে আর নেই। জমে আছে পূর্বজন্মের উপযোগী স্মৃতি কেবল, পূতিগন্ধময়…
অভি ঠোঁট সরিয়ে নেয়; হতাশ চোখে দেখে অদিতি তখনও সেই শূন্যকে ঠোঁটে চেপে চোখ বুজে বসে আছে। সেই একই মুখ, একই পোশাক, একই দেহ; গত দেড়বছরের গ্লানি যাকে এতটুকু ছুঁতে পর্যন্ত পারেনি; অথচ এই দেড়বছরেই অভির দাড়িতে পাক ধরতে শুরু করেছে; অভি একা হয়ে গেছে, হয়ত অদিতিও… এবং প্রেম মানে যদি দুটি প্রাণের যত্নলালিত ইতিহাস হয়, তবে তা-ও আজ ধ্বস্ত হয়ে গেছে…
অভি পাহাড়ের দিকে তাকায়। তার মন চায় ঐ কুৎসিত উঁচু পাহাড়গুলোকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে আর তক্ষুনি একটা অদ্ভুত ঘটনা তার নজরে আসে।

সে দেখে অন্ধকার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে লাল-লাল আলো মানুষের গঠনে নেমে আসছে, যেন হৈ-হৈ করে ছুটে আসছে তাদেরই দিকে;- মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সদলবলে তাদের নদীর ওপারে পৌঁছে যাওয়ার কথা। চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে লাল মেঘে। কড়াৎ-কড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে পিলে চমকে দিয়ে। অমাঙ্গলিক আঁচে আচমকাই মুষড়ে পড়েছে গোটা রাত্তির। ব্যাকগ্রাউন্ড দখল করে নিয়েছে একটা হাই-অক্টেভ হর্‌র্‌ মিউজিক; উদ্বেগের সঙ্গে সিঙ্ক্রোনাইজড্‌। মুহূর্তে দেখা যায় লাল-লাল লিলিপুটেরা জঙ্গলের অন্ধকার দখল করে নিচ্ছে ভয়াল আলোয়।

অভি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। পাশ ফিরে দেখে, অদিতি নেই। ব্যাপারটা কি? ঘটনাচক্রে তার মনে একটা ভয়ঙ্কর ভয় তৈরী হয় যার কারণ সে নিজেও আন্দাজ করে উঠতে পারে না; অভিমন্যু স্তব্ধ হয়ে ব’সে থাকে অথর্বের মত…

অদিতি অফলাইন হয়ে যায়। সবার আগে অদৃশ্য হয় লাল-লাইটের লিলিপুটগুলো। আকাশও তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হরর্‌ মিউজিক বন্ধ হয়ে ফের নদীর স্রোতের কলকলে শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হয়। অভির স্নায়ু ক্রমে শিথিল হয়ে এলে রহস্যটা বুঝতে পেরে সে তাজ্জব হয়ে যায়।
বেশ কয়েকদিন আগে অ্যালার্মের এই ফিচারটার ব্যাপারে অদিতিই তাকে খবর দিয়েছিল। সে এও বলেছিল এক্সপিরিয়েন্সটা এখনও পার্সোনালাইজড্‌ করা পসিব্‌ল হয়নি। সফ্‌টওয়্যার বাগ্‌। তাই অ্যালার্মিং এক্সপিরিয়েন্স কমন্‌ ইন্টারফেসেই ঘটবে। কিন্তু অভির আশ্চর্য লাগে এত চয়েস্‌ থাকতে অদিতি কিসের জন্য এরকম একটা এক্সপিরিয়েন্সকে রিমাইন্ডার হিসেবে সেট্‌ করে রেখেছিল, সেকথা ভেবে। ব্যাঙ্গালোরের টপ্‌-নচ্‌ ইন্সটিটিউট থেকে ফ্যাশন ম্যানেজমেন্টের কোর্স করছে সে, অ্যাসাইনমেন্টের খুব চাপ। তবে কি এটাই কারণ, নাকি অন্য কিছু? অদিতির এরকম চয়েসের পক্ষে-বিপক্ষে সে কিছুক্ষণ বৃথা যুক্তির জাল বোনার চেষ্টা করে এবং অগত্যা সেই জটিল যুক্তিজালে আত্মবিস্মৃত হয়েই হয়ত হাতের মুঠোয় ধরা টাচ্‌ কন্ট্রোলারের বোতাম টিপে চ্যাট্‌ মোড চেঞ্জ করে গেম মোড অন্‌ করে দেয়, আর ঠিক তক্ষুনি বদলে যায় চারপাশের আবহ।

চাঁদ হয়ে ওঠে লাল; ব্লাড মুন। গ্রহণের মাঝে যেন রক্তে স্নান সারে। যে নদী সামনে দিয়ে সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছিল এতক্ষণ, নিমেষে তা প্রকাণ্ড খাতে অভিমন্যুর হাত-দশেক পিছন দিয়ে প্রবল বেগে বইতে থাকে। পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গল থেকে নেকড়ের ডাক ভেসে আসে। অভির হাতে একটা শট্‌গান। তার কিছুতেই আর মন লাগতে চায় না। বন্দুক হাতে জঙ্গলের দিকে এগোনোর সময় সে অদিতির কথা চিন্তা করে-
মেয়েটা গত দেড়বছর কলকাতায় ফেরেনি। নানানরকম পারিবারিক রেস্ট্রিকশনের মধ্যে বাড়িতে ফিরতে ওর মন চায় না। আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছিল কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্গালোর ঘুরে আসতে; আমারই যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমাদের যেটুকু যা দেখা-সাক্ষাৎ তা এই ভি.আর প্ল্যাটফর্মেই হয়। এমনকি এই ডিভাইস-টাও তারই দেওয়া, যাতে আমাদের মধ্যে নিয়মিত দেখা আর কথা দুই-ই হ’তে পারে; কিন্তু ঐ যে শরীর এতক্ষণ দেখলাম, যাকে জড়িয়ে পেতে চাইলাম হারানো সময়ের স্পর্শ, তা তো অদিতির নিজের নয়! ইনফ্যাক্ট কোনও শরীরই নয়। ওটা তো তার দেহের একটা ভার্চুয়াল ম্যাপিং, তারই পছন্দমতন বছর-পঁচিশের ভারতীয় যুবতী অ্যাভেটারের শরীরে। সেখানে অদিতির নিজের বলতে শুধুমাত্র তার ফেশিয়াল এক্সপ্রেশান্স আর অঙ্গভঙ্গিগুলোর ইনস্ট্যান্ট্‌ ম্যানিফেস্টেশান্স। এমনকি এই যে আমার শরীর, আমার নাক-কান-চোখ-বুক-হাত-পা – এগুলোও তো রিয়্যাল নয়! আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে ম্যানিপুলেট করে তৈরী করা একটা সিমুলেশন মাত্র, আর তাও একজন অনুর্দ্ধ-চল্লিশ ইন্ডিয়ান মেল অ্যাভেটরের, অদিতিরই পছন্দ করে দেওয়া। কিন্তু কতদিন, কতদিন আর ভালো লাগে এই মিথ্যে-মনোরম চাঁদ-পাহাড়-নদীর মাঝে ব’সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বাস্তবকে নিয়ে কথা বলতে? এত নিখুঁত সবকিছুর মাঝে রোজকার পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত লজ্‌ঝড়ে হয়ে যাওয়া দুটো আত্মার কথোপকথনের সত্যতা কাঁহাতক্‌ মেনে নেওয়া যায়! অদিতি, আমি আর মেনে নিতে পারছি না এই যোগাযোগ যাতে কোনো শরীর নেই; ইন্দ্রিয় বিকৃত ক’রে তৈরী এই শারীরিক স্পর্শ আমি আর কোনমতেই পারছি না স্বীকার করে নিতে। নকল জ্যোৎস্না আর ভালো লাগে না, অদিতি; চতুর্দিকে শুধু আলো আর আলো! কতরকম সুযোগ-সুবিধে, যোগাযোগ, টেকনোলোজি, প্রগ্রেস, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড; তবু ঐ শালা চাঁদ…ওহ্‌হ্‌হ্‌…

অভিমন্যু চাঁদের দিকে ধাঁই-ধাঁই ক’রে পাঁচটা গুলি ছোড়ে। গুলির শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়। সে লক্ষ্য করে কখন যেন হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের একেবারে ধারে চলে এসেছে। হঠাৎই ভূমিকম্প শুরু হয়; বিকট ধুপ্‌ধাপ্‌ আওয়াজে মাটি কেঁপে-কেঁপে উঠতে থাকে, পশুপাখির ভয়ার্ত চীৎকারে বিস্তীর্ণ বনভূমি নিমেষে অশান্ত হয়ে পড়ে। মুহূর্তেই জঙ্গল তছনছ ক’রে এক প্রকাণ্ড দৈত্য অভির সামনে এসে উপস্থিত হয়। দশতলা বাড়ির সমান বিরাট তার চেহারা, তিনখানা কদাকার মাথা;- মাঝখানের মাথায় তার একজোড়া চোখ, দু’পাশের দুটোয় একখানা-একখানা;- টকটকে লাল চোখে ক্রোধ আর ঘৃণার আগুন, মুখ থেকে ভলকে বেরোচ্ছে স্যালাইভার বমি;- আবির্ভাবেই বীভৎস শব্দে সে দিগ্বিজয়ী হুঙ্কার ছাড়ে, সদর্পে পদাঘাত করে ঘাসের জমিতে। প্রচণ্ড কম্পনে টাল সামলাতে না পেরে অভি মাটিতে ব’সে পড়ে, যদিও পরক্ষণেই বন্দুক হাতে সে উঠে দাঁড়ায়। হাতে সময় বেশী নেই। তার টার্গেট তিনটে মাথায় তিনটে হেডশট করে দৈত্যটাকে কুপোকাত করা। যদিও মনের কোথাও এই বোধ তার আছে যে এসবটাই আন্‌রিয়্যাল, একবার লগ আউট করলে কোনোকিছুরই কোন অস্তিত্ব থাকবে না, তবু দৈত্যটার আচমকা আবির্ভাবে সে সন্ত্রস্ত বোধ করে;- ধীর পায়ে পিছতে পিছতে লক্ষ্য সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকে। টাচ্‌-সেন্সরের কি হাস্যকর মহিমা! উত্তেজনায় তার নিঃশ্বাসের দ্রুতি বেড়ে যায়, বন্দুকের ভার অসহ্য মনে হয়, লক্ষ্য নড়বড়ে লাগে। তিনমুখো দানব তখন পাষাণের মত অনড় দৃষ্টিতে তার শিকারের দিকে তাকিয়ে। অভি সেই অচলতা লক্ষ্য করে এবং গভীর শ্বাস টেনে শক্ত হাতে বন্দুক উঁচু ক’রে প্রথম হেডশট-টা করে ডানদিকের মাথায়;- একদম নিখুঁত! দৈত্যটা ভয়ঙ্কর শব্দে আর্তনাদ ক’রে ওঠে, চারপাশ কেঁপে ওঠে তার চীৎকারে। কিন্তু, নেক্সট ফায়ারিং-এর সময় অভিমন্যু টের পায় তার গুলি শেষ, ছ’টা বুলেটের সবক’টা সে খরচ করে ফেলেছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় সে; কি করবে ভেবে না পেয়ে বোকার মতন তিন-চার বার ট্রিগার দাবানোর চেষ্টা করে। তারপর বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রাণপণে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। ঘায়েল দৈত্যটাও সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নেয়;– যদিও ঐ বিশাল-বিশাল পায়ের থাবা থেকে অভিমন্যু ঠিক দশ সেকেন্ড নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, এগারোতম সেকেন্ডে শেষবারের মতন একটা অবর্ণনীয় ভার নেমে আসে তার শরীরের ওপর…

GAME OVER

ঘরের অন্ধকারে রামধনু রঙ খেলা করে, যেন-বা ত্রিদেশীয় মস্তকে অনুপ্রবিষ্ট কোনো সময়-চেতনা। হেডকিটের এক কোণে লাল আলো উজ্জ্বল বিন্দুবৎ জ্বলে আর নেভে, নেভে আর জ্বলে। টাচ্‌-কন্ট্রোলার দু’টো কাত হয়ে পড়ে থাকে খাটের ওপরে। ল্যাপটপের ব্রাইট স্ক্রিনে ভেসে থাকে –

পরবর্তী লেখার কি-ওয়ার্ডস –

অল্টারনেটিভ প্রেম
VR Porn
মৃত শুক্রের সমাধি
হাঃ

Facebook Comments

Leave a Reply