আমাদের সবার অধিকার আছে : অমিত্রজিৎ নাগ
আমরা যত একটা করে দিন এগিয়ে চলি জীবনে, চোখের পর্দার বিশ্লেষণ ক্ষমতা আরও বাড়তে থাকে, সুষম একটা ছবিকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এসে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার মত বা জুম করে দেখার মত চোখে পড়তে থাকে বাস্তবের দৃশ্যপটেও অবিচ্ছিন্নতার অভাব| সেই বিচ্ছিন্নতার ফাঁকগুলোয় জায়গা করে থাকে আমাদের জীবনের আর মনের অন্ধকারেরা| শুধুমাত্র সম্ভাবনার অঙ্কের খেলায় আমাদের মধ্যে কেউ বসে আছি ছবির উজ্জ্বল অংশটায়, কেউ ডুবে গেছি বাদ পড়ে যাওয়া ফাঁকা অংশটায়; দূর থেকে তাকালে শুধু উজ্জ্বল অংশটা নিয়ে তৈরি সমাজের ছবিটাই চোখে পড়বে| ছোট ছোট সমস্যাগুলো ওই ফাঁকের মধ্যে পড়ে গিয়ে ডুবে গেছে, হারিয়ে গেছে| তাহলে সমস্যাগুলো কি আদৌ চোখে পড়ে না? পড়ে বৈকি, নাহলে আমরা টের পাই কি করে! কিন্তু পাশপাশি এটাও সত্যি, যেমনটা পন্ডিত মানুষেরাও বলে থাকেন যে যেটুকু চোখে পড়ছে সেটা অসংখ্য সমস্যা-অন্যায়ের সমষ্টির স্তুপীকৃত হিমশৈলের চূড়া মাত্র; যেটুকু আমরা দেখছি, জানছি তার থেকেও কতটা বেশি আড়ালে নিমজ্জিত আছে এই একটা উপমায় খুব সহজ বোঝা হয়ে যায়| আবার যদি ছবির কথাতেই আসি তাহলে বলা যায় যে ছবির অনেকটা উজ্জ্বল অংশ যদি হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায় তখন আমাদের খেয়াল হয় যে কিছু গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়ই|
আমার মনে পড়ে কোথাও একটা পড়েছিলাম মানুষ কবে থেকে পশুর থেকে আলাদা হয়ে মানুষ হল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে কোন্ ঘটনাকে রাখা যায় সে বিষয়ে একটা আলোচনা; সেখানে এক প্রত্নতাত্ত্বিকের মত ছিল যে একটি প্রাগৈতিহাসিক নমুনায় তারা লক্ষ্য করেছেন একজন পায়ের হাড় ভেঙে আহত হয়ে পড়া মানুষের পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠা; এরকম ক্ষেত্রে যেটা স্বাভাবিক ধরা হয় যে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণীর দলে কোনো একজন আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে ক্রমশ গোষ্ঠী তাকে ফেলে রেখেই রওনা দেয় সেটাই কাম্য ছিল মানুষের ক্ষেত্রেও, কিন্তু তা হয়নি| তারা প্রমাণ পেয়েছেন ওই পায়ের হাড় ভেঙে আহত থাকা মানুষটি কারোর শুশ্রূষা পেয়েছে, কেউ ক্রমাগত তার সাথে থেকে তাকে খাবার যোগান দিয়েছে, ফলে মানুষটি একসময় সেরে উঠতে পেরেছে| এই ঘটনাকে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণীদের থেকে মানুষের আলাদা হয়ে ওঠা, সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠার প্রথম ইঙ্গিত মনে করেছেন| অর্থাৎ ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ এর পাশাপাশি মানবিক, সহমর্মী দৃষ্টিভঙ্গিও জায়গা করে নিতে থাকল মানুষের মনে; পশুর থেকে মানুষ আলাদা হতে শুরু করল| কিন্তু কোনো বিষয়ই যত সময় এগোতে থাকে তখন আর সহজ থাকে না, মানুষের এই শুরুর দিনের সহজ সহমর্মিতাও ক্রমশ জটিল হতে থাকল| আমি এর সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়েরই বিশেষজ্ঞ নই, তাই আমি নিশ্চিত কিছু বলতে পারি না, শুধু অনুমান হয় যে যত বেশি মানুষের মধ্যে মানবিক বোধ ছড়িয়ে পড়তে থাকল ততই সেই বোধের মধ্যে পরিপক্বতা আসতে থাকল, অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে বুদ্ধির ধার বাড়তে শুরু করল এবং বিভিন্নরকম যুক্তির সমাবেশ হতে থাকল| আমাদের কাছে মানবিক শব্দটা একটা আরামদায়ক শব্দ হিসেবে গ্রাহ্য হয়, শব্দটা শুনলে আমরা আশ্বস্ত হই যে ঘটনার মধ্যে কিছু দয়া-মায়া-সদ্গুণ অবশিষ্ট আছে| কিন্তু আসলে হয়ত শব্দটা যথেষ্ট জটিল, কারণ আমরা আদৌ বুঝি না আমরা আসলে কি কি করতে পারি; সুতরাং মানবিক মানে মানুষের উপযুক্ত স্বভাব এইটুকু ভেবেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ, এর বেশি কিছু ভেবে ফেললে পরে হতাশ হতে হতে পারে| মানুষের সমাজ ওই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আজকের দারুণ আধুনিক যুগে এসে পৌঁছবার জন্য কেমন কি পথ পেরিয়েছে সেটা ইতিহাস আমাদের জানায় বটে, কিন্তু সেও প্রকৃত ইতিহাসের উপরিতল মাত্র| ভাষার সৌজন্যে আমরা এমন অনেককিছু বিবর্তনের উদাহরণ পাই এবং সমাজের একটি জীবন্ত প্রবহমান ধারা হিসেবে ভাষাই অতীতের অনেক ছোট ছোট উপেক্ষিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দলিল হয়ে থাকে; ভাষার গতি-প্রকৃতি দেখেও সম্ভবত আন্দাজ পাওয়া যায় কীভাবে সমাজের ক্রমবিকাশ হয়েছে|
সমাজের ক্রমবিকাশের কথা বলার কারণ, সমাজকে যখন একটা ছবির সাথে তুলনা করেছি, সেখানে দিনে দিনে বিভিন্ন ছবির বিষয় সংযোজিত হয়েছে, আরও নতুন রঙ এসেছে, ছবির বৈচিত্র বেড়েছে, বেড়েছে আকার| তবে যত যাই হোক, ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ আড়ালে একইরকম রয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে; প্রাকৃতিক নিয়ম তাই চলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই| শুধুমাত্র আমাদের বুদ্ধি, যুক্তি আর উন্নত স্বভাব তার রুক্ষ-উগ্র রূপটাকে প্রশমিত করেছে| প্রশমিত হয়ে তা জায়গা করে নিয়েছে সমাজ-চিত্রের ওই ছোট্ট-ছোট্ট ফাঁকগুলোয়, ডিজিটাল ছবির এক-একটা পিক্সেলের ফাঁকের মত, যেটা অতিক্রম করা যায় না| যত উন্নত হয়েছে মানুষ তত বিভেদ তৈরী হতে দেখা গেছে, বুদ্ধি ভেঙে গেছে শুভবুদ্ধি-দুর্বুদ্ধিতে, মান ভেঙে গেছে সম্মান-অপমানে, চিন্তার সাথে বেড়েছে দুশ্চিন্তা, মানুষ ভেঙে গেছে সজ্জন-দুর্জনে| সমস্ত বিভেদই এসেছে স্বার্থে, বুদ্ধিমান মানুষ স্বার্থের সংঘাতে যাওয়ার আগে খুঁজে পেয়েছে সতীর্থকেও; যাদের স্বার্থ মিলে যেতে থাকল তারা হতে থাকল জোটবদ্ধ| এটা অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে মানুষ বুদ্ধি ধরে এবং তার চিন্তা করার ক্ষমতা আছে বলেই তার স্বার্থের লক্ষ্যগুলোও ক্রমাগত জটিল হতে থেকেছে| ইতিহাসে যেমন আমরা পড়ি যে এক একটা দল থাকত যে দলের সবচেয়ে দক্ষ মানুষেই হত দলপতি, দলপতির তৈরী রীতি-নীতিই দলের নিয়মে পরিণত হত, দিনকালের বদল হতে থাকলেও এই প্রথাটার বদল কখনই হয়নি; দক্ষতার সংজ্ঞা যুগের সাথে সাথে বদলেছে, সেই অনুযায়ী বদলে গেছে দলপতিরা, সেইসব দল নানা কারণে মিলেমিশে তৈরী করেছে বিরাট জনগোষ্ঠী বা জাতি, দক্ষ মানুষেরা বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে| মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে, ‘মানবিক’ হওয়ার প্রয়োজনে অর্থাৎ পশুদের থেকে আলাদা হওয়ার তাগিদে নিজেদের তৈরি রীতি-নীতিগুলোকে নিজেদের দুর্গরক্ষার ঢাল হিসেবে দাঁড় করায় যাতে মানুষ পশুর মত আচরণ না করে, আর সেই থেকে এসে যায় বিভিন্ন প্রথা-সংস্কার| সবই মানুষের উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির ফসল হলেও আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাশবিক প্রবৃত্তি উস্কানি দিতে কসুর করে না| যুক্তি-বুদ্ধির সন্নিবেশে দক্ষ মানুষে অনুভব করে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শাশ্বত, তাকে কোনদিনই জীবন থেকে মুছে ফেলা যাবে না, যেটা মুছে ফেলা যায় সেটা হল প্রতিদ্বন্দ্বী; তাহলে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলেও তার জন্য বিশেষ ঝামেলা পোয়াতে হবে না| বনফুল তাঁর একটি গল্পে এর উপযুক্ত একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, বখেড়া| দক্ষ-বুদ্ধিমান মানুষে সুদূর অতীত থেকেই ছক কষে গেছে যাতে সামাজিক জীবনে নিজেদের গতিবিধিতে কোনো বখেড়া না তৈরী হয়; চিন্তা করে আগেই বখেড়াকে সরিয়ে ফেলাই কাজের মত কাজ হিসেবে সমর্থন পেয়েছে|
প্রকৃতপক্ষে বখেড়া মারতে গিয়ে পৃথিবীতে গাদা গাদা বখেড়ার জন্ম দিয়েছে মানুষ নিজেই; এমনিতেই প্রকৃতির সামনে অসহায় মানুষ হামেশাই বিপর্যস্ত হয়েছে দুর্যোগের জন্য, তার ওপর অবশিষ্ট সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভাগ বসার ভয়েই তারা আরও বেশি মরিয়া হয়েছে আসন্ন ভাগীদারদের দূর করার জন্য| পৃথিবী গোল না চ্যাপ্টা, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে না পৃথিবী সূর্যের চারপাশে, সমুদ্রের ওপারে পৃথিবী শেষ না আরও দেশ আছে এসব সমাধানে পৌঁছনোর আগেই মানুষ শিখে গেছিল যে সম্পদ সীমিত; সুতরাং ভাগাভাগিও সীমিত রাখতে হবে| রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের স্বাদ পাওয়া মানুষের মধ্যে তফাৎ কিছু পাই না, দুয়েরই খিদে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে| সুতরাং বুদ্ধিমান মানুষে আগে ভোগের স্বাদ পেয়েছে, তারপর বুদ্ধির জোরে এবং অবশ্যই শক্তির জোরে সেই ভোগকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে গেছে| এই লোভ একসময় ব্যক্তিগত পরিসরকে গ্রাস করতে শুরু করলে অন্যায় দেখা দিতে থাকে| লোভ কখনই সীমিত থাকে না, তাই হয়ত নিজেদের অজান্তেই মানুষ লোভের বশে ছিনিয়ে নিতে থেকেছে অন্যের মুখের গ্রাস| এখানে আর তার যুক্তি কাজ করেনি যে অপরের দখলে থাকা সম্পদটা জোর করে ছিনিয়ে নিলে অন্যায় হয়|
ক্রমাগত বেড়ে চলতে থাকা বিদ্বেষ আর বৈষম্য এই লোভ থেকেই জন্ম নিয়েছে| বরং বুদ্ধিমানের অস্ত্রতেই পরিণত হয়েছে এগুলো; যখন মানুষে মানুষে স্বার্থ এবং শক্তি মিলে গেছে, তারা সমকক্ষ হয়ে পড়েছে তখন একে অপরের সাথে সমঝোতা করেছে| একই স্বার্থের সতীর্থরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে বেশি যাদের দক্ষতা তারা হয়েছে নির্ণায়ক, তারাই তৈরী করেছে রূপরেখা কীভাবে অন্যদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়| স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে মানুষ প্রকারান্তরে বেশ কিছু মানুষের উপকারও করে, যেমন কোনো একটা জাতির কথা ভাবা যায় যারা অন্যদের আক্রমণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য; তখন উদ্দেশ্য ধার্য থাকে জাতির প্রতিটি সদস্যের জন্যই| কাজ সফলভাবে শেষ হলে তখন সাফল্যের বন্টন শুরু হয়; সামগ্রিকভাবে গোটা জাতি উপকার পায়, তবে অবশ্যই সেখানেও শ্রেণীবিভাগ থেকে যায়; আর যারা আক্রান্ত হল, সর্বস্ব খোয়াল তাদের দুর্দশা আর আলাদা করে বলে দিতে লাগে না| অর্থাৎ স্বার্থরক্ষার তাগিদে, কঠিন স্বার্থকে সহজে জিতে নেওয়ার তাগিদে অনেক মানুষকে দরকার পড়ে সঙ্গে নেওয়ার, ফলে উদ্দেশ্য সফল হলে তাদেরকে খুশিও করতে হয়| এই পদ্ধতিটা ধাপে ধাপে জাতি-রাষ্ট্রের গন্ডি থেকে নেমে আসে সমাজের ছোট ছোট পরিসরে, শ্রেণী-উপশ্রেণীতে, আদর্শে-বিশ্বাসে এবং আরও অসংখ্য ক্ষেত্রে| সবক্ষেত্রে দুর্বল তারাই হয় যাদের হয়ত স্বভাব নিরীহ, বা যারা অল্পে সন্তুষ্ট, বা যাদের তাগিদ কম অথবা যারা বুদ্ধি কমবেশি যেমনই ধরুক সেটাকে নোংরা করে ফেলেনি; বিদ্বেষ, বৈষম্য এই সবকিছুর প্রয়োগ তাদের ওপরেই করা হয় অথচ তার কোনো উপযুক্ত যুক্তি থাকে না| আমি প্রশ্ন করি যে, বিদ্বেষ, বৈষম্য কার ওপর স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে? যে মানুষ খারাপ, ভীষণভাবে খারাপ, সবার পক্ষেই বিপজ্জনক তার ওপর; কিন্তু এই ধারণা কখনও কি সর্বজনীন করে দেওয়া যায়? যায় না, কোনো যুক্তিই এর সপক্ষে আসে না| বিদ্বেষ, বৈষম্য কোনো যুক্তির অপেক্ষাও করে না| আমরা শিক্ষা নিই যাতে আমরা আরও বেশি যুক্তিকে আপন করে নিতে পারি, যুক্তি যত বেশি গৃহীত হবে তত আমরা মানুষ হয়ে উঠবো, তত শক্ত হয়ে উঠবে মানুষের উপযুক্ত স্বভাবকে ধরে রাখার আইন; যুক্তির বিচার এবং আইন শক্ত হলে তাহলে বিদ্বেষ, বৈষম্য দূর হতে পারে| এতগুলো কথা লিখছি এই কারণেই যে, আমি নিজে বুঝবার চেষ্টা করছি এবং পাঠকেরাও হয়ত বুঝতে পারবেন বা ইতিমধ্যেই তারা বোঝেন এবং সহমত হবেন যে বিদ্বেষ, বৈষম্য কীভাবে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের মজ্জায় মজ্জায় মিশে আছে| যতগুলো যুগ মানুষ পেরিয়ে এসেছে এতদিনে, তাতে তাকে লড়াই করে যেতে হয়েছে বিদ্বেষ আর বৈষম্যের সাথে; তার সামনে কখনও টিঁকে থেকেছে আবার কখনও আত্মসমর্পণ করেছে| বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষেরা যখন ইতিহাসের চাকায় ভর করে পেরিয়ে গেছে দুঃস্বপ্নের দিন, তখন তারাই একই অন্যায় করেছে অন্য কোনো দুর্বলের ওপর, এই ঘটনাও প্রচুর ঘটেছে|
আমি নিজেও ছোটবড় বৈষম্য দেখেছি ছোটবেলা থেকেই; দেখেছি এই আধুনিক যুগেও শহরের স্কুলে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণী থেকে পড়তে আসা ছাত্রকে শিক্ষকের উপহাস করা, দেখেছি পিছিয়ে পড়া মানুষকে খাটিয়ে নিয়ে তার প্রাপ্য তাকে না দেওয়া| প্রাপ্যের বৈষম্যকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করা হয়েছে, অত্যাচারকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ন্যায়বিচার নামে| যে বিদ্বেষ, বৈষম্য দেখি নি তা জেনেছি ইতিহাসে, বর্তমানে জানতে পারছি সংবাদে; কোনো বৈষম্য ধ্বংস হয়ে গেছে, কোনোটা দুর্বল হয়ে গেছে, কোনোটা অবিকল একই রয়ে গেছে যুগান্তরের দুর্যোগ সামলেও| এত আধুনিক যুগে এসেও অবাক হতে হয় কীভাবে এই অন্যায়গুলো এখনও ইন্ধন পায়; কিন্তু এরা সত্যিই ইন্ধন পায়| ইন্ধন আমরাই দিয়ে এসেছি চিরকাল, কখনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য, কখনও পরোক্ষে ইন্ধন নিজেই জায়গা পেয়ে গেছে শুধুমাত্র অন্যায়কে উপেক্ষার মাধ্যমে প্রশ্রয়ের জন্য; বাড়তে বাড়তে অন্যায় এখন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, তাকে আর যেমন উপেক্ষাও করা যায় না তেমনই তার থেকে সহজে রেহাইও পাওয়া যায় না| আশ্চর্যের বিষয় হল বিদ্বেষ আর বৈষম্যের বিষ ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় বিশ্বাস আর ভরসা থেকে, যে বিশ্বাস আর ভরসা এই বিষে আক্রান্তরা করে থাকে আক্রমণকারীর ওপর| যুগের অগ্রগতির সাথে, শিক্ষার অগ্রগতির সাথে মানুষ নিজের ছদ্মবেশকেও পোক্ত করতে পেরেছে, ফলে যাকে সে মারতে চলেছে তারই বিশ্বাস আদায় করাটা এখনও সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে যায়নি| তাহলে এর সমাধান কি? এত বিপুল এক রোগের সমাধান খুব সহজে যে সম্ভব নয় সে আমরা খুব ভালো করেই জানি| এমনকি এর বিপুলতার সামনে সমাধান চাওয়াটাই মনে হয় বাড়াবাড়ি, যুগ যুগ ধরে একে ঠেকিয়ে রাখতেই মানুষ ব্যস্ত থেকেছে, শুধুমাত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া রুখতে| এই রোগ এতটাই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে থেকেছে একটা সময়ে, হয়ত ইতিহাসের ভাষায় তাকেই বলা হয় মধ্যযুগ, যেখানে মানুষ দুবেলার আহারের মত হজম করেছে একে, ততটাই সত্যি বলে মেনেছে একে যতটা সত্যি মেনেছে নিজের অস্তিত্বকে| তার অন্তরে এই অনুভূতি পৌঁছেই দেওয়া যায়নি যে বিদ্বেষ, বৈষম্য আসলে অন্যায়|
বিদ্বেষ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই নতুন কিছু নয়; যুক্তি-বুদ্ধি যেমন অধিক শক্তিশালী প্রতিপত্তিসম্পন্ন মানুষের কাছে ছিল তেমনই দেরিতে হলেও তা শোষিত মানুষের কাছেও এসে পৌঁছেছিল| আগুন আর আলোকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা যতই থাক, সামান্য ছিদ্র আগুনে অক্সিজেন যেমন পৌঁছে দিতে পারে তেমনই আলোকে ছড়িয়ে পড়ার পথও করে দেয়| ফলে অন্যায়ের প্রতিকারে লড়াই অনেক আগেই তৈরী হতে থেকেছে| একুশ শতকের দুনিয়ায় এসে প্রগতির গতি দেখে এইটুকু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, বেশিরভাগ মানুষের বিবেক পর্যন্ত যুক্তির ভিত্তিটা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, যাতে সে নিজেই কোনটা যৌক্তিক কোনটা অযৌক্তিক চিনে নিতে পারে| এই যুগে এসে আশা করাই যায় যে, চিরাচরিত অন্যায়গুলোর সমাধান করা সম্ভব; সমাধান, কোনো আপোস নয়, কোনো শর্তসাপেক্ষে ঠেকিয়ে রাখা নয়, সম্পূর্ণ মুক্তি| যেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় যে, প্রতিটা জীবনই সমান মূল্যবান, তাকেই সত্যি সত্যি প্রতিষ্ঠা করা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বলে মানা হয়| অথচ, কতরকমের যে বৈষম্য পৃথিবীতে রয়েছে তা আমরা নিজেরাই হয়ত বুঝে উঠতে পারি না| কত মানুষকে প্রভাবিত করেছে তার ওপর ভিত্তি করে বৈষম্যেরও শ্রেণীবিভাগ হয়ে আছে, বোধহয় পৃথিবীতে কিছু কিছু প্রাণীর যেমন অসংখ্য প্রজাতি পাওয়া যায় সেরকম, তার মধ্যে কিছু কিছু বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, কিছু একেবারেই দুর্লভ| কিন্তু এই আধুনিক যুগ এটাই হয়ত দাবি করে যে, সবরকম বৈষম্যকেই এবার চিহ্নিত করা প্রয়োজন, কারণ একসময় তার সমাধান তো করতেই হবে | আমি ইচ্ছে করি যদি এমন সম্ভব হত যে, যারা অত্যাচার করে, বৈষম্য করে তাদেরকে একমুহূর্তে ওই সমস্ত অত্যাচারিতদের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া যেত তবেই তারা ঠিকভাবে বুঝতে পারত অত্যাচার কি জিনিস, বিদ্বেষ, বৈষম্য কি ক্ষতি করে, কীভাবে বেঁচে থাকা থেকে বঞ্চিত করে| বেঁচে থাকার অধিকার কোনো মানুষ আরেকজনকে দেয় না, এটা আমাদের সবার জন্মগত; এই বোধ থেকেই প্রত্যেকটা প্রতিবাদ উঠে আসে| প্রত্যেকটা বৈষম্যই আমাদের বেঁচে থাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কোনোটা সরাসরি মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে, কোনোটা মাথার ছাদ কেড়ে নিয়ে, কোনোটা আপনজনকে কেড়ে নিয়ে, কোনোটা রাতের ঘুম আর সম্মান কেড়ে নিয়ে| সুতরাং বৈষম্যের আকার-আয়তন নিয়ে বিচার করাটাও বৈষম্য; আমরা নিশ্চয়ই বৈষম্য তাড়াতে গিয়ে বৈষম্যেরই হাত ধরব না!
আমাদের সমাজের দিকে তাকিয়ে সমগ্রের কথা ভাবতে হয়, যেমন একটা সম্পূর্ণ ছবিকেই আমরা দেখি, বিন্দু-বিন্দু রং-কে নয়| কিন্তু ছবির থেকে আমাদের নিজেদের তফাৎটা হল আমরা প্রত্যেকেই এক একজন স্বয়ং-সম্পূর্ণ মানুষ, আমাদের প্রত্যেকের কিছু আপনজন থাকে, যাদের সাথে ডিএনএ-নিয়ন্ত্রিত গাঢ় সম্পর্ক থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকেও না, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ততটাই আমাদের সকলের ভালোমন্দের সাথে জুড়ে থাকে| শুধুমাত্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা অকারণ মানুষকে ঘেন্না করব, অত্যাচার করব, ভাগ্য সহায় হয়েছে তাই সেই অন্যায় অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও সাজা পাচ্ছি না এতে আরও উৎসাহিত হয়ে অত্যাচার বাড়িয়ে দেব এটা কখনই মেনে নেওয়া যায় না, এর উত্তর একমাত্র এটাই যে, তাদের সেই একই অত্যাচার, একই ঘেন্না উপলব্ধি করানো; তবেই তারা হয়ত কিছুটা থমকে দাঁড়াবে| অবশ্যই সবাই নয়, তবে অনেকেই উপলব্ধি করতে পারবে| আর যারা উপলব্ধি করবে না, যারা আসলে উপলব্ধি করতে চায় না কারণ তারা জেনেবুঝেই অন্যায় করে, তাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লড়াই করাটাই শেষ কথা|
একটা কথা বলা হয় যে, যারা অত্যাচার করে, বিদ্বেষ করে, অন্যায় করে তারা নিজেরা অনেক আগেই হেরে গেছে জীবনের কাছে, ইতিহাসের কাছে; হয়ত তা খুবই সত্যি কথা, কিন্তু একজন সামান্য মানুষ হিসেবে এটাও আমি বিশ্বাস করি যে, জীবন একমুখী, অপরিবর্তনীয়; তাই যে ক্ষতি হয়ে যায় তা কখনই পূরণ করা যায় না, যে ক্ষতি করল তার চরম সাজাতেও নয়| অথচ কত অবাক লাগে যখন দেখি অত্যাচারিত দিনের পর দিন সংযম বজায় রাখছে তার অধিকারের লড়াইয়ে; সত্যিই তখন মনে হয় মানুষগুলো জীবনের কাছে জিতে গেছে, ইতিহাসের পাতায় জিতে গেছে| তবু প্রত্যেক যুক্তিশীল মানুষই বিশ্বাস করবেন যে, একক মানুষের স্বতন্ত্র বেঁচে থাকার অধিকার অযাচিত ক্ষতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন|
সবশেষে এটুকুই বলি, আগেও যেমন বলেছি যে, এমনিতেই আমরা বিশাল প্রকৃতির সামনে এখনও অনেকটাই অসহায়, অপূরণীয় ক্ষতি আমরা সেখান থেকেই পাই; তার ওপর মানুষের নিজের তৈরি এই উপদ্রবগুলো যারা ভোগ করেন তাদের কথা শুধু কল্পনা করলেও ভয় করে| নিজের মত বেঁচে থাকার অধিকারে সময় এসেছে এইসমস্ত বিদ্বেষ, বৈষম্য, অত্যাচারের বখেড়াগুলোকেই এবার উপড়ে ফেলার|
Posted in: ARTICLE, July 2020 - Cover Story