যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

ষষ্ঠদশতম পর্ব

২৯

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
দাঁতে দাঁত চেপে আমি খুব সাদাকালো কবিতা কবিতা
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

সরস্বতী যে দৃশ্য অথবা দৃশ্যসম্ভাবনায় স্থিত, কেন না, দৃশ্য তথা স্মৃতি আমাদিগকে কেবল বিভ্রান্তই করিতে ব্যাকুল, এক্ষণে, সরস্বতী প্রারম্ভে অধিষ্ঠিতা। ফলতঃ, নগ্ন অক্ষরসমূহ রেশম রেশম হইল, মূর্ত ও অনির্ব্বচনীয় হইল এরূপে। রৌদ্র অবধি ধাবিত হইতে থাকিল সম্বোধন ও দিনলিপি। নূতন অথচ পরিচিতা একটি দর্পণ। বিদ্ধ হইল। বিসমিল্লায় অমৃত হইল হে ভাষা হে কবিতা হে সরস্বতী…

আয়না এই মান ও চিত্রের বেলা
সেতুসম্ভব যে ক্ষত ছিল
স্রেফ সরস্বতী অবধি
ছুটে যাওয়া এই নগ্ন হরফগুলো মুহূর্তগুলো
ত্বক রঙের দিনে বিদ্ধ হতে হতে
আমি কি শহর ভেবে
আইসক্রিমের গন্ধটাই আইসক্রিম
কার রেশম রেশম একটা নামের কাছে হুহু
বিষাদের যে মুদ্রাটি নীল
তাকে অপেক্ষা করো ক্রমে
আর দেখো
এই শীত আমরা পরিধান করেছি
এঁকেছি
ধাতু দিয়ে গুণ করা গাছেদের কথায়
ছায়া ভেবে
ফেলে আসা কলের দুপুর…

# * # * #

— আমরা সবাই আসলে সংখ্যালঘু… কেন বুঝতে পারছ না? কোনও না কোনওভাবে…

— আলু-ঢেঁড়সের চচ্চড়িটা আগেরদিন আরও ভাল হয়েছিল… একদম শুকনো শুকনো ঝরঝরে… আজ একটু তেল বেশী হয়ে গেছে…

— আমি একটা লোকঠকানো স্বপ্ন দেখেছি…

— মেজাজ খারাপ না তো?

— এবার না কি ভার্চুয়াল ডিম্ভাত খাচ্ছে লোকে…

— আর কী, ধুতি-পাঞ্জাবীর মুখ্যমন্ত্রী দেখেছ… শাড়ির সাথে হাওয়াই চটির মুখ্যমন্ত্রী দেখেছ… এবার খাঁকি হাফপ্যাণ্টের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তোড়জোড় দেখে পিলে চমকাচ্ছে তো…

— দ্যাখো, গরু তো ঘাস খাবেই। এতে কাস্তে কীই বা করবে বলো? গরুর গলায় ধরবে, না কি ঘাস কেটে গরুর মুখে ধরবে সেটা ভাবতে ভাবতেই মরচে পড়ে গেল যে…

— ঘটনা হল, যে কোনও বিষয় নিয়েই তর্ক করা যায়। যে কোনও… ইউ জাস্ট নেম ইট! সব থিসিসেরই অ্যান্টিথিসিস নামিয়ে দেওয়া যায়, সব ন্যারেটিভেরই কাউন্টার-ন্যারেটিভ তুমি লিখে ফেলতে পারো অনায়াসে। বিশ্বাস করো, এতদিনে সবাই জেনে গেছে সব লজিকেরই কাউন্টার-লজিক আছে, থাকতে বাধ্য। এখন তাতে লাভ কী, ক্ষতি কী সেগুলো ব্যাপার না। আসল কথাটা হল, তুমি সেটা চাও কি না, আর তোমার হাতে তর্ক, বা, প্রতিতর্ক করার মতো বাড়তি সময় কতোটা আছে, এইটুকুই, ব্যস, তার বেশী আর কিচ্ছু না…

— তোমার সঙ্গেই কথা বলছি আসলে…

— মনমেজাজ একটু ভাল থাকলেই তো বাবা গান গায় সারাক্ষণ… অথচ, মুখে বলে এই পৃথিবীটা না কি সংখ্যা দিয়ে তৈরী আর কবিতা দিয়ে তৈরী। কই? সুরের কথা তো বলে না একবারও…

— ওই ছবিটা পোস্ট করে অনেকগুলো লাইক পেয়েছি… হে হে…

— বাবা, পরের জন্মে তুমি আমার কী হবে?

# * # * #

আজকের বিশেষ খবর

বাড়িতে সম্বল বলতে একটি দুধেল গরু। দুধ বেচেই কোনরকমে সংসার চলে যায়। ছেলেরা অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না বলে, সেই গরু বিক্রি করে দিয়ে ছ’হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন কিনলেন হিমাচল প্রদেশের কুলদীপ কুমার।

৩০

আসুন। কোনোদিন তৈরী হবে না, এমন একটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট দেখি খানিকটা…

প্রথম দৃশ্য –

একটা ইন্টারনাল উঁচু দেওয়ালে লাল রঙ করা হচ্ছে। প্রচুর সূর্যালোক। বড়ো বড়ো জানলা। ঘরের বাকি দেওয়ালগুলি সাদা। কোনও আসবাব নেই।

দ্বিতীয় দৃশ্য –

ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে প্লেন চলে যাওয়ার দৃশ্য।

তৃতীয় দৃশ্য –

বাড়ি – জানলা – মেঘ সরে যাচ্ছে – প্রচুর সূর্যালোক – এরোপ্লেন যাওয়ার শব্দ।

চতুর্থ দৃশ্য –

খাতায় হিজিবিজি আঁকছে একটি বাচ্চা মেয়ে।

পঞ্চম দৃশ্য –

প্রথম দৃশ্যের লাল রঙ করা দেওয়ালে সেই হিজিবিজি ফুটে ওঠার দৃশ্য।

ষষ্ঠ দৃশ্য –

কালো স্ক্রীন। সাদা হরফে একটা একটা সংখ্যা ফুটে উঠবে নানারকম জায়গায়। কিছু পরে সবটা একসাথে। ঘড়ি উল্টোদিকে ঘুরছে।

সপ্তম দৃশ্য –

খুব খুব হালকা সবুজ দেওয়াল। তার সামনে ঐ রঙেরই জামা আর একটু গাঢ় প্যান্ট… রোগা, বেঁটে, চশমা পরা একজন বছর ত্রিশ-বত্রিশের মানুষ। সিগারেট হাতে ক্যামেরার দিকে তাকায়। অল্প নার্ভাস, সিগারেটটা মুখে নিয়ে দুহাতে কোমরের বেল্ট ঠিক করে… ‘আমি, আসলে, একটা চাকরীর ব্যাপারে (চশমা ঠিক করে, অল্প হাসে) … এসেছিলাম…’

অষ্টম দৃশ্য –

বেসিন, ব্রাশ, পেস্ট – চতুর্থ দৃশ্যের বাচ্চা মেয়েটি দাঁত মাজছে। বেসিনের ওপরে একটা ছোট দেওয়াল-আয়না। তাকের আয়নাটা মুভিং। আস্তে আস্তে ঘুরছে। ঘরটা অন্যরকম লাগে…

নবম দৃশ্য –

দিনের বেলা। নীরবে একটা লম্বা মিছিল চলে যাচ্ছে। নানারকম প্ল্যাকার্ড। দূরে পুলিশ।

দশম দৃশ্য –

বিরাট পুকুর জুড়ে অনেকগুলো ফাঁকা বয়াম (প্লাস্টিকের) ভাসছে… ক্লোজ আপ আর লং শট একাধিকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে…

একাদশ দৃশ্য –

একটা লম্বা ফাঁকা রাস্তা দুদিকে গাছপালা… ছোট ছোট পাতা ঝরে পড়ছে… ক্যামেরা এগিয়ে চলে… রাস্তার দু’ধারে প্রচুর আয়না বসানো… সারা রাস্তা জুড়ে… মাথায় অভিধান নিয়ে একজন রাস্তা পার হচ্ছে… হলুদ গোলাপী নীল… এই তিনটে আলাদা আলাদা রঙের অনেক লিফলেট ঝরে পড়ছে…

দ্বাদশ দৃশ্য –

ফাঁকা জায়গা… বড়ো মাঠের মতো… এদিক-ওদিক একটা দু’টো গাছ আর ঝোপঝাড়… তার টাঙানো… A3 মাপের কাগজ ঝুলছে… ক্লিপ দিয়ে তারে আটকানো… কালো কালিতে বড়ো ফন্টে (৪৮ বা ৭২) বোল্ডে কোনোটায় লেখা “DELIVERABLES” কোনোটায় লেখা “PROJECT MEETING” আবার কোনোটায় “VIDEO CONFERENCE”… ওখানে অত্যাধুনিক অফিসের একটা কিউবিকল বসানো… কম্পিউটার বসানো তাতে… পুরোদস্তুর ফর্ম্যাল পোশাক পরে চেয়ারে বসে মাথা নীচু করে একজন কাজ করছে…

# * # * #

সাদা ডায়েরী

একসময় আমি একটা থানায় ভাত খেতে যেতাম রোজ দুপুরে। থানায় মানে থানার ক্যান্টিনে। প্রায় রোজই আমার সাথে একই টেবিলে সাদা ও উর্দির পুলিশবাবুরাও। তাদের নানারকম কথাবার্তা। খাওয়ার জায়গাটা একটু উঁচু একটা বাড়ির মতো। মাথায় সবুজ শেড দেওয়া। বাইরে রান্না হত। ভাত, ডাল, আলুভাজা, ছোট ছোট কায়দার পাঁপড়, কোনও একটা তরকারী, ডিম / রুই / কাতলা / মুরগীর ঝোল। খাওয়ার জায়গায় একটা বড় ঝুড়ির মধ্যে রাখা ভাত, ক্রমে ফুরিয়ে এলে মশারির মতো একটা বড়ো গোলাপি রঙের জালে করে ভাত আসত রান্নার জায়গা থেকে। থানার সেই ক্যান্টিনে কাজ করত কয়েকটি শিশুকিশোর… তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাস্টমারকে প্যাসেঞ্জার বলতো আমি মনে রেখেছি… আচ্ছা, আমরা তো প্যাসেঞ্জারই। রফিসাহেব আর লতাজীর ওই গানটা কেই বা না শুনেছে, আদমি মুসাফির হ্যয় / আতা হ্যয় যাতা হ্যয় / আতে যাতে রাস্তেমে ইয়াদে ছোড় যাতে হ্যয়…

(চলবে)

Facebook Comments

Leave a Reply