কালো বিন্দু : তুষ্টি ভট্টাচার্য
ঘন কুয়াশা মাখা ভোরের আকাশে, আধো অন্ধকারে হঠাৎ করে দৃশ্যমান হত দুএকটি কালো উড়ন্ত বিন্দুর। সেই বিন্দুর পিছনে ধীরে ধীরে আরও একটি, দুটি করে জমায়েত হতে থাকত। এক একটি ঝাঁক উড়তে উড়তে মাথার ওপর নেমে আসত দুম করে। আর তাদের পাখনার ঝাপটায়, তাদের বিদেশী গড়নে, চিড়িয়াখানার দিকে উড়ে চলার অভিমুখ দেখে আমরা বুঝে যেতাম শীত এসে গেল প্রায়। কোন সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এসেছে ওরা। ওই দুটি ছোট ডানায় ভর করে কী করে এলো এতদূর? ওদের হাঁফ ধরে না? ডানা ভারি হয়ে অবশ হয় না ওদের শরীর? ওই তো তুলোর মতো একটা মাংসপিণ্ড, ওইটুকুই তো প্রাণ, কী করে পারে ওরা দিশা চিনে এতদূর আসতে? সাঁতরাগাছির বিলে থিকথিকে ভিড় তখন, চিড়িয়াখানায় ওদের কোলাহলে কানে তালা ধরে যায়। ওদেরই তো পরিযায়ী বলে। শীত কমে এলে ফিরে যাবে তাদের বরফ গলা শহরে। আমাদের খাল, বিল শূন্য করে আবার একদিন আকাশ কালো বিন্দুতে ছেয়ে যাবে। আমরা বুঝব শীত চলে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। ওরা তো থাকতে আসে না। কদিনের উষ্ণতা পেতে এসেছে এখানে। আসার পথে, ওই লম্বা সফরে কী খেল ওরা? কোথায় ঘুমল? এসব খবর আমাদের জানা নেই যদিও, জানার উৎসাহও নেই তেমন। আমরা শীতের নরম রোদ মেখে পরিযায়ী পাখি দেখতে যাই। ওদের নাম মুখস্থ করে কেউ-“ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস”, “কালো হাঁস”, “কালোঘাড় সারস”, “খয়েরি ডানা পাপিয়া”, “কালাপাশ চুটকি”, “রাঙ্গামুড়ি”, “লাল ঘুঘু”, “সাইবেরিয়ান সারস”, “হ্যারিয়ার”, “স্মিঊ হাঁস”, “বৈকাল তিলিহাঁস”, “ফুলুরি হাঁস”, “পান্না কোকিল”, “দেশি মেটে হাঁস” ……
পরিযায়ী নাম নয় কোনো, পরিযায়ী একটা তকমা মাত্র। খিদের জ্বালায়, বাঁচার তাগিদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয়। অথচ পাখি নিয়ে এই যে আমার এত আদিখ্যেতা, আমাদের শিল্প, সাহিত্যে পাখিদের এত কদর, এর কারণ শুধুই বাঁচার তীব্রতম প্যাশন ছাড়া আর কিছুই না। এই ইচ্ছারূপ আগুনের ভেতরে কয়েকটি কালো বিন্দুর আকারের পরিযায়ী পাখিরা ঘিয়ের ছিঁটের মতোই ইন্ধন জোগায়। কবি বাল্মীকি নাকি এক বিরহাতুর পাখিকে দেখেই ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।’ শ্লোকগুলি লিখেছিলেন। এটিই নাকি আদি কবিতা। এরপর জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শেলী, কিটস, আপনি, আমি, কেউই বাকি রাখিনি পাখি নিয়ে লিখতে, এবং পরিযায়ী নিয়েও।
তাহলে আর পরিযায়ী তকমার দোষ কী? সে কি কেবল পাখিদের অধিকার? শ্রমিকের নয়? পরিযায়ী পাখিরাও কি শ্রমিক নয়? কঠিন পরিশ্রম করে, বাঁচার তাগিদে এক দেশ থেকে আরেক দেশে হাজার হাজার কিলোমিটার পারি দিয়ে সে পৌঁছে যায় অন্য দেশে। যাতায়াতের পথে খানিক বিশ্রাম আর সামান্য আহার সম্বল করে একেবারে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে তাদের ভুল হয় না। আর যারা পারে না, অর্ধেক রাস্তাতেই মরে যায়। ইদানীং অবশ্য কিছু সচেতন মানুষ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের জন্য এই পরিযায়ীদের আসাযাওয়ার পথে ট্র্যাকিং করে দেখে নেওয়া হয়, খাদ্য ও জলের ব্যবস্থা থাকে কোনো কোনো অঞ্চলে। সেগুলি ওদের উপরি পাওনা। কয়েক মাসের জন্য থিতু হয় তারা যেখানে, সেখানেও উষ্ণতা, খাদ্যের প্রতুল ব্যবস্থা থাকে বলেই তারা সেখানে থামে। এমনও হয়েছে, বা হচ্ছে, আগেকার মতো দূষণ মুক্ত নয় বলে বা হাইরাইজের জন্য তাদের সাময়িক অনেক আস্তানা বেহাত হয়েছে। চিড়িয়াখানায় আজকাল আর পাখি আসে না আমাদের ছেলেবেলার মতো। সাঁতরাগাছিতেও তাই। ওরা খুঁজে নিয়েছে অনেক নতুন অঞ্চল। আর পরিযায়ী শ্রমিকরাও নিজেদের দেশ অর্থাৎ গ্রাম, শহর বা ভিটে ছেড়ে রুটিরুজির জন্য পারি দেয় সূর দূরান্তে। কখনও একা, কখনও বা সপরিবারে। ছুটিছাটায়, উৎসবের মেজাজে তারা ‘দেশে’ ফেরে বছরে এক আধবার। কেন দেশ ছেড়ে যায় ওরা? হয়ত যে দেশে থাকে, সেখানে কাজ নেই, জমিতে লোনা জল ঢুকে গেছে, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ইটভাঁটার মালিক যোগ্য পারিশ্রমিক দেয় না। আরও কত যে কারণে মানুষ বাধ্য হয় নিজের দেশ ছেড়ে যেতে! বাধ্য না হলে কেউ পরিযায়ী হয় না। সে পাখিই বল আর মানুষ।
‘Hail to thee, blithe Spirit!
Bird thou never wert,
That from Heaven, or near it,’
বিদেশ বিভুঁইয়ে তারা পৌঁছে তো গেল, সাময়িক আস্তানাও গাড়ল, পেটে দানাপানি জুটল, ব্যস! বিদেশ তখন দেশ হয়ে গেল সাময়িক। অবরে সবরে মনে পড়ল তাদের দেশের কথা। মনের ভেতরটা হুহু করে উঠল তখন, ডানায় তিরতির কাঁপন লেগে থাকল। ভাবল, এই তো, আর কটা দিন। তারপর পৌঁছে যাবে নিজের দেশে। নিজের দেশে ফেরার জন্য আবার লম্বা সফরের শ্রমকে লঘু মনে হবে। স্মিত পায়ে আর হাল্কা ডানায় চলে যাওয়া যাবে ফের। আর এইরকম সময়ে রাষ্ট্র যদি আচমকাই ওলোটপালোট হয়ে পড়ে? অতিমারী হোক বা যেকোনো অকস্মাৎ দৈব দুর্বিপাকে রাষ্ট্রকে যদি থমকে যেতে হয়? হঠাতই কোনো ঘোষণা ছাড়াই দেশে ফেরার নোটিশ মেলে? যে সাময়িক আস্তানায় ওরা থাকত, সেখান থেকে উৎখাত করে দেওয়া হয় ওদের, যে জীবিকার ওপর নির্ভরশীল ছিল তারা, সেও আচমকা বন্ধ হয়ে যায়—তখন? চলে যাও এখান থেকে, নিজের দেশে ফিরে যাও এবার মানে মানে…সকালে ঘুম চোখ খুলে জানা গেল, কাজ নেই এখন, কারখানা তালা বন্ধ। রাস্তা বন্ধ, ট্রেন, বাস, সব, সব বন্ধ। এদেশে তাদের আর থাকার উপায় নেই। চারিদিকে হাজারে হাজারে অতিমারী আক্রান্ত রুগী, তীব্র তার ছোঁয়াচ। মুখ ঢাকো, দূরত্ব বজায় রাখ। আর ফিরে যাও। যে করেই হোক, বিদেয় হও। কী করে ফিরবে? সে তোমাদের মাথাব্যথা।
পাখিগুলো ডানা ঝাপটে উড়তে থাকে। ফিরতে হবে। মানুষগুলো পায়ে হাঁটতে থাকে, ফিরতে হবে। এ দেশ তাদের নয়, দূরত্বকে অস্বীকার করতে হবে এই সময়ে। আগে তো প্রাণ! যে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই এ দেশে আসা। সেখানেই যদি বেঘোরে মারা পড়তে হয়, তার চেয়ে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যাবে তারা দূর দূরান্তের নিজ ঘরে। কোলের বাচ্চা সামলিয়ে মাটি একহাতে ধরে নেয় আরেকটি শিশুর হাত। বাবার মাথায় তাদের অসামান্য গৃহস্থালি। আর কত দূর যেতে হবে বাবা? ছোটটি ক্ষিদেয় কাঁদে, কোলের শিশুটি মায়ের শুকনো বুকে মুখ গুঁজে ঝিমোয়। একটু দুধ নেই এই রাস্তায়, একটু জল নেই। খাবারের কথা মনে এনো না। শুধু হাঁটো। পৌঁছতে ওদের হবেই। আর মাঝপথে যদি ঘুম আসে, সেখানকার লোকেদের প্রহার পাওনা হয় তাদের। কেন তারা এ পথে এসেছে অসুখ নিয়ে? ছোঁয়া নিয়ে ফিরে যাও নিজেদের দেশে। মাঝপথ তোমাদের নয়। এখানে খাদ্য বা ঘুমের আশা কর না। তোমরা পরিযায়ী, এদেশে তোমাদের স্থান হবে না। হাঁটতে হাঁটতে কারা যেন মরেই গেল! বাকিরা তবুও চলেছে।
‘Thou wast not born for death, immortal Bird!
No hungry generations tread thee down;’
কারা যেন রেললাইন ধরে হাঁটছিল। ওরা কতজন? বারো, পনেরো, কুড়ি? ওদেরও ঘুম পায়। রাতের গভীরে রেললাইনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ট্রেন বন্ধ যেহেতু, নিশ্চিন্তে ঘুম নেমে আসে চোখের পাতায়। কিন্তু মালগাড়িটিকেও যেতে হবে। তার অধিকার আছে পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার। রাতের অন্ধকারে সে কি দেখতে পেয়েছে ঘুমন্ত কটা প্রাণীকে? ওদের বাঁচার অধিকার ছিল না হয়ত। ওদের পিষে দিয়ে চলে গেল মালগাড়ি পণ্যসামগ্রী নিয়ে। পণ্যবাহী ট্রাকে উঠে বসেছিল কেউ কেউ। ট্রাকড্রাইভারের কৃপায় কিছুটা পথ অন্তত পেরনো যাবে ভেবে। ভাবেনি শুধু দুর্ঘটনার কথা। মুখোমুখি দুই ট্রাকে সংঘর্ষ হলে কতজন মারা যায় বা যেতে পারে? ২৪/২৫ জন মাত্র? সংখ্যায় কী আসে যায় এখন? আর কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে কারা যেন মার খেল…রক্তাক্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করল কারা? বাপ/বেটা রেললাইন ধরেই ফিরছিল, মাঝপথে জল খেতে গিয়ে মার খেল গ্রামবাসিদের হাতে। সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য এক গ্রামের স্কুলবাড়িতে লুকিয়ে রইল তারা কিছুদিন। শেষে খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে, প্রকাশ্যে এলো মারের ভয় না করে। যদিও এবার আর মার নয়, বরং ভাত জুটেছিল ওদের। ওরা ভাগ্যবান। সবার ভাগ্যে তো এমন হয় না! ফেরার ট্রেনে চেপে বসেছিল কেউ। জলপাইগুড়ি যাবে সে। স্টেশনে ট্রেন থামল না কিছুতেই। এত কাছে এসেও কি সে পৌঁছতে পারবে না নিজের ডেরায়? প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপ দিল স্টেশনে। কতটা পথ পেরলে ওদের পথিক বলা যাবে? আর কত মানুষ মরলে রাষ্ট্রের হুঁশ ফিরবে? একটা সীমা আছে রাষ্ট্রের। যা পরিযায়ীদের থাকে না, থাকতে নেই। আর সহ্যের সীমার বাইরে বসে থাকে জনগণ। তারা ক্ষোভ উগরে দেয়। থমকে যায় রাষ্ট্র। অগত্যা ব্যবস্থা হয় পরিযায়ীদের ফিরিয়ে আনার। বাস, ট্রেনে ফিরতে থাকে তারা বোঝাই হয়ে। দূরত্ববিধি শিকেয় তুলে। অসুখের ভয় ওদের নেই আর। দেশে ফিরতে পেরেছে, এইই অনেক।
খবরে প্রকাশ, এ পর্যন্ত চার কোটি পরিযায়ীর মধ্যে পঁচাত্তর লাখ মানুষ নিজের ডেরায় নির্বিঘ্নে ফিরতে পেরেছে। আর বাকিরা? জানা নেই।
[লেখক – বিশিষ্ট কবি।]
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE
পরিযায়ী পরিভাষা নিয়ে মতবিরোধ আছে জানো।
পরিশিষ্টে পরিবেশিত হয় পরিশেষ।