পরিযায়ী…একটি বিশেষ্য : তৃপ্তি সান্ত্রা

শব্দ নিয়ে আমাদের রোমান্টিকতা আছে। চলতে চলতে পড়তে পড়তে শুনতে শুনতে কত শব্দের মায়ায় যে জড়িয়ে যাই। রিখিয়া বেলাকোবা অরুন্তুদ উর্ণনাভ রিমঝিম আকাশলীনা আত্মদীপ। তেমনই একটি শব্দ পরিযায়ী।
রুমি, ছেলের জন্য উর্ণনাভ নামটা ভেবেছে। সেকী! মানে জানিস উর্ণনাভ-র!
– নাতো! খুব সুন্দর শব্দধ্বনি! তাই ভাবলাম নাম রাখি।
– উর্ণনাভ মানে মাকড়সা!
– দূর তবে বাদ। পরিযায়ী রাখা যাবে?
– কেন পরিযায়ী কেন!
– কী সুন্দর শব্দটা! পরিযায়ী পাখি .. বলে না! ওই যে পাখিরা, দূর দূরান্ত থেকে আসে, কী রোমান্টিক না!
– রোমান্টিক তো বুঝলাম। কিন্তু কী কষ্টেরও ভাব। পাখিরা থাকে সুমেরু বা অন্য কোনও বরফের দেশে। ঝুরো বরফ। গুঁড়ো বরফ। মিহি বরফ। পাথর বরফ। ওরা বাচ্চা পাড়বে। অতো ঠাণ্ডায়? নতুন অতিথিরা সইতে পারবে তো সেই শীত!? সাদা নিঃরক্ত। আর খাবার? বেঁচে থাকার রসদ কই?
তার ওপর শীতে দলবেঁধে চোরা শিকারিরা আসবে ওদের মারতে। তো পালাও। পালাও। হাজার হাজার মাইল ডানার দৌড়। আমাদের দেখতে ভালো লাগে।
শব্দটা নতুন আমদানি। নতুন মানে এই শতকের বিশ্বায়নের জোয়ারে ফ্যানায় আমরা পরিযায়ী শব্দের ব্যাপক ব্যবহার দেখছি। পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী শ্রমিক। পরিযায়ী বর।

পরিযায়ী বর
একবিংশের শুরুতে ‘পরিযায়ী বর’ নামে একটা অণুগল্প লিখেছিলাম। চুমচুম উচ্চশিক্ষিত সুন্দরী ধনী কন্যা। রোমান্টিক। নোতুন শতাব্দীর নোতুন ঢেউয়ে জীবন কাটাতে চাই একটা স্টেডি বর। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অনেক রকম সম্বন্ধ আসে। কিন্তু অনেক লোভনীয় ক্রয়ক্ষম পাত্রের মধ্যে তার পছন্দ হয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পাত্রকে।
সারা বছরের ঝক্কি নেই। বছরে দুই তিন মাসের দাম্পত্য। গুচ্ছেক গিফট নিয়ে ফেরা বর। আউটিং। আর মস্তি। বাকী দিনগুলো কুলিকের অরণ্যে পাখি বিলাস। লামাহাট্টার ফুর্তি মেঘ আর সাউথসিটির মেট্রোসেক্সুয়াল অ্যাপিলে বুঁদ হয়ে যাওয়া।
যা ছিল প্রাণীদের অভ্যাস—খাদ্যের কারণে, প্রজননের কারণে—পরবর্তী কালে মানুষকেও ছুটতে হল নতুন জায়গায়, নতুন দেশে। খাদ্যের জন্য। ভালো ভাবে বাঁচার জন্য।

ব্যর্থ ইকারাস
এই পরিযায়ী বরদের নির্মাণ পর্ব একবিংশর শুরুতেই আমরা দেখেছি।
বাজার এনে ফেলেছে হাল্কা টেকসই উড়ানযোগ্য পিঠ-ব্যাগ। কম্প্যুটার, মেকানিকাল, সিভিল… আরো নানাবিধ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, টেকনিশিয়ান, ডিরেক্টর হবার লক্ষ্যে ছুটছে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে—উত্তর থেকে দক্ষিণে। পূব থেকে পশ্চিমে। এদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম উজাড় করে যাচ্ছে টাওয়ার শ্রমিক, বিল্ডিং শ্রমিক, সোনার শ্রমিক, গালিচা শ্রমিক, গমকাটা শ্রমিক। ভারী টিনের বাক্স, অ্যাটাচির ঝামেলা নাই। নীল লাল কালো হলুদ ব্যাগ নয়—যেন হরেক রঙের ডানা লাগানো এক ঝাঁক ইকারাস…
ওড়ো… ওড়ো… ওড়ো… মোমের ডানা নিয়ে, লোভের হাজার স্বপ্ন নিয়ে ওড়ো। বিশ্বায়ন এসেছে। হাতের মুঠোয় পৃথিবী। কত কম্পানি। কত প্রোডাক্ট। ভিটেমাটিতে আটকে থাকলে হবে? আমরা সাম্যে বিশ্বাসী। সব খাদ্য। পানীয়। বিলাস ব্যবস্থা বিনোদন। সবকে কেন্দ্র মুক্ত করে ছড়িয়ে দিয়েছি ঘরে ঘরে। হাতে হাতে। পাউচ শ্যাম্পু। পাউচ ক্রিম সাবান মশলা পানীয়। পাউচ ঋত্বিক। পাউচ করীনা। নীল ছবি মায়া।
..ওড়ো ..ওড়ো ব্যর্থ ইকারাসের মতো। যা কিছু প্রাপ্য চাইতে নেই। শ্রমসীমা নেই। নির্দিষ্ট মজুরি নেই। জীবন সুরক্ষা নেই। বেশি ডানা ঝাপটিও না। মোমের ডানা নিয়ে ওড়ো। ব্যর্থ ইকারাসের মতো… সূর্যের কাছাকাছি যেও না! ঈশ্বর বেড়া দিয়ে রেখেছেন। তার বাইরে যাবার শাস্তি। মৃত্যু। নির্বাসন। উচ্ছেদ। বিতাড়ন।

ভাষার রাজনীতি
বন কেটে বসত। রেল লাইন। কারখানা। পাট-কল। চা-বাগান। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে জল জমি বন দখল হয়েছে নানা ধারায়। উচ্ছেদ হয়েছে নির্মম ভাবে।
শীতে পাখি আসতো। এখনও কম বেশি আসে। গাঁয়ের লোক কি বেলে সেই উড়ে আসা পাখিকে? পরিযায়ী পাখি? না তারা বলে—চরখা-চরখি। বিদিশি (বিদেশী) পাখিও বলে। আর যখন সাঁওতাল পরগনা থেকে, চা-শ্রমিকরা এলো, তারা হল বুনো-কুলি।
‘কুলি’ শব্দে শ্রমিকের জোশ সবচেয়ে বেশি ফোটে। জামালপুরে রেলের ওয়ার্কশপ। সেখানে প্রচুর লেবার দরকার। লেবার আসে সুলতানগঞ্জ থেকে। তো ট্রেনের নাম-ই হয়ে গেল ‘কুলি-গাড়ি’।
এই সব শব্দে হেটো গন্ধ। স্মার্ট শব্দ চাই। তাই পরিযায়ী। বিশ্বায়নের থাবার নিচে আমরা সবাই পরিযায়ী।
অ-ঋণী, অ-প্রবাসী হয়ে দিনান্তে শাকান্ন ভাতের স্বপ্ন থেকে আমরা অনেক দূরে। ভুবন গ্রামে আমরা সবাই ভিটে ছাড়া পরিযায়ী।
শ্রম, ‘বুনো-কুলি’ শব্দে আটকে ছিল না। পরিযায়ী শব্দেও আটকে যায় না। তারা বৃত্তির নানা রঙে চিহ্নিত হয়। হোয়াইট কলার জব। ব্লু কলার জব। পিঙ্ক কলার জব। গ্রে কলার জব।
মুক্ত বাজার এই শ্রম ব্যবহার করবে। কিন্তু তাকে যথাযথ মূল্য ও মর্যাদা দেবে না। শ্রম আইন থাকবে। কিন্তু সে সব মানা হবে না। ন্যায্য দাবির অধিকার চেয়ে আন্দোলন। প্রতিরোধ। দেশদ্রোহ বলে চিহ্নিত হবে। প্রতিবাদীদের নানা আইনি চক্করে ঠেলে দেওয়া হবে জেলখানায়।

দগদগে ভারত ।। ইন্ডিয়া নয়
থালা বাজিয়ে লকডাউন উদযাপনে, উচ্চ মধ্যবিত্ত – মধ্যবিত্তর আমোদে চাপা পড়ে গেছে লক্ষ শ্রমিকের ঘরে ফেরার আর্তি। অন্ততঃ দিন দশেক সময় নিয়ে, ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করলে, মালিক পক্ষ, সরকার শ্রমিকদের খাওয়াবার দায়িত্ব নিলে—এতোটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতনা মানুষকে।
অতিমারীর আক্রমণের চেয়ে অনেক বেশি দাউ দাউ ক্ষুধা। মহানগরে, বড় বড় শহরে যে জন ঘনত্ব, বিশেষ করে বস্তিতে, মহল্লায় যে ভাবে ঠাসাঠাসি করে মানুষকে থাকতে হয় সেখানে সামাজিক দূরত্ব একটা হো – হো – রসিকতা!
আমরা রসেবশে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে এই ওরা বাইরে গেলো – ওই ওরা বাইরে গেলো – বলে চিৎকার করছি – আর মেতে উঠছি চিহ্নিতকরণের খেলায় –
– কারা – কারা – কারা! ওরা – ওরা – ওরা কারা?
শ্রমিক শব্দটা বাদ দিলে ওরা পরিযায়ী। বিশেষ্য নাম। হয়ে যায়। রুমি যেমন চেয়েছিল। রাষ্ট্রও তাই চায়। ‘শ্রমিক’ চিহ্ন, ‘শ্রমিক’ অভিজ্ঞান মুছে যাক। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি। কোন ইউনিয়ন থাকবে না। দাবি থাকবে না। শ্রম আইন মেনে কোন অধিকার থাকবে না। শিল্পনীতি, শ্রমনীতি, পুঁজিকে সুরক্ষা দেবে। শ্রমিকের সুরক্ষা কোথায়?
পরিযায়ী। শ্রমিক। এই সব শব্দ নিয়ে দেয়ালায় আসল সত্যটা দগদগে। সেখানে শব্দ নিয়ে রোমান্টিকতার কোনও দাম নেই।
রক্তাক্ত পা, ঝলসানো বুক নিয়ে যে মানুষরা ফিরলেন না।
ফিরলেন—
অতিমারী-ক্ষুধায়-উচ্ছেদে-ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা—সবাই অনার্য দলিতবহুজন সংখ্যালঘু শ্রমজীবী। দগদগে ভারত। ইন্ডিয়া নয়।

[লেখক – বিশিষ্ট গল্পকার।]

Facebook Comments

Leave a Reply