গল্প : তপোন দাশ

পরিযায়ী মানুষদের কথা

বাড়ি থেকে প্রায় কাছেই সাঁতরাগাছি। মাত্র তিনটে স্টেশন। বড়ো জোর আধা ঘণ্টা হবে। সেখানে তালপুকুরে প্রতি বছরই আসে ভিনদেশি পাখিরা। হাজার হাজার পরিযায়ী পাখিদের কোন ছোটবেলা থেকে দেখছে অতীন। এই বড়ো বয়সেও সেই নেশা কাটেনি। পাখিমেলা দেখতে পুরো শীতকালই মানুষের ভীড় হয়। রেলের এই ঝিলে পরিযায়ী পাখিদের বিস্তর আসা নিয়ে কতো রকমই না সুমারি হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে এই করোনাকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অতীন “পরিযায়ী শ্রমিক” শব্দ দুটি বারবার একসঙ্গে দেখে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা কেন শ্রমিকরা হঠাৎ পরিযায়ী হয়ে গেল! বিভিন্ন দেশ থেকে পাখিরা আসে এবং চলেও যায়। দেশের শ্রমিকরাও কি তেমনই কোন দিকহাঁস! পাখিদের মতো তারাও কি অতিথি নাকি! অন্য রাজ্যে রুজিরোজগার করতে গিয়ে মানুষ যে পরিযায়ী হয়ে যাবে কে জানতো!

দিশেহারা ক্ষুধার্ত সেই সব শ্রমিক মানুষদের মাইলের পর মাইল হেঁটে ফেরার ছবি গুলো দেখে আঁতকে ওঠে অতীন। নিজেকে চিমটি কেটে দেখে সে সভ্য জগতে রয়েছে তো! দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ সর্বত্র একই চিত্র। এই প্রচন্ড গরমে খাবার তো দূরের কথা, পিপাসার জল পর্যন্ত নেই। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া পা গুলো দেখে নিজেকে মানুষ ভাবতে লজ্জা লাগে তার। কৃষিক্ষেতে,কারখানায়, ইঁটভাটায়,বিল্ডিং তৈরিতে বা ভাটিখানায় শ্রমিকরা একটা নির্দিষ্ট মরশুমে কাজ করে। বিভিন্ন শহরে অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিজের ঘরবাড়ি বা গ্রাম ছেড়ে এসে গাড়ি চালায়,ফেরি করে, কুলির কাজ করে। এরা সবাই এই লকডাউনে কাজকর্ম হারিয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরতে চাইছে। তারা হয়তো জানে যে দেশের সরকার তাদের মতো গরীবদের মানুষই ভাবেন না! তাই রাস্তায় অজস্র মৃত্যু জেনেও তারা পায়ের উপর ভরসা করে ঘরে ফেরার দিকে এগিয়ে যায়। কারো কাঁধে বাচ্চা, কারো দু’হাতে লটবহর, কারো কোলে বয়স্ক বাবামা। ক্ষুধায়, পিপাসায়,ক্লান্তিতে একের পর এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। কি অসহায় ভাবে ঘুমে লুটিয়ে পড়েছিল কিছু শ্রমিক আর আমাদের সভ্য সমাজের গাড়ি তাদের নির্মমভাবে পিষে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি!

শুধু অন্তহীন দূরত্বই নয় নিজেদের মৃত্যুও অতিক্রম করে তাদের মিছিল শুরু হয়েছে। অতীন ভাবে এরা সবাই যাযাবর! তাদের বাসায় ফেরা যেন অন্তহীন যাত্রা। কেউ জানেনা তারা সত্যিই নিজের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারবে কিনা! তবু অদম্য জেদ নিয়ে তাদের পায়ের লড়াই এগিয়ে যায়। তাদের সাথে তো পোকামাকড়ের মতো ব্যবহার করছে সরকার। মুনাফার লোভে সংক্রমিত পুঁজিবাদী শ্রেনী নিরীহ শ্রমিকদের ভিতর মাইগ্রেশন খুঁজে পেয়েছে! যেভাবে তারা নিজেদের স্বার্থে মার্ক্সের ভূত খুঁজে পেয়েছিল একদিন। অতীন প্রতিদিন এইসব মানুষদের দুঃখ গুলো পড়ে। তারপর ক্ষোভে, ঘৃণায় নিজের ভিতর দগ্ধ হতে থাকে। গরীব শ্রমিক বলে তারা নুন্যতম বেঁচে থাকার স্বাধীনতাও পায়না। মানুষকে প্রয়োজনে প্রচরনশীল হতেই হয়। শুধু শ্রমিক কেন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মানুষকেও জীবিকার টানে অন্য রাজ্যে বা ভিনদেশে যেতে হয়। বসবাস করতে হয়। পরিযায়ী শব্দটা শুধুমাত্র শ্রমিক শব্দের আগেই মেনে নিতে পারছে না অতীন। পেটের দায়ে মানুষকে দূরদূরান্ত যেতেই হয়। তাই বলে সে না ভিটেমাটি ছাড়া হলো না বহিরাগত হলো! আসলে পরিযায়ী শব্দটা চিরাচরিত মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের অসাম্যতাকেই প্রকট করেছে বলেই মনে করে অতীন।

কাজের অভাব এবং কম মজুরির কারনেই মূলত শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়। নিজেদের রাজ্যে যদি অনুকূল কাজের সন্ধান থাকতো বা সঠিক পারিশ্রমিক পেতো,তাহলে তো কাউকে নিজের ঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হতো না। তারা আতঙ্কেই ফিরছে। কাজ হারিয়ে ঘরমুখো হয়েছে। সমস্ত দেশ জুড়েই ছিল এই সব শ্রমিকেরা। গহনা শিল্প থেকে শুরু করে শহর গড়ে ওঠার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, শপিংমল, বড়ো বড়ো আপার্টমেন্ট সবই তো তৈরি হয়েছে শ্রমিকদের পরিশ্রমে। তাদের সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে হাত গুলো কিনে নেয় পুঁজিবাদী মানুষেরা। আজ তাদের বাড়ি ফেরা নিয়ে এতো জলঘোলা দেখে অস্থির হয়ে ওঠে অতীন। তাদের ফেরার ভাড়া নিয়ে পর্যন্ত দলাদলি হচ্ছে। ক্ষুধা নিয়ে কতো দূর হাঁটা যায়! ক্লান্ত শরীর শুয়ে পড়েছে রাস্তায়। খিদের জ্বালায় কেঁদে উঠেছে ছোট বাচ্চারা। রাস্তাতেই প্রসব করে এক মহিলা শ্রমিক সমস্ত যন্ত্রণা গুটিয়ে আরো কয়েক কিলোমিটার হেঁটেছে! অতীন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে,এটাই কি প্রকৃত ভারতবর্ষ! এই জন্যই মুখোরিত হই আমরা!

কর্মহীন শ্রমিকেরা ফিরে এলেও পেটের জোগাড় করে উঠতে পারেনি! কোনো কর্মসংস্থান হবে কিনা কেউ জানেনা। ভোটের সময় কিছু দিশা দেখা যেতে পারে বলে মনে করে অতীন। ততোদিন এই সংকট থেকে বাঁচবে কি করে গরীব মানুষ গুলো! কেউ হয়তো ফুটপাতে ত্রিপল টাঙিয়ে ছাতুর শরবত বেচবে। কেউরা হাটেঘাটে মুটের কাজ করবে। কেউ কেউ টোটো চালাবে। সরকার কোন ব্যবস্থা নেবে না জেনেই তো কুয়োয় ঝাপ দিয়েছিল কিছু শ্রমিক। ফেরার পথে ট্রাক পিষে দিয়েছে কতো জনকে। মালগাড়ি পৃষ্ঠ করেছে। ট্রেন থেকে ঝাপ দিয়েছে কতো জন। লাগাত্তার মৃত্যু ঘটেছে শ্রমিকদের। অতীন প্রায় প্রতিদিনই নিরুপায় শ্রমিকদের এই দুর্দশা গুলো দেখে হাহাকার করে উঠেছে। ফুঁপিয়ে উঠেছে মনেমনে। আর সাইলেন্ট সরকার প্রতিবারই ক্ষতিপূরণের দামামা বাজিয়ে চাপা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে নিজেদের দায়দায়িত্ব গুলো। এবার হয়তো হেঁটে আসা পা’য়েরা আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। বিপ্লব হয়ে উঠবে ওদের ক্ষুধাই।

অতীন এই কয়েক দিন ধরে তার ডাইরির পাতা গুলো শুধু শ্রমিকদের কথা লিখে ভর্তি করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরে ফেরার দুর্দশা দেখে সে নতুন এক ভারতবর্ষের সন্ধান পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের ভারতবর্ষ। লকডাউনের জেরে কাজকর্ম বন্ধ করে রাখতে হবে দেখে শ্রমখোর মালিকেরা রাতারাতি শ্রমিকদের কর্মচ্যুত করে দেয়। নিজের ঘরে বা গ্রামে অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না ভেবেই সেই সব শ্রমিকেরা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মাইল কে মাইল হাঁটার মতো অসম্ভবকে তারা সম্ভব করে তোলার কথাই ভেবেছিল। দিনরাত পেড়িয়ে চলা পা গুলো কখনও ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছিল নির্জন কোন রাস্তায়। খাবার নেই। জল নেই। কখনও লাঠির তাড়া। অচেনা মানুষদের বিদ্রুপ ছিটিয়ে দেওয়াও চলছিলো। অপর দিকে বিত্তশালীরা ঠান্ডা ঘরের মেশিন খারাপ হলে অসহ্য হয়ে উঠেছে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়া শ্রম অধিকারের মধ্যেই পড়ে। দেশ জুড়ে যে এতো শ্রেণীর শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে তাদেরও তো বিশেষ কোন তৎপরতা দেখা গেল না! শ্রমিকদের ফেরানোর ব্যাপারে সবাই কেমন যেন বোবা বেনে গেছিল! তার সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তৈরি করা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও। তাও এই সব ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের দমিয়ে রাখা যায়নি। তারা কখনও বিক্ষোভ করেছে। কখনও নিজেদের দুরাবস্থার কথা স্পষ্ট জানিয়েছে। ফিরেও তাদের নানান সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অনেকেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি। অনেক স্টেশনেই থার্মাল স্কিনিং-এর ব্যবস্থা ছিল না। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা এবার কোথায় যাবে? দুবেলা তারা খাবে কি!

অজস্র মৃত্যু দেখতে দেখতে ফিরলো যারা সেই সব মেহনতি মানুষদের নিয়ে এবার শুরু হয়েছে নানান বিস্ময় প্রকাশের পালা। লক্ষ লক্ষ মানুষেরা পেটের দায়ে যে এতো দিন অন্য রাজ্যে আস্তানা গড়ে ছিল তা যেন কেউ জানতোই না! মালিকপক্ষ তো কোভিডের অজুহাতে কাজকর্ম বন্ধ করে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তারা আর বসিয়ে কাউকে মাহিনা দিতে পারবেনা। তাদের কোন আর দ্বায়িত্ব নেই। কেউ কেউ তো শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরিটুকুও দেয়নি। ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেখেও সরকার ঘুরে তাকায়নি। তাদের ফেরার কোন ব্যবস্থা না করেই লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া অবিবেচনাপ্রসূত কাজ নাকি রাজনৈতিক কোন চাল! হঠাৎ টানা তিন সপ্তাহের জন্য দেশ জুড়ে ঘরে থাকার নিষেধাজ্ঞা জারি করার সময় শ্রমিকদের কথা মাথায় ছিল না! অসহায়,বিপন্ন, দুঃস্থ,কর্মজনিত পরিযায়ী মানুষেরা ফেরার কোন সুরাহা না পেয়ে দলেদলে হাঁটতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে ছিল সিকিউরিটি গার্ড,ওয়েটার, ঘরামি, রাজমিস্ত্রী, ধোপা, কুলি,মুটে,মেথর, সব্জি বিক্রেতা,ইঁটভাটা,ক্ষেতের কাজ,কলকারখানা, ড্রাইভার, হকার, খাদানের কাজ,গহনার কারিগর প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির দিনমজুররা। এক একটা শ্রমিকের দল প্রায় নব্বই কিলোমিটার হেঁটে ফিরছে দেখেও কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলেও হয়তো এই শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা যে দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে তাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই আর অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করতে চাইবে না।

শ্রমিকদের সাথে সরকারের এই নির্দয় ব্যবহার কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি অতীন। সে মনেমনে ধিক্কার জানায় এই সমাজ ব্যবস্থাকে। যে সমাজ শুধু মাত্র নিজেদের মুনাফার স্বার্থে মজুরদের কাজে লাগিয়ে, তাদের ঘামরক্ত চুষে খায়,তাদের প্রতিনিয়ত শোষণ করে সেই সমাজ ব্যবস্থাকে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।

Facebook Comments

Leave a Reply