পরিযায়ী ঘুম : সোমনাথ ঘোষাল
এতদিন ঘরে মুখবাঁধা অবস্থায় থেকে থেকে কখন যে মোবাইলের মেমোরি কার্ডে ঢুকে গেছি টের পাইনি। অবসরের বাড়িতে আমি আর একটা বুড়ি। যে বুড়িটা কোনো এককালে তলপেটে চাপ নিয়ে আমাকে জন্ম দিয়েছে। সেখানেও ঘুমিয়ে ছিলাম। আকাশের দিকে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যেতে সময় লাগে না। সেই সময় সাদা শাড়িটা পায়রার ভূমিকায় মুড়ি খেতে আসে। জন্মের পর খিদে পায়। খিদে পেলে লাগানো পায়। হাগা মোতা এইসবও পায়। কিন্তু এযাবৎ কিছুই পায় না! একটা মৃত্যুভয়ে সবকিছুই শুকিয়ে গেছে। তাই গাছেদের সঙ্গে সময় কাটাই। সিঁড়ির ভাঁজে পড়ে থাকা গতকালের নামহীন শব্দ আমাকে ডাকে। আবার ডাকে। আমার ঘুম পায়! মোবাইলের ওপারে বুড়িটা গুমরে বসে থাকে। যদিও আকাশে তখন বিজ্ঞাপনের শুটিং চলছে। কী ভালো আছি এই বিকেলের পড়ন্ত ডানায়।
বুড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ছোট আয়তনে। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমের জলঘোলা করে রাত পা টিপে টিপে চলে যায়। রেললাইন ধরে। কিছু মানুষ বাড়ি খুঁজছিল। নিজের বাড়ি। কিন্তু কাকগুলো ভুল জায়গাতে ডেকেছে। তাই বুড়িটার ঘুম ভেঙে ছিল। রেললাইন ধরে খিদের আনন্দ কুড়িয়ে নিয়েছে পরিযায়ী। ঘুমে চাপ দিয়ে সেই বাড়িগুলোয় চলে যাবে। তাই আনন্দ! ঘুম পড়ে ছিল। লাইন জুড়ে। বুড়িটা চা খেতে খেতে এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারাগায়ে শামুকের জন্ম হয়েছে। এই ঘুমে। আমি তখনও মোবাইলে আধখোলা সাদাকালো বিছানা দেখছি। অনেকগুলো ছোট ছোট পাখি উড়ে যাচ্ছে না। যাদের যাওয়ার কথা ছিল। উলটো দিকে সংবাদ আসছে। কাক এসেছে। পাশাপাশি আলোচনা চলছে। বুড়িটা কাকের ঘর খুঁজে যাচ্ছে। গতকাল ঝড় হয়েছে। বুড়িটার সমান বৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার গাছ মারা গেছে। জলের ধারেও বছরের পর বছর পরিযায়ী ঘুম লেগে থাকে। বুড়িটা আজকাল জল ছেটাতে পারে না ঘুমে! ঘুমন্ত দৃশ্য দেখা যায়।
চাঁদের গায়ে সুতো জড়িয়ে
রাত গজিয়েছে বুড়িটার চাকায়
গড়িয়ে পড়ছে মানুষের পাল
আকার নিয়ে যাচ্ছে ছায়া পরগণা
না বুড়িটার কোনো ঘুম হয়নি। সে জানে না পরিযায়ী কথা! মানুষের ছায়া তুলে নিলে যে শূন্যতা জমাট বেঁধে থাকে, তাতেই ঘুম হয়। আমি এই বন্ধ দোকানগুলোর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছি। কোনো কাঁচা মাল নেই। খালাসীও নেই। আছে একটা মোবাইল। ছবি তুলে যাচ্ছি সময়ের। খিদে, মৃত্যু, একা, আর বুড়িটার!
বুড়িটার গা ভরতি শামুক। মাটি লেগে আছে। বুড়িটার দেশ ছিল। ঘর ছিল। আর একটা স্বপ্ন দেখার জন্য চাঁদ ছিল। কালো অন্ধকারে সাদা শাড়িটা নদীর পাড়ে শুয়ে থাকত। এখন বুড়িটাকে মোবাইলে ঢুকিয়ে, এডিট করে নিচ্ছে। পরিযায়ী ঘুমে।
১ঃ
কী এই নিঃসঙ্গ মরফিন মায়া
আলোতে ঘ্রাণ নিতে নিতে
মৃতপ্রায় চামড়া ও খোলস
কীসের বিরতি নিয়েছে মানুষ
যেখানে শরীর জুড়ে হাজার হাজার
পায়ের ছাপ জমেছে রোজ
মরা পালকের হাড়মাস শুকিয়ে নেয়
অস্থির রাত ঘুমে মাস্তুল
এ কেমন মাস্তুল
কোন মৃত কবির জন্মের আঁশ ছড়ানো গন্ধ
আমাকে পায়ের ছায়া গুণতে
বাধ্য করছে প্রতিদিন একাকী শূন্য
এই শূন্যতার কোনো দেশ নেই
এই দেশের কোনো শূন্যতা নেই
কেবল লক্ষ লক্ষ রাস্তা জুড়ে পড়ে আছে
নাগরিক শামুকের নির্বাসন
২ঃ
রাতের গন্ধ নিয়ে চারপাশ
কেমন নিশ্চুপ শুয়ে আছে
দেখা যায় শুধুমাত্র অপেক্ষা
কীভাবে ছুঁয়ে যাব একা
এখন অনেক তারারা ফিরেছে
একফালি চাঁদ দেখার জন্য
কবিতার শেষে পরীরা উড়ছে
শব্দ করে ডাকে মৃত জোনাকির
কথাবার্তা
এ যেন যুদ্ধের দৃশ্য নয়
চামড়ার গন্ধ নিয়ে মানুষ
বহুদূরে ফলের মতন মুড়ে আছে
শুকনো রোদের আস্তিনে
নির্বাক একাকী শিশুরা
ডানা ঝাপটায় রাষ্ট্রের মুখে
Posted in: June 2020 - Cover Story, PROSE