গল্প : সৌগত ভট্টাচার্য

বিজন ও হাইগেন্স

কী যেন একটা স্বপ্নে বিজনের ঘুম ভেঙে যায়। আজকাল ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে নমিতা বিজনকে ডাকে না। বিজনও আজকাল আর ঘড়ি মিলিয়ে দোকান খুলতে পারে না। একটা সময় ছিল শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মতই ঘড়ির কাঁটা কাঁটায় বিজনের দোকান খোলা বন্ধ হত। আশেপাশের দোকানদারা বিজনকে দেখে ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে সময় ঠাহর করতে পারত! বাড়ির খুব কাছেই বিজনের দোকান। কোনো রকমে চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়েই নমিতাকে বলে, “দেরী হয়ে গেছে, এখন আর খাবো না, তাড়াতাড়ি এসে দুপুরের ভাত খেয়ে নেব।” “তাই বলে খালি মুখে যাবে?” “একটু আগে ডাকলে না কেন তুমি?”। নমিতা রাগ করে–“নিজেই তো বলো তোমাকে নাকি শান্তিতে স্বপ্ন দেখতেও দিই না!” উত্তর না দিয়ে বিজন কোনো রকমে গায়ে জামাটা চাপিয়েই দোকানের দিকে রওনা দেয়। নিটোল ফর্সা গোল মুখ, মাথার কোঁকড়া চুল পাতলা ও সাদা হয়ে এসেছে। ছানি অপারেশনের পর থেকে এখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পায় বিজন।

ইট সুরকি চুন দিয়ে গাঁথা বিল্ডিংটির বয়েস একশ বছরের বেশি। নোনা ধরা বিল্ডিঙটি দাঁড়িয়ে আছে শহরের ঠিক মাঝখানে। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে ইট মরচে পড়া লোহার কড়িবর্গার কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। বিল্ডিঙের ছাদের কার্নিশ থেকে বেরোনো বট গাছ গুলোর বয়সও দেশের স্বাধীনতার থেকে বেশি। বিল্ডিঙের নীচ তলার কোণার প্রশস্ত একটি ঘরেই বিজনের ঘড়ির দোকান। দোকানের মাথায় লোহার সিটে লালের ওপর সদা দিয়ে লেখা “ইম্পেরিয়াল টাইমস”। এটাই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন বনেদি ঘড়ি বিক্রি ও মেরামতের দোকান। একসময় দোকানের মেঝেতে লাল রঙের পালিশ ছিল বোঝা যায়। পলেস্তারার মতোই মেঝেতে চির ধরে ডেবে গেছে শান। উঁচু ছাদের লোহার কড়িবর্গায় একটা বিরাট ফ্যান লাগানো, প্রতি গ্রীষ্মে ঘটাং ঘটাং শব্দ করে করে ক্লক ওয়াইস ফ্যানটি চলেই যাচ্ছে সেই কবে থেকে। পাল্টানোর কথা উঠলেই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বিজন বলে, “এই ফ্যানটি আমার থেকে বেশি গ্রীষ্মকাল দেখেছে!” দোকান ঘরের একদিকে একটি বিরাট লোহার গরাদ দেওয়া জানলা, পাশ দিয়ে একটি গলি নদীর দিকে চলে গেছে। জানলা দিয়ে নদী দেখা যায়। জানলার দিকে পেছন দিয়ে বসলে সমানে কাচের পার্টিশন দিয়ে বক্স করে ঘেরা ঘড়ি সরানোর টেবিল। জানলার দিয়ে আসা আলোয় যাতে ঘড়ি সরানোর সুবিধা হয়। বিরাট দোকান ঘরটির এক দিক জুড়ে মেহগনি কাঠের “এল” শেপের হাত ঘড়ি রাখার শো কেস। দশকের পর দশক মুছে মুছে পালিশ অনেক দিন আগেই উঠে গেছে। নমিতা বিজনকে অনেক বার বলেছিল, “শোকেস গুলো একটু পালিশ করিয়ে নিলেই পারো!” বিজন খুব উৎসাহ দেখায়নি, বলেছে, “সে অনেক হ্যাপা, শো কেসের কাচ গুলোও ভেঙে গেছে, আর কয়দিনই বা আছি!” “তোমার সঙ্গে এ জন্যই কথা বলতে ইচ্ছে করে না!” নমিতা বলে। “কত দিনের ধুলো এই শোকেসে জমা আছে তুমি জানো? ধুলো গুলোর ওপরও মায়া পরে গেছে আমার!” বিজন নমিতাকে বলে। দেওয়াল ঘড়ি গুলো চুন করা দেওয়ালে গাঁথা পেরেকে ঝুলছে। কয়েকটা বিক্রি না হওয়া ব্যাটারির কোয়ার্টজ ঘড়িও আছে। বড় রাস্তা থেকে সোজা দোকানের দিকে তাকালে একটা বড় সাদা পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ি দেখা যায়। “ঢং ঢং” শব্দ বিজনের ঝিমোনি ভাঙিয়ে দেয়, ধড়ফড় করে উঠে বিজন চোখ কচলায়, বিজন বড় ঘড়িটার তলায় বসে কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিল। ঘুম ভাঙার পর বিজনের আর স্বপ্ন মনে থাকে না। কিন্তু স্বপ্নের আবেশটুকু থেকে যায়। দোকান খোলার পর বিজন বড় ঘড়িটিকে রোজ দম দেয়। বেশি করে দম দিলে যদি গোটা জীবনের সবটা সময় পার করে দিত ঘড়িগুলো, বিজন মনে মনে প্রায়ই একথা ভাবে!

হাতে ধুয়ে সারা দোকানে জলের ছিটে দিয়ে বিজন ধুপ ধারায়। বিড়বিড় করে একটা মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে ক্যাশ কাউন্টার ক্যাশ বাক্স রিপেয়ারিং টেবিল শোকেস দেওয়াল ঘড়ি চৌকাঠে পিতলের ধূপদানি দিয়ে ধূপধুনো দেখিয়ে একদম শেষে দরজার ওপরের একটা বিরাট ছবিতে অনেক্ষণ হাত ঘুরিয়ে ধূপ দিয়ে বিজন অনেক্ষণ ধরে প্রণাম করে। গোটা দোকানে একটাই ছবি আছে, মেহগনি কাঠের মোটা ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো। ফ্রেমের ভেতরের ছবিটি একজন বিদেশি যুবকের। তাঁর ঘাড় পর্যন্ত লম্বা সোনালী চুল, টিকালো নাক, আর নদীর দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা জোড়া চোখ। বিজন না চাইলেও সারাদিন ছবিটার দিকে চোখ চলেই যায়। দোকানের দরজার সোজাসুজি যে চেয়ারে বিজন বসে থাকে ঠিক তার সামনে দরজার ওপর ছবিটি টাঙানো। এই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে হালকা ঘুমে স্বপ্নে সোনালী চুলের এক যুবকের মুখ ভেসে ওঠে! একটা হলদেটে সময়ের ভিতর হেঁটে যায় একলা বিজন, নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। চোখ খুলে ঘরটাকেই যেন আবছায়া স্বপ্ন মনে হয় ওর।

“নরেশের আসতে আজ দেরি হচ্ছে!” বিজন শৈলেনকে জিজ্ঞেস করে। শৈলেন ঘড়ির দিকে তাকায়। দোকানে বেশ কয়েকটি কাঠের হাতলওয়ালা মুজবুত চেয়ার আছে। বিজন ছোটবেলা থেকেই এই চেয়ার গুলো দেখে আসছে। একসময় এগুলোই কাস্টমারদের বসার চেয়ার ছিল। সন্ধের পর একে একে বিজনের বন্ধু বান্ধবরা দোকানের সেই চেয়ারগুলোতে এসে বসে। বিজন বসে থাকে কাউন্টারের ভেতর। “ফণীর কোনো খবর জানিস?” অশোক বিজনকে জিজ্ঞেস করে। বিজন বলে, “খবর আর কী! একই খবর! নতুন খবর মানেই তো…!” দুটো চেয়ার ফাঁকা হয়ে গেছে, গৌতম আর ফিরবে না, ফণীর হাসপাতালে ডায়ালিসিস চলছে। বিজন দোকান বন্ধ করা পর্যন্ত বন্ধুরা সকলেই থাকে। ইদানিং শীতের রাতে দোকান বন্ধ করতে খুব বেশি দেরি করে না বিজন। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে দোকান বন্ধের আগে চারিদিক দেখে শুনে দোকানের বিভিন্ন কোণে অনেকবার প্রণাম সেরে, একদম শেষে দরজার ওপরে টাঙানো বাঁধানো বিদেশি যুবকের ছবিতে প্রণাম করে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বিজন।

এক সময় “ইম্পেরিয়াল টাইমস” ছিল শহরের একমাত্র বনেদী নামকরা ঘড়ির দোকান। বিজনের বাবা সুখময় গাঙ্গুলি ছিলেন এই দোকানের ম্যানেজার। আংলো ইন্ডিয়ান সাহেব জন ক্লার্ক এই দোকানটি খুলেছিলেন চা বাগানের সাহেব সুবোদের ঘড়ির বাজার ধরার জন্য। তখন চা বাগান সদ্য খুলতে শুরু করেছে ডুয়ার্স অঞ্চলে। সাহেবদের মধ্যে হাত ঘড়ি দেওয়াল ঘড়ির কেনা, সার্ভিসিং অয়েলিং এর চাহিদা তুঙ্গে। ঘড়ি তখন শুধু প্রয়োজনই না, আভিজাত্যের অন্যতম চিহ্ন। এই বিদেশি যুবকের ছবিটি জন ক্লার্ক এর লাগানো। সুখময় গাঙ্গুলি ম্যানেজার হলেও ঘড়ির কাজ জানতেন অসামান্য, কলকাতা থেকে ঘড়ির কাজ শেখার অভিজ্ঞতা তাঁর। যদিও অন্যান্য কয়েকজনকে ঘড়ি সারাইয়ের কাজ শিখিয়ে পড়িয়ে কাজে লাগানো হয়েছিল দোকানে। স্বাধীনতা বছর দুয়েক আগে জন তাঁর প্রিয় ম্যানেজার সুখময় গাঙ্গুলিকে প্রায় নামমাত্র জলের দামে দোকানটি দিয়ে জন ক্লার্ক দেশের বাড়ি ফিরে যান। গাঙ্গুলিবাবু একটুও না পাল্টে দোকানটি একই রকম রেখে দিয়েছিলেন। সুখময় গাঙ্গুলি বনেদিয়ানায় বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। অনেকে বলার পরও দোকানের নামটা একই রেখেছিলেন বদল করেনি।

বিজনকে বিভিন্ন জনের থেকে প্রশ্নটা শুনতে হয়েছে “দেওয়ালে টাঙানো ছবির এই বিদেশি লোকটি কে?” বিজন ছবির দিকে আঙুলের ইশার দিয়ে দেখিয়েছেন, বলেছেন “নিচে লেখা আছে!” ছবির নিচের সাদা অংশে খুব ছোট ছোট কালো অক্ষরে ছাপা Christiaan Huygens FRS (1629-1695)। বিজন শৈশব থেকে এই লোকটির ছবি দোকানে টাঙানো দেখে আসছে। শৈশব থেকেই বিজনের কৌতূহল যে লোকটি কে! কেনই বা এখানে ঝুলছে ছবি হয়ে! বিজন হাইগেন্স সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানে না। সুখময় মাঝে মধ্যে যেটুকু বলেছিলেন সেটুকুই তার পরিচয় হাইগেন্স এর সঙ্গে। শুধু জানে হাইগেন্স নাকি বিরাট বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু ফাঁকা দোকানে সারাদিন ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছবিটির সঙ্গে বিজনের একরকম নির্বাক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বহুদিন। অবসরে ঘুমে ঝিমিয়ে থাকা বিজনের সব স্বপ্ন গুলোর কথা যেন ছবিটি জানে। বাবাকে দেখতেন ছবিটি প্রণাম করে দোকান খুলতে বন্ধ করতে, বিজন সেটিই প্রশ্নহীন ভাবে অনুসরণ করে গেছে আজীবন। ভালো স্কুলে পড়াশোনা শুরু করলেও বাবার শরীর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় বিজনকে পড়াশোনাকে পাশে সরিয়ে দোকানের দায়িত্ব নিতে হয়। আই লুপ লাগিয়ে টুইজার নিয়ে বিজনের ঘড়ির কাজে হাতেখড়ি বাবার হাতেই। বাবা চলে যাওয়ার পর রাতের কলেজে গ্রাজুয়েশন করে বিজন। সেই থেকে এই “ইম্পেরিয়াল টাইমস” বিজনের জীবনের রুটিন। দিন দুপরে ঝিমিয়ে স্বপ্ন দেখার ব্যবসাও বটে!

‘এই ঘড়ির পার্টস এখন আর পাওয়া যায় না’– বলে ঘড়িটির ব্যাক কভার লাগিয়ে কাস্টমারের দিকে ঘড়িটা এগিয়ে দেন বিজন। “কোথাও পাব না? এটা আমার ঠাকুরদার ঘড়ি!” কাস্টমার বিজনের দিকে তাকিয়ে বলেন। বিজন বলেন,”ব্যাটারির ঘড়ি আসার পর দম দেওয়া ঘড়ির কোনো ডিমান্ড নেই আর, কোম্পানি তাই পার্টস বানায় না!” বিজনের দোকানে যদিও সবই দম দেওয়া ঘড়ি। দিনে সাকুল্যে দু’ একজন কাস্টমার আসে অয়েলিং করাতে বা ব্যালেন্স স্টাফ ঠিক করাতে সেটাও দিনেদিনে কমে প্রায় নেই হয়ে গেছে। চারপাশে অনেক নতুন নতুন ঘড়ির দোকান খুলেছে। বিজনের সংসারে অভাব বেড়েছে, কিন্তু বিজন কিছুতেই ব্যাটারির ঘড়ি দোকানে রাখতে চাননি। এক সময় এই শহরে বিজন ছিল সবচেয়ে ভালো ঘড়ির মেকার। দোকানে কর্মচারী ছিল কিন্তু যে ঘড়ির জটিল সমস্যা সেগুলো রাতে বাড়িতে নিয়ে কাজ করত। নমিতা একসময় বিজনকে বলেছিল দিকে “কিছু ব্যাটারির ঘড়ি রাখলেই তো পারো। এত চাহিদা যখন আজকাল!’ নামিতার কথায় বিজন রেখেওছিল কিছু ব্যাটারির ঘড়ি কিন্তু মন থেকে কোনো সায় পায়নি। বিজনের বলে, “বুঝলে নমিতা ব্যাটারির ঘড়িতে কোনো আত্মা থাকে না, প্রাণ থাকে না। চোখের ডাক্তার তো শুধু চোখটাই দেখেন! দৃষ্টিটা তো আর দেখেন না। যে ঘড়ি চলার জন্য মানুষের শরীরের স্পর্শ প্রয়োজন হয় না, আঙুল দিয়ে দম দেওয়ার দরকার হয় না, সে যন্ত্র শুধু রোবট।” বিজন নিজের এই বিশ্বাস কাউকে বোঝাতে চায় না সে। বিজনের ভেতরে ভেতরে ব্যাটারির ঘড়ি সম্পর্কে যত বেশি অবজ্ঞা তৈরি হয়েছে, দম দেওয়া ঘড়ি ওঁর দোকান থেকে শুধু নয় দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে বিদায় নিয়েছে। ‘ইম্পেরিয়াল টাইমস’ এর দেওয়াল জুড়ে ধূসর কিছু পেন্ডুলাম দুলছে। কাস্টমারটি দোকান থেকে চলে যাওয়ার সময় একবার বিক্ষিপ্ত ভাবে দেওয়ালে টাঙানো ছবিটির দিকে একবার তাকিয়ে যায়।

ঝাঁকড়া কাঁধ পর্যন্ত সোনালী চুল, চোখা নাক, ফর্সা রঙের যুবকটির ছবিটার দিকে বিজন মাঝে মাঝে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখটা বন্ধ হয়ে আসে। বিজন ছবিটার দিকে তাকিয়ে কিছু না কিছু ভেবেই গেছে সারাজীবন। ছবির যুবকটি যেন দোকানের জানলা দিয়ে সোজা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিজন ভাবে সময় ব্যাপারটাতো শুধু ঘড়ি মিনিট সেকেন্ড এমন যান্ত্রিক নয়, পেন্ডুলামের দোলকের মধ্যে যেন একটা শ্বাস প্রশ্বাস লুকিয়ে আছে। হৃদপিণ্ডের ওঠানামা আছে। সময়ের স্পন্দনকে ধরতে চেয়েছিল একদিন মানুষ। নিজের হৃদয়ের সঙ্গে পেন্ডুলামকে এক করে দিয়েছে। সময়কে শরীরের অংশ করেছে। তাই তো হার্টবিট ঘড়ি দিয়েই মাপে ডাক্তার। বিজনের খুব আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে সময়ের মত একটা রক্ত মাংসের ব্যাপারকে মানুষ কি ভাবে যন্ত্রে নিয়ে এসেছে! বিজন। পেন্ডুলামের ঘন্টার শব্দে বিজনের সম্বিৎ ফিরে আসে। যদিও সম্বিৎ ফিরলেও বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ তো নেই। এখন সকলের হাতেই একাধিক ঘড়ি, মানুষ জামা কাপড়ের মতোই ঘড়ি বদলায়। নষ্ট হলে কেউ আর ঘড়ি সারায় না, সময়কে ফেলে দিয়ে নতুন করে সময়ের শাসন যন্ত্র হাতে তুলে নেয়। সেদিন সন্ধ্যার আড্ডায় অশোক বলছিল, “শোন, এখন নতুন ইলেকট্রনিক ঘড়ির পর স্মার্ট ঘড়ি এসেছে, সেগুলো কোনটা রোদে চলে কোনটা আবার হার্টবিট ক্যালোরির খরচ মাপে,কে কয় পা হাঁটলো সারাদিনে সেটাও বলে দেয়।” সব শোনে বিজন কিন্তু ঘড়ির দোকানে বসে দোকানের বাইরের সময়কে ঠিক ধরতে পারেনা!

বিজন যখন আই লুপ আর টুইজার দিয়ে ঘড়ি খোলা শিখছিল বাবার থেকে, ছেলেকে সুখময় হাইগেন্স এর ছবির দিকে দেখিয়ে বলেছিল, “কুক আর হাইগেন্স মিলে ঘড়ির পেন্ডুলামের চলন নিয়ে বিরাট কাজ করেন। ভেবে দ্যাখ পেন্ডুলামের দৈর্ঘ্য কতটা হলে সেটা কত সময় ধরে দুলবে সেটার উপর গোটা দুনিয়ার সময় নির্ভর করে।” বিজন আশ্চর্য হয়ে শুনেছিল। “হাইগেন্স আর কুক মিলে একটা স্প্রিং এর কথা ভেবেছিলেন সেই সময়, এখন যেটা হাত ঘড়ির ভেতরেও থাকে, সেটাকে বলে হেয়ার স্প্রিং। সেটাই ওঠানামা করে, হার্ট যেমন করে শরীরে। হেয়ার স্প্রিং হল ঘড়ির আত্মা।” সেদিন সুখময় ছেলের শিক্ষক হয়ে বিজনকে বলেন,”হার্ট বললে যেমন শুধু শরীরের একটা যন্ত্র বোঝায় না, মনও বোঝায় তেমনি হাইগেন্স শুধু বিজ্ঞানী নয় রে, একজন বিরাট দার্শনিক। যে সময়কে শুধু বিজ্ঞান দিয়ে নয়, আরো অনেকটা বড় কিছু দিয়ে ধরেছেন”। তরুণ বিজন বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল “সময়কে তাহলে কী দিয়ে ধরেছে?” সুখময় বলেছিলেন “বড় হলে বুঝবি, সময় শুধু বিজ্ঞান না, শুধু ঘড়ি না, মনের গভীরের একটা দর্শন, একটা যোগাযোগ!” বাবার কথা শুনে বিজন ছবিটার দিকে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ, এখনো যেমন তাকিয়ে থাকে। সারা দোকান জুড়ে টিক টিক টিক টিক…

সন্ধ্যায় বিজনের দোকানে আড্ডায় ঢুকতে ঢুকতেই নরেশ বলে,”চীন ইতালি ইংল্যান্ড আমেরিকার অনেক জায়গায়ই নাকি কোনো ঘড়িই আর সঠিক সময় দিচ্ছে না শুনলাম।” শৈলেন বলে,” টুসকি,ওইযে পাড়ার সুরেন ব্যানার্জি বাড়ির ছোট মেয়েটা এসেছে আজ বিদেশ থেকে, কি সব সমস্যা শুরু হয়েছে নাকি ওই দেশে প্লেন ওঠা নামায় সময়ের গোলমাল…!” “আমি যা শুনলাম সব ঘড়িই পনেরো সেকেন্ড থেকে পনেরো মিনিট গোলমাল করছে এদিক ওদিক টাইম দেখছে।” অশোক বলে। “কেউ কোথাও সময়কে ধরতেই পারছে না, সারা বিশ্বের সব যন্ত্রপাতি নাকি লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে এক নিমেষে” বিপ্লব বলে। বিজন সমস্ত আলোচনা শুনে গম্ভীর হয়ে বলে, “কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?” নরেশ বলে'” অত তো জানি না, শুনলাম, আমাদের পাড়ার ছোটু তিনদিন আগে দার্জিলিং মেলে আসার কথা ছিল বর্ধমান পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে গেছে ট্রেন। সিগন্যালিং এর টাইম মিলছে না এক স্টেশনের সঙ্গে অন্য স্টেশনের। এক্সিডেন্ট হওয়া থেকে বেঁচেছে। কোনো মতে কিছুটা হেঁটে কিছুটা অন্য গাড়িতে এসেছে।” “সব রকম সময়ের সঙ্গে যুক্ত ইলেকট্রনিক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে নাকি একরকম ভাইরাস হানা দিয়েছে। এমন সময়-মারণ ভাইরাস আগে পৃথিবী দেখেনি কখনো। এর কোনো অ্যান্টি ভাইরাসও এখনো অবধি নাকি নেই!” শৈলেন বলে। “আমাদের দেশে তো এই সমস্যা নেই?” বিপ্লব বলে। কী শুনলি এতক্ষণ দার্জিলিং মেল লেট, প্লেন নামতে সমস্যা, ইন্টারনেট খুলছে না, ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবীতে! ছোট বেলায় ভূগোল বইয়ে ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইনের কথা পড়িস নি? সময়ের এই দেশ ওই দেশ হয় না!” নরেশ বলে। নরেশকে সমর্থন করে অশোক বলে ” ভাইরাস কি আর দেশ কাল রাজনীতি মানে! যেখানে টাইম ডিভাইস দেখছে সেখানেই হানা দিচ্ছে ভাইরাস। ভাইরাসের শুধু একটা ডিভাইস লাগে, সেটা ঘড়ি।” “বিজ্ঞানীরা বুঝেই উঠতে পারছে না কী এর সমাধান। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই অনেক সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্টারনেট সার্ভিস নিউজ ওয়েদার ফোরকাস্ট প্লেন ট্রেন। এমন পৃথিবী জোড়া টাইম ডিভাইসে ভাইরাস হানা আগে কখনো হয়নি। সব দেশের সব সরকার শুধু বলেছে আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বোঝার চেষ্টা করতে…!” শৈলেন দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে কথা গুলো! পেন্ডুলামের ঘড়িতে ঢং বেজে ওঠে, বিজনের দোকান বন্ধের সময় হয়।

— কি যে হল!
—- এমন ভাইরাসের কথা জন্মেও শুনিনি।
—- সেটা ঠিক।
—-তিনদিন হল নিউজ পাচ্ছিনা!
—- কেন হল?
—- কেন আবার হবে, এগুলো ভাইরাস ছেড়ে দেওয়ার সব চক্রান্ত!
—- আরে দাদা চক্রান্ত করে লাভটা কার বলুন দেখি!
—এগুলো অনেক উঁচু লেভেলের পলিটিক্স, আমি আপনি বুঝব না।
— জানেন না যারা ভাইরাস বানায় তারাই পরে অ্যান্টি ভাইরাস বেচে। গ্লোবাল বিজনেস পলিসি দাদা। সেল পলিসি…
— আরে রাখেন। সব কিছুতে পলিটিক্স! একটা শত্রু পক্ষ দাঁড় করাতে পারলেই খুশি!
—-দেশের এত ফিনান্সিয়াল লস করে কেউ পলিটিক্স করে! অ্যান্টিভাইরাসে আর কত লাভ হবে? যা লস হল তা পোষাবে?
— মোবাইল ইন্টারনেট যে আবার কবে কাজ করবে। আমাদের অফিস ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
—- আরে আমাদের সব ক্লায়েন্ট বাইরের। কিছুতেই সময় মিলছে না। না আছে ফোন না পাওয়া যাচ্ছে নেট। মোবাইল এখন পেপার ওয়েট।
— মাইক্রো ওভেনে খাওয়ার দিয়ে টাইমার সেট করলে হয় গরম হচ্ছে না নয় পুড়ে যাচ্ছে। কী জ্বালা বলুন।
—এ ভাবে বেশিদিন চললে তো কোম্পানি চাকরিতেও রাখবে না। বসিয়ে কি আর মাইনে….

বিজন তাঁর দোকানের সামনে পৌঁছতেই ভীরের মধ্যে হওয়া আলোচনা থেমে যায়। বিজন দেখে প্রচুর মানুষ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ আবার উঁচু বিল্ডিঙের ফাঁক দিয়েই সূর্য দেখার চেষ্টা করছে। ভিড়ের চোটে দোকানের পুরানো দোকানের দরজা এই ভাঙে কী সেই ভাঙে অবস্থা। বিজন সমানে বলে, “কী হয়েছে? এত ভীড় কেন?”

সবার হাতে বা পকেটে একটা করে বাপ ঠাকুরদার আমলের দম দেওয়া ঘড়ি। যেগুলো অযত্নে ধুলো পরে থেকে কোন কালে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে সময় দেওয়া! “একটু সরে দাঁড়ান একটু সরে দাঁড়ান। আমি দেখতে পাচ্ছি না। দোকানটা খুলি” মানুষের আর তর সয় না! সবাই অস্থির মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিজন যদি এই ঘড়ি গুলোকে আবার সচল করে দেয়। কারণ চারিদিকে সময়ের যে গণ্ডগোল চলছে পৃথিবী জুড়ে তাতে নাকি একমাত্র দম ঘড়িতে ভাইরাস হানা দিতে পারেনা। সারা পৃথিবীতে যেখানে যত মোবাইল ফোন গাড়ি সফ্টওয়্যার কম্পিউটারের কারখানা আছে সেগুলো প্রোডাকশন বন্ধ করে রাতারাতি দম দেওয়া ঘড়ি বানানোর কারখানা বানিয়ে দিতে চাইছে। শোনা যাচ্ছে দম দেওয়া ঘড়ির নাকি বিশ্বজুড়ে বিপুল চাহিদা বাড়বে। বিজন সব দেখে শুনে থ । বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে! প্রতিদিন বিজন দোকান খোলার সময় চার পাঁচটি কুকুর বিজনের দোকানের সমানে রোজ আসে। বিজন ওদের খেতে দেয়। আজও বিজনের দোকানের বড় দম দেওয়া পেন্ডুলামের ঘড়ির সময়ের কাঁটায় কাঁটায় কুকুর গুলো চলে এসেছে। ভীড়ের মধ্যে এক পাশে অপেক্ষা করছে খাওয়ার জন্য।

বিজন চোখে আইলুপ লাগিয়ে একটার পর একটা ঘড়ি খুলতে থাকে আর দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়, সব ঘড়িরই হেয়ার স্প্রিং নষ্ট। বিজনের বাবা বলত, ” হেয়ার স্প্রিং হল ঘড়ির আত্মা, সময়ের প্রাণ, হৃদপিণ্ডের মত ওঠানামা করে!” কিন্তু এত হেয়ার স্রিং এখন বিজন পাবে কোথায়! এত আত্মা, এত প্রাণ কে সাপ্লাই দেবে এই দুর্দিনে!

বিজন হাইগেন্স এর ছবিটার দিকে তাকায়! একের পর এক ঘড়ি যত বাজারে এসেছে, মানুষ তত ব্যস্ত হয়েছে! ঘড়ির দাম যত কমেছে, মানুষের সময়ের দাম নাকি বেড়েছে! দম দেওয়া ঘড়ির স্প্রিং সময়ের নিয়ম অনুসারেই সারাদিন ধরে আস্তে আস্তে খোলে, কোনো ব্যস্ততা নেই। সময়ের আগেও না পরেও না, হেয়ার স্প্রিং এর ওঠা নামার শব্দ শুনতে পায় বিজন, সময়ের শব্দও শুনতে পায়! বিজনের মনে পড়ে বাবা একদিন তাঁকে বলেছিল সময় শুধু বিজ্ঞান নয়, অনেক বড় কিছু… বড় হলে বুঝবে বিজন। বিজন সামান্য ঘড়ি বিক্রেতা, আজ কিছুটা বড় হয়েছে। এই প্রাচীন বাড়ির ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে বিজনের আজ নিজেকে হাইগেন্স এর একান্ত বন্ধু বলে মনে হয় যে এত বছর ধরে বিজনের সব স্বপ্ন দেখার সাক্ষী! হাইগেন্স এর মত তাঁরও সময় নিয়ে কারবার! বিজন ভাবতে ভাবতে নদীর দিকে তাকায়, হাইগেন্সও ছবি থেকে নদীর দিকে তাকায়। ঘড়ি বন্ধ শহরে সন্ধ্যা নামে। ‘ইম্পেরিয়াল টাইমস’এ শুধু পেন্ডুলামের ঘন্টার আওয়াজ ভেসে ওঠে! সোনালী চুলের এক যুবক অন্যমনস্ক হেঁটে চলে যাচ্ছে নদীর তীর বরাবর, বিজন দেখে।

Facebook Comments

1 thought on “গল্প : সৌগত ভট্টাচার্য Leave a comment

  1. ভাবনাটি চমৎকার। শুভেচ্ছা গল্পকারকে

Leave a Reply