রাজস্থান ডায়েরিস : সিন্ধু সোম
পর্ব-১১
রাজস্থান ডায়েরিস—২১
মোনালিসা কলেজ যায়। একা গোলাপী আদর ভুট্টার খই হয়ে ওঠে। জনারের বুলেট ছোটে। সাঁই সাঁই। রেস্টুরেন্টের নাম ‘ধর্ম কাঁটা’! গিলতে গেলে খচখচ করেন সত্যজিৎ। পিচ গলতে গলতে থেমে গেছে এখানে। রাস্তা নিজেকে ভেড়ার পালের মতো মারে। এক সঙ্গে। জোনারের ট্রাক। বাবলা বনে গোরুর লেজ। গাঙ্গুরের জলে কবাড়খানার শব ভাসে। পাঁচিল দেখছে টিয়াপাখি। একা টিন। ঘর বাঁধা অশ্বত্থের পিছনে সিমেন্ট তোলে ক্রেন। এখানে ঝিলের বুকে ভুরুর জন্ম হয়। খুঁটে টান। আঙুলের মেহেন্দি লাগে বুকে। বিস্তৃত চর। সামনে আখেরনের কালো জল। ফেনার উপরে এক জোড়া ডানা নেমে আসে। জলের বুকে। অনেক্ষণের সঙ্গী হয় ছোট্ট আবিলতা। ঘোলাটে চোখের রঙে জল হয় কর্দমাক্ত। মন্ত্র জপ করতে করতে ভেজা অবয়ব ওঠে তীরে
“কোন অনন্ত নৈঃশব্দ হয়ে আছে স্ত্রী ও পুরুষের সঙ্গমে
শুধু এটুকু জানার জন্য শংকরাচার্য প্রবেশ করছেন
সম্রাটের শিশ্ননালী পথে।
জন্মান্ধ আর হাত-পা খসে পড়া নুলো যেমন
পায় নারী শরীরের স্বাদ;
আগুন, অনন্ত, অসীম…কোষ্ঠকাঠিন্যের অবসাদ;
বীর্য—মলমূত্র একই মূল্যমান।
আমি যখন আমার পুত্র
তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় নীতিগল্পের বিভীষিকা
আমি যখন আমার কন্যা
চোখের ধারায় ঝরে পড়ে ডিম্বকোষ থেকে স্বপ্নকণা
দুহাতে দুটো রক্ত চোঁয়ানো আপেল, মাথার চুল আগুন শিখা
আর আমি যখন আমি
শিশুকে যেভাবে উলঙ্গ করে মা, সেইভাবে
খুলে দেয় আমার পাগলামি……” [১]
ফলের গাড়ি। প্রতীক্ষারত বাইক। জলে ডুব দেয় হটি। ব্রজেন বন্দ্যো সিঙাড়া হাতে হাসেন মিটিমিটি। এই জলের কাছে বসব রোজ রাতে। পটপট জাল ছেঁড়ার শব্দ। উঠে আসে। মাথা দেখা যায়। খোলা জামার গায়ে দোল খায় নিঃশ্বাস। জলপরীর প্রতিবেশী। ঝোপের ফাঁকে ঘন হওয়া রাজস্থান তখন গুমরে ওঠে। গায়ের চুনি জল। স্বেদবিন্দুর মতো। “তালফলাদপি গুরুমতিসরসম” “কুচকলসম্” গ্রহণ লাগা বলয় সূর্যের ভারে চারদিক রাঙা করে এনেছে। রোদ যেতে যেতে ফিরে দেখে। আঙুলের মাথা ভেজে। পিছল শরৎ নেমে আসে। কেঁপে ওঠে নারী। আমার পাশের বালি। ওঁৎ পাতা ঘোড়ার খুরের দাগ। বসন্তের চিহ্ন। অনিশ্চয়তার উপর আরাম করে বসে। আমি প্রশ্ন করি,”পরিচয়?” সে দিগন্ত বুকে ধরে। ভারে বুক নেমেছে উদারায়। কোমল গান্ধারের মহাকর্ষ পেয়ে জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে চোখ। সে বললে, “কেন? কোন জন্মে বিবাহিতা আতর দিয়েছিল গায়ে জানতে চেয়েছিলে? পরিচয় কি? সুকুমার রায়ের স্বপ্ন না স্বপ্নের তাতা?”
বালি ভিজছে। রূপ ধোয়া সিঁদুরে জল পথ টানতে পারে না। আমার একটা বিরাট তেলের কড়াই মনে পড়ে। গুলগুল্লা। গুলগুলগুল্লা। দূরে। ওকি! কি নড়ে চড়ে হিংস্রতায়। সিঁদুরে জল থেকে উঠে আসছে একটা ভালুক। কালো বিড়ালের মতো থম মেরে গেছে হাওয়া। নখ চাটছে জীবিকা। কালো বলের মতো এগিয়ে আসে, এগিয়ে আসে। আমার ভেতরটা খুব হালকা হয়ে এল। নারীর দিকে চোখ। কাজের ভারে আটকে যায় বুকে। বলি, “পালাও, পালাও!” নারী ঠোঁটে অবজ্ঞা। আমার স্বর আর কালো নখের রক্ত। দুটোই জাতিস্মর তবে! পোটো পাড়ার তুলির মতো সংযুক্ত দুই মহাকাল। লাল। চারদিকে তীক্ষ্ণ পোড়া রঙ। কুমোরের চাকায় আমার চেতনা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বয়। প্রানীটা এগোতে থাকে। ধর্ষিত হয় বালি। গতি বাড়তে থাকে ভাল্লুকের ক্রমশ।
ঝির ঝির। উঠে দাঁড়ায় নারী। নগ্নতা মাথা কোটে আধো আলো লাল সেই চুলে। আমার সাধনাটুকু ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে ঠোঁটে। সে আমাকে দেখেও দেখে না। অস্তমিত সূর্যের মতো। তখন পাড়ের ধূলো পাহাড়ের চোখ ঠেলে ওঠে। কালো ঝড় । গর গর করে লেজ আছড়ায় সভ্যতা। একফালি তরমুজের হৃদয়রঙা হয় নারীর একগাছি চুল। প্রকৃতির রঙ। তাতে কলপ পড়ে না কোনও দিন। ছুটে আসা ভালুকের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলে নারী। সমস্ত শরীরের নগ্নতা এবার গাঢ় হয়। রক্তের পোষাক। ভাষা পায় গাম্ভীর্য। আমি নিজের অজান্তেই এগিয়ে যাই তার পাশে। ভালুকের ভোঁতা নখ আমাকে নির্বাক করে। নারী আমার কানের পাশে মুখ আনে। ফিসফিস। মুহুর্তে ছায়া তার মিশে যায় শরীরের লালে। লাল ঘন হলে কালোর দরজা খোলে। আস্তে আস্তে ডুবে যায় নাক, মুখ, চোখ। পরিচয়। শনাক্তকরণ পেরিয়ে হঠাৎ সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন। আমি দেখি তার ডানার মধ্যে সংকুচিত হয়ে মিলিয়ে গেল আমার খানিকটা অহং। আকাশ তাকে কোলে টেনে নিল দুহাত বাড়িয়ে। রোজ রাতে ফেরার প্রতিশ্রুতি নেওয়া নদীর বুক তিলের মতো সাজিয়ে দিল অহংহীন আদিমতাকে। আমাকে সে গ্রাহ্যই করল না। ব্যাঙ্গমী। এতদিন যারা সংসারের গল্প করত, এখন তারাও তাতার হয়ে উঠেছে। এ চোখে আবার আমি ব্যাঙ্গমী দেখলাম, হাজার বছর পরে নাম না জানা কথকতার পাতায় তার চিহ্ন ধীরে ধীরে আরও ধীরে গেল সম্পূর্ণ মুছে। দিতির কোলে খুঁজতে হবে আতর আবার। পৌঁছে গেছি। আখেরনের তীর। দিনের পথ চলার ক্লান্তি রাত্রে ভালোবাসা হয়ে ওঠে। আমাকে থাকতে হবে খেয়ার জন্য। ততদিন উজান বেয়ে এগিয়ে যাব খালি। দাঁড়াতে পারি নে আমি। পায়ে বড় ঘুন ধরে যায়, বড্ড বেশি ঘুন…
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৩০শে অক্টোবর ২০১৮
বিকেল ৫টা ২০
সুলোচনা অথবা লোচনহীন, ব্যাঙ্গমীরা চিরদিন রাজপুত্রের বীর্যভার সইবেনা মালতী
রাজস্থান ডায়েরিস-২২
দড়ির খাটিয়া। বিবাহিতা বসতেই ঝুল। ঐ বাঁকানো চিকুররেখ নিয়েই পাহাড় উপত্যকা গড়ে। পাহাড়ের সমস্ত মুখে নকুলদানার মতো বাবলা ঝোপ। ও প্রহরী শুনে যাও। হাঁটুর ওপর কাপড়। রোদের উঁকি। আটকাতে চায় ঘোমটা। জলসেচ। পা দিয়ে ডলে দেয় মাটি। আকাশের ছোঁয়া মাটির ওপর। গাঁদার আগুনে দাউ দাউ করে পুড়ছে প্রজন্ম। আমি লজ্জাবতীর পাতা দেখি। সে চোখ রাঙায়। আমি বেগুনি ওড়নির দিকে ফিরি। সে হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। উঁচু টুকরো পাথরের চাদরে মোড়া রেলগাড়ি। পিছনে পরিত্যক্ত সুর। অশীতিপর স্থাপত্যকে বুকে জড়িয়ে রাখে নিমের শিকড়। দুনি দুনি পাতা ঝুমুক ঝুমুক দোলে। আখের পাতার মতো ভুরু। ছুটে আসে নির্বাসন। সোনার দেশের ধস বড় বেশি আঁকড়িয়ে ধরে।
চমকালো। বিবাহিতা চুলে পরেছে নীল তারা। আমি সময়কে বলি,”ও কি?” মাঠের বুক। ঝাঁপিয়ে পড়ে সাদা দেয়াল। গোল হয়ে বসে তক্তপোষ জপে রাজস্থানও। এখানে বেদুইন নেই। সংকীর্তন আছে। ঘাঘরার রক্ত আমার কাঁখে কলসি পরিয়ে দেয়। সময় অধর দাঁতে চেপে বলে,”দিদি কোত্থেকে পায় নীলতারা? আমাকেও এনে দিতে হবে!” নাও! জানতে গিয়ে রাগ ধরেছে অভিশাপ। এখন কাঁটার মালা এঁকে দাও পায়ে ভোরবেলা। আমার ডান হাতে ঠোকরাচ্ছে পথ। বিবাহিতাকে আমি দেখি। রেললাইনের উঁচু দু’ঠোঁটের মাঝখানে। পাথরভাঙা যন্ত্রণার ওপর বসেছে মোনালিসার মুখোমুখি। বাঘবন্দী খেলা। ঠুক ঠুক্কুর। খোপের ঘেরে বিশেষ হয় নোনা। পুষ্কর পেরোয় সময়ের আঁচলে। অজমীর।
আমি নদীটার তীর বরাবর এগিয়ে চলেছি। মরা গাছের ছায়ায় হরিণ খেলা করে। খস খস। হাওয়ায় নড়ে শাখা। এলোমেলো পাথরের গানে কাগজ ফুল খোঁপায় নিয়েছে বাগান। আখেরনের ওপার থেকে আরতি ভেসে আসে। আকন্দের মূলে দাঁড়িয়ে কোতওয়াল। রাজঘরানা। কি বিশাল আহরণ। সর্ষেফুলের ক্ষেতে মরণের পাগড়িটা ভারি হয়ে ওঠে। পাঁচরংগা। চারটে স্তম্ভ। চাঁদোয়ার বাটি উপচে ওঠে সান্ধ্য যাপনে।
রঙ। চকমকি অন্ধ করে। আমি ওদিকে তাকাতে পারি না। রোদ নিজেকে গুটিয়ে এনে ফেলে। তারার চাষ আগাছার শরীরে। ধিকি ধিকি। আগুন জ্বলে তুষের মতো। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মান্না দে-কে দাঁড় করিয়ে ঘর খুঁজতে যান। কোতওয়াল কি গাইবে,”ও কেন এত…”? নলকূপে আতা ধরে না কোনও দিন। আতার চক্রবূহ ভেদ করে তলোয়ারের ঝলকানি। দু ইঞ্চি। একটা শো পিস বার করে কোতওয়াল ভয় দেখায়। এইও। সাবধান। আজমীরের দরগার সামনে পকেট কাটে। আমি বলি,”ধুর শালা, একটু তুলে ধর!” ছেঁটে ফেলা গাছে সবে নতুন পাতার স্ট্রোক লেগেছে। ভাঁ সঁ-র মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভিজছে আবেগ। কোতওয়াল গদগদে গলায় বলল, “দাদাগো! দুমুঠো খেতে দেবে?” ভাস্কর। ভাস্কর্য। “আমি শালা ভিখারির চেয়েও ভিখারি.”! আকুলতায় বুক বাড়ে। বলি,”কি খাবি বল? চারকোল মাখানো বাংলা না সপ্তপদীর ‘টাচ করবে না’?” দাড়ি নেড়ে কোতওয়াল জানায়, উৎপল দত্ত। এখানেই স্কচ আর বাংলা এক করে ফেলে বাঙালি।
গব গব। ঢেকুর। ইঁটের বুকফাটা হাহাকার অশ্বত্থ আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখে। ইতি উতি। উঁকি দেয় ইঁদুর। খাবারের গন্ধ। কোতওয়াল আরামে ঝিমোয়। আমি তারার দিকে এগোই। পাহাড়ের চেয়েও উঁচু বিজলির তার। সেতারের তারের অনাত্মীয়। নতুন নতুন বিয়ে। ঘুঙ্ঘট ওঢ়েছে খানসামা। আমি একটুকরো অপরাজিত তুলে নিলাম। বিভূতি মাখা সত্যজিৎ-কে এখানে চার্বাকের মতো লাগে। কানের কাছে সংঘের মন্ত্র। রোদের মখমলে হামাগুড়ি। আবার নদী। বিবাহিতা আর মোনালিসা ছুটে এল। ভাঙা ঠেলা। খঁচ খঁচ। মাটি সেঁকছে ডেও পিঁপড়ে। মানুষ তারই পায়ের ধূলোয় লীন। আমি সময়ের কানে পরিয়ে দিই নীলতারা। ধৈর্যের কৌতুহলে ফুটে ওঠে পান্থ। ধীর স্থির। মুখোমুখি দুই ময়ূরের মতো। প্লেটো যাদের কথা উচ্চারণ করতে চান। বসন্ত যাদের পাশে পেখমের ছাতিমতলায় দাঁড়ায় দুদণ্ড। আজ। হেমন্তের প্রতিকূল এক ছবি, সাদাকালোর মহামানব আরেক ছবির মতোই বিনাদোষে জেল খেটে বেরিয়ে আসে। দাঁড়ায় আমাদের সামনে। সময় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। নীলতারার কোলে লালের আভাস দোলে। আমি এগিয়ে চলি গোলাপি শহরের দিকে। এক প্রজন্মের কোতওয়াল আত্মসাৎ করতে করতে…
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৩১শে অক্টোবর ২০১৮
সকাল ১১টা ৫
তারা নীল সন্ধের কাটা কাটান্বিত অলস একটা রাত, বিনতার মতো জ্বলতে জ্বলতে আগুনের লিঙ্গ হয়ে ওঠে
ছায়াবলী ছাঁদে ছাওয়া ছেনালী ছিটিয়ে ছিল, আজ ঋজু স্পষ্ট খঞ্জরে খঞ্জন প্রথম পাণ্ডূলিপির মতো ধূসর ধূমাবতী
_____________________________________
তথ্যসূত্র:
[১] অরুনেশ ঘোষ
Posted in: June 2020 - Serial, PROSE