মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
১. জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানী:
শৈশব থেকে বিস্ময় আমার চিরসঙ্গী। কৈশোরে হাতে এসেছিল কতরকমের গল্পের বই, যা আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এক বিস্ময়কর জগৎ। বাংলাভাষায় লেখা সেইসব অমর সাহিত্যমালা– লেখক অবন ঠাকুর, রাজশেখর বসু, উপেন্দ্রকিশোর, অন্নদাশংকর, প্রবোধ সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, আরও কত। এই বিভূতিভূষণের যেদিন মৃত্যু হয়, সুবর্ণরেখা নদীর ধারে ঘাটশীলায়, সেদিন ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫০। তার ঠিক ১৮-দিন পরে, ওই সুবর্ণরেখা নদীর ধারেই, কিছুটা উজানে দলমা পাহাড়ের নীচে সাকচি নামের গ্রামটিতে আমার জন্ম। এই সামান্য তথ্যের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক কিছুই নেই, তবু একদিন এটা খেয়াল করে আমি বেশ বিস্মিত বোধ করেছিলাম। অল্প বয়সে এমন কত সাধারণ ব্যাপারেও বিস্মিত হতাম আমি।
খুব ছোটবেলায় বাবা কখনও রেগে গিয়ে আমায় বলতেন : ‘তুমি একটা হাঁ-করা ছেলে’। তো, এই ডায়ালগ আমি পরে বিভূতিভূষণের উপন্যাসেও পেয়েছি, বালক অপুকে বলছেন তার বাবা হরিহর। আসলে, বাল্যকালে অনেকেই এমন। যা দেখে যা বোঝে তাতেই বিস্মিত হয়, হাঁ করে থাকে। তবে বিজ্ঞানীদের কথা আলাদা; বিশেষতঃ তিনি যদি পদার্থবিদ বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী হন। তাঁদের কাজকর্ম আজীবন বিস্ময়ে ভরা। কবিদেরও তাই। কবিত্বের মূলেই আছে বিস্ময় ও রহস্যময়তা। এই নিয়েই কবিদের জগত। অবশ্য একেক কবির জগত একেক রকম। কবিমনকে আলোড়িত করে বিশ্বজগতের ক্ষুদ্র ও বিশাল, যাকিছু রহস্যবিস্ময়ে ভরা। কতরকম তার অবলোকন, কতরকমে প্রকাশিত তার বিশালতার ব্যঞ্জনা-–
যেমন, ‘একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি’।
অথবা, ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে’।
অথবা, ‘ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে, হাসে সাগরবেলা’।
অথবা, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।
অথবা, ‘জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ’!
শহুরে নাগরিকদের কাছে আকাশ একটা অস্বচ্ছ ক্লান্তিকর আবরণ। চোখের ছানির মতো ঘোলাটে। মড়ার খুলির মতো প্রাণহীন। শুধু সূর্যোদয়ে বা সূর্যাস্তে দৃশ্যতঃ সুন্দর। তাকে কবি ও চিত্রকর ছাড়া আর কেই বা দেখেছে? তাকে দেখেছে সন্ধ্যেবেলা গ্রামবাংলায় মায়ের কোলের শিশু। মা তাকে চাঁদের থেকে টিপ এনে পরিয়ে দেন। সূর্য তার মামা। – ‘ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি, আমরা যখন উড়িয়ে ছিলাম ফানুস’।
আশির দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পের দিনগুলোয়, কবি স্বদেশ সেন একবার আমাকে বলেছিলেন : ‘বেশি বয়স হয়ে গেলে কবিতা কেন আসে না জানো তো, বেশি বয়স হলে মানুষ আর বিস্মিত হতে পারে না’।
আমার বয়সও তো এখন প্রায় সত্তর হোল। কবিতা কি তাহলে আর আমার কাছে আসবে না? তবে আমি শারীরিক বয়সকে বিশেষ আমল দিইনা আজও। কয়েক বছর আগে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত আমাকে একদিন বলেছিলেন- ‘তুমি বয়স্কও বটে, তরুণও বটে’। আমি দেখেছি, বয়স্ক হয়ে গেলে মানুষ ক্রমে মনের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। ছোট হয়ে আসে তার জগত। বিখ্যাত দার্শনিক ও মনোবিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং তো কবেই বলে গেছেন—মানুষের আছে কালেক্টিভ কনশাসনেস। আদিকাল থেকে অর্জিত সকল জ্ঞানের নির্যাসের অস্তিত্ব বুঝি রক্ষিত আছে আমাদের মগ্ন চৈতন্যের গভীরে। তথ্য নয়, নির্যাস। তাকে, সেই প্রজ্ঞাকে, জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে বিস্ময় এবং অন্বেষণ। প্রাশ্চাত্যের গ্রীক দার্শনিকরা মনে করতেন, মুক্ত মনে শুধু যুক্তি দিয়ে চালিত হয়ে ক্রমে ক্রমে বিশ্বজগতের সকল বিস্ময়কর সত্যের কাছে পৌঁছনো সম্ভব। আর প্রাচ্যের মুনি ঋষিরা জ্ঞানের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন ধ্যানযোগে।
ওই বিশাল আকাশের সুনীল ঢাকনাটা খুলে দিলে যে অনন্ত অন্ধকার, সেখানে জ্বলজ্বল করছে কোটি কোটি গ্রহ, তারা, রবি। সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, নীহারিকা, নক্ষত্রমন্ডলী। প্রাচ্যের কবির মনে হয়েছে—‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। অথবা, ‘খেলিছ এ-বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু’। আর ষোড়শো শতকের মহাকবি সেক্সপীয়ার লিখেছেন তাঁর ‘সনেট ১৪’ কবিতায় —
‘Not from the stars do I my judgement pluck;
And yet methinks I have Astronomy;
..But from thine eyes my knowledge I derive,
And constant stars, in them I read such art,
As truth and beauty shall together thrive’
হ্যাঁ, ট্রুথ অ্যান্ড বিউটি। প্রাচ্যের বিশ্বদর্শনেও আছে সত্য, শুভ ও সুন্দরের আরাধনা; সত্যম, শিবম, সুন্দরম।
*
ইশ্বরের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তর্কের আলোচনায় নেমে প্রথমেই বিপক্ষে আমি একটা অকাট্য যুক্তির আভাস হাতে পেয়েছিলাম। আমার যুক্তি হোল, ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, যদি তাঁর অসাধ্য কিছুই না থাকে, তবে তিনি কি পারেন তাঁর চেয়েও অধিক শক্তিমান কিছু সৃষ্টি করতে? যদি তিনি পারেন, তবে তিনি নিজে আর সর্বশক্তিমানের তালিকায় এক নম্বরে থাকেন না। আর যদি না পারেন, তাহলেও তো তাঁর সর্বশক্তিমান খেতাব আর অক্ষুণ্ণ থাকেনা। অথচ, যিনি সর্বশক্তিমান তাঁকেই তো আমরা ঈশ্বর বলেছি। এইভাবে ঈশ্বরের সর্বোচ্চ শক্তিধরের তকমাকে অস্বীকার করে আমি যখন পৌরাণিক দেবদেবীদের একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন করে দেবতাহীন মর্ত্যভূমির গাছপালা-মাটি-হাওয়া-মেঘ-বিদ্যুৎ-জলকে বোঝার চেষ্টা করছি, তখন আমি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে থার্মোডায়নামিক্সের ক্লাসে, মেশিনশপে, হাই-ভোল্টেজ ল্যাবরেটরিতে, ড্রয়িংবোর্ডে, থিয়োডোলাইটে, ডিফারেন্সিয়াল ইকোয়েশানে। কোনও কিছুকেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা চলবে না, এমনকি নাস্তিকতাকেও নয়, -আমার মনে হয়েছিল। মানুষ কিভাবে স্থিরবুদ্ধিতে নিজেকে আস্তিক অথবা নাস্তিক বলে প্রচার করে, -দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। সমসাময়িক গল্পে কবিতায় আমি লক্ষ্য করেছিলাম সাহিত্য হারিয়েছে তার গভীরতা; যে অন্বেষণ, এনকোয়ারী, খোঁজ, রচনাকে করতে পারে মূল্যবান ও কালজয়ী, তা ক্রমশঃ পথ ছেড়ে দিয়েছে সহজকে, চটুল ও প্রগলভকে। প্রত্যেক যুগের একটা সময়োপোযোগী দৃষ্টিকোণ জরুরী হয়। তাই প্রত্যেক বড় লেখকের দায়িত্ব তার নিজের সময়ের জানালায় দাঁড়িয়ে চিরকালীন প্রশ্নের স্বরূপকে নতুনভাবে সজ্জিত করে তোলা, আর শ্রদ্ধা করতে শেখা যা নীরব ও নিয়ত, সেই অনুচ্চারিতকেও।
উপনিষদের অন্তর্মুখী অন্বেষণ ও মনোজগতে আমাদের অস্তিত্বের সকল দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের সীমানার বাইরে আমাকে বেশী করে ভাবিয়ে ছিল বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিরহস্য। অ্যামিবা থেকে শুরু করে, উদ্ভিদ মাছ সরীসৃপ পাখি কচ্ছপ ডায়নোসর, এবং মেরুদণ্ডী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীরূপে শিম্পাঞ্জী বাঁদর হয়ে, ক্রমে সভ্য মানুষের আত্মপ্রকাশের যে ইতিবৃত্ত চার্লস ডারউইন গবেষণা করে লিখে গিয়েছেন, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে প্রাণীজগতের বিবর্তনের সেই মর্মোদ্ধার, যার মূলে আছে ‘স্বাভাবিক নির্বাচন’-তত্ত্ব, তা আমার মনের অনেক প্রশ্নকেই অমীমাংসিত রেখেছিল। এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবদেহে বিবর্তনের হাজার হাজার বছরব্যাপী ধাপে ধাপে কীভাবে জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোষ জিন ক্রমোসোম, তা এখনও অনেকটাই অজানা রয়ে গিয়েছে।
মূলতঃ নাস্তিকরা বিশ্বাস করেন ডারউইনের ঐ ‘স্বাভাবিক নির্বাচন’ তত্ত্বে, আর আস্তিকরা বলেন বিবর্তন সম্ভব হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে অথবা তাঁর নির্দেশিত পথে, অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক’ নির্বাচন-এর বদলে ‘মনোনীত’ নির্বাচনে। দুপক্ষেরই হাতে আছে বিস্তর যুক্তি। পৃথিবীর পোড় খাওয়া বিজ্ঞানীরা, যাঁরা আস্তিক বা নাস্তিকের কোনটাই নন, যাঁরা খোলা মনে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিতে পছন্দ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। মৃত্যুর কিছুকাল আগেও তাঁর মনে হয়েছিল— ‘এই বিশ্ব কোনও ঈশ্বরের সৃস্টি নয়, আমরা কোনও ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি না’।
এই প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আমাদের এই প্রাণী জগতের সৃষ্টিকর্তা সম্ভবতঃ অনেক আলোকবর্ষ দূরে আরও বহুগুণ উন্নত কোনও সুদূর মহাকাশবাসী শক্তি, যারা আমাদের ক্ষয়বৃদ্ধি জন্মমৃত্যু রাশিচক্র নিয়ন্ত্রণ করে, ঈথার তরঙ্গে, কস্মিক দ্যুতিতে, তড়িৎ-চুম্বকে, সাইমালটেনিয়াস ইকোয়েশানে, সুপারফাস্ট কম্পিউটিং-এ। হয়তো তাদের ইন্দ্রিয়ের সম্ভার আমাদের চাইতেও বিপুল, আমাদের চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আরো উপযোগী আরেকটা সেট। -তাদের খোঁজেই তো বিজ্ঞানীদের বিশ্বব্যাপী সাজিয়ে রাখা রেডিও টেলিস্কোপগুলো হাজার লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের মহাকাশে নজর রেখে চলেছে, আর উপগ্রহগুলো থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অবিরাম সঙ্কেত। সেই প্রোগ্রামের নাম ‘সেটি’ ( SETI : Search for extra-terrestrial intelligence )।
*
এই পৃথিবী আর ব্রহ্মান্ডের স্বরূপ নিয়ে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে, পুরাণে, উপনিষদে, রামায়ণ ও মহাভারতে আছে অনেক কাহিনী, যার কিছুটা দার্শনিকের আন্দাজ, কিছুটা ধর্মীয় বিশ্বাস, আর বাকিটা রোম্যান্টিকের কল্পনা। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার কালেও ছিল এমনই অনেক কল্পনা, যা কয়েক হাজার বছরের তর্কাতর্কি বিচার অত্যাচার হত্যা ও বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে নানাভাবে আমূল পরিবর্তিত ও পরিশীলিত হয়ে আজ আমাদের কাছে গ্রহণীয় হয়েছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষ বিশ্বাস করতেন পৃথিবী একটা চ্যাপ্টা চৌকো থালার মতো, যার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী, যার চার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে চারজন ডানাওয়ালা পরী অথবা দেবদূত। আর এই থালাটির মাথার ওপরে রয়েছে একটা বিশাল অর্ধগোলাকার ঢাকনা, যা তীব্র গতিতে ঘুরছে; ওই ঢাকনাতেই থাকে সমস্ত নক্ষত্ররা। সমগ্র পৃথিবীকে গোলাকার ভাবার অসুবিধে ছিল এই যে— ১, দৃশ্যতঃ যা চৌকো থালা, তাকে চারদিকে বাঁকিয়ে দিলেও সে কখনো গোলক হতে পারবে না। ২, মিশরদেশে এত যে দীর্ঘ নীলনদ, যা একদম সমতল পথে বয়ে গিয়ে শেষে ভূমধ্যসাগরে মিশেছে, কোথাও তো প্রপাত হয়ে নীচে নামেনি, পৃথিবী থালার মতো বলেই তো সেটা সম্ভব হয়েছে। ৩, পৃথিবী গোলাকার হলে, আমাদের উল্টোদিকের মানুষগুলো কি তবে সারাক্ষণ মাটি থেকে উলটো হয়ে ঝুলে আছে নাকি? -পৃথিবী তাই চ্যাপ্টা ও চৌকোই।
গ্রেকো-রোমান সভ্যতার সময়কালেই কিছু মানুষ ক্রমে বুঝতে পেরেছিল যে পৃথিবীটা চ্যাপ্টা নয়, বরং গোলাকার। তবে সবাই মানেনি। চ্যাপ্টা-পৃথিবীর সপক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে, ১৮৮৭ সালেও, নিউইয়র্ক শহরে তিনদিন তিনরাত ধরে তর্কাতর্কি সালিশি সভার পরে নাগরিক মঞ্চের রায়ে হেরে গেছিলেন বিপক্ষের গোল-পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। আজও বিশ্বের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবী চ্যাপ্টা। এঁদের সংগঠনের নাম ‘ফ্ল্যাট আর্থার্স’। সদস্য সংখ্যা কয়েক কোটি। ব্রাজিল, আমেরিকা, ইউরোপেও। ব্রাজিলেই নাকি আছেন ১১-মিলিয়ন। এঁদের মধ্যে আছেন সাও পাওলোর রেস্তঁরা মালিক, জুয়ারী, ব্যান্ডমাস্টার, ছুতোর, রাজমিস্ত্রি, চৌকিদার, অবসরপ্রাপ্ত আমলা। এঁরা গোল-পৃথিবীর মতবাদীদের মনে করেন অশিক্ষিত, ধাপ্পাবাজ। বলেন, পৃথিবীর কিছু মাতব্বর লোক অপবিজ্ঞানে ভর ক’রে মানবসভ্যতাকে ধোঁকা দিয়ে চলেছে। আর গোল-পৃথিবীর মনোবিজ্ঞানীদের মতে ওঁরা হয়তো এক ধরণের মানসিক রোগী, যাহোক একটা পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে চান।
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে ইটালি দেশের বিখ্যাত আঙ্কিক ও দার্শনিক ছিলেন পিথাগোরাস। কয়েকশো বছর ধরে তাঁকে নিয়ে অনেক আলোচনা। অনেক তাঁর ভক্ত শিষ্য। এমনই একজন আঙ্কিক ছিলেন ফিলোলয়াস (৪৭০-৩৯০ খ্রিস্টপূর্ব), যাঁর মতে ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে রয়েছে বিশাল দাউদাউ আগুন, যাকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার কক্ষপথে সমান গতিতে ঘুরে চলেছে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্ররা। হ্যাঁ, সূর্যও সেই বিশাল অগ্নিপিন্ডকে প্রদক্ষিণ করছে।
পিথাগোরাসের পরম্পরাতেই ছিলেন সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো। কিন্তু তাঁরা তখনও পৌরাণিক গল্পেই আস্থা রাখতেন। বিশ্বাস করতেন পৃথিবীই রয়েছে ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে। প্লেটো মনে করতেন ব্রহ্মান্ডের মতিগতি যথেষ্ট খামখেয়ালি, তাকে কোনও নিয়মের সুত্রেই নির্ধারণ করা যাবে না। -এইসব বিশ্বাসে ভর ক’রে মানুষের কেটে গেছে প্রায় দুহাজার বছর।
পরে এর বিরোধিতা করে, গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টার্কাস (৩১০-২৩০ খ্রিস্টপূর্ব) এক নতুন তত্ত্ব খাড়া করে বললেন যে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে—পৃথিবী নয়—রয়েছে সূর্য, এবং তারই চারপাশে ঘুরছে পৃথিবী, চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্ররা। নতুন তত্ত্ব, কিন্তু অনেক কিছুই তিনি ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। এর প্রায় ৪০০ বছর পরে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এসে ক্লডিয়াস টলেমি (Ptolemy, 100-170 CE) যে মডেল পেশ করেন তারও কেন্দ্রে আছে পৃথিবী, যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সূর্য গ্রহ তারা। এবং পৃথিবী স্থির হয়ে আছে কেন্দ্রে। ঘুরছে না। কারণ, ঘুরলেই তো প্রচন্ড ঝড় উঠবে চারিদিকে, টলেমি বললেন।
এরপর আরও বহুকাল কেটে গেছে। প্রায় চোদ্দোশো বছর পরে আসরে নামলেন বিখ্যাত পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543)। তিনি বললেন, সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন্দ্রে। তাকে নানা বৃত্তাকার কক্ষপথে সমান গতিতে প্রদক্ষিণ করছে চাঁদ, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ তারারা। -জিওসেন্ট্রিক অর্থাৎ, পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেলকে সরিয়ে এইভাবে এসে গেল হেলিওসেন্ট্রিক অর্থাৎ, সূর্যকেন্দ্রিক মডেল। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেন ধর্মযাজকরা। কোপার্নিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক মডেলকে সমর্থন ও চার্চের বিরোধিতা করায় সাত বছর কারাবন্দী করা হোল ইতালীয় বিজ্ঞানী, কবি ও দার্শনিক জিয়োর্দানো ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)। পরে একদিন তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হোল। মারলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মান্ধ মানুষজন। ব্রুনো বলেছিলেন– ব্রহ্মান্ড অসীম এবং সেখানে আছে আমাদের সৌরমন্ডলের মতোই আরও অনেক নক্ষত্রমন্ডল।
কোপার্নিকাসের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভুত হন জার্মান দেশের এক বিরাট মাপের বিজ্ঞানী, আঙ্কিক ও জ্যোতির্বিদ। হ্যাঁ, আবির্ভাবই বলা যায়। তাঁর নাম জোহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)। তিনিই প্রথম জানালেন যে, গ্রহদের কক্ষপথগুলো—কোপার্নিকাস যাকে বৃত্তাকার মনে করেছিলেন—আসলে সবই উপবৃত্তাকার, যার দুপ্রান্তের দুটো কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে অবস্থান করে সেই নক্ষত্র, যাকে সে প্রদক্ষিণ করছে। এবং ঘুরতে ঘুরতে যখনই গ্রহটি সেই নক্ষত্রের (বা সূর্যের) কাছে আসে, ততই তার গতিবেগ বেড়ে যায়, আবার দূরে চলে গেলে কমেও যায়।
নীচের ছবিতে লক্ষ্য রাখা যাক। এই হোল উপবৃত্তাকার কক্ষপথ, যা কোপার্নিকাস-বর্ণিত বৃত্তাকার নয়। এই উপবৃত্তের দুই প্রান্তের দুই কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে রয়েছে আমাদের সৌরমন্ডলের নক্ষত্র- সূর্য। তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবী। সূর্যথেকে কখনও সে অনেক দূরের প্রান্তে চলে যায় (সেই অবস্থানকে বলা হয় apogee) এবং পরে সে আবার খুব কাছে চলে আসে (যাকে বলে perigee), তখন তার গতি বেড়ে যায় অনেক। এভাবেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আরেকটা ছোট উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে চলেছে চাঁদও।
তিনিই প্রথম গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান, চলাচল ও গতি সম্পর্কিত সঠিক আঙ্কিক সুত্রগুলো আবিস্কার করলেন, যে তিনটে সুত্র ধরে আজও এগিয়ে চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান। কেপলার বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর একজন বড় আঙ্কিক, এবং ঠান্ডা মাথায় যুক্তিবুদ্ধি দিয়েই নাকি সেটা বোঝা সম্ভব। যুগে যুগে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল চালচলন ও কর্মকান্ডের অন্তরালে এইমতো নিখুঁত অঙ্কের উপস্থিতিই বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করে এসেছে; সপ্তদশ শতকের কেপলার থেকে শুরু করে, বিংশ শতাব্দীর স্টিফেন হকিং পেরিয়ে, অদ্যাবধি।
কেপলারের সমসাময়িক ছিলেন আর এক মহান আঙ্কিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যাঁর নাম গ্যালেলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২)। ইটালিদেশের পিসা শহরে তাঁর জন্ম। কেপলার এবং গ্যালেলিওই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রকৃত নায়ক। হল্যান্ডের চশমার দোকানদারদের কাছে কাজ শিখে, ১৬০৯ সালে গ্যালেলিও বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের জন্য একটা টেলিস্কোপ। অনেকেই ভাবলেন—বাঃ, এটা দিয়ে তো দূর সমুদ্রের জাহাজগুলোকেও বেশ চেনা টেনা যায়। কয়েকজন পয়সাওয়ালা বণিক তাকে বরাত দিলেন টেলিস্কোপ বানানোর। গ্যালিলিওর কাজ জুটে গেল। তবে নিজের টেলিস্কোপ দিয়ে বন্দরে দাঁড়িয়ে জাহাজ দেখা নয়, গ্যালিলিও চোখ রাখলেন মহাকাশে। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন মঙ্গলগ্রহ আর শুক্রগ্রহের চালচলন, উজ্জ্বলতা, গতি; আবিস্কার করলেন বৃহস্পতি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে তার অনেকগুলো উপগ্রহ।
সেই শুরু হোল বিজ্ঞানের হাত ধরে মহাকাশের গভীরে মানুষের পর্যবেক্ষণ। কেপলারই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি গ্রহনক্ষত্রের চলাচল, গতি ও কক্ষপথের সঠিক অঙ্কসূত্রগুলো আবিস্কার করেছিলেন। আর গ্যালিলিওকে বলা যায় অবজার্ভেশানাল অ্যাস্ট্রোনমির জনক। তবে অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকেও। অনেকগুলো বছর থাকতে হয়েছে গৃহবন্দী হয়ে। কারণ ক্যাথলিক চার্চের গোঁড়া ধর্মযাজকরা প্রতিপদে তাঁর আবিস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাঁকে বিধর্মী ঘোষণা করেছে।
গ্যালিলিও যেবছর মারা যান, তার ঠিক এক বছর পরেই জন্ম নেন বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক আইজাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭)। নব্য বিজ্ঞানের সে এক স্বর্ণযুগের সূচনা। নিউটন আবিস্কার করলেন মাধ্যাকর্ষণ বল, যা বিশ্বব্যাপী সকল বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া করছে, আর অঙ্ক কষে বের করলেন গতিজ্যামিতির প্রধান সুত্রগুলো। কেপলার ও নিউটনের আবিস্কৃত সূত্রগুলো আর গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ—এই নিয়েই শুরু হয়ে গেল পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিক যুগ। বিশ্বজগত ও পৃথিবী নিয়ে মানুষের কয়েক হাজার বছরের সম্পূর্ণ ধারণাটাই পালটে গেল। ভাবলে অবাক লাগে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে পৃথিবী বসে নেই এবং সে পিৎজার মতো চ্যাপ্টাও নয়—এইটা নিশ্চিত করতেই মানুষের কেটে গেছে কত হাজার বছর! কতসব ভয়ংকর অত্যাচার, কারাগার, গৃহদাহ, রক্তপাত, হত্যা। মৌলবাদ বনাম মুক্তচিন্তা।
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর মাথার ওপরে বিশাল আকাশ জুড়ে লক্ষ কোটি নক্ষত্রের সমাহার। পারস্য গালিচার মতো। চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো। কত সূর্য, গ্রহ, নীহারিকা, নেবুলা, ধুমকেতু, সুপারনোভা, প্লাজমাস্রোত, বিকিরণ-বলয়, কৃষ্ণগহ্বর। কিভাবে সৃষ্টি হোল এই বিপুল ব্রহ্মান্ড? সৃষ্টি হোল ক্ষেত্র ও সময়? সৃষ্টি হোল তরঙ্গসাগর? তাপ, বিদ্যুৎশক্তি, ক্ষণজীবী কণিকারা? পদার্থ, ভর, অভিকর্ষ! জল, আলো, চৈতন্য, প্রাণ!
[ ক্রমশঃ ]
Posted in: June 2020 - Serial, PROSE