পরিযায়ী: রাষ্ট্রের দায় স্খালনের অভিসন্ধি – শিল্পী ঘোষ

পরিযায়ী শব্দটা প্রথম শুনি স্কুলবেলায়। কলকাতায় চিড়িয়াখানা দেখতে যাবার কথা হলেই বড়োরা বলতো শীতকালে যেতে হবে কারণ তখন প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে চিড়িয়াখানায়। কোথা থেকে আসে, না শীতের দেশ থেকে। কেন আসে, না প্রাণ রক্ষার তাগিদে। শীতকালিন ভ্রমণের ক্ষেত্রেই এযাবৎ এই শব্দবন্ধটির ব্যবহার সীমিত ছিলো বলে এতকাল জেনে এসেছি। এখন করোনাকালে হঠাৎ সেই শব্দবন্ধটি জুড়ে দেওয়া হোলো খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর নামের আগে, যেন হঠাৎ এঁরাও উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন ডানা মেলে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে।

এই পরিযায়ী শ্রমিকরা কারা? না, ঠিক আমার আপনার মতো তথাকথিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে হয়তো নন, তবে আমাদেরই পাড়ার বা এলাকার বা অঞ্চলের বা জেলার বা রাজ্যের। ইচ্ছে করে বা বিলাসিতার জন্য তারা ভিন রাজ্যে গেছেন এমন নয়। স্থানীয় ভাবে কর্মসংস্থান হয়নি বলে জীবন রক্ষার তাগিদে তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে অন্যত্র, কিন্তু একই সংবিধানের আওতাভুক্ত ভুখন্ডের মধ্যে। আমরা মনে রাখিনি এঁরা লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্বাচন করেছেন, অর্থাৎ দেশের সীমারেখার মধ্যে যে কোনো প্রদেশে স্থায়ী/অস্থায়ী ভাবে বসবাস করার অধিকার এঁদের আছেই। তাহলে কেন এই পরিযায়ী শব্দটি ব্যবহার করা হবে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক হলেও অনেকেই তা করছিনা।

আমাদের পরিবার বা বন্ধুবর্গের কেউ যদি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি করেন এবং সরকারি নির্দেশে ভিন্ রাজ্যে বদলি হন সেক্ষেত্রে কি তাদের আমরা পরিযায়ী চাকুরে বলি? নিশ্চিত ভাবেই বলিনা। সীমান্তে যে সৈন্যেরা নিরলস কর্তব্য পালন করে চলেছেন তাঁরাও কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসেন। লাদাখে চীনা সৈন্যদের হাতে যাঁদের প্রাণ গিয়েছে তাঁরা কেউ অন্ধ্রপ্রদেশের কেউ পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের। এদের ক্ষেত্রেও বলা হয়না পরিযায়ী সৈনিক। তথ্য প্রযুক্তির বিপূল সম্প্রসারণের পর যে লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে পাড়ি দিয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই বিশেষ শব্দটি ব্যবহৃত হয়না। তাহলে এই শ্রমিক মানুষদের নামের আগে এই আপত্তিকর শব্দটি জোড়া হচ্ছে কোন যুক্তিতে?

আর যাই হোক এই বিশ্বজোড়া আতঙ্কের কালে এই শব্দটি মেহনতী মানুষের সম্মান বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়নি একথা নিশ্চই সকলেই জানেন ও আশাকরি মানেন। একেবারে প্রান্তিক এবং অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষগুলির প্রতি রাস্ট্রের দায় ঝেড়ে ফেলবার জন্য এই শব্দটি খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার অবকাশ থাকা উচিৎ নয়। লকডাউন চলাকলীন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে এই শ্রমিকদের অস্বীকার করার চেষ্টা নগ্ন ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাই শ্রমিক এর আগে এই পরিযায়ী শব্দের ব্যবহার। কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেবেন, I L O তেও migrant labour শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পুঁজি নির্ভর এই বিশ্বে শ্রমিকের ভূমিকা কিভাবে খর্ব করা হচ্ছে তা আমরা জানি। কোন মর্যাদায় তাদের দেখা হয় তাও অজানা নয়। খুব সম্প্রতি লক ডাউন চলাকালে আমাদের দেশের সরকার শ্রম আইন পরিবর্তনের নামে আসলে শ্রমিকদের সব রকম অধিকারকেই নস্যাৎ করে দিয়েছে।

আমরা শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষে খুব সহজে এই শব্দটা আয়ত্ত করে নিয়েছি এবং বহুল ব্যবহার করেছি। তার একটা অন্যতম কারণ এই যে এই ভিন্ রাজ্যে রুজির যোগাড়ে যাওয়া মানুষদের পঁচানব্বই শতাংশই নিম্নবর্ণের হিন্দু অথবা মুসলিম। কোনো উচ্চবর্ণীয় হিন্দু নেই বল্লেই চলে। তাই বুঝি এত অশ্রদ্ধা। দেশজুড়ে বর্ণবাদের যে হাওয়া তোলা হচ্ছে আমরাও যেন কোথাও গিয়ে সেই হাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছি। রবিঠাকুর যতই চান দু’বাহু বাড়ায়ে “শক-হুন-দল পাঠান-মোগল ” একদেহে লীন হোক, আমরা তা এখনও চাই না। আমরা ভাসিয়ে দেওয়া কথায় ভেসে থাকি। আর আমাদের এই ভেসে থাকার অন্তরালে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি রাষ্ট্রের বঞ্চনার অভিধান লেখা হতে থাকে নিঃশব্দে। কর্মচ্যূত শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস শুধু জমা হতে থাকে ইতিহাসের পাতায়।

[লেখিকা – শ্রমজীবী হাসপাতালের কর্মী; সঙ্গীতশিল্পী এবং সমাজ কর্মী।]

Facebook Comments

Leave a Reply