আয়না ভাঙা অক্ষর – নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি : শতাব্দী দাশ
আয়না ভাঙা অক্ষর: নারী কলমে বিগত সত্তর বছরের যুদ্ধ-কাহিনি
গল্প নির্বাচন, সম্পাদনা ও প্রাক-কথন: অদ্বয় চৌধুরী
গল্পের নাম: বন্দুকপাণি
গল্পকার: হারেগু কেলেতা
রাষ্ট্র: এরিট্রিয়া
মূল ভাষা: তিগরিনিয়া
অনুবাদের সোর্স ভাষা: ইংরেজি
বাংলায় অনুবাদক: শতাব্দী দাশ
তৃতীয় কিস্তি
[ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে এরিট্রিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে হারেগু কেলেতা ছিলেন ‘এরিট্রিয়ান পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর একজন সশস্ত্র যোদ্ধা।পরবর্তী কালে সতেরো বছর ধরে এরিট্রিয়াতে সাংবাদিকতার কাজ করে বর্তমানে ‘এরিট্রিয়ান আমেরিকান কালচারাল ইন্সটিটিউট’-এর পাবলিক রিলেশন সেকশনের সর্বোচ্চ পদে আসীন রয়েছেন হারেগু। তাঁর লেখা গল্প বিভিন্ন সংবাদপত্রে, পত্রপত্রিকায় এবং সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধের দাগ লেগে থাকাজীবনের রূঢ় বাস্তবধর্মী গল্প উঠে আসে হারেগুর লেখায়। তাঁর লেখা এতটাই বাস্তবধর্মী যে তাঁর অতীত জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই কল্প-কাহিনিকে আত্মজৈবনিক বলে ভ্রম হয়।
‘দ্য গার্ল হু ক্যারিড আ গান’ গল্পটির মূল ভাষা তিগরিনিয়া। এই সেমিওটিক ভাষাটি এরিট্রিয়ার প্রধান ভাষা। এছাড়াও ইথিওপিয়ার উত্তরাংশের মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। তিগরিনিয়া থেকে ইংরেজিতে গল্পটি অনুবাদ করেছেন চার্লস ক্যান্টালুপো এবং রাহেল আসগেদমজেরে।
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার ছোট্ট দেশ এরিট্রিয়ার সামাজিক ও পারিবারিক ট্যাবু ও প্রথা ভেঙে একজন নারীর বন্দুক ও বিবাহের মধ্যে থেকে বন্দুককে বেছে নেওয়ার গল্প হল ‘বন্দুকপাণি’।এ হল প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চেতনার গল্প, যে চেতনা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার নয়।বাস্তবে ‘এরিট্রিয়ান পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট’ একটি সশস্ত্র মার্ক্সীয় সংগঠন ছিল।ওই ফ্রন্টের একজন সশস্ত্র যোদ্ধার লেখা গল্পটিও মার্ক্সীয় সাম্যবাদী চেতনায় জারিত হয়ে উঠেছে। তবে, আবারও উল্লেখ্য, গল্পটি আত্মজৈবনিক নয়।]
বন্দুকপাণি
যখন ছোট ছিলাম, আমার তুতো ভাই সলোমন, বয়সে খানিক বড়, সে খরগোশের মতো লাফাত। আটের ক্লাসে ফেল মারার পর সে গ্রাম থেকে পশুর চামড়া এনে বিক্রি শুরু করে। নিজের বা গাধার পিঠে চাপিয়ে চামড়া আনত সে। তার সঙ্গে থাকত মোমবাতি। বছর পনের পর সে এক ভুঁড়িওয়ালা, অলস চালের বড়লোক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিল। আমার শুধোতে ইচ্ছে করেছিল, ‘বড়লোক হতে গেলে বুঝি বুড়োতে হয়?’ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা ফতুর হতে লাগলাম, আর সে ফুলেফেঁপে উঠল৷ যেন সে অন্য কোনো জগতের লোক!
সে সর্বদাই কালো চামড়ার জ্যাকেট আর সাদা শার্ট পরত। এখন তার বেশ কিছু বাড়ি, দোকান, গাড়ি। আমহারিক আর টিংরিনিয়া ভাষার সংমিশ্রণে এক খিচুড়ি ভাষায় সে কথা বলত৷ আমি যখন এরিট্রিয়ারপিপলসলিবেরেশন ফ্রন্টের হয়ে ইথিওপিয়ার সঙ্গে লড়ছিলাম, সে তখন আমার দিদির প্রত্যাবর্তনে একটা বড় পার্টি দিয়েছিল। দিদি ছিল সৌদিআরবে, নির্বাসনে।
এখন আমি এসেছি বাড়িতে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটি পেয়ে। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর এই আমার প্রথম ফেরা। আগামীকাল অতএব আমার জন্য পার্টি। কেমন হবে সে পার্টি? আমি ছিলাম যোদ্ধা। মাঠেঘাটেথেকেছি। কেউমাস-মাইনে দেয়নি সে কারণে। শত্রুসৈন্যরা বাঁধা চাকুরে। এরিট্রিয়ার সৈন্যরা তা নয়৷ আমরা লড়েছি এরিট্রিয়ার স্বাধীনতার জন্য৷ সেটাই উপার্জন। ফিরেছি এখন। আমাকে ধন্যবাদ জানাতে কী করবে সে?
জানতাম, সে আমাদের শেষ মোলাকাতের প্রসঙ্গ তুলবে। জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমার সহযোদ্ধাদের কী হল? এফ্রেম বলে ছেলেটা, যে তোমার স্কুলের সহপাঠী ছিল আমি ক্লাস থেকে হড়কে যাওয়ার আগে, তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত হয়?’
আটের ক্লাসে, এফ্রেম বছর দুয়েকের জন্য স্কুল ছেড়েছিল অসুস্থতার কারণে৷ যখন ফিরল, তখন আবার আটের ক্লাসেই ভর্তি হল, কিন্তু ততদিনে আমিও আটের ক্লাসে উঠেছি। পরের তিন বছর আমরা সহপাঠী ছিলাম৷ আমার চেয়ে বয়সে বড় হওয়ায়, সে নিজেকে বিরাট তালেবর ভাবত। আমি বিজ্ঞানে বেশি নম্বর পেতাম, তাই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলাম৷ কিন্তু নয়ের ক্লাসে ওঠার আগেই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। বন্ধুত্ব বয়ঃসন্ধির প্রেমে গড়াল।
সলোমন বুঝতে পেরে বাবা-মাকে জানিয়ে দিল। প্রথমে তারা বিশ্বাস করল না, কারণ আমি ছিলাম বড়ই লাজুক। তারপর একদিন আমি আর এফ্রেম ধরা পড়ে গেলাম৷ বাবা-মার পরিকল্পনা ছিল অন্য, আর তা আঁকড়েই তারা বাঁচছিল। তারা আমার সঙ্গে এক ধনী ব্যবসায়ীর বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এফ্রেমকে সে কথা জানালাম৷ সে অনুনয় করল, ‘বিয়ে কোরো না।’
তারপর সে হাওয়া হয়ে গেল। আমি মুষড়ে পড়লাম৷ সে কথা বাবা-মার অজানা ছিল না৷
পরের জানুয়ারিতে দেশের বাড়ি গেছিলাম এক ভাইপোর বিয়েতে। জানুয়ারি এরিট্রিয়ায় চিরাচরিত বিয়ের মাস৷ সলোমন সঙ্গে গেল৷ আমাকে ঘুমন্ত ভেবে ওদের নিজেদের মধ্যে তর্ক শুরু হল৷
সলোমনকে বলতে শুনলাম, ‘ও যদি পালিয়ে যায়? যদি যুদ্ধে যোগ দেয়? আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো তা-ই করছে!’
‘অসম্ভব। কী আর করতে পারে ও! বাড়ির বাইরে পা রাখতেও ভয় পায়।’ আমাকে এত তুচ্ছজ্ঞান করতে মাকে আর কখনও দেখিনি৷
বিয়ের এলাহি তোড়জোড় আমাকে ভারি হতচকিত করল। এত লোক আগে কখনও দেখিনি। বিশেষত এত যুবক-যুবতী, পরিপাটি পোষাক পরা। এত সবল তারা! পরস্পরকে সাহায্য করছে সবেতেই৷ আমার খুড়িকে সাহায্য করছে এটা ওটা বয়ে দিয়ে,তাঁবু খাটিয়ে দিয়ে,কাঠ কেটে। খুড়ি যেমন চাইছে, তেমনই করে দিচ্ছে তারা। এমন যূথবদ্ধতা আগে দেখিনি কখনও। যেন জীবন বদলে গেল। এই ভাগ-বাঁটোয়ারার যাপন… এই যে হাসি-কান্না-দুঃখ-হরষ-লড়াই, সবই ভাগ করা যায়, তেমন করে আগে ভাবিনি। একসঙ্গে কাজ করতে তারা সদা প্রস্তুত।
তাদের খাকি উর্দি আর মিলানো দেখেই বুঝতে পারছিলাম, তারা সৈনিক। সেই যে খাটো-হাতার সেইসব শার্ট, যা ইতালিতে তৈরি হয়, যা ইতালির মজুররাও পরে! কয়েকটি মিষ্টি মেয়েও ছিল সৈন্যদের সঙ্গে৷ আমি তুতো ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েগুলো ওদের সঙ্গে কী করছে?’সে হেসেবলল,’আলগু, ভয় পাচ্ছ? ভাবছ ছেলেগুলো মেয়েদের ধর্ষণ করবে? ওরা জানে, ওরকম করলে ওরা মারা পড়বে। ওরা আইনকে ভয় পায়, আইন ভাঙার চেয়ে হিজড়ে হয়ে থাকাই ওদের পক্ষে শ্রেয়।’
লজ্জা পেয়ে আমি ওদের নাচ দেখতে লাগলাম। নাচের সময়েও তারা বন্দুক নামায়নি কাঁধ থেকে, কার্তুজওয়ালাকোমরবন্ধনীওখোলেনি। যে গান গাইছিল তারা, তাতে ছিল এমন এক মেয়ের কথা,যার কোলে শিশুর বদলে ছিল বন্দুক।
তার কোলে বন্দুক
আজ কি বা প্রয়োজন?
রক্ত স্নানের পরে
বাদামী শরীরে
সে এনেছে বিজয়।
তার কোলে বন্দুক
যেন সিংহী-শাবক
ভালোবাসায় বাড়ে।
সৈন্যদের মধ্যে যে নেতাগোছের, ওয়েদিশেকিয়া, সে আমার দিকে এগিয়ে এল। এতটাই বিনয়ী, এতটাই শান্ত ভাবে সে কথা বলল, যে সব কথার মানেও বুঝলাম না। কিন্তু ভালো লাগল। তার দাড়িটাও বেশ, ওর বড় বড় কোঁকড়া চুলের সঙ্গে সুসমঞ্জস। সেই অবিন্যস্ত চুলসদর্পে ঘোষণা করে, ‘আমি সৈনিক।’
‘আমরা সবাই এরিট্রিয়ারগর্ভজাত’, প্রথমে কিছুটা বাধো-বাধো স্বরে সে বলছিল, কিন্তু ক্রমশ গলায় প্রত্যয় ফিরছিল তার। ‘মানে, আমরা সবাই, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-জোয়ান, মুখ্যু-শিক্ষিত, শহুরে-গেঁয়ো নির্বিশেষে সবাই। সবারই উচিত ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়েঝাঁপিয়ে পড়া।’
তার সব কথার মানে বোঝা যাচ্ছিল না, তবু জিজ্ঞেস করলাম- ‘আপনাদের সঙ্গে মেয়েগুলো…কারা ওরা? কী করে ওরা?’
‘ওরাও আমাদের মতো যুদ্ধ করে।’
‘ওরাও? ওরা পারে? ছেলেরা আর মেয়েরা একসঙ্গে লড়ে? মাঠে ময়দানে? অসুবিধে হয় না?’
সে হাসল। ‘আমার আইন-কানুন আছে। সেসব মেনে চলি। আমরা মেয়েদের অসুবিধে ঘটাই না।’
ঠোঁটের ডগায় আরও জ্বলন্ত প্রশ্ন এসে গেছিল আমার। ‘শহর থেকে এফ্রেম নামের কোনো ছেলে আপনাদের দলে যোগ দিয়েছিল?’
‘কেন জিজ্ঞেস করছ?’
‘আমরা স্কুলে সহপাঠী ছিলাম।’
সে একটা নোটবুক বের করে আবার নামটা জিজ্ঞেস করল। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে পাতা উলটালো। একটা পাতায় এসে থমকালো। বলে, ‘আমাদের সাংগঠনিক সেলের এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত সদস্য উনি। এখন জেলে।’
আমি আর শুনতে চাইনি।
বাড়ি ফেরার পথে, সলোমনকে বলেছিলাম, আমার বিয়ে-বাড়িতে বড় ভালো লেগেছে। শুনে মা তো ডগোমগো। এফ্রেমকে জেলে গিয়ে খোঁজার আসল পরিকল্পনা আমি গোপনই রাখলাম। শহরে ফিরে আমি আর সলোমন এক বিকেলে সেল্যাসিঅ্যাভিনিউ ধরে হাঁটছিলাম। ইথিওপিয়ানরা সদ্য নতুন নাম রেখেছে ন্যাশনাল অ্যাভিনিউ, কিন্তু আমাদের যোদ্ধাদের আক্রমণের ভয়ে বাস চলাচল আর শুরু হয়নি। সলোমন চুপচাপহাঁটছিল। তাই আমিই প্রশ্ন করলাম, ‘কী ভাবছ?’
‘তোমার বিয়ের কথা।’ সে ধীরে বলল। ‘ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে তোমার বাগদান স্থির হয়ে গেছে।’
মনে মনে ভেঙে পড়লাম, কিন্তু প্রকাশ করার বদলে বললাম আমার পেচ্ছাপ পেয়েছে। একটা ক্যাফেতে ঢুকে পড়লাম।
তারপর থেকে প্রতি মুহূর্তে সেই স্বাধীনতার যোদ্ধাদের কথাই মনে আসত ঘুরে ফিরে। আমি তাদের খুঁজে নিলাম নাকি তারা আমাকে, এ নিশ্চিত করে আজ বলা কঠিন। উভয়েরই বোধহয় একে অপরকে প্রয়োজন ছিল। ওয়েদিশেকার মুখটা বারবার চোখে ভাসত আমার। সেই যে সেআরও বেশি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিল—সবাই, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-জোয়ান, মুখ্যু-শিক্ষিত, শহুরে-গেঁয়ো নির্বিশেষে সবারই উচিত দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া…
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, আমার সঙ্গে অন্য অনেক যোদ্ধার আলাপ হল। কমবেশি একই কথা বলত তারা। তাদের আত্মবিশ্বাস আমাকেমুগ্ধ করত। এরিট্রিয়ার মানুষদের নিপীড়নের গল্প যখন তারা আন্তরিকভাবে বলত, তখন বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগত, কোনো কাথাবার্তাতেই যোদ্ধাদের পরিবারের উল্লেখ থাকত না৷ পারিবারের প্রতি কি তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই? কীভাবে এই বৈরাগ্য সম্ভব হল? তাদের কি কোনো অনুভূতি নেই? কিন্তু আবার তারা যখন নারীদের উপর নির্যাতনের কথা বলত, আর আমার মনে পড়ে যেত কীভাবে আমার পরিবার আমার উপর নির্যাতন করে, তখন মনে হত, হয়তো ঠিকই বলছে তারা।
তারা কখনও তাদের পরিকল্পনা খোলসা করত না। যেমন একদিন এক যোদ্ধা আমার সমবয়সী তিন মেয়েকে হাজির করল একেবারে আমাদের পারিবারিক বাড়িতে৷ যোদ্ধাদের একটা রীতি ছিল। মাঠে-ঘাটে পাঠানোর আগে, ঝোপে-ঝাড়ে রাত কাটাতে পাঠানোর আগে, নব-নিযুক্তদের এক রাতের জন্য তুলনামূলক নাগরিক আয়েশে রাখা হত। সে রীতির কথা আমার অজানা ছিল না। আমাকে বলা হল—’ওদের এক রাত তোমার বাড়িতে রাখো। ওরা যুদ্ধে যাবে।’ আমি মনে মনেভাবলাম—’কিন্তু আমার বাড়িতেই বাকেন? তোমার সঙ্গে কেন শুতে পারবে না তারা?’
ভাগ্য ভালো, মা সে-সময় বাড়ি ছিল না। সে রাতে আমরা কেউই ঘুমোইনি৷ যখন তারা প্লাস্টিক জুতো, বিছানা, স্যানিটারিন্যাপকিন, ব্রা, প্যান্টি গোছাচ্ছিল, তখন বিয়ের কনের বান্ধবীদের মতোখিলখিলিয়ে হাসছিল তারা। আমিও হাসছিলাম। তার আগে পর্যন্ত বুঝিনি, তরুণ এরিট্রিয়ানরা বাড়ি-পালিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দিতে চাইলে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে নিতে হয় তাদেরই।
তারপর তারা যখন চুল কাটতে বসল, আমার ঈর্ষা হল। ‘আমিও চাই…’, আমি বলে উঠলাম। তারা মুহূর্তেই বুঝল আমার কথার মানে।
প্রথমে তারা বিস্ময়ের ভান করল এবং আমাকে অনুনয় করল, যেন শহরেই থাকি। কিন্তু যখন তারা দেখল, আমিও যুদ্ধে যেতে ততটাই উদগ্রীব, যতটা তারা, তখন তারা থেমে গেল।
‘কী লজ্জা!এ চুলে তুমি বেণীবাঁধতে পারতে বরের জন্য,’ সুর করে একজন ছদ্ম-অভিযোগ করল।
‘আর তার বদলে, দেখ, এ মেয়ে মাঠে ঘাটে যুদ্ধে যাবে বলে চুল ছেঁটে ফেলল!’
আমার কোলে ঝরে পড়তে লাগল চোখের জল আর চুলের গোছা। সে আরও বলল, ‘কেঁদো না, ভয় পেয়ো না। চুল তোমার কন্যে৷মাটিতে দেব পুঁতে।মাটি-চাপা দিলে চুল, সৌভাগ্য আসে।’ এফ্রেম বলেছিল, আমার চুলের আবেদনেই সে মোহিত হয়েছিল। দেখলাম, এখন আমাকে অবিকল আমারই ভাইয়ের মতো দেখতে হয়েছে।
পরদিন যখন সেই যোদ্ধা আমাদের নিতে এসেছে, ঠিক তখনই মা ফিরল। আমি ভাঙা দরজার ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলাম। মাকে মাথা আবৃত করতে দেখেছিলাম। যেন কোনো প্রিয়জন মারা গেল৷ জানতাম, মা বুঝেছে আমি চলে যাচ্ছি।
যোদ্ধারা আমাদের ঘিরে ছিল৷ প্রতিবেশী মেয়েরাও কেঁদেকেটে অনুরোধ করছিল তাদের, যেন তারা আমাদের নিয়ে না যায়। মা গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। বাগদানের দিনের জন্য কেনা গহনাগাটি আঁকড়ে ধরে আছাড়ি-পিছাড়ি খেল মাটিতে। দৌড়ে গিয়ে মাকে তুলে ধরতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ছোট চুল নিয়ে যেতে সাহস পেলাম না।
আমার পরিবার নাকি আমার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সলোমনকেই দায়ী করেছিল। পনেরো বছর পরে সলোমন বলেছিল, ও কথা সে আর মনে করতে চায় না।
পার্টিতে সলোমন অন্যান্য তুতোভাইবোনদের সঙ্গে কথা বলছিল৷ বলছিল, ‘আমি আলগানেশেরমতো, কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, লড়াইয়ে যেতে চাইনি৷ যদিও শুনেছিলাম, অনেকেই যাচ্ছিল।’
যেন সে না যেতে পেরে খুশি, এমন কী গর্বিতও৷ চোখ তুলে সে আমায় দেখতে পেল৷
‘আলগু, তুমি কার সঙ্গে ফিরলে?’
‘একদল অন্য সৈন্যর সঙ্গে৷ তারাও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছে।’
‘ইয়ে, আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, তুমি কি বিবাহিত?’
‘না, বিবাহিত নই।’
‘তাহলে তোমার সঙ্গের ওই সৈন্যরা কারা?’
ওর প্রশ্নের ধরন ভালো ঠেকছিল না৷ আমার গলার স্বরে তা ও বুঝতেও পারছিল, কিন্তু বুঝতে যে পারছিল তা ওর মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছিল না৷ উপরন্তু, সে জানত, আমি জানি তার প্রশ্ন করার আসল কারণ৷
মা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘এসব নাহয় ও পরে বলবে, এখন নয়।’
বাড়িতে লোক সমাগম হতে লাগল৷ বেঁচেবর্তে থাকার জন্য তারা অভিনন্দন জানাল আমাকে৷ সলোমন যা জিজ্ঞেস করছিল, সে কথা তারাওজিজ্ঞেস করল। তারা সেকথাজিজ্ঞেস করল মাকেও, আর তিনি একই উত্তর দিতে থাকলেন। ‘ওসব নাহয় ও পরে বলবে’খন।’কখনও আবার যোগ করলেন, ‘হ্যাঁ, ও বিয়ে করেছে বৈকী। আপাতত সেসব কথা লুকিয়ে রাখছে।’
আর আমি ভেবেছিলাম, অজস্র সঙ্গীদের কবর দেওয়ার পর, আমার বেঁচে থাকাটাই যথেষ্ট আনন্দের হবে সবার কাছে।
বাড়ি ছাড়ার পর,প্রথমদিকে নিজেকে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছি, ‘মাকে ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে এসেছি কি এই প্যাচপ্যাচেমিলিটারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য?’
সেই প্রথম দেখা যোদ্ধাদের কথাও মনে পড়ত। দেশপ্রেমের যে বীজ তারা আমার মনে বুনেছিল, সেসব এই খাটুনির জীবনের চেয়ে ঢের মিষ্টি ব্যাপার। পরিবারের স্মৃতিও তখন মধুরই লাগত, যতই বৈরিতা থাকুক।
কিন্তু কয়েক বছরের মিলিটারি ট্রেনিং-এর পর আমার কোমল তনু দৃঢ় হল। পেশী গজালো। রঙ গাঢ় হল। ছুটে পাহাড়ে ওঠা-নামা করতে পারলাম। বালিতে লম্বা লাফাতে শিখলাম। এরিট্রিয়ার লাঞ্ছনা আর তার নারীদের অবমাননা আমাকে শেষমেশ যোদ্ধা বানিয়েই তুলল। বাড়ি থেকে বেরোতেও নাকি ভয় পেত যে বালিকা, সে হারিয়ে গেল।
পরিবারের, আর মায়েরও, স্মৃতি ফিকে হয়ে এল ক্রমে। ক্কচিৎ স্বপ্নে আসত তারা। তাদের কথাবার্তা মনে পড়লে আমার হাসি পেত। মূলত নিজের এই উত্তরণেই হাসি পেত। হাসি পেত এটা আবিষ্কার করে যে, বিয়ের কথা-টথায় আমি আর বিচলিত হচ্ছি না। বিয়ের প্রস্তাব যে আমি সেখানেও পাইনি তা নয়। কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলিনি তাদের। শুধু যখনই বিয়ে অথবা শিশুর কথা শুনতাম, তখন দেশ-গাঁয়ের কোনো বিয়েবাড়িতে শোনা সেই গানটা মনে পড়ে যেত। সেই যে, সেই মেয়ের গান, যার কোলে শিশুর বদলে বন্দুক ছিল!
তার কোলে বন্দুক
আজ কী বা প্রয়োজন?
রক্ত স্নানের পরে
বাদামী শরীরে
সে এনেছে বিজয়।
তার কোলে বন্দুক
যেন সিংহী-শাবক,
ভালোবাসায় বাড়ে।
আমার মনে পড়ত সেসব, আর হেসে ফেলতাম। বন্দুক হাতে ছেলে-মেয়েদের ঘুরে ঘুরে নাচের স্মৃতি ফিরে এলে, মনে হত, আমিও তাদের একজন।
এক সন্ধেয় আমাদের দলনেতা ডেকে পাঠালেন দপ্তরে। সৈন্যদের মধ্যে আবার হয়তো কেউ এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, আমি ভাবলাম।
‘এক যোদ্ধা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়’, অশ্রুতপূর্ব মোলায়েম গলায় দলনেতা বললেন৷
কাঁচাপাকা দাড়ির লোকটা কে? সে বলল, ‘আলগু!’ তার কালো দাঁত দেখা গেল৷খেলার মাঠে আমাকে বাঁচাতে গিয়েই ওই দাঁতটা ভেঙেছিল৷ এফ্রেম!
নিস্তব্ধতা ভেঙে সে-ই প্রথম কথা বলল।
‘ তোমার দলনেতা বললেন, তুমি অসাধারণ যোদ্ধা! দারুণ ছাত্রীও। আর তোমার মতো কার্তুজের ব্যাগ কেউ বানাতে পারে না৷ আর তুমি নাকি দয়ালুও।’
এতক্ষণে মাথায় কথার জোগান এল। ‘জানতেই পারিনি তুমি কোথায় আছ! তোমাকে সবচেয়ে ভালো কার্তুজের থলে বানিয়ে দেব আমি। মৃত শত্রুসৈন্যদের জুতোর চামড়া দিয়ে ওগুলো তৈরি করি।’ তার পিস্তল দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে নিজেও দলনেতা।
কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে সে বলল, ‘মা যা শিখিয়েছে তা ভোলোনি দেখছি?’
‘না। বরং ন্যাকড়া-চোকড়া যা পাই তা থেকেই সঙ্গী সৈন্যদের জন্য জামাকাপড় বানিয়ে বানিয়ে হাত পাকিয়েছি।’
‘আমাদের বিয়ের জন্য যে বিছানা-চাদরটা সেলাই করছিলে, সেটার কথা মনে পড়ে?’
কিন্তু আমার সে’সব অকিঞ্চিৎকর কথা আর ভালো লাগে না। জিজ্ঞেস করলাম—’জেল থেকে কীভাবে ছাড়া পেলে? তুমি ইপিএলএফ-এ যোগ দিতে যাবে, সে কথা আমায় জানিয়ে গেলে না কেন?’
‘আমি চাইনি তোমার সঙ্গে চাক্ষুষ দেখা করার আগে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে। কে জানে, আমাদের কথা সব ভুলে গেছ কী না, কে জানে হয়ত এখন অন্য কেউ…’
‘মানে? এখানে আসার পর আমি বিয়ের কথা কখনও ভাবিইনি।’
‘তোমার কোনো প্রেম নেই এখন?’
‘না।’
‘সত্যি বলো। আমার পরে আর কেউ…’
‘না। শহীদদের দিব্যি। না।’
তাকে খুশি দেখালো। যেন স্বস্তি পেল। তার জেরা করার স্বরটি এবার উবে গেল। সে বলল,’তোমার কথা আমি অনেক শুনেছি। কীভাবে তুমি বাড়ি ছাড়লে। কোথায় কোথায় যুদ্ধে গেছিলে। তোমাকে খুঁজে পেতে আমি অনেক সাধনা করেছি। আমাদের তো এখন নামও বদলে গেছে৷ আমি ওয়েদি-স্মেরা। তুমি সেগেন।’ সে আমার কাঁধ ছুঁল।
‘তোমাকে তো বললামই, এইখানে…ভালোবাসা, বিয়ে…এগুলো ঠিক মাথায় আসে না আমার।’
‘কে এভাবে মগজধোলাই করল তোমার? প্রেম কেন লড়াইয়ের পথে অন্তরায় হবে?’
‘সমস্যাগুলো তো চাক্ষুষ দেখতে পাই। দু নৌকায় পা দেওয়া মানুষেরা কেমন ছিঁড়ে-খুঁড়ে যায়! হয়তো ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বছরে একবার দেখা হয়। এভাবে কি আর…’
‘আমরা তো অন্যরকমও হতে পারি। আমরা স্বাধীন হতে পারি। আমরা হয়তো একসঙ্গে থাকলাম, হয়তো আমাদের সন্তানাদি হল…’
‘ওরকম হয় নাকি! মজা করছ?’
‘এখানে তোমার মতো যোদ্ধা নারীরা সন্তানের জন্ম দেয় না বলছ?’
‘দেয় বৈকী। তারপর তারা হয়তো ডিভিশন সতেরয় লড়তে চলে যায় বাচ্চাকে ফেলে। এমন কোনো মেয়ে দেখলাম না, যার এই নিয়ে অনুশোচনা নেই।’
‘যুদ্ধ তোমাকে অনেক বদলে দিয়েছে আলগু। তুমি বড় কঠিন হয়ে গেছ।’
ফেরার সময় আমরা চিরুনি অদল-বদল করেছিলাম। আমারটাবেশি সুন্দর ছিল, আমার নাম খোদাই করা, কিন্তু আমি চাইছিলাম সেটা এফ্রেমের সঙ্গে থাক। সে অনুরোধ করেছিল, যেন চিঠি লিখি, যেন ভেবে দেখি সম্পর্কটা আবারও গড়ে ওঠা সম্ভব কিনা। চিঠির বদলে আমি তাকে নিজের হাতে সেলাই করা কার্তুজের থলে পাঠিয়েছিলাম, নতুন কার্তুজে ভরা৷
কিছুদিন পর আমার টাইফয়েড হল। যে হপ্তায় আমি ব্যাটেলিয়নেফিরলাম, সেই হপ্তাতেই একটা মহা-বিবাহের আয়োজন হয়েছিল। প্রায় আশিজন সৈনিকের একসঙ্গে বিয়ে করার কথা ছিল। আমি যে খুব পথ চেয়ে ছিলাম ওই আয়োজনের, তা নয়। বরং আমি জানতাম, অনেক কপোত-কপোতী সেদিন বিয়ের আসরে পৌঁছতে পারবে না। তারা যুদ্ধে মরে গেছে।
এতসবের, পরেও সে আসরে বেশ লাগল। কথাবার্তা-হাসিঠাট্টা-গভীর রাতের পানভোজ। আর নবদম্পতিদের সঙ্গে নাচ। আমি যেন রোগভোগের পর শক্তি ফিরে পেলাম। কিছুটা কি ঈর্ষাও ছিল?
স্থির করলাম, এফ্রেমের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইব। তা পাওয়াও শক্ত হল না। যখন পৌঁছলাম, এক যোদ্ধা আমাকে অভিবাদন জানালো। সে এক মেয়ে সৈনিককে ডাকল, তার কানে কানে বলল কিছু। মেয়েটি এমন ভাবে আমায় জড়িয়ে ধরল, যেন কতদিনেরচেনা৷ সরু একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে সে আমাকে মাটির নিচের কুঠুরিতে নিয়ে গেল। বস্তা বিছিয়ে বসতে দিল। বলল, ‘কার্তুজ নামিয়ে রাখতে পারো।’ তার কথা বলার সহজ ছন্দে যেন আশ্বস্ত হলাম। দেখে মনে হচ্ছিল, সে এখানে দীর্ঘদিন আছে।গুলিগোলার শব্দে অভ্যস্ত। সহসা ঝুলন্ত একটা জিনিষে আমার চোখ আটকে গেল। আমি হেসে ফেললাম। সে আমায় হাসতে দেখল, তারপর চলে গেল।
আমি একটা জ্যাকেট আর আমার চেনা সেই কার্তুজের থলেটি নামিয়ে আনলাম। এফ্রেমের পথ চাইতে চাইতে আমি তার চিঠিটি পড়ছিলাম। সে হাসপাতালের ঠিকানায় চিঠি লিখেছিল। বারবার পড়ছিলাম, বিশেষত সেই অংশটা, যেখানে সে আমাকে অনেক আকুতি নিয়ে উত্তর দিতে বলছে। জানি, আজ আমি ঠিক কী বলতে এসেছি। তা উচ্চারণ করে ফেললাম প্রায়।
কিন্তু কেউ এল না। সেই নারী সৈনিকও না, এফ্রেমও না। বন্দুক-কার্তুজ-জ্যাকেট সব ফেলে, কোনো যোদ্ধা কোথায় যেতে পারে? ভাবতে ভাবতে আমি উদবিগ্ন হয়ে পড়লাম। যেন গুলিগোলার শব্দের চেয়ে বেশি তীব্র হয়ে উঠল বুকের ধুকপুকানি। শেষে সেই নারী ফিরল। শুধু বলল, ‘কাল কথা হবে।’
যুদ্ধক্ষেত্রে বহু রাত কাটিয়েছি। কোনো রাত এত দীর্ঘ মনে হয়নি৷ দম বন্ধ লাগছিল। ঘুম আসছিল না৷ চোখ জ্বলছিল৷ উদ্ভট ভাবনারা আসছিল৷
ওই কার্তুজের ব্যাগে একটা গোল ফলক, তাতে খোদাই করে লেখা ‘মৃত্যু ছাড়া আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে না কেউ’।আর আছে আমার দেওয়া চিরুনিটি। আর তার ডায়েরি, তাতে চল্লিশ দিন কেউ আঁচড় কাটেনি।
পালাতে চাইছিলাম। কিন্তু কীভাবে? চারদিকে শত্রু সৈন্য। খুব ভোরে উঠে কোনোভাবে পথ হাতড়ে সেই যুদ্ধপরিখা থেকে বেরোলাম। ফিরে এলাম নিজের ব্যাটেলিয়নে। ভেবেছিলাম, দলনেতাজিজ্ঞেস করবেন সফরের কথা৷ কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না৷ রেডিয়োতে আমার ফেরার খবর পাননি কি? তিনি কি জানতে চান না কেন এত শীঘ্র এবং অনুমতি ছাড়াই আমি ফিরলাম? আমাদের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল, তিনি কাছে ডাকলেন। ভাবলাম, হয়তো আমার মাসিকের কথা জিজ্ঞেস করবেন।তিনি হয়তো ধরে নিয়েছেন এখন আমি বিবাহিত। ভ্রু কুঁচকে আমি গেলাম৷
‘ছুটি কেমন কাটল?’
‘ভালোই’।
তিনি আমাকে হাসপাতালে পাঠাতে চাইলেন, শুধু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে যে আমার টাইফয়েডের পুরোপুরি আরোগ্য হয়েছে৷ কিন্তু বললাম, তার প্রয়োজন নেই, আমি ভালোই আছি। বাকি ছুটিতে বিশ্রাম নিতে চাই, যদিও জানি না কোথায় গিয়ে তা সম্ভব।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে একদল সৈন্যের সঙ্গে ট্রাকে চেপে বসলাম। সারারাত চলল সে ট্রাক। দিনে এক জায়গায় থামা গেল। পাতা দিয়ে ছেয়ে দেওয়া হল ট্রাকখানি, যাতে শত্রুসৈন্য আমাদের দেখতে না পায়। সূর্যাস্তের আগে ড্রাইভার এক নদীতে নামলো, আয়নার কাচগুলি ধুয়ে নিতে। আমরাও নামলাম।
নদীর ধারে সার সার গাড়ি ও ট্রাক। গাড়িতে নানা জায়গার সৈন্যরা, অনেকেই আহত। তাদের দিকে চোখ চলে গেল। হঠাৎই তাকে দেখতে পেলাম৷
‘এফ্রেম! তুমি?’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘আলগু! তুমি এখানে!’
‘তুমি কাকে দিয়ে এসেছ তোমার কার্তুজের ব্যাগ? তোমার নোটবুক? এমনকী তোমার চিরুনি?’
‘আমি তো আমার কমিশনারকে সেইকার্তুজের থলেটা দিয়ে, ওরটা নিয়ে এসেছি। নোটবুকে আর দুটি মাত্র পাতা ছিল, তাই আনিনি। আর চিরুনিটা আনিনি কারণ তোমার চিরুনি হারাতে চাইনি। আলগু, তুমি কখনই আমার চিঠির উত্তর দাওনি। যে অপারেটরের সঙ্গে আমি ছিলাম, সে হঠাৎ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল আর…’
‘কী? তুমি কাউকে অন্তঃসত্ত্বা করেছ? তুমি?’
‘…আর তারপর সে বিয়ে করতে চাইল।’
‘তুমি বিয়েও করেছ?’
ক্ষণিকের জন্য সে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়’। পিছন ঘুরে সে দ্রুত চলে গেল৷
এবং এখন আমার সামনে সলোমন। পনেরটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর। এফ্রেম? আমার মৃত সঙ্গীরা? রণাঙ্গন? কোথায় তারা সব? আমি বাড়ি ফিরেছি৷
হ্যাঁ, বিয়ে আমার হয়েছে বটে৷ আমি বিয়ে করেছি দেশকে। সন্তানের জন্মও দিয়েছি তো। ওই যে, সে দেশের পতাকা!
__________________________________________________
বাংলা অনুবাদক
শতাব্দী দাশ একজন গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক। পেশায় শিক্ষক, সমাজকর্মী।
Posted in: June 2020 - Serial, TRANSLATION