জন্ম নেবে নতুন গ্যালাক্সি : মিল্কোমিডা – সহস্রলোচন শর্মা
জ্যোতিষীর কাজই হলো ভবিষ্যৎ বাণী করা। প্রশ্ন হলো, আগামী কত বছরের ভবিষ্যৎ বাণী গণনা করতে পারেন একজন জ্যোতিষী? ৫ বছর? ৫০ বছর? আচ্ছা, ধরলাম ৫০০ বছর। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী- থমাস জে কক্স এবং আব্রাহাম লোব, ৫০০ কোটি বছর পরে সৌরজগতের পরিণতির কথা জানিয়েছেন আমাদের। না, হস্তরেখা বিচার করে নয়, তাঁরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির গতিপথ বিচার করে। কি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তাঁরা? কেমনইবা গতিপথ এই অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির? সংক্ষেপে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে নেওয়া যাক।
আমরা থাকি মিল্কি ওয়ে (আকাশ গঙ্গা) গ্যালাক্সিতে। স্পাইরাল আকৃতির এই গ্যালাক্সির অন্তত চারটে বাহু চক্রাকারে ছড়ানো আছে মহাকাশে। মোট ২০,০০০ কোটি (মতান্তরে ৪০,০০০ কোটি) নক্ষত্রের আবাসস্থল এই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। মিল্কি ওয়ের গড় ব্যাস ১০০,০০০ আলোকবর্ষ বা ৩০.৬৬ কেপিসি (কেপিসি = কিলোপারসেক, ১ কেপিসি = ৩২৬১.৫৬ আলোকবর্ষ)। মিল্কি ওয়ের কেন্দ্রে রয়েছে ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’। মিল্কি ওয়ের কেন্দ্র থেকে ৮ কেপিসি দূরে অবস্থিত আমাদের এই সৌরজগত।
মিল্কি ওয়ে থেকে ৭৭৯ কেপিসি দূরে অবস্থিত অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। স্পাইরাল আকৃতির এই গ্যালাক্সির অন্তত দু’টো বাহু চক্রাকারে বিস্তৃত আছে মহাকাশে। অ্যান্ড্রোমিডার গড় ব্যাস ৬৭.৫ কেপিসি। অ্যান্ড্রোমিডার নক্ষত্র সংখ্যা ১,০০,০০০ কোটি। বিশালাকার এই অ্যান্ড্রোমিডায় অন্তত ১৪টা ‘ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি’ আছে, যারা স্যাটেলাইটের মতো প্রদক্ষিণ করে চলেছে অ্যান্ড্রোমিডাকে। অ্যান্ড্রোমিডার কেন্দ্রেও রয়েছে ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’। তাছাড়াও, আরও ২৬টা ব্ল্যাক হোলের সন্ধান পাওয়া গেছে অ্যান্ড্রোমিডায়।
প্রায় ১০০ বছর আগেই জানা গিয়েছিল, ধীরে ধীরে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির দিকে সরে আসছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। তখন থেকেই বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন, দুই গ্যালাক্সি কি তবে মুখোমুখি সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছে? নক্ষত্র খচিত মহাকাশের প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালে অ্যান্ড্রোমিডাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল, ২০১০ সালে সেই অবস্থানের সামান্য চ্যুতি ঘটতে দেখা গেছে। এই সামান্য চ্যুতি থেকেই বিজ্ঞানীরা হিসাব করতে বসে গেছেন, কোন দিকে কি বেগে সরছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি।
হিসাব কষে কক্স ও লোব বলেছেন, ১২০ কিমি/সেকেন্ড বেগে মিল্কি ওয়ের দিকেই ধেয়ে আসছে অ্যান্ড্রোমিডা। আর ঠিক যেদিকে সে এগোচ্ছে, তাতে এই দুই গ্যালাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষ অনিবার্য। তাঁরা বলেছেন, আজ থেকে ২০০ কোটি বছর পর ঘটতে চলেছে এই ‘টাইটানিক গ্যালাটিক কলিশন’- আমাদের মিল্কি ওয়ের সাথে অ্যান্ড্রোমিডার মুখোমুখি মহাসংঘর্ষ। এই মহাসংঘর্ষের এক চমৎকার বিবরণ পেশ করে তাঁরা বলছেন, আজ থেকে ২০০ কোটি বছর পর দুই গ্যালাক্সির দুটো বাহু পরস্পরকে স্পর্শ করবে। পেন্ডুলামকে মৃদু টোকা দিলে, পেন্ডুলাম যেমন খানিকটা উপবৃত্তাকার পথে ঘুরতে ঘুরতে দোল খেতে থাকে, ঠিক তেমনই পরস্পরকে স্পর্শ করার পর একে অপরকে পাক খেতে খেতে দুলতে থাকবে দুই গ্যালাক্সি। যত সময় যাবে, দুলতে দুলতে ততই পরস্পরের কাছে সরে আসতে থাকবে গ্যালাক্সি দুটো। এই ভাবে ঘুরতে ঘুরতেই দুই গ্যালাক্সির সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাল হোল দুটোর একে অপরের মধ্যে সমাপতন ঘটবে, আর ঠিক তখনই সৃষ্টি হবে নতুন গ্যালাক্সি, কক্স ও লোব যার নাম দিয়েছেন মিল্কোমিডা। মিল্কোমিডাকে অবশ্য মিল্কড্রোমিডা নামেও অভিহিত করছেন কেউ কেউ। কক্স ও লোব আরও দেখিয়েছেন, দুই স্পাইরাল গ্যালাক্সির মিলনে উৎপন্ন মিল্কোমিডার আকার কিন্তু আর স্পাইরাল থাকবে না। উপবৃত্তাকার বুদ্বুদের মতো দেখতে হবে নব গঠিত মিল্কোমিডাকে। তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, পরস্পরকে স্পর্শ করার পর থেকে দুটো গ্যালাক্সির একীভূত হতে সময় লাগবে ৩০০ কোটি বছর। অর্থাৎ আজ থেকে ৫০০ কোটি বছর পর সৃষ্টি হবে নতুন গ্যালাক্সি মিল্কোমিডা। ‘কলিশন বিটউইন দ্য মিল্কি ওয়ে অ্যান্ড অ্যান্ড্রোমিডা’ প্রবন্ধে কক্স ও লোব লিখেছেন, ”…their first close passage will occur in less than 2 Gyr, and the final coalescence will occur in less than 5 Gyr.” (Gyr = gigayear = ১০০ কোটি বছর)।
দুই গ্যালাক্সির মুখোমুখি এই মহাসংঘর্ষের মধ্য দিয়েই কি তবে পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে আমাদের সৌরজগতের? ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে আমাদের পৃথিবী? না, তেমনটা হবার সম্ভাবনা অবশ্য দেখছেন না বিজ্ঞানীরা। তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তাঁরা। হাজার কোটি নক্ষত্রের সমাহারে তৈরি যে কোনো গ্যালাক্সির যে কোনো দুটো নক্ষত্রের মাঝে রয়েছে বিরাট শূন্যস্থান (বস্তুত ডার্ক ম্যাটার পূর্ণ)। মহাকাশে আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী নক্ষত্র হলো প্রক্সিমা সেন্টরি। সূর্য থেকে প্রক্সিমা সেন্টরির দূরত্ব ৪.২৪ আলোকবর্ষ। মিল্কি ওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডা যখন একে অপরের মধ্যে প্রবেশ করবে, দুজনের নক্ষত্রগুলো একে অপরের শূন্যস্থান দিয়ে চলে যাবে বলেই মত প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করা যাক বিষয়টাকে। ধরা যাক, সূর্য ও প্রক্সিমা সেন্টরি হলো দু’টো টেনিস বল। সেই অনুপাতে, তাদের মধ্যে দূরত্ব দাঁড়াবে ১২০০ কিমি (কলকাতা-আগ্রা)। ১২০০ কিমি দূরে দু’টো টেনিস বল রেখে আকাশ থেকে কয়েক লক্ষ ফুটবল ফেলা হলেও, টেনিস বলের সাথে ফুটবলের ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ঠিক তেমনই, মিল্কি ওয়ের নক্ষত্রগুলোর মাঝের শূন্যস্থান দিয়ে গলে যাবে অ্যান্ড্রোমিডার নক্ষত্রগুলো। দু’একটা ক্ষেত্রে যে দুটো নক্ষত্রের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে না এমন নয়। তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। মিল্কি ওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডার কোনো দুটো নক্ষত্র যদি মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে তা হবে এক পরম প্রাপ্তি। এতো কাছ থেকে (হয়তো ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে!) এমন মহাজাগতিক আতসবাজি দেখার (অবশ্যই খালি চোখে দেখা যাবে না) সৌভাগ্য ৫০০ কোটি বছরে হয়তো একবারই আসে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকছে, ততদিনে মানুষ কোন পরিণতিতে পৌঁছবে? এটা জানা আছে, সূর্যের আয়ু ৭০০ কোটি বছর। সেই হিসাবে সূর্যের জীবদ্দশার মধ্যেই ঘটবে সেই মহাসংঘর্ষ। তবে এই সময়ের মধ্যে, সূর্য আরও উজ্জ্বল ও তপ্ত হয়ে উঠবে। ফলে, পৃথিবীর জলভাগ বাষ্পীভূত হবে এবং প্রাণের বিলুপ্তি ঘটবে, যদি না অভিযোজিত কোনো মনুষোত্তর প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীতে অথবা ভিনগ্রহে তাঁদের উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে মানুষ।
আমরা জেনেছি, মিল্কি ওয়ের কেন্দ্র থেকে ৮ কেপিসি দূরে অবস্থিত আমাদের এই সৌরজগত। কক্স ও লোব হিসাব করেছেন, প্রথমবার অ্যান্ড্রোমিডা যখন মিল্কি ওয়ের গা ঘেঁষে যাবে, অ্যান্ড্রোমিডার টানে মিল্কি ওয়ের কেন্দ্র থেকে অন্তত ২০ কেপিসি দূরে আমাদের সূর্যের ছিটকে যাবার সম্ভাবনা ১২%। দোলন পূর্ণ করে ফেরার পথে, দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময়, অ্যান্ড্রোমিডার টানে মিল্কি ওয়ের কেন্দ্র থেকে আরও দূরে সূর্যর সরে যাবার সম্ভাবনা ৩০%। তৃতীয় সাক্ষাতের সময় এই দূরত্ব বাড়ার সম্ভাবনা ৪৮% এবং একদম শেষে অন্তত ৩০ কেপিসি দূরে সূর্যের সরে যাবার সম্ভাবনা ৬৮%। ৩০ কেপিসির থেকেও দূরে সরতে সরতে শেষ পর্যন্ত মিল্কি ওয়ে পরিবার ছেড়ে পুরোপুরি আন্ড্রোমিডার পরিবারে আমাদের সূর্যের ঢুকে যাবার সম্ভাবনা ২.৭%। যদিও তার কিছুকালের মধ্যেই দুটো গ্যালাক্সি মিলেমিশে জন্ম নেবে নতুন গ্যালাক্সি- মিল্কোমিডা। তখন আলাদা করে ‘মিল্কি ওয়ে পরিবার’ কথাটার আর কোনো প্রয়োজনই পড়বে না। কারণ আমরা তখন নতুন মিল্কোমিডা পরিবারের সদস্য হয়ে যাবো। দুই গ্যালাক্সির মিলনে, রাতের আকাশ তখন অনেক বেশি তারায় ঝিকিমিকি করে জ্বলে উঠবে। তাই দেখে তখনও কি কেউ গেয়ে উঠবেন, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা …’?
[মূল সূত্র: কলিশন বিটউইন দ্য মিল্কি ওয়ে অ্যান্ড অ্যান্ড্রোমিডা]
[লেখক – ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। এখনো বিজ্ঞানের ছাত্রই আছেন। পড়ানোর পাশাপাশি বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা তাঁর কাছে গুরুদায়িত্ব। লেখেন ছদ্মনামে।]
বাহ! রোমাঞ্চিত হলাম।
এই নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক, বলছি ‘টোটেম ভোজ’ বইটি কী নিয়ে যদি বলেন…
টোটেম ভোজ, কবি অমিতাভ মৈত্রের একটি কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে কবিতা পাক্ষিক প্রকাশনী থেকে। পরবর্তীকালে পুনর্মুদ্রণ হয় ২০১৫ সালে বৈখরী ভাষ্য প্রকাশনী থেকে।
বইটি সংগ্রহ করার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করতে পারেন —
অপরজন অনলাইন বুকস্টোর থেকে সংগ্রহের জন্য
https://aparjan.com/product/টোটেম-ভোজ/
ফ্লিপকার্ট থেকে সংগ্রহের জন্য
https://www.flipkart.com/totem-bhoj/p/itmb26e99a0a8b00?pid=RBKFPDNQDYKMWZA4